সময় মানুষকে বদলাতে বাধ্য করে। তবে হুট করেই সময় মানুষকে বদলে দেয় না। ধীরে ধীরে সময় মানুষকে বদলে দেয়।
ঠিক তেমনিই হয়তো ইরা সময়ের সাথে সাথে বদলে গেছে। আগে যে মেয়েটা দিনে একশোবার ফোন দিয়ে আমার খোঁজ নিত সেই মেয়েটাই আজ একসপ্তাহ যাবত ফোন দেয়না।
যে মেয়েটা আমাকে একনজর না দেখলে থাকতে পারতো না সে মেয়েটাই আজ একসপ্তাহ যাবত আমার সাথে দেখা করেনি।
এতে আমার কোন দুঃখ নেই। কারন ইরা হুট করেই আমার জীবনে এসেছিল। আমি জানতাম ইরা আবার হুট করেই একদিন চলে যাবে।
তবে বুকের ভেতর হাপরের দাপাদাপিটা কিছুতেই বন্ধ হচ্ছে না। মনে হচ্ছে একসপ্তাহ যাবত অক্সিজেন গ্রহন থেকে বিরত আছি।
রাতের বেলা ঘুমাতে পারিনা বলেই ছাদে উঠে বসে থাকি। মাঝে মাঝে আকাশের ওই তারাগুলোর সাথো কথা বলি। ওরা হয়তো কথার জবাব দিতে পারে না। তবে ওরাই বর্তমানে আমার বন্ধু।
ইরার সাথে পরিচয় হয়েছিল অনার্সের ফরম জমা দেওয়ার সময়। দুইটা লাইনে ছেলে এবং মেয়ে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েদের তুলনায় ছেলেদের লাইনটা ছিল অনেক বড়। সকালের ঠান্ডা ভাব ছেড়ে সূর্যমামা প্রবল গতিতে মধ্যগগনে ধাবমান। তাই গরমটা পড়তে শুরু করলো আস্তে আস্তে।
প্রায় ঘন্টাখানেক লাইনে দাঁড়িয়ে তারপর ফরম জমা দিয়ে বেরিয়ে এলাম। গরমে একেবারে ডিমসেদ্ধ হয়ে গেছি। পানির তৃষ্ণায় গলাটা একেবারে ভুষন্ডির মাঠ হয়ে আছে। হঠাৎ দেখলাম একটু দূরে একটা মেয়ে গাছের নিচে দাঁড়িয়ে বোতল থেকে পানি খাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে গেলাম মেয়েটার সামনে।
তারপর নিসংকোচে মেয়েটার কাছে পানি চাইলাম। মেয়েটা কিছুটা ইতস্তত করে পানির বোতলটা আমার দিকে এগিয়ে দিল। আমিও তখন পানি ঢেলে দিলাম মুখে।
মুখে নিয়েই আমি চমকে গেলাম। আরে! এটাতো সাধারন পানি না। এটাতো কোমল পানিয়। না চাইতেও এক ঢোক গিলে ফেললাম। তারপর লজ্জা পেয়ে বোতলটা ফিরিয়ে দিলাম মেয়েটার দিকে।
তখনই প্রথম মেয়েটা কথা বললো,
– আরে আরেকটু পান করুন। দেখেই বুঝতে পারছি লাইনে দাঁড়িয়ে গরমে খবর হয়ে গেছে আপনার
– নাহ আমি এসব কোল্ড ড্রিংক খাই না।
– আরে একটু আধটু খেলে কিছু হয়না। নিন আরেকটু খান।
– আচ্ছা খাচ্ছি।
সেদিনকার মত সেখানেই আমাদের কথা শেষ। মেয়েটাকে ধন্যবাদ দিয়ে চলে এলাম বাসায়।
তারপর শুধুই অপেক্ষার পালা। কবে শুরু হবে স্বপ্নের বিশ্ববিদ্যালয় যাত্রা?
প্রথম দিনই আবারো সেই মেয়েটার সাথে দেখা। আজও মেয়েটার হাতে বোতল। মেয়েটা মনে হয় সবসময় এই কোল্ড ড্রিংক নিয়েই পড়ে থাকে।
আমাকে দেখেই বলে উঠলো,
– কেমন আছেন?
– হুম ভালো। আপনি?
– হুম ভাল আছি।
একথা বলেই মেয়েটা আমাকে বোতলটা এগিয়ে দিল। আমি মৃদু মাথা নাড়িয়ে বললাম,
– নাহ লাগবে না, ধন্যবাদ।
– আরে ধরুন তো। ওইদিন বললাম না একটু আধটু খেলে কিছু হয়না। আমি জানি এসব খাওয়া শরীরের জন্য ভাল নয়। তারপরও খেতে ইচ্ছে করে।
মেয়েটার জোরাজুরিতে বোতলটা নিলাম। এবারো মুখে নিয়ে অবাক হলাম। আরে এটাতো কোল্ড ড্রিংক না। এটাতো সাধারন পানি। তারমানে মেয়েটা আমাকে বোকা বানিয়েছে?
আমার এই অবস্থা দেখে মেয়েটা হাসিতে লুটিয়ে পড়লো। হাসলে মেয়েটার গালে টোল পড়ে। কি সুন্দর লাগে তখন।
আমিও মেয়েটার হাসির সাথে তাল মেলালাম।
হাসি থামার পর মেয়েটা হ্যান্ডসেকের জন্য হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
– আমি ইরা।
– আমি আরমান।
– আমরা কি বন্ধু হতে পারি?
– কেন নয়?
– তাহলে একে অপরকে তুই করে বলতে হবে।
– বলতেই হবে?
– না বললেই নয়।
– ঠিক আছে, তবে তুই আগে আমাকে তুই বলতে হবে।
– ঠিক আছে আমিই তোকে আগে তুই বলবো।
এভাবেই শুরু হয়েছিল আমাদের। তারপর প্রায় দুইবছর ধরে হাঁটি হাঁটি পা পা করে আমাদের বন্ধুত্বের সম্পর্কটা ভালবাসায় গড়িয়েছে। তবে এখন সবকিছুই অতীত। বর্তমান হচ্ছে ইরার সাথে একসপ্তাহ কথা বা দেখা হয়নি আমার। ক্লাসেও আসেনি সে। কারনটা অজানা এখনো।
তবে ইরার এভাবে নিজেকে লুকিয়ে ফেলায় আমি মোটেও অবাক হয়নি। বেশকিছুদিন ধরেই দেখছিলাম ইরা আমাকে কেমন যেন ইগনোর করতে শুরু করেছে। দেখা হলে ঠিকমত কথা বলতো না। ব্যস্ততা দেখিয়ে চলে যেত।
আগের ঘন্টার পর ঘন্টা ইরার সাথে ফোনে কথা বলে কাটিয়ে দিতাম আর এখন ইরাকে কল দিলে ঘন্টার পর ঘন্টা ইরার ফোন ওয়েটিং পাই। বুঝতে পারছিলাম সময়ের সাথে সাথে ইরাও বদলো যাচ্ছে।
অতীতের অতল থেকে আমাকে ফিরে আসতে হচ্ছে। কারন কে যেন ফোন দিয়েছে। অচেনা নাম্বার থেকে ফোন। অনিচ্ছা স্বত্তেও ফোন ধরলাম।
– হ্যালো।
– হ্যালো কেমন আছো আরমান?
ইরার সেই চিরপরিচিত কন্ঠস্বর। আমার গলাটা অস্বাভাবিক রকম কাঁপছে।
– ভাল আছি। তু..তুমি কেমন আছো ইরা?
– ভাল আছি। তোমাকে একটা কথা বলার ছিল।
– একসপ্তাহ পর ফোন দিয়ে কি এমন কথা বলবে ইরা?
– আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে আরমান। ছেলে আমেরিকা থাকে। বিয়ের পর আমিও আমেরিকা চলে যাচ্ছি।
কথাটা শুনেই বুকের ভেতর দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। নিজেকে যতটা সম্ভব স্বাভাবিক রাখতে চেষ্টা করছি।
– সত্যিই তোমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে ইরা?
– হুম।
– অভিনন্দন ইরা। আর হয়তো তোমার সাথে দেখা হচ্ছে না তাইনা?
– হুম।
– তাহলে তোমাকে একটা প্রশ্ন করি। আমাকে ছাড়া তুমি ভাল থাকতে পারবে ইরা?
– (কিছুক্ষন নিরবতা) হ্যা পরবো।
– তাহলে কেন আমাকে মিথ্যা স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছ? কেন ভালবাসা নামক শব্দের সাথে পরিচয় করিয়েছ?
– (নিরবতা)
– জানো ইরা তোমাকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখেছি। তবে আজ সবই হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। ভাল থাকো তুমি তোমার আমেরিকার বর নিয়ে।
– আরমান শোনো।
– ভাল থেকো। আর শোনো, তোমার বিয়ের দাওয়াতটা পেলে খুশি হবো। অনেকদিন হলো বিয়ের দাওয়াত খাইনা।
ফোন কেটে দিয়ে আবারো তারাদের সাথে কথা বলা শুরু করলাম। আমি জানতাম হুট করে আসা জিনিস হুট করেই চলে যায়। তাই মন খারাপ হয়নি মোটেও। ইরা ক্ষনিকের জন্য এসে আবারো চলো গেছে। এটা কোন ব্যাপারই না। চোখের জল আটকানোর বিভিন্ন পন্থা আমার জানা আছে।
শপথ করে বলতে পারি আমি কাঁদবো না ইরার চলে যাওয়াতে…..!!