সাদা মেঘেদের ভেলায়

সাদা মেঘেদের ভেলায়

জয়ীতা দাঁড়িয়ে আছে কাশবনের সামনে।সাদা কাশফুলে ছেয়ে আছে পুরো জায়গাটা।যেন সাদা মেঘেদের ভেলায় দাঁড়িয়ে আছে সে অনন্তকাল ধরে।

সামনে আরেকটু এগিয়ে গেল জয়ীতা।হাত বাড়িয়ে কাশফুল ছুঁয়ে দিতে গিয়ে হাতের কাচের চুড়িগুলো টুংটাং শব্দ করে উঠলো, পরক্ষণে হাত উঠিয়ে বাতাসে উড়িয়ে নেয়া চুল কানে গুঁজে এদিক ওদিক তাকালো কয়েকবার।সামনেই ছোট্ট রাস্তা পেরিয়ে সিমেন্টের বাঁধানো সিটে গিয়ে বসলো জয়ী।চুড়ির শব্দটা আবার অস্বস্তিতে ফেলল ওকে।কেমন যেন সবকিছু খাপ ছাড়া,এলোমেলো লাগছে ভীষণ।

মুঠোফোন বের করে মাকে ফোন করলো জয়ীতা।পথে আসবার সময় অপরাজিতা কথা বলেছে একবার।এখন আবার ফোন দেওয়াতে মা বললেন ঘুমোচ্ছে একটু।স্যুপ খাইয়ে মা মাত্রই নাকি ঘুম পাড়িয়ে দিলেন।

মুঠোফোন ব্যাগে পুরে ডানের রাস্তায় তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল জয়ীতা।কত অজস্রবার এখানটায় অপেক্ষা করেছে জয়ীতা রুদ্রের জন্য,অথচ আজকের অপেক্ষাটা মনের খচখচানি বাড়িয়েই চলেছে দ্রুত।

শাড়িতে চোখ পড়তেই আবার বুকটা খচখচ।বেছে বেছে রুদ্রের দেওয়া সাদা পাড়ের সাদা জমিনের শাড়িটাই পড়েছে জয়ীতা,হাতে কয়েক রঙের কাচের চুড়ি একসাথে।চুলে ঢোলা হাত খোপা,কপালে এলো চুল।

এসবই রুদ্রের পছন্দ ছিল।রুদ্রই জয়ীতার ভিতর থাকা আসল সৌন্দর্যটাকে টেনে বের করে এনেছে,নয়তো জয়ীতা জানতোই না ভালবাসার কতশত রূপ,সৌন্দর্য, সৌখিনতা আছে।

কিন্তু জয়ীতা কেন আজ এভাবে এল সে নিজেই বুঝতে পারছে না।অথচ ডিভোর্সের আর কয়েকদিন বাকী।দুজনের দুটো সাক্ষর,আদলতের রায়ে যে কোন একজনের তত্ত্বাবধানে অপরাজিতাকে পাওয়া,তারপর যে যার মত জীবন গুছিয়ে নেওয়া।কত সহজ সবকিছু।

বাধ সাধলো অপরাজিতার এক্সিডেন্ট।

সিঁড়ি থেকে পড়ে মেয়ে মাথা ফাটিয়ে ফেললো,বাসায় জয়ীতার বড় ভাই,বাবা সবাই ছিলেন,সবাই ছুটোছুটি করছে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য কিন্তু সবার আগে জয়ীতা রুদ্রকেই ফোন দিল,রুদ্রতো অপরাজিতার বাবা।এমন বিপদে রুদ্র পাশে না থাকলে চলছিল না জয়ীতার।

সেদিন থেকে এই টানা আট দিন দুজনে একদম সেটে ছিল মেয়ের কাছে।দুজনের কেউই চোখের আড়াল হয়নি অপরাজিতার।নাকি দুজন দুজনের কাছ থেকে সরতে চায়নি?কোনটা!জয়ীতার হিসেব মেলেনা।
সন্তান দুজন আলাদা হয়ে যাওয়া স্বামী স্ত্রীকে কিভাবে যেন কিছুদিনের জন্য এক করে দিল।একই কেবিনে রুদ্র,জয়ীতা আর অপরাজিতা। তিনজনের এতটুকু অস্বস্তি লাগেনি,যেন ওরা ওই ছোট্ট কেবিনটায় সংসার করছে আগের মত।

জয়ীতার কেন যেন মনে হয়,মাথায় দুটো সেলাই নিয়েও অপরাজিতা মনের জোড়ে এত তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে পেরেছে।নয়তো ওইটুকুন বাচ্চাকে এত তাড়াতাড়ি কি রিলিজ করে দিত ডাক্তার!জয়ীতা জানে,মনের জোর মেয়ে পেল কোথা থেকে!দীর্ঘদিন পর বাবা মাকে একসাথে কাছে পেয়ে অপরাজিতার শারীরিক, মানসিক দুই প্রশান্তিই ফিরে এসেছে। গতকাল বাসায় ফেরার পর থেকে রুদ্র কম করে হলে দেড়শো বার ফোন দিয়েছে জয়ীতাকে।অপরাজিতা কি করছে,কেমন আছে শুধু এতটুকু জানতেই এতবার ফোন।জয়ীতা বিরক্ত হয়নি,বরং ওর ভাল লাগছিল রুদ্রের দ্বায়িত্ববোধ দেখে।

শেষমেশ যখন রাত দুটোয় জয়ীতাকে শেষ কল দিল রুদ্র,ফোন রেখে দেওয়ার আগে একবার ডেকে উঠলো সে,জয়!
জয়ীতা চোখ বুজে ফেলেছিল ডাক শুনে।বহুদিন পর রুদ্রের মুখে জয় ডাক শুনে দম বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম হয়েছিল ওর।কোনরকমে শুধু একবার বলল,হুম বল।

রুদ্র জানালো আকাশে শরতের সাদা মেঘেরা নাকি খুব ছুটোছুটি করছে,কাশবনের কাশফুলেরাও।জয়ীতা চাইলে এসে দেখে যেতে পারে তাদের সেই প্রিয় জায়গাটায়।

জয়ীতা এক কথায় কেমন যেন রাজি হয়ে এসে পড়লো রুদ্রের পছন্দের গেট আপে।ভীষণ লজ্জা আর অস্বস্তি নিয়ে জয়ীতা দূরে তাকিয়ে দেখলো সাদা পাঞ্জাবী পড়া রুদ্র হেটে আসছে মৃদুলয়ে।

কাছে এসে দাঁড়াতেই রুদ্র হেসে চোখ নামিয়ে ফেললো।রুদ্রের বুকে কে যেন ড্রাম পিটিয়ে যাচ্ছে দ্রিমদ্রিম শব্দে।জয়ীতার শাড়ি,চুড়ি রুদ্রের কানে অনেক কিছু বলে যাচ্ছে।রুদ্র বুঝতে পারছে সব।

রুদ্র ঢোক গিললো একবার।কিছুক্ষণ আগেও জয়ীতার দেওয়া এই সাদা পাঞ্জাবী নামাতে গিয়ে হাতে ডিভোর্সের কাগজটা এসে পড়েছিল,সযত্নে আবার সেটা আলমারির তাকে তুলে রেখে এসেছে সে।
জয়ীতাকে আঙুল উঠিয়ে রুদ্র বলল,চল কাশবনের মাঝখানটায় যাই জয়!

বলেই লম্বা লম্বা পা ফেলে হেটে যেতে লাগলো রুদ্র,জয়ীতা শাড়ির ভাজ ঠিক করে,আচল মুঠোয় নিয়ে রুদ্রের পিছন পিছন যেতে লাগলো।

এক ঘন্টা দুজন কাশবনে কাটিয়ে দিল দাঁড়িয়ে, হেটে,বসে।মেঘ,কাশফুল আর অদৃশ্য বাতাসের দুলুনিতে ওদের দুজনের নিস্তব্ধতা আরো খান খান করে দিচ্ছিলো ওদের সব কিছু।কিন্তু রুদ্র,জয়ীতা দুজনেই জানে ওরা মনে মনে কত কথা বলে নিয়েছে এই এক ঘন্টায়,কতটা বুঝে নিয়েছে দুজনকে দুজন সব বুঝে ওরা।কত অভিমান গাল ফুলিয়ে মনে জায়গা করে নিয়েছিলো,রুদ্র জানে এক লহমায় জয়ীতার সব অভিমান ধুলিতে উড়ে গিয়েছে কিংবা জয়ীতাও ঠিক ধরে ফেলেছে রুদ্রের ভিতরটা এখন অথৈ জলে কানায় কানায় পূর্ণ যেখানে জয়ীতার সবটুকু অধিকার আছে সাঁতরে নেওয়ার!

বাতাসে এলো চুল,শাড়ির আচল সামলাচ্ছে জয়ীতা।পেছন থেকে রুদ্র এসে ঘেঁষে দাড়ালো জয়ীতার পিঠে।জয়ীতা নড়লো না,ওভাবেই আকাশ দেখতে লাগলো সে।নিজের চোখের জলটুকু প্রাণপণে আটকে রেখে রুদ্রকে অনুভব করতে চাইছিলো জয়ীতা। রুদ্র আরেকটু কাছে মিশে আলতো জড়িয়ে রাখলো জয়ীতাকে পেছন থেকে।রুদ্র টের পেল সে জয়ীতাকে আগের মতই ভালবাসে,ঠিক আগের মত।অনুভূতিরা মরে যায়নি,বেচে আছে।

জয়ীতা ততক্ষণে কাঁদছে, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নার দমকে কেপে কেপে আলতো করে একটা হাত রাখলো রুদ্রের বাহুডোরে। অপরাজিতা ওদেরকে নতুন প্রাণ ফিরিয়ে দিয়েছে,নতুন করে পুরোনো প্রায় মরে যাওয়া আধো হলুদ পাতার মত জীবনটায় এই শেষ বিকেলে ওরা সবুজ কচি পাতার রং দেখতে পেল।

গল্পের বিষয়:
জীবনের গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত