বারো নাম্বার টিউশনি ছেড়ে বাড়ি এসে আম্মার মুখে শুনলাম বারোটা টিউশনি ছেড়ে দেওয়ার কথা বাবা সব জেনে গেছে। বাবা যদি জানতে পারে যে বারোটা টিউশনি আমি ছাড়িনি ওরা আমাকে ছেড়ে দিয়েছে তাহলে কপালে খুব খারাপি আছে। নিশ্চয় বাবা এতক্ষণে আমার গুণ গেয়ে ফেলছে। মনেমনে অকর্মা, টকর্মা বলে বকছে। রাতে ঘুমানোর মাঝে বাবা দরজা ধাক্কা দিচ্ছে আর ডাকছে।
_এই নবাবজাদা দরজা খোল। বাবার কণ্ঠ শুনে ভয়ে সারা শরীর তরতর করে কাঁপছে। ছোটবেলা থেকেই বাবাকে খুব পাই। নরম কণ্ঠে আস্তে করে বললামঃ-
_আস্তে ধাক্কা দেও দরজা ভেঙে যাবে।
_দরজা ভাঙলে আমার ভাঙবে তোর কি.? আমি ভাঙবো আমিই আনবো।
দরজা খুলে দিতেই বাবা আমার দিকে জল্লাদের মত চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে আছে। বাবা চেয়ারে বসলো আর আমি খাটে বসলাম। কিছুক্ষণ পর বাবা বললোঃ-
_শুনলাম তোর কোনো টিউশনিই টিকে না কারণ কি.? মনেমনে বলছি বাবা তাহলে আসল কারণ জেনে গেলো।
_আসলে বাবা।
_এই তোর সমস্যা কি আগে আব্বা ডাকতি এখন বাবা ডাকিস যে.? ঢাকা গিয়ে মডার্ন হয়ে গেছেন আপনি.?
_ইয়ে মানে বাবা না মানে আব্বা ঢাকা থাকাকালীন অভ্যাস হয়ে গেছে। বাবা চোখ থেকে চশমা খুলে আমার দিকে হা করে তাকালো তারপর বললোঃ-
_কিহ.!! তুই ঢাকা কাকে বাবা ডাকলি.?
_এমা, ছিঃ এসব কি বলো।
_তাহলে কি.?
_ঐ যে আমি যাদেরকে পড়াতাম তারা তাদের আব্বাকে বাবা বলে ডাকতো। ড্যাডি বলে ডাকতো পাপা বলে ডাকতো।
_হয়েছে রাখেন আপনার পাপা টাপা। এখন কাজের কথায় আসেন।
_আব্বা আমি কি কাজ করবো.?
_দুজন আমাকে বলেছে ভালো একটা টিচার্স দেখতে পড়ানোর জন্য।
_কিন্তু বাবা। সরি আব্বা। এই টিউশনি আমার দ্বারা হবে না।
_তাহলে একটা রিক্সা কিনে দেই কাল থেকে রিক্সা চালা। যা বলছি তাই কর। কাল বিকেলে আড়ৎ এ দেখা করবি।
এই বলে আব্বা চলে গেলো।
.
রাতে শুয়ে শুয়ে ভাবছি দুজন টিউশনি কাদেরকে পড়াবো.? তারা কি ছেলে নাকি মেয়ে.? তারা কি ঐ বারোটা মেয়ের মত.? এসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ ঘুমিয়ে পরলাম। সকালবেলা দশটা বাজে ঘুম থেকে উঠলাম। মোবাইকে তাকিয়ে দেখি আব্বার বারোটা মিসডকল আজ দেখা হলে আব্বা তেরোটা বাজাবে। ফ্রেশ হয়ে না খেয়েই বের হলাম। রাস্তায় এসে খেয়াল করলাম আব্বার শাহী লুঙ্গি পরেই চলে আসছি। আমার সব লুঙ্গি ভিজা ছিলো তাই রাতে আব্বার লুঙ্গি পরে ঘুমিয়েছিলাম। এই মুহূর্তে বাড়ি ফেরাও যাবে না। এমনিতে অনেক দেরি করে ফেলছি। যাইহোক পাঁচমিনিট পর আড়ৎ এ গেলাম। আব্বা আমাকে লুঙ্গি পরা অবস্থা দেখতে পেয়ে খুব হাসছে হঠাৎ হাসি বন্ধ হয়ে গেলো। আব্বার চোখ গেলো লুঙ্গির ফুটা জায়গাতে।
_এইটা তুই কি করছিস.? নতুন লুঙ্গিটারে ফুটা কইরা দিলি.?
_আব্বা আমি কিচ্ছু করিনি।
_আজ এই লুঙ্গি পরে শ্বশুরবাড়ি যাবো ভাবছিলাম আর তুই কি না ফুটা কইরা দিলি। ভেজাবেড়ালের মত আব্বার সামনে দাঁড়িয়ে আছি। একটু পর আব্বা একটা ঠিকানা দিয়ে বললোঃ-
_কাল সকালে এই ঠিকানায় গিয়ে দুটো মেয়েকে পড়াবি।
.
তারপর লুঙ্গির ফুটা জায়গায় হাত দিয়ে বাড়ি যাচ্ছি। মানুষজন আমার দিকে হা করে তাকিয়ে দেখছে। কৌতুহলবশত কয়েকজন জিজ্ঞেস করেই ফেললো আমার কি হয়েছে। কেউ আর বুঝতে পারছে না যে আমার লুঙ্গি ফুটা তাই হাত দিয়ে ঢেকে বাড়ি যাচ্ছি। কয়েকজনকে বললাম। আমার মিড়কিব্যারাম হয়েছে তাই এইভাবে প্যারালাইজড রোগীর মত হেটে যাচ্ছি।
পরেরদিন সকালবেলা নতুন টিশার্ট নতুন প্যান্ট পরে বের হলাম। পনেরো মিনিট পর সেই ঠিকানায় পোঁছালাম। কলিং বেল টিপ দিলাম। দরজা খুলতেই দেখতে পেলাম দুইটা মেয়ে আমার বরাবর দাঁড়িয়ে আছে। দুজনেই আমার দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে। আমিও দুজনের দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছি কারণ দুজনের চেহারাই একরকম। তার মানে এরা দুজন যমজ বোন। আব্বা তুমি এ কেমন টিউশনি যোগাড় করে দিলা। শেষ পর্যন্ত দুই যমজ বোনকে পড়াতে হবে। না এদেরকে আমি পড়াবো না বলে পিছনে ঘুরে তাকাতেই দেখি আব্বা একটা রিক্সা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আর ইশারা দিয়ে বলছে। এটা নাকি ওটা.? মানে টিউশনি পড়াবো নাকি রিক্সা চালাবো। কি আর করা দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকলাম। সোফায় গিয়ে বসলাম। দুই যমজ মেয়ে আমার ঠিক সামনে বসে আছে। একজনের দিকে আঙুল উঠিয়ে বললামঃ-
_তোমার নাম কি.?
_জ্বী, স্যার আমার নাম কোয়েল।
_আর তোমার নাম কি.?
_জ্বী, স্যার আমার নাম পায়েল।
মানুষ নায়কনায়িকাদের দেখার জন্য কতকিছু করে আর আমার সামনে দু দুজন নায়িকা বসে আছে। নিশ্চয় এদের মা-বাবার নামও কোনো নায়কনায়িকাদের হবে। যাইহোক পরিচয়ের কাজটা মোটামুটি সেরে নিলাম। হঠাৎ পায়েল বলে উঠলো।
_আচ্ছা স্যার আপনি এত ভয় পাচ্ছেন কেন.? এর মাঝে কোয়েল বললোঃ-
_স্যার আপনার জন্য এক গ্লাস পানি নিয়ে আসি.? মাথা নাড়িয়ে হা সূচক বলে দিলাম। কোয়েল চলে যাওয়াতে পায়েল ফিসফিস করে বললোঃ-
_স্যার কোয়েলের আনা পানি খাবেন না এতে ঘুমের ওষুধ মেশানো থাকবে।
_তুমি কেমনে জানো যে এই পানিতে ওষুধ মেশানো থাকবে.?
_ও আমাকে বলে গিয়েছে।
_হা হা হা, ছাত্রী কখনো স্যারের সাথে এমন করতে পারে না।
কোয়েল পানি নিয়ে আসলো। গফগফ করে খেয়ে ফেললাম। কিছুক্ষণ পর আন্দাজ করলাম চোখে ঘুম চলে আসছে। এখন মনে হচ্ছে পায়েল ঠিকই বলেছিলো। চোখে ঘুম আসলে কি আর পড়ানো যায়.? আজকের মত পড়া শেষ করে দিলাম। দরজার কাছে আসতেই দেখলাম পায়েল আর কোয়েল হাসতে হাসতে শেষ। স্যারকে বোকা বানানোর খেসারত দিতে হবে বলে বাড়ি ফিরে আসলাম।
.
বাড়ি এসে তেলাপোকা খুঁজতেছি। কাল পড়াতে যাওয়ার আগে কয়েকটা তেলাপোকা সাথে নিয়ে যাবো। উল্টাপাল্টা কিছু করলেই তেলাপোকা দেখিয়ে ভয় দেখাবো। মেয়েদেরকে ভয় দেখাতে হলে এটাই যথেষ্ট।
পরেরদিন দুই যমজ মেয়েকে পড়াতে বের হলাম সাথে একটা ব্যাগ নিলাম তার ভিতরে দুইটা তেলাপোকা আছে। কাল দুইটা তেলাপোকা ধরতে গিয়ে কত কষ্ট যে হলো আর কি বিশ্রী গন্ধ।
যথারীতি ছাত্রীদের বাড়ি গিয়ে সোফায় বসলাম আর টেবিলে ব্যাগটা রাখলাম। গ্রামার বই বের করে টেনস সম্পর্কে বুঝাচ্ছি এইভাবে আধা ঘন্টা পড়ানোর পর ব্যাগটা খুলে একটা খাতা বের করতেছি এর মাঝে দুইটা তেলাপোকা বের হয়ে গ্রামার বইয়ের উপর দৌড়তে লাগলো। তেলাপোকা দেখে কোয়েল আর পায়েল চিৎকার চেঁচামেচি করতে লাগলো। কোয়েল আর পায়েলের আম্মা আসলো ততক্ষণে দুজনেই অজ্ঞান হয়ে গেলো। আর আমি তেলাপোকা দুইটাকে ধরতেছি। অনেক কষ্টে দুইটা তেলাপোকা ধরলাম। ততক্ষণে দুজনেরই জ্ঞান ফিরছে। সামনে গিয়ে পিছন থেকে হাত বের করে বললামঃ-
_এই দেখো তেলাপোকা দুইটা ধরে ফেলছি আর ভয়ের। পুরো কথা বলতে পারলাম না তার আগেই দুজনে আবার চিৎকার। কোয়েল আর পায়েলের আম্মা গণ্ডারের মত চিৎকার দিয়ে বললোঃ-
_এই ছেলে তুমি আমার বাড়ি থেকে এক্ষুণি বের হয়ে যাও। তুমি আমার মেয়েদেরকে আর পড়াতে আসবা না।
.
ভাবতেই পারছি না যে তেলাপোকার জন্য টিউশনি চলে।যাবে। আর এতে আমার কোনো দোষও নেই। তেলাপোকা ব্যাগ থেকে বের হয়ে গেলে আমি করতাম.?? আসল কথা হলো এসব টিউশনি আমার দ্বারা হবে না। আজ বাড়ি গেলে আব্বা বলবে কাল থেকে টিউশনি বাদ দিয়ে রিক্সা চালাবি। আর আমিও বলবো একটা রিক্সা কিনে দাও।
গল্পের বিষয়:
জীবনের গল্প