আমার অন্য গল্পের মত এই গল্পটা মনগড়া বানানো গল্প নয়। এতদিন চিরল দাঁতে হাসতে দেখেছি যে মেয়েটাকে, ডাগর চোখে সরু করে আই-লাইনার টেনে সাজতে দেখেছি যে মেয়েটাকে, এটা তার গল্প। তার জীবনের গল্প!
বছর দুয়েক আগের কথা, মেয়েটা তখন ইন্টারমেডিয়েটের ছাত্রী। নিজের বাসা থেকে কলেজের দূরত্ব ৭০ কিলোমিটারেরও বেশী। শহরে নিকটাত্মীয় কেউ ছিলনা, তাই মেয়েটা একটা মেসে উঠেছিল।
নিয়মিত ক্লাস, প্রায়ভেট আর খুব প্রয়োজন ছাড়া একদম বাইরে বের হত না মেয়েটা।
হঠাৎ একদিন মেয়েটার ফোনে একটা অপরিচিত নাম্বার থেকে কল আসে। মেয়েদের ফোনে অপরিচিত নাম্বার থেকে কল আসা একটা সাধারণ ব্যাপার।
সেই নাম্বার থেকে আসতে থাকে পুনঃপুনঃ বিরক্তিকর কল। মেয়েটা দুয়েক দিনেই জানতে পারে যে ছেলেটা তাকে বারবার কল করে বিরক্ত করে সে তার পাশের গলিতেই থাকে।
ছেলেটা প্রচন্ড রকমের মাদকাসক্ত, বখাটে। তার নামে তখন তিনটে নামলা ঝুলছিল। দুইটা রেপ কেস, একটা মার্ডার।
গুনে গুনে পা ফেলে পথ চলতো যে মেয়েটা সে ছেলেটার এমন ভয়াবহ অতীত শুনে ভয় পেয়ে যায়। মেয়েটা বদলে ফেলে নিজের ফোন নাম্বার।
মেয়েটার নাম্বার বন্ধ পেয়ে ছেলেটা ভীষণ ক্ষেপে যায়! রাস্তা-ঘাটেই করতে থাকে ইভটিজিং।
সেই মহুর্তে মেয়েটা কী করবে? তার কী করা উচিত সেটা ভাবতেও তো যে কারো অন্তত দু-তিন দিন লাগতো!
ঠিক দু-তিন দিন পরের এক বিকেলে মেয়েটা প্রায়ভেট থেকে ফিরছিল। মেয়েটার ফেরার পথ আটকে দাড়িয়ে গেল ছেলেটা। নানা অশ্লীল অঙ্গ-ভঙ্গী আর অশালীন আচরণ করতে থাকে ছেলেটা। মেয়েটা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে, ভয়ে কুঁকড়ে যায় একদম।
ছেলেটা একপর্যায়ে ছোঁ মেরে মেয়েটার বাহু চেপে ধরে, স্পর্শকাতর অঙ্গে হাত দিতেও উদ্ধত হয়! মেয়েটা তখন আর স্থির থাকতে পারেনি একটুও৷ হঠাৎ ঠাস শব্দে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দেয় ছেলেটার গালে।
তারপরেই বেশ কয়েকজন মানুষের একটা জটলা বেঁধে যায় সেখানে। তারা মেয়েটাকে চলে যেতে বলে, মেয়েটা চলে যায়!
অন্যের অপমান দেখার নেশা এ জগতের সবথেকে বড় নেশা। জড়ো হওয়া মানুষজন ছেলেটাকে দু-চারটা চড় থাপ্পড় দিয়ে ছেড়ে দেয়।
এর পরের গল্পটা আরো ভয়ানক, আরও লোমহর্ষক। একটা মেয়ের জন্য যা মৃত্যুর সমান কষ্টের।
কয়েকদিন পর মেয়েটা তার এক মেসমেটের সাথে বাজার শেষে ফিরছিল! তখন সূর্য ডুবেছে কেবল! ঈষৎ সন্ধ্যায় ঝাঁপসা হয়েছে চারপাশ। কে জানতো এই সন্ধ্যায় ওই ফুটফুটে মেয়েটার জীবনটাও অমন ঝাঁপসা হয়ে যাবে!
কালো একটা মাইক্রোবাস এসে পাশে স্লো করতেই অকস্মাৎ দরজা খুলে যায়! মাইক্রোবাসের গেটের দিকে থাকা মেয়েটাকে টেনে মাইক্রোবাসে ওঠানো হলেও তার পাশে থাকা মেসমেটকে টেনে ওঠানোর কোন প্রয়োজন পড়েনি, সে স্বেচ্ছায় উঠে পড়ে মাইক্রোবাসে।
মাইক্রোবাসে সেই বখাটে সহ পাঁচজন ছিল।
এরপরে মেয়েটাকে একটা নির্জন বাড়িতে নিয়ে যায় আর মেয়েটার মেসমেটকে অন্য একটা বাসায় নামিয়ে দেয়।
একে একে মাইক্রোবাসে থাকা পাঁচ জনের লালসার শিকার হয় মেয়েটি। নির্জন বাড়িতে সারারাত চলতে থাকে নির্যাতন।
নির্যাতিত সেই মেয়েটা অনেক পরে হলেও বুঝতে পারে সেদিনের সেই প্লানিংয়ে তার মেসমেটও জড়িত ছিল। মেয়েটার সেই মেসমেটই তার কাজে মেয়েটাকে বাইরে নিয়ে এসেছিল সেদিন, অপেক্ষাও করিয়েছিল সন্ধ্যা পর্যন্ত।
ছেলেটার প্রযুক্তির অপব্যবহার মেয়েটার জন্য অভিশাপ হয়ে যায়। মুঠোফোনের ক্যামেরায় করা ভিডিওর বেশ কয়েকটা ক্লিপ সেই বখাটের হাতে থাকে।
তারপর চলতে থাকে ব্লাকমেইল! তোমার বান্ধবীদের এই ভিডিওগুলো পাঠাবো, তোমার রিলেটিভদের পাঠাবো, তোমার পরিবারকে পাঠাবো! সবাই তোমার এই ভিডিওগুলো দেখবে! তুমি কী করে তাদের মুখ দেখাবে? এমন ভয়ঙ্কর ভয়ঙ্কর হুমকির মুখে মেয়েটা বেশ কয়েকবার আত্মহত্যা করতে উদ্ধত হয়! কিন্তু নানা কারণে আর সফল হতে পারেনি।
এই দুবছরে অনেক অনেকবার ব্লাকমেইলের শিকার হতে হয়েছে তাকে৷ কখনো অর্থে, কখনো কু-প্রস্তাবেও সাড়া দিতে হয়েছে। অনেকবার ভেঙে পড়তে হয়েছে মেয়েটাকে।
কিন্তু আর না! মেয়েটা আর চুপ থাকতে চায় না।
মেয়েটা এখন দেশের নামকরা একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের শিক্ষার্থী। জানিনা মেয়েটার মনে কী আছে, হয়তো একটু বেশিই প্রতিশোধপরায়ণ!