মৃত্যুর শেষ ডাক

মৃত্যুর শেষ ডাক

সন্ধ্যে ঘনিয়ে এসেছে। ঝিঁঝিপোকাদের শব্দ ভেসে আসছে বাড়ির পশ্চিম পাশের বাঁশ ঝাড় থেকে। বিশাল আয়তনের বাঁশঝাড়, লোকমুখে শুনা যায় এখানে অনেকের সাথে ঘটেছে অঘটন!

প্রতিটি সন্ধ্যে মানে প্রতিদিন নতুন কিছুর আবির্ভাব! কোনো সময় অচেনা নামে, ডাকে, তো কোনো সময় ছোট্ট বাচ্চাদের কাঁন্নার সুর বাজে লাগাতার। তবে সন্ধ্যার কিছুটা পর আবার সব নিস্তব্ধ। একদম নিশ্চুপ কোলাহল বিহীন একটা ঝাড়।মানে সেই বাঁশ ঝাড় যার রহস্য ভেদ করতে পারেনি আজ অবধি।কেন এমন হয়! প্রশ্ন জাগে সবার মনে। তবে সেই প্রশ্নটা নিছক প্রশ্ন হয়েই থেকে গেল সবার মধ্যে।কেউ আগ বাড়িয়ে প্রশ্নের জবাব খুঁজতে যায় নি।কারণ যেই এই প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গিয়েছে।বিনিময় মহা বিপদ নেমে এসেছে তার জীবণে।তার প্রত্যেকটি কাজে।

এমন ঘটনা একটা দুটো নয়।গ্রামের প্রায় বেশকিছু সংখ্যক লোকের সাথেই এটা হয়েছে। সবাই এড়িয়ে চলতে চায় এই ঝাড়টা। গ্রামের লোকেরা এই বাঁশ ঝাড়কে ডাকে মৃত্যুর ডাক। কি জন্যে বা কী উদ্দেশ্যে নামটা রাখা হয়েছে কেউ জানে না বা কে রেখেছে সঠিক তাও জানা নেই।পূর্বের বংশের কাছ থেকে শুনে আসছে এবং এটাকেই ধরে রেখেছে গ্রাম বাসী আজোও। কিন্তু সবাই মৃত্যুর ডাক বাঁশের ঝাড় এড়িয়ে যেতে চাইলেও পারে না। গ্রামের মধ্যবর্তী একটা হাঁট। সেখানে গ্রামের মানুষগণ বাজার করতে যায়।কেউ জমিতে ফলানো ফসল, শাক, সবজি, ইত্যাদি বিক্রি করতে যায়।তবে সেই বাজারে যেতে হলে একটাই রাস্তা।একটাই পথ। গ্রামের পশ্চিম পাশে বিস্তর জমিন।সেখানে কৃষক ভাইয়েরা চাষাবাদ করেন। সেই বিস্তর জমির পাশ ঘেঁষেই সেই মুত্যুর ডাক নামের বাঁশ ঝাড়টা।একেবারে গ্রামের প্রধান সড়কটার গা ঘেঁষে প্রায় অনেকটা পথ দখল করে রেখেছে। দুইপাশে বাঁশঝাড় তার মধ্য বরাবর সেই গ্রামের প্রধান সড়ক।যা দিয়ে দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় কাজে বাজারে যান গ্রামের প্রতিটি মানুষ। এই তো বেশ কিছু দিন হলো।গ্রামের শফিকুর রহমানের ছেলে আজগর আলী, বাজার থেকে ফিরছিল। কিন্তু সে দিন খুব তাড়াতাড়ি ফিরবে বলে আশা করলেও ভাগ্যের পরিহাসে সেদিন সন্ধ্যার বেশকিছু পর বাজার থেকে সবে মাত্র রওনা দিয়েছে। বাড়িতে ফিরতে ফিরতে অন্ধকার ঘনিয়ে ভূতুড়ে পরিবেশ তখন পুরো বাজার ছমছম করছে। কিন্তু কী আর করা! বাড়ি তো ফিরতে হবে।না হলে আস্তে, আস্তে বাজারের লোক জনশূণ্য হয়ে যাবে।তখন কী একা থাকব?

মোটেও না। তবে সেই ভয় মনের ভেতর! যদি মুত্যুর ডাক বাঁশ ঝাড়ে অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো ঘটনা ঘটে যায়? তখন? সে কি বেঁচে আসতে পারবে? নাকি শেষমেষ ভূতের কবলে পড়ে মরতে হবে? এমন অজানা চিন্তা ভাবনা তখন আজগর আলীর মনকে বলছিলো “তুই চাস নে ” তাও মনের বিরুদ্ধে গিয়ে রওনা হলো এই ভরসায় যে মুত্যু তো একদিন আগে পরে হবেই। সুতরাং ভয় করে কোনো ফায়দা নেই। সেদিন বাজারে সে জমিনের ফলানো সবজি, টমেটো আর কাঁচা মরিচ বিক্রি করতে গিয়েছিল। বিক্রি শেষ হতে, হতেই দেরী হয়। ডান হাতে হারিকেন আর বাম হাতে সবজি নিয়ে আসার ঝুঁড়ি। কাঁপা, কাঁপা পায়ে হেঁটে প্রায় সেই জঙ্গলের কাছাকাছি চলে এসেছে। কিন্তু ভয়টা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে চারপাশের পরিবেশটা।ঘুটঘুটে অন্ধকার।ব্যাংঙ্গের ডাক, ঝিঁঝিপোকাদের ঝিঝি শব্দ ভেসে আসছে মৃত্যুর ডাক বাঁশঝাড় থেকে। এর মধ্যে সে কী পারবে নিজেকে বাঁচিয়ে ফিরে যেতে! নাহ্। নাকি হ্যাঁ? তবে সেটা সময় বলে দিবে। আজগর একটু দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করল।যদি এই রাস্তা দিয়ে কেউ আসে!

তো সে তার সাথে যাবে।কোনো ভাবেই সম্ভব না একা একা দুই পাশে বাঁশঝাড় মধ্যখানে রাস্তাটা দিয়ে যাওয়া। কিন্তু বেশ কিছু সময় থাকার পরেও কেউ আসছে না। আজগর মনে মনে বললো।হায় রে আমার পুড়া কপাল। আমি যে কেনো এই বাজারে গেলাম।একবার যদি ফিরে যেতে পারি তো আর কোনো দিন সন্ধ্যের পর আসব না বাড়ি হয় বিক্রি হোক না হয় না হোক। হারিকেন এর আলোতে যতোটুক দেখা যাচ্ছে কেউ নেই আশপাশে। গ্রামের মানুষ এই সময়টাতে খেয়ে দেয়ে ঘুম গিয়ে অর্ধমৃত প্রায়। তবে আর অপেক্ষা নয়।কোনো মতেই নয়।কারণ রাত যতো বাড়বে ততোই বিপদ।মহা বিপদ নেমে আসবে এই অন্ধকার মৃত্যুর ডাক ঝাড়ে। কাঁপা, কাঁপা পায়ে এবার রওনা হলো বেশ কিছুক্ষণ চিন্তাভাবনা করে। হাঁটু যেন যেতেই চাইছে না।অজানা আতংক, ভয় হৃদপিন্ডে ধুকধুক করছে প্রতিনিয়ত! মরনের ভয় তাড়া করে বেড়াচ্ছ মস্তিষ্কে। প্রানপণে হারিকেনটার আলো বাড়িয়ে দিয়ে জোরে, জোরে হাঁটতে লাগলো আজগর আলী। অনেকটা পথ এভাবে যেতে হবে।

চার মিনিট যেতে হবে এভাবে জোরে জোরে হাঁটলেও।বুঝতেই পারছেন কতটা বিশাল আয়তন মুত্যুর ডাক “বাঁশ ঝাড়টা! আন্দাজ করা যায় তবে কখন কীভাবে অদৃশ্য জগতের আত্মা, অদৃশ্য জগতের সেই বিভৎস মানুষগুলোর সাথে কখন দেখা হয়ে যায় মনের অজান্তে, চোখের পলক না পড়তেই, দেখতে মন না চাইলেও কিন্তু ওরা দেখা দেয়।কি জন্য দেয়? সেটা যারা সেই পরিস্থিতি সম্মুখীন হয়েছে তারাই ভালো বলতে পারবে। এমন পরিস্থিতির সম্মুখে দাঁড়িয়ে যে কেউ আজান্তেই ভয় পাবে এটাই স্বাভিক এটাই মানতে হবে।কারণ অদৃশ্য জগতের মৃত মানুষের সাথে আমাদের সব সময় দেখা হয় না এবং তারা আমাদের মতো স্বাভিক নয়। মনে, মনে এমন হাজারও চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে আজগরের মাথায়।দু’পা যেন সামনে এগোতেই চাইছে না বরংচো পিছু ফিরে যেতে বলছে। মনে হয় সামনে নয় পিছনে ফিরে গেলে ভালো হবে অন্তত আজকের রাতটা জন্যে। এদিকে এসব ভাবতে, ভাবতে, হাঁটছে তো হাঁটছে, বেশ জোরে, জোরে কিন্তু পথ তো শেষ হচ্ছে না!

বরংচো তার কেন জানি মনে হলো সে একি জায়গাতেই হেঁটে, হেঁটে ফিরে আসছে। অজানা আতংকে ঠোঁটগুলো কাঁপা শুর করলো।চিৎকার দিতে ইচ্ছে হলেও মুখ দিয়ে সেই চিৎকার দেওয়ার মতো শক্তির জোগান হচ্ছে না। কিন্তু এই বার বার এক পথে একি জায়গাতে সে বার বার আসছে কেন? এটার রহস্য কী? এর মানে কী? এমন প্রশ্নের জবাব আপাতত নাই আজগরের কাছে। তবে এতোটুক সে আন্দাজ করেছে সে কোনো অদৃশ্য অশুভের ফাঁদে পড়েছে।তাই সে হারিকেনের আলো আরও বাড়িয়ে দিল।এবং সোজা, একদম নাক বরাবর হাঁটতে শুরু করেছে।তবে পা চলছে না।ইতিপর্বে একি জায়গাতে অধিকবার যেয়ে শক্তি কমে গিয়েছে তার মধ্যে অজানা আতংক! মানসীক চাপ সব মিলিয়ে সে ক্লান্ত! তার মানে এই নয় সে ফিরে গিয়েছে।সবে মাত্র শুরু হলো সেই অদৃশ্য জগতের অশুভ আত্মাদের কর্ম। একটু দূর যেতেই পিছন থেকে প্রচুর কাঁন্নার শব্দ।যখন বাচ্চারা কাঁন্না করে সেই সময় যেমন সেই কাঁন্নার শব্দ শুনা যায়! তেমন নয়।একটু ভিন্ন।

পিছন থেকে যে কাঁন্নার শব্দ আসছে সেটা নিশ্চিত বাচ্চাদের কাঁন্না তবে শব্দটা অন্য রকম রহস্যময়।আর কাঁন্নার মাঝে করুণ সুর।যেন সে খুব কষ্টে আছে।খুব কষ্টে। পুরো পরিবেশটা সেই বাচ্চা কাঁন্নার শব্দে থমথমে অবস্থা বিরাজমান। হালকা বাতাসে আবার মৃদু হাসির শব্দও এখন! কী করব! ভাবলো আজগর। মনে, মনে ভীষণ বকা দিতে ইচ্ছে করছে তার বড় ভাই সাইফুদ্দীন কে। সে বলেছিল তুই যা বাজারে আমি একটু পর আসছি। তার আশায়, থেকে আজ এই পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে আজগরকে। মৃদু হাসির শব্দটা আসার পর বাচ্চাটার কাঁন্না থেমে গেল।আজীব তো? মৃদু হাসির সাথে কাঁন্নার সম্পর্ক কী? তবে সেই মৃদু হাসির মধেও রয়েছে অস্বাভিক রহস্য।পৃথিবীর মানুষ স্বাভিক হাসার যে শব্দ! তার সাথে সামান্যও মিল খুঁজে পাওয়া যায় নি সেই হাসির। ইতিমধ্যে হালকা বাতাসটা জোরালো হচ্ছে ধীরে, ধীরে।বাঁশ ঝাড়ের ফাঁকে মনে হয় কেউ লক্ষ্য রেখেছে আজগর এর দিকে।মনে হয় কোনো একজন পিছনে, পিছনে আসছে তবে তাকে দেখছে না আজগর।

ঝোপ ঝাড়ের ভিতরে টুকটাক শব্দ।গ্রামের বিস্তর জমিন থেকে শিয়ালের করুন সুরে কাঁন্নার শব্দ, আর এই মৃত্যুর ডাক বাঁশ ঝাড়ের সেই বাচ্চার কাঁন্না আবার মৃদু হাসি যা রহস্যময় এবং মৃদু বাতাস থেকে জোরে জোরে বাতাসের গতিবেগ বেড়ে যাওয়া এবং পিছনে পিছনে কেউ আসছে যা তার চোখে দেখা যাচ্ছে না এই পরিস্থিতিতে হঠাৎ আজগরকে কোনো এক অদৃশ্য কিছু টেনে নিয়ে জঙ্গলে ভেতরে নিয়ে যাচ্ছে।কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও সেই অদৃশ্যের কিছুর কাছ থেকে নিজেকে ছাড়াতে পারছে না আজগর।প্রানপণে চেষ্টা করছে তবে সব বৃথা। চাপা কাঁন্নার শব্দটা বেড়ে গেল আজগরের। জোরে, জোরে চিৎকার দিয়ে জানে শরীরের শক্তি কমা ছাড়া কোনো লাভ হবে না।কারণ সেই চিৎকার কারো কানে যাবেও না।তবে গেলে কেউ আসবেও না।

যেহেতু এই মৃত্যুর ডাক বাঁশঝাড় থেকে প্রায় কিছুদিন পর পর চিৎকার করে কাঁন্নার শব্দ কাছের বাড়ির মানুষগুলো শুনতে পায়। হারিকেনটা ছিটকে পড়ে গিয়েছে, ঝুঁড়িটাও পড়ে গিয়েছে। ঘুটঘুটে অন্ধকার এর মধ্যে টেনে হিছড়ে আজগরকে নিয়ে যাচ্ছে একদম ভিতরের দিকে। লোকে বলে একদম ভিতরে একটু ছোট্ট পুকুর রয়েছে। ইতিপূর্বে দুইজনের মৃত দেহ সেখানে পাওয়া গিয়েছিল।তবে কিভাবে মরেছে। এটা কী খুন! নাকি অন্য কোনো রহস্য তা কেউ জানতে পারেনি আজ অবধি। সেখানেই নিয়ে যাচ্ছে।এতো টানা টানির পর আর ভয়ে আজগর অজ্ঞান হয়ে যায়। কিছুদিন পর খোঁজ মিলে আজগরের। হারিকেনটার কেরোসিন কিছুটা জায়গায় তরলের মতো, আর ঝুঁড়িটা কিছুদূর পড়ে আছে। আর এর ঠিক সামনে বেশ ভিতরে ছোট্ট সেই পুকুরটাতে অর্ধ লাশ ভেসে আছে।

গল্পের বিষয়:
জীবনের গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত