আমি সবে মাত্র এক পা দু পা করে হাঁটতে শিখেছি। তখন যে কোন কোলই তখন আমার কাছে চিড়িয়া খানার মত। ঘরের ফ্লোরে বা উঠোনে একা একা ঘুরে বেড়ানোয় আমি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। কেউ কোলে নিতে চাইলেই আমার চিৎকার। আর ফলাফলে আমায় ছেড়ে দিয়ে সবারই বৌ দৌড়। কেননা কেউ আমায় কাঁদিয়েছে শুনলে ফুফু তাকে আচ্ছামত বকে দিতেন। দাদী তো আরও একহাত উপরে ছিলেন। তাই আমি খুবই স্বাধীন ছিলাম। যদিও ঐ সময়টায় রাখালের মত একজন সাথেই লেগে থাকত।
সবি-ই শুনেছি আমি আমার খালামনি আর আম্মুর কাছে। ঐ সময়টায় কারো কোন ধরনের বড় অসুখ বা কোন সমস্যায় পড়লে মাজারে বা মসজিদে মানত করাটা একটা নিয়মের মতই ছিল। যে কেউ-ই এই নিয়ত করে বসত। আমার ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছিল। ছয় মাস বয়সের সময় যখন আমার উপর খারাপ আত্মার প্রভাবে আমি প্রায় মরতে বসেছিলাম তখন আমার দাদী আমাকে নিয়ে মাজারে খাঁসি দিয়ে শিন্নি করার মানত করেছিলেন।
আমি তখন অনেক ছোট ছিলাম বলে তারা স্থির করেছিল আমার বয়স যখন এক বৎসর পূর্ণ হবে তখন তারা আমাকে সাথে নিয়ে গিয়ে মানতের পরিপূর্ণতা দিবে। আমার একবছর পূর্ণ হওয়াই মানতের পূর্ণতা দেওয়ার জন্য সব আয়োজন সম্পন্ন হয়েছে। সবার সুবিধা আর জুমআ বার হওয়াই শুক্রবারকেই বেছে নেয়া হয় মানতের পরিপূর্ণতা দেওয়ার জন্য।
দাদু বাড়ী থেকে মাজারের দুরত্ব নানু বাড়ীর কাছে হওয়াই আগের দিনই আমাকে সাথে নিয়ে আম্মু, দাদী আর ফুফুমনি নানু বাড়ী চলে আসে। আব্বু অফিসের কাজে বাহিরে থাকায় আসতে পারে নি। সেদিন নাকি নানু বাড়ীতে উৎসবের আমেজ। ফুফু আর খালামনি তো আমাকে নিয়ে খুঁনসুটিতে ব্যস্ত। পরের দিন সকালে সবার আগে ফুফু আর খালামনি মিলে আমাকে সুন্দর করে সাজিয়ে দিয়েছে। তারপর তারা সবাই রেড়ি হতে ব্যস্ত।
আমি চিড়িয়া খানার খাঁচা হতে ছাড়া পেয়ে আনন্দে আত্মহারা। আমার খালাতো বোন আমার চেয়ে তিন বছরের বড়। তার হাত ধরে এক পা দু পা করে বাড়ির পাশে আমগাছের সাথা বাঁধা খাঁসির কাছে গিয়ে উপস্থিত। ছাড়বে না তবুও আপুর হাত কষ্টে ছাড়িয়ে নিয়ে খাঁসির সাথে খেলায় ব্যস্ত। এর মাঝে খালামনি এসে আপুকে বলে গেছে যেন আমাকে ধরে রাখে যাতে আমি কোথাও না যেতে পারি। কিছুক্ষন পর আপু আমার হাত ধরে নিয়ে আম গাছ থেকে বেশ দুরে বড়ই গাছ পেরিয়ে গভীর কূপের নিকটে নিয়ে যায়। কূপের মাটির উপরের নিরাপত্তা বেষ্টনির উচ্চতা আমার কপাল সমান। আমার কোন ভাবেই কূপের ভিতর পড়ে যাওয়ার কোন রিস্ক নেই।
আপু কূপের মুখে মাথা দিয়ে জোরে জোরে আওয়াজ করতে ছিল আর সেই আওয়াজ প্রতিধ্বনিত হয়ে আমাদের কানে ফিরে আসছিল। আর তা শুনে আমাদের দুজনের মুখেই হাসির ফোয়ারা। (অবশ্য খালামনিরা এসব কল্পনা করে নিয়েছিল। কারন আগের দিন বিকালে একই দৃশ্যের মঞ্চায়ন হয়েছিল। আপু আওয়াজ করতে ছিল আর আমিও দেখার জন্য উদগ্রিভ ছিলাম। আপুও আমায় কোলে তুলে দেখাতে চেয়েছিল।
কিন্তু ফুফু আর খালামনি থাকায় তাদের কল্যাণে আমি কূপ দেখেছিলাম কোন অঘটন ঘটেনি।) সকালেও একই কাজ করেছিল আপু। আমি দেখতে চাওয়ায় আমায় কোলে তুলে দেখাতে চেয়েছিল। আমি উৎফুল্লতে বেশি ঝুকে দেখতে যাওয়ায় আপু আর আমায় ধরে রাখতে পারেনি। আমি সোজা গভীর কূপের ভিতর। তখন সবাই রেড়ি হয়ে আমায় খোঁজা শুরু করে দিয়েছে।
আপু ভয় পেয়ে অন্য বাড়িতে গিয়ে দাড়িয়ে আছে। আমায় না পেয়ে আপুকে ডেকে জিজ্ঞাসা করতেই আপু কান্না শুরু করে দিয়েছে। প্রথমে কিছু না বললেও পরে কূপের দিকে ইশারা করে। খালামনি আপুর ইশারা পেয়েই দ্রুত কূপের নিকটে চলে আসে। কুপে তাকিয়েই চিৎকার দিয়ে উঠে খালামনি। আমি কূপের পানিতে ভেসে আছি ( অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি আমি নাকি কূপের দুই পাঢের মাঝে একটু ফাকা ছিল সে ফাকায় দু হাত দিয়ে পাঢ ধরে ভেসে ছিলাম )। আমাকে উঠানোর জন্য প্রথমে রসিতে বেধে খাঁচা নামিয়ে দেয়া হয়।
আমি খাঁচায় না উঠে আরো জোরে জোরে চিৎকার করতে থাকি। পরে প্রতিবেশি এক মামা অনেক কষ্টে নেমে আমাকে উঠিয়ে নিয়ে আসে। আমি অলৌকিক ভাবে বেঁচে যায়। অবিশ্বাস্য ঘটনা আমি এক ফুটা পানিও খায় নি আর একটুও ব্যাথাও পায় নি। সেদিন আর আমাদের মাজারে যাওয়া হয় নি। রাতে আব্বু বাড়িতে এলে আমি নাকি আব্বুকে জড়িয়ে ধরে অনেক ফুপিয়ে ফুপিয়ে কেঁদেছি। আমি কেন কাঁদছি, আর কেন মাজারে জায়নি কেউ, আব্বু এসব জিজ্ঞাসা করলে সবাই কৌশলে মিথ্যা বলে এড়িয়ে গেছে। তবে রাতে সবাই এড়িয়ে যেতে পারলেও সকালে পারেনি। আমি আব্বুকে টেনে নিয়ে সোজা কুপের কাছে নিয়ে গেছি।
বারবার নাকি ইশারা করে কুপের ভিতরে দেখতে বলতেছিলাম। আমার এমন আচরন দেখে আব্বু বুঝে ফেলেছিল যে আমি কূপের ভিতর পড়ে গিয়েছিলাম। পড়ে সবাইকে জিজ্ঞাসা করলে সবাই সত্যতা স্বীকার করে নেয়। আম্মুকে নাকি আব্বু অনেক বকাবকি করেছিল। সেদিনই কূপ ভেঙ্গে ফেলা হয়। সেদিন না হলেও পরের শুক্রবারেই মানতের পূর্ণতা দেওয়া হয়। পরে দাদুর কাছে সবাই জানতে পারে দাদুর পরীর কারনেই নাকি সেদিন আমি বেচে গিয়েছিলাম। অশুভ আত্মাটাকে ছাড়ানোর পর থেকেই নাকি পরীটা আমার ছায়া সঙ্গী হয়ে ছিল।