সকালে ঘুমটা ভেঙ্গে গেল স্বপ্নার।কে যেন কলিংবেল বাজাচ্ছে। একবার – দুবার নয়- বেশ কয়েকবার।এই বাড়িতে বেলের আওয়াজটা এত কর্কশ কেন? বেলটা পাল্টে দিতে হবে। স্বপ্না মোবাইল ফোনে দেখলো নয়টা বাজে। আজ কি বার?শুক্রুবার? আজকাল দিন তারিখ, ঘন্টা কিছুই মনে থাকেনা স্বপ্নার। তার অফিসের কলিগ সুমিত বলেছিল, যে সব মানুষ খুব স্ট্রেসে থাকে তারা অনেক কথাই ভুলে যায়! আমি কি স্ট্রেসড?- নিজেকে প্রশ্ন করলো স্বপ্না। কাল রাতে মাটিতে চাদর পেতে শুয়েছিল। মাঝরাতে একবার ঘুম ভেঙ্গে গেল-ঘুমের ঘোরে দেখেছে কিছু তেলাপোকা তার পাশ দিয়ে ঘোরাফেরা করছে। তেলাপোকায় ফোবিয়া আছে স্বপ্নার। কিন্তু কাল রাতে একটুও নড়তে পারলোনা। নতুন অচেনা জায়গা্য কিভাবে অঘোরে ঘুমিয়ে পড়লো?এত বছরের ক্লান্তি! নতুন ফ্ল্যাটে গতকাল বিকেলে উঠেছে স্বপ্না – আসার সময় একটা ছোট ব্যাগে কিছু কাপড়চোপড় এনেছে—আর সেই সাথে এনেছে সারা শরীর জুড়ে হাসানের লাথি আর মারের দাগ।বেশ কিছুদিন ধরে সে একটা ফ্ল্যাট খুঁজছিল- কিন্তু সে একা থাকবে শুনে কেউ ভাড়া দিচ্ছিল না। হাজব্যান্ড কি করে – কেন সাথে নাই এইসব হাজারো প্রশ্ন। এরপর ছোটবেলার বান্ধবী সামিনাকে বলাতে সেই তাকে এই ফ্ল্যাটটি ঠিক করে দিল।এইটা সামিনার চাচার ফ্ল্যাট। তিনি বিদেশে থাকেন। সামিনা এই ফ্ল্যাট দেখাশুনার দায়িত্বে আছে। দুই রুমের ছোট একটা ফ্ল্যাট । এই বিল্ডিঙয়ে ইন্টারকম নাই। যে বেল বাজাচ্ছে সে প্রচন্ড নাছোড়বান্দা – এবার একেবারে টিপে ধরে আছে ।স্বপ্নার বুক ধড়ফড় করতে শুরু করেছে- হাসান নাকি?
স্বপ্না পিপহোল দিয়ে দেখল মুক্তা খালা! দরজা খোলার সাথে সাথে মুক্তা খালা হইহই করে ঢুকল । এই সাতসকালেও মহা সাজগোজ করে এসেছে। লাল লিপস্টিক ঠোঁটের কোনা দিয়ে পানের রসের মত ছড়িয়ে আছে।অবশ্য বরাবরই খালা এমন। সাজতে চায় কিন্তু সাজটা ঠিকমত হয়না। স্বপ্না দেখেছে কোন মেয়ের সাজগোজ সুন্দর হোক বা না হোক – কিন্তু সাজতে থাকা মেয়েদের মনে দারুণ ফুরফুরে ভাব হয়! খালা তো মাঝে মধ্যেই সাজতে সাজতে বিকট গলায় গেয়ে উঠে ‘সখী ভাবনা কাহারে বলে……’তবু ভালো লাগে স্বপ্নার।কিন্তু সে কখনো সাজে না- সাজলে হাসান রাগ করে!
– অ্যাই স্বপ্না আমাকে পানি দে!উফ্ কি বাসা এটা – একটা লিফটও নাই?চার তলায় উঠে আমার পা ব্যথা করছে। চিপা গলিতে গাড়ি ঢুকল না। তাই গলির সামনে গাড়ি রেখে হেঁটে হল! রাস্তার লোকেরা আমার দিকে তাকায়া ছিল!তুই রাজপ্রাসাদ ছেড়ে বস্তিতে উঠলি?
– লিফটওয়ালা বাসার ভাড়া অনেক। তুমি আমার খোঁজ পেলে কিভাবে?
– সামিনা আমাকে তোর ঠিকানা জানিয়েছে ।তুই হাসানের কাছে ফিরে যা। হাসান তোকে খুঁজছে। কালরাত্রে আমার কাছে এসে কত মন খারাপ করলো। তুই নাকি তাকে ডিভোর্স দিচ্ছিস?
– খালা তুমি চা খাবে? এখানে গলির মোড়ে একটা চায়ের দোকান আছে- কাল আসবার সময় দেখলাম!
– কি বললি? আমি গলিতে দাঁড়িয়ে চা খাব? তাও আবার ড্রাইভারের সামনে? তোর মাথা খারাপ?
– আচ্ছা খেয়োনা।কাল সন্ধ্যায় এখানে এসেছি।তাই বাসায় খাবার- দাবার-চেয়ার টেবিল কিচ্ছুই নাই। আজকে একটা খাট আর চেয়ার এর অর্ডার দিব।মাটিতে ঘুমালে তেলাপোকা হেঁটে বেড়ায়।আজ রাত থেকে মনে হয় ভয় লাগবে!
– তোর মাথা খারাপ-তোর এত বড় বাসা থাকতে এখানে কেন থাকবি? চলে যা। একা এখানে ভয় লাগবেই।
– হাসানকেই আমার ভয় লাগে!আমি হাসানের কাছে আর ফিরে যাব না।কাল ডিভোর্স ফাইল করেছি।
– মেয়েমানুষ হইসিস এত তেল কিসের? খালি কমপ্লেন করিস হাসান মারধোর করে! একটু আধটু চড় থাপ্পড় খেয়ে সারা দেশের মেয়েরা সংসার করছে- আর তোর এত দেমাগ!
-খালা, আমি গালি-মার খেয়ে আর সংসার করতে পারবোনা।তুমি তো জান সে ১০টা বছর সন্দেহ করে আমাকে মেরে মেরে শেষ করে দিয়েছে?মারে- কাটে আবার পায়ে ধরে।আমি আর পারছি না। আমি যে কারও সাথে কথা বললেই সে সন্দেহ করে ।এভাবে কি সংসার হয় বল? সে কি সুস্থ? ডাক্তার দেখাতে চাইলে বলে আমি চরিত্রহীণ।
এরই মধ্যে খালুর ফোন এসে গেল। এইতো আসছি ইত্যাদি বলে খালা ফোন রেখে ‘যাই! তোর খালু যেন কেন রেগে আছে, কাল আসবো আবার’ – এইসব বলতে বলতে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল।
দরজা বন্ধ করতে করতে স্বপ্নার মনে হল- এখান থেকে পালাতে হবে। সে চায় না তার ঠিকানা কেউ জানুক। কিন্তু বললেই তো পালানো যায়না ।মা বাবা মারা গেছে। আত্মীয় স্বজনদের বাসায় উঠতে ইচ্ছে করে না- কেমন বাধো বাধো ঠেকে!
স্বপ্না একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীতে চাকরী করে।সে ফ্ল্যাটটা ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলো।দুই বেডরুমের ছোট্ট একটা ফ্ল্যাট- বেশ সুন্দর। বেডরুমের সাথে লাগোয়া ব্যালকনি। ড্রইং-কাম ডাইনিং আর একটা কিচেন। ব্যালকনিটা স্বপ্নার খুব পছন্দ হয়ে গেল!এর পাশ দিয়ে একটি নারিকেল গাছ।হাত বাড়ালেই পাতা ছোঁয়া যায়- পাতাগুলো কি সবুজ!কাল রাতে বৃষ্টি হওয়াতে পাতাগুলো পরিষ্কার হয়ে চকচক করছে! বাড়ির সামনের প্লটটি এখনো খালি । তাই ব্যালকনিতে একটা রকিং চেয়ার আর ল্যাপটপ নিয়ে ছুটির দিন পার করা যাবে।আরেকটা বেডরুমকে বেবি রুম বানাবে কি? স্বপ্নার বাচ্চা নেই- কিন্তু একটা বাচ্চার অনেক অভাববোধ করে সে । সে ঠিক করে রেখেছে একটা মেয়ে বাবু অ্যাডাপ্ট করবে।বাবুটিকে পাবার পর সে চাকরী ছেড়ে দিয়ে একটা বুটিক শপ করবে। আর সারাদিন বাবুকে নিয়ে থাকবে। এইসব আবোল- তাবোল ভাবতে ভাবতে অনেকটা সময় পেরিয়ে গেল।
খিদেয় পেট চোঁ চোঁ করছে- ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে দুপর সাড়ে বারোটা বাজে। সকালে তো নাস্তাও খাওয়া হয়নি।কোন রেস্টুরেন্টে গিয়ে কিছু খেয়ে নিলে হয়। এরপর কেনাকাটা শুরু করতে হবে। বাসাটা ছেড়ে দিবে নাকি এখানেই থাকবে সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না সে!বাসাটা ভাল লেগে গেছে! স্বপ্নার তেমন একটা বন্ধুবান্ধব নেই। এক সামিনা আছে- সে আবার পেটে কথা রাখতে পারেনা। সব কিছু বলে দেয়।এতে বড় সমস্যা হল তার ঠিকানা হাসান পেয়ে যেতে পারে।ভাবতে ভাবতে স্বপ্না একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকে চিকেন বিরিয়ানীর অর্ডার দিল। একা একা কি তার ভালো লাগছে? সে তো এতদিন একাই ছিল-অহেতুক এক ছাদের নীচে দুজনের বাস! আজ বরঞ্চ ভালো লাগছে !কেমন একটা স্বাধীন স্বাধীন ভাব- সে যেন মুক্ত পাখী!কিন্তু কান্না পাচ্ছে কেন? সেটেল্ড ম্যারেজ হলেও হাসানকে কতো ভালবেসেছিল! প্রথম প্রথম ভাবতো হাসান রগচটা -ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু কিছুই ঠিক হয়নি। সবসময় তাকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে, সন্দেহ করে, কষ্ট দিয়ে কেন যে আনন্দ পায় সে! স্বপ্নার চোখে পানি এসে গেল! কিছুক্ষণ পর ওয়েটার এসে জিজ্ঞাসা করল- আপা বিরিয়ানি কি ঝাল হইসে? টিসু লাগবো?
স্বপ্নার কাল অফিসিয়াল ট্যুরে নেপাল যেতে হবে। তাই কিছুই রাঁধবে না; রাতের জন্য স্যান্ডউইচ জাতীয় কিছু কিনে নিলেই চলবে। কিন্তু কাপড়চোপড়পড়, লাগেজ , টয়লেট্রিজ সব কিছু কিনতে হবে যে! কাছেই একটা শপিং মল থেকে কেনাকাটা করতে করতে রাত ৯ টা বেজে গেল।
এই বিল্ডিং এ ৮টা ফ্ল্যাট। ৪ তলাবাড়ি। স্বপ্না ৪ তলায় পূর্ব দিকের ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছে।দারোয়ান কে জিজ্ঞাসা করাতে সে জানালো পাশের ফ্ল্যাটের মানুষজন গ্রামে বেড়াতে গেছে। আজকেও তেলাপোকার সাথে ঘুমাতে হবে? বিছানা তো নেই! যাক মশারী কেনা হয়েছে। মশারী চাদরের নীচে গুঁজে দিয়ে সেফটিপিন লাগিয়ে নিতে হবে।তাহলে তেলাপোকা কাছে আসতে পারবেনা। অনেক জিনিসপত্র চারতলায় উঠাতে উঠাতে স্বপ্না হাঁপিয়ে গেল। দরজা খুলে ঘরে এসে সব এক এক করে ঢুকাল। কাল ফ্লাইট – ব্যাগ গুছাতে হবে আবার!
ব্যালকনির দরজা খোলা।বেডরুমে বসে কাপড় গুছাতে গুছাতে স্বপ্না দেখল আকাশে কি বিশাল চাঁদ উঠেছে! আজ কি জ্যোৎস্না রাত? কি সোনালী আলো তবু চারদিক কি গা ছমছমে চুপচাপ!এত একা লাগছে ! কিছুটা ভয়!বারান্দায় লাইট লাগাতে হবে।স্বপ্না উঠে ব্যালকনিতে গেল। হঠাত একটা পরিচিত কোলনের গন্ধ নাকে এসে লাগলো- “আমার মাথা কি খারাপ হয়ে যাচ্ছে- হাসান নিশ্চয় এখানে আসেনি”-স্বপ্না চমকে পিছনে তাকাল!তাকিয়ে দেখে হাসান তার পেছনে দাঁড়িয়ে- মুখে বিচিত্র হাসি!
দরজায় তালা লাগানো ছিলো- স্বপ্না চীৎকার করে উঠল!তুমি কিভাবে আসলে?
- ডুপ্লিকেট চাবি নেওয়া আমার জন্য কি কঠিন? তানিয়া ব্যবস্থা করে দিয়েছে!প্রেম করার জন্য বাসা ভাড়া নিয়েছো- আমার কাছ থেকে পালাবে, তাই না? আজকে আমি তোমাকে মেরেই ফেলবো। আমাকে ডিভোর্স দেয়! কত বড় সাহস!
হাসানের হাতে গত বছর সুভিনিয়র হিসেবে নেপাল থেকে আনা নেপালী ভোজালি!
- তুমি চলে যাও- আমি অন্য কারও সাথে প্রেম করিনি- তোমাকে নিয়েই ছিলাম। তোমার যত মিথ্যা সন্দেহ …।
ব্যালকনির রক্তাক্ত মেঝে পূর্ণিমার সোনালি আলো পড়ে ভয়াবহ ভাবে ঝকঝক করছে!