গুম…গুম…গুড়–ম।
গু-ম…গু-ম…গু-ড়–-ম। গু–ম…গু–ম…গু–ড়––ম।
বৈশাখের মাঝামাঝি সময়। প্রচন্ড ঝড় বৃষ্টি হবে। আকাশে কালো মেঘ জমেছে। চারদিক থমথমে। এক্ষুনি যেন প্রবল বেগে বাতাস শুরু হবে। ঘন ঘন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। এই সময়টার জন্য সারা বছর ধরে অপেক্ষা করছে হরিহর জলদাস।
প্রকৃতির এই রুদ্ররোষ। কাল বৈশাখী। যদিও এই তান্ডব অনেকের কাম্য নয়। তবুও প্রকৃতি তার আপন গতিতে চলবে। কারও ইচ্ছা অনিচ্ছাই কিছু যায় আসে না। এটাই প্রকৃতির নিয়ম। বৈশাখ জোষ্ঠ্য মাসে কালবৈশাখী ছোবল মারবেই। তাতে কারও সর্বনাশ আবার কারও পৌষ মাস।
সবে মাঠের ধানগুলো সোনালী রং ধারণ করছে। আর ক’দিন পরেই শুরু হবে ধান কাটা। এদিকটায় ইরি ধানের চাষ হয়। ফসলও ভালো। তবে কৃষক কুলিয়ে উঠতে পারে না। সার বীজ পানি আর রোজ খরচ মিলিয়ে র্পতা পোষায় না। তবুও কি করা। নিজেদের যেটুকু জমি তা একেবারে অনাবাদী রেখে লাভ কি। হরির ছয় সদস্যের সংসার। যা ধান হয় তাতে বছর কুলায় না। তবুও নিজেদের জমি বলে কথা।
হালদা নদীর পাড়ে ডোমখালীর বাঁকে হরি জলদাসের দো-চালা টিনের ঘর। পাশাপাশি আরও কয়েকঘর জেলে পরিবার। নিজের কোন জাল নেই। অন্যদের সাথে বাউনি করে। আর নদীতে মাছ ধরে যেটুকু আয় তাতে সংসারের ভরণ পোষণ কোনভাবে চলে যায়। সম্বল বলতে একখানা ডিঙি নৌকা। নদীর ওপাড়ে মুন্সীর হাট। নৌকা পারাপার করেও কিছুটা বাড়তি আয় করে। তাতে সাহায্য করে বড় ছেলে হারাধন। ছোট দুই মেয়ে। যশোদা আর সারদা। মা আছে। বাবার কথা মনে হতেই সেই কর্ণফুলীর উজানের কথা মনে পরে।
বাবা সুখেন্দু জলদাস সেই যে কর্ণফুলীর মোহনায় গিয়েছিল মাছ ধরতে। আর ফিরে আসেনি। সেবার উজানি ঢলে মিটা পানির স্রোত বেয়ে প্রচুর বড় মাছ উঠেছিল। হালদাতে প্রচুর মাছের পোনা ধরা পরেছে। আরও একটু বেশী মাছ পাওয়ার আশায় এগিয়ে গিয়েছিল সুখেন্দু। একেতো পানির স্রোতে স্রোতে, তার উপর ঘন ঘন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। সন্ধ্যা হয়ে গেলেও সুখেন্দুর ফেরার নাম নেই। দু’দিন পরে সুখেন্দুর লাশ পাওয়া গেল মাছুয়া ঘোনায় এক বেড়ী জালে। সেই থেকে হরিহর আর ওদিকে কখনও মাছ ধরতে যায়নি।
এবার বৈশাখের প্রথম বৃষ্টির লক্ষণ দেখে মনে খুব আনন্দ হচ্ছে। বারান্দায় বসে নেট কাপড়ের জালটা ভালোভাবে শেষবারের মত দেখে নিচ্ছিল হরিহর। কোথাও কোনো ছেড়া ফাটা আছে কিনা। দু’এক জায়গায় একটু ছেঁড়া থাকলেও তা পরম যত্নে নিজে সেলাই করে নিয়েছে। জাল বুনার সাথে সাথে নিজের স্বপ্নটাও বুনতে শুরু করেছে। এ-পাড়টায় ভাঙ্গন ধরেছে। কখন যে বাড়িঘর সব খেয়ে ফেলে তার ঠিক নেই। গত দু’বছর ধরে মাছুয়া ঘোনা থেকে এদিকে বাঁক নিচ্ছে।
কয়েক বছর ধরে সরকারও প্রাকৃতিক মৎস্য সম্পদ রক্ষায় এই নদীকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিচ্ছে। সরকার হালদাকে ”জাতীয় ঐতিহ্য” হিসাবে ঘোষণা করেছে। হালদাকে জাতীয় নদী ঘোষণার জন্য বিভিন্ন মহল থেকে জোড় দাবী উঠছে। স্থানীয় প্রশাসন খুবই গুরুত্ব সহকারে নজরদারী বাড়িয়ে দিয়েছে। যাতে যে কেউ অবৈধ ভাবে মা মাছগুলোকে মারতে না পারে।
এত কিছুর পরও হরি কিংবা হারাধন যখন লোক পারাপারের জন্য নদীতে নৌকা নিয়ে অপেক্ষা করে তখন দু’টো বড়শী ফেলে রাখে। তাতে কয়েকটা গলদা চিংড়ী কিংবা টেংরা, পাবদা বা বেলে মাছ ধরে। নদী আর জীবন দু’টোই যেন একই সূত্রে গাঁথা। যতক্ষণ পানিতে থাকে তাতে মাছ কেনার পয়সাটা বেঁচে যায়। এবার রেণু পোনার খেপটা ঠিকমত মারতে পারলে একটু দূরে গিয়ে আলাদা একটা জমি কেনার স্বপ্ন দেখছে হরি। বলাতো যায় না, নদীর ভাঙ্গন আর মানুষের মন কোনটারই বিশ্বাস নাই। ছেলেটাকে লেখাপড়া করাতে পারেনি। মেয়ে দু’টোকে লেখাপড়া করানোর খুব ইচ্ছা। প্রাইমারী স্কুলে ভর্তিও করে দিয়েছে। দু’বোন একসাথে স্কুলে যায়। হরি অপলক চেয়ে থাকে মেয়ে দু’টোর দিকে। বড় হলে মেয়ে দু’টোকে ভালো ঘরে বিয়ে দিতে হবে। তাতে কিছু টাকা পয়সা লাগবে। এখন থেকে কিছু কিছু জমা জাতি করতে হবে। ছেলেটার বিয়ে দিতে হবে।
এ সব কিছুই ভাবতে ভাবতে হঠাৎ যেন আকাশটা ভেঙ্গে পড়ল মাথার উপর। প্রচন্ড মেঘের গর্জন শুনে বউ নিয়তি বালা-কে ডেকে বলল-অ’বউ তুই জাল আ’ন এখখানা চাই দে, কন অ’মিক্কা কন’অ ছিঁড়া ফাডা আছেনি। আঁই নদীর ঘাড্ত্তুন উগ্গা পাক দি আই। আকাশ’র অবস্থা বেগতিক। মনে হয় আজিয়া রাতিয়াই নদীত্ যউন পরিবু। (বউ, তুই জালটা একটু দেখে দে, কোথাও কোন ছেড়া ফাটা আছে কিনা। আমি একটু নদীর ঘাট থেকে ঘুরে আসি। আকাশের অবস্থা ভালো না। মনে হচ্ছে আজ রাতেই নদীতে যেতে হবে।)
হরিহর উঠোনে নেমে আকাশের পশ্চিম দিকে ভালো করে তাকায়। কি যেন দেখে। তার পর কোমরের কোঁচায় শক্ত করে গামছাটা বেঁধে সামনের বাড়ীর নিধিরামকে ডেকে বলে, ও নিধু কাকা, বাইর অ’ই আইয়ু। চ’না আকাশ’আন কে’ন লাল হই রইয়ি। আজিয়া মাছে ডিম ছাড়িবো। চল’অ নদীর পাড়ত্তুন একখানা হাঁ’ডি আয়। (ও নিধু কাকা, বাইরে এসো। দেখো আকাশটা কেমন লাল হয়ে আছে। আজ মাছের ডিম ছাড়বে। চলো, নদীর পাড় থেকে একটু হেঁটে আসি।)
নদীর পাড়ে একটা বড় অশ্বত্থ গাছ। এই বুঝি পানিতে পরে যাবে। গোঁড়া থেকে ধীরে ধীরে মাটিগুলো সরে যাচ্ছে। এ পাড়ার জেলে সম্প্রদায় মিলে অশ্বত্থের গোঁড়ায় ছোট একটা মন্দির করেছে। মা শীতলার মন্দির। গ্রামের বৌ ঝি’রা মা শীতলার নামে এখানে মানত দেয়। তাদের মনোবাসনা পূর্ণ হয়। এইতো সেদিন মা শীতলার কৃপায় অনেক বছর পর কানুর বৌ’টা পোয়াতি হয়েছে। সারা গ্রামে সে কি আনন্দ। সাধভক্ষণের দিন কানু মন্দিরে ভোগ দিয়ে সবাইকে নেমন্তন্ন করে খাইয়েছে।
নিধিরাম ঘর থেকে বাইরে এসে বলল-হ, ল যায়। আইজ ক’দিন ধরি হালদা’ত মা মা’ছর আনাগোনা বাড়ি গেইয়ি। নদীর পাড়’ত খাড়াইলি বুঝা যায়। মা মাছগুন কি সোন্দর গড়ি ভাইসতে ভাইসতে জোয়ারর পানির উ’র উডি যায়। আবার ভাডা’ত নামি যাইগ’ই। আর ক’ট্টা শ’তানর দল জাল লই ঘোপ’র মধ্যে বই থাকে। মা মাছগুন ধরি লই যায়। অথচ ক’দিন পরে ডিম ছাড়িবু। বহুত ডিম। মা মাছগুন বাছি থাইলি আঁ’রার লাভ। হে কথা’ন ত হি’থারা ন’বুঝে।
(চল যায়। আজ ক’দিন ধরে হালদাতে মা মাছের আনাগোনা বেড়ে গেছে। মাছগুলো কি সুন্দও কওে জোয়ারের পানিতে ভাসতে ভাসতে উপরে উঠে যায়। আবার ভাটার সময় নেমে যায়। অথচ কিছু অসৎ লোক জাল নিয়ে ঝোপের মধ্যে মাছ ধরে নিয়ে যায়। অথচ কয়দিন পরে ডিম ছাড়বে। অনেক ডিম। মা মাছগুলো বেঁচে থাকলে আমাদের লাভ। এই কথাটা ওরা বুঝে না।)
অশথ গাছের গুড়ির সাথে নৌকাগুলো বাঁধা। দু’জনে নৌকায় জমে থাকা পানি গুলো ফেলে দিয়ে আরেকবার ভালোভাবে সবকিছু দেখে নিল। দু’টোই ছোট ডিঙ্গি নৌকা। একটা নৌকা এই মৌসুমের জন্য খেপ হিসাবে ভাড়া নিয়েছে। যা ডিম পাবে তার একটা অংশ নৌকার মালিককে দিতে হবে। তাতেও অসুবিধা নেই। মা শীতলার কৃপায় ভালোমতো খেপটা মারতে পারলে হলো। যা ডিম পাওয়া যাবে তা যদি ঠিকমত রেণু করা যায় তাতে সব খরচ বাদ দিয়ে বেশ কিছু টাকা হাতে থাকবে। অন্তত জমির দামটা হয়ে যাবে। জমি ওয়ালার সাথে একরকম কথাও বলে রেখেছে। এদিকে ভাঙ্গনটাও একেবারে ভিটে মাটি ছুঁই ছুঁই করছে। রাক্ষুসে নদীটার যেন কিছুতেই তর সইছে না। এই বুঝি সব গিলে খাবে।
হরি নিধু কাকাকে নিয়ে হাট পর্যন্ত ঘুরে এসেছে। সবাই বলাবলি করছে। যেভাবে মেঘ করেছে তাতে আজ রাতে মাছের ডিম ছাড়বে। অন্যরাও শেষবারের মত প্রস্তুতি নিচ্ছে। হরি বড় একটা নতুন কুপি বাতির সাথে দুইটা মোটা সলতে কিনে নেয়। একটা কুপি আছে। সলতেটা ছোট। ভাড়া নৌকার জন্যও একটা লাগবে। কুপি ভর্তি করে তেল নেয়। মায়ের মন্দিরের জন্য দু’টো বড় মোমবাতি আর ধুপসলা নিয়ে বাড়ির দিকে পা বাড়ায়।
হাট থেকে ফেরার পথে ডিম ফুটানোর জন্য তৈরি করা কুয়াগুলো দেখে যায়। সব ঠিকঠাক আছে। পানিগুলো পরিষ্কার আছে। পাশের জমি থেকে বাইরের পানি ঢুকানোর জন্য ছোট পাইপ দিয়ে ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। নদী থেকে ডিম তুলে এনে এই কুয়াতেই পরম যতেœ নেট কাপড়ের মধ্যে রাখতে হবে। তারপর সারা দিন রাত পাহারা দিয়ে রাখতে হবে। ছোট শিশুর মত ডিমগুলোর গায়ে আস্তে আস্তে পানির ঢেউ দিতে হবে। সেই ঢেউয়ের দুলুনি খেয়ে দুই তিনদিনের মধ্যে ডিমগুলো প্রাণ ফিরে পাবে। ছোট ছোট পোনাগুলো নেট কাপড়ের উপর খিলবিল খিলবিল করে খেলবে।
কুয়ার পাড়ে বসে হরির মত আরো অনেকে তখন স্বপ্নের বীজ বুনে। এই অঞ্চলের জেলেরা এবং যারা এই পেশায় থাকে সবার মনে নির্মল আনন্দ বয়ে যায়। হিড়িক পরে যায় পোনা বিক্রির। পোনা যত ছোট থাকে দাম তত বেশী। পোনা বড় হলে দাম কম। পোনা যত বড় হতে থাকে ওজনও বাড়তে থাকে। সারা দেশে হালদা পোনার কদর বেশী। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ক্রেতারা আসতে থাকে। হাট বাজারে নতুন নতুন মানুষের সমাগম হয়। হালদার দু’পারের মানুষের জীবনে শুরু হয় নতুন দিন। নতুন সূর্য। শুরু হয় নতুন স্বপ্ন পূরণের সকাল।
চাঁদের সাথে জোয়ার ভাটার সম্পর্ক। আজ ভরা চাঁদের জোয়ার। চাঁদের আলো যেন নদীর দু’কুল উপচে পরছে। এই সময় পাহাড়ী ঢলের কারণে নদীর জলটাও ঘোলা থাকে। আকাশ একদম ফর্সা। বৃষ্টি শুরুর কোন লক্ষণ নাই। থেমে থেমে এক আধটু হালকা মেঘের গর্জন শোনা যাচ্ছে। হরি বাইরের খোলা বারান্দায় মাদুর পেতে আকাশের দিকে মুখ করে শুয়ে আছে। বারান্দায় শুয়ে নদীর এপার ওপাড়ের দশ গ্রামগুলো চাঁদের আলোর একবারে চিকমিক করছে। পাশে কেরোসিনের কুপির আলোতে যশোদা আর সারদা পড়ে চলেছে ”বাঁশ বাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ঐ——–। হরি বউকে ডেকে বলল- ভাত হইতে সময় লাগিবো। এক কাপ চা দিবানি। (ভাত হতে সময় লাগবে। এক কাপ চা দেবে) বাইরে থেকে নিধিরামের গলা শোনা গেল।
– ও’ হরি, মেঘ’ত কাডি গেইয়ি। মনে হয় আইজ আর বৃষ্টি হই’ত ন। (মেঘ তো কেটে গেছে, আজ মনে হয় বৃষ্টি হবে না)। কিন্তু বুঝতে পারছে না, আজ তো ভরা পূর্ণিমার জো। নদীতে ডালা পরেছে। সবি-ই তো ঠিক আছে। কিন্তু ঝড়ের কোন লক্ষণ নাই কেন। কে জানে ভগবানের কি লীলা।
– ও নিধি কাকা, আস। তো’য়ার বউ চা বানার। মুড়ি দি এক কাপ চা খ’অ। (আস, তোমাদের বউ চা বানিয়েছে, মুড়ি দিয়ে এক কাপ চা খেয়ে যাও)
চা খেতে খেতে আবারো মেঘের গর্জন শোনা গেল। দক্ষিণ দিক থেকে আকাশটা যেন খুব দ্রুত কালো হয়ে আসছে। হরি গলা বাড়িয়ে দেখে। চোখে মুখে আবারও খুশীর ঝিলিক। আকাশের দক্ষিণ দিক থেকে যেন কালো মহিষের পাল নেমে আসতেছে। য’অ তাড়াতাড়ি বাড়িত যায় দু’আ ভাত খাই ল’অ। আঁই’অ দু’আ খাই লই।
নিধিরাম আর বের হতে পারে নাই। তার আগেই প্রচন্ড গর্জনে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে শুরু হলো ঝড় বৃষ্টি। আঁধারে ছেয়ে গেছে ফর্সা আকাশ। এক মুহূর্তে পৃথিবীটা যেন লন্ড ভন্ড করে দেবে। প্রকৃতির এমনিই শক্তি। হরি বার বার মা শীতলার উদ্দেশে হাত উঁচিয়ে প্রণাম করে চলেছে।
বাতাসের সাথে বৃষ্টিটা একটু কমে এসেছে। নিধিরাম মাথায় গামছা দিয়ে দৌড়ে নিজের ঘরে গেল। হরির বউ গরম ভাতের সাথে মলা মাছের ঝোল রান্না করেছে। খেতে বেশ লাগছে। ঘন ঘন বিদ্যুৎ চমকানির সাথে প্রচন্ড মেঘের গর্জন যেন বেড়েই চলেছে। এই সময়টায় মিঠা পানিতে উঠে আসা মা মাছগুলোর ডিম ছাড়ার মোক্ষম সময়। চিৎ হয়ে উজান স্রোতে ভাসতে থাকে মাছগুলো। তারপর বৃষ্টির ঝাপটার সাথে সাথে ফুর—ফুর—-ফুর—ফুর— করে ডিম ছাড়তে ছাড়তে পেট খালি হলে আবার পানিতে ডুবে যায় মা মাছগুলো। এ দৃশ্য হালদা পাড়ের লোকজনের সাথে হরিও অনেকবার দেখেছে।
প্রকৃতির এ এক বিচিত্র নিয়ম। প্রতিটি প্রাণীকুলের প্রজননের জন্য চাই একটি নিরাপদ আবাসস্থল। এমন অভূতপূর্ব দৃশ্য যারা দেখেছে তারা কেবল উপরওয়ালার রহমত ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারে না।
এক একটি মা মাছের পেটে লক্ষ লক্ষ ডিম। লক্ষ লক্ষ ডিম মানে লক্ষ লক্ষ মাছ। এত এত মাছ মানে অনেক অনেক টাকা। আমাদের দেশটা সত্যিই একটা সোনার খনি। এমন দেশের এমন খনি আর কোথাও নেই। হরি আর কিছু ভাবতে পারে না। দেশ মানে হরির কাছে হালদা নদী আর তার পাড়ে ছোট একটা ঘর। এই নদীই হরির জীবন জীবিকা সব। সংসারের দুঃখ কষ্ট স্বপ্ন সব এই নদীর উপর। ডিঙ্গি নৌকাটায় এখন একমাত্র স্বপ্নের চাবিকাঠি।
হরির খাওয়া প্রায় শেষ। হঠাৎ নদীর দু’কুল থেকে প্রচন্ড শোরগোল শুরু হলো। একে অন্যকে ডাকাডাকি করে বলছে মাছে ডিম ছাড়ছে। নদীতে ডিম ছাড়ছে। এমন কাল রাত্রিতেও সবার মনের মধ্যে যেন খুশীর বন্যা। শুধুমাত্র নিজেদের জীবনের সুখের জন্য। অথচ বিপদ প্রতি পদে পদে। প্রচন্ড ঝড়ো বাতাস, বিদ্যুতের চমক, ঘন ঘন বজ্রপাতের শব্দ সব মিলিয়ে কেউ চাইবে না কোন আপনজন ঘরের বাইরে থাকুক।
হরির বউ নিয়তিরও এজন্য মন কেমন করছে। হরি সুপারি পাতার জুঁইর আর গামছা নিয়ে তৈরী। একটু পান মুখে দিয়ে বের হবে। বউকে বলেছে কয়েক খিলি পান বেঁধে দিতে। একটা বিড়ি জ্বালিয়ে বিড়ির বান্ডিল আর দিয়াশলাইটা একটা প্লাস্টিকে ভালো করে মুড়িয়ে কোমরে গুজে নেয়। নিয়তি একটা পানের খিলি হাতে দিয়ে বলে, কইজ্জি, তুঁই ত ন’হুনর। ঝড় তুয়ান’গান একখানা থামক। তারপর যাই’উ। মাছর ডিম’ত আর হালদা ফা’ডি ন’যাইবু গই। আঁর’ত কেয়া জানি ডর ডর লাগের। দ’পার দ’পার গড়ি যেভাবে নদী ভাঙা শূরু হইয়ি”। (বলছি, তুমি তো শুনছো না। ঝড় বৃষ্টিটা একটু থামুক, তারপর যাবে। মাছের ডিম তো হালদা থেকে পালিয়ে যাবে না। আমার ভীষণ ভয় করছে। ধপাস ধপাস শব্দে যেভাবে নদীর ভাঙন শুরু হয়েছে।)
বউয়ের এই সময়ে বলা কথাটা ভালো লাগেনি। মনে হল যেন শুভ কাজে বাঁধা পরল। আজ কতদিনের সাধনা। নিজের ডিঙি নৌকায় মাছ ধরবে। একটু রাগও হল। পানের খিলিটা মুখে দিয়ে বলল-”মায়া মাইন’ষর জাত, হক্কল সম’ত বেশী বুজছ। বাইর হইবার সম’ত কন্ডে ইক্কিনি সা’হস দিবু, ইয়ান ন’অ, কু’গীত গ’অন শুরু গইজ্জি। মইরলি দইজ্জা’ত মইরজ্জুম। আঁ’র বাপ’অ মইজ্জি, আঁই’অ মইজ্জুম, ত’অ যাইয়ুম। (মেয়ে মানুষ সব সময় বেশী বুঝে। শুভ কাজে যাওয়ার সময় কোথায় একটু সাহস দেবে তা না, খারাপ চিন্তা করা শুরু করেছে। মরলে নদীতে মরব। আমার বাবাও মরছে, আমিও মরব। তবুও যাবো।) এই বলে পানগুলো কোমরে গুজে বেরিয়ে পড়ল। গা অন্ধকারে মিলিয়ে গেলে হরির ডাক শোনা গেল, ও নিধি কাকা, তাড়াতাড়ি বাইর হও।
রাত দ্বিতীয় প্রহর। বাতাসের বেগ বেশী। কুপি বাতিগুলো জ্বালানো যাচ্ছে না। সারা নদী জুড়ে অসংখ্য টর্চের আলো। তার উপর আবার বিদ্যুৎ চমকানিতে নদীর পানির সাথে নৌকার মানুষগুলোর চেহারাও চিক চিক করছে। আলো আধাঁরির এই ভয়াল রাত্রিতে সারা নদী জুড়ে জেগে থাকা অসংখ্য মানুষগুলো স্বপ্নের প্রহর গুনছে। হরির নৌকাটাও উজান বাইতে বাইতে মাছুয়া ঘোনার দিকে যাচ্ছে। স্রোতের ধার ধরে দু’পাশে দুই নৌকায় লগি মেরে মাঝখানে জাল ফেলেছে।
বউয়ের কথাটা ভাবছে হরি। আসার সময় এভাবে রাগ করাটা ঠিক হয় নাই। ভালোবাসার মানুষদের জন্য মন সবসময় কু’ডাক ডাকে। খারাপ চিন্তাটা আগে আগে হাটে। শীত শীত লাগছে। নৌকার ছইয়ে বসে আর একটা বিড়ি জ্বালায়। ভাবছে ঝড় বৃষ্টি থামলে বালতি ভর্তি ডিম হবে। ডিম নিয়ে আগে কুয়ার পাড়ে যাবে। ময়লা পরিষ্কার করবে। ডিম আলাদা করবে। ঠিকমত নেট কাপড়ে ডিম রেখে তারপর বাড়ী ফিরবে। সকাল হতে এখনও অনেক রাত বাকী।
মা শীতলার নাম নিয়ে প্রথমবার জাল তুলল হরি। বিদ্যুৎ চমকানির আলোয় মুখে তৃপ্তির হাসিটা একবার ঝিলিক মারল। ভেজানো সাগু দানার মত ডিমগুলো চিক চিক করছে। নিধি কাকা ওপাশ থেকে ডেকে জিজ্ঞাসা করল-
– ও হরি, কিছু হইয়ি না? নাকি উজানে আরও সামনে যাই জাল ফালাবি। (কিছু হলো, না কি উজানে আরও সামনে গিয়ে জাল ফেলবি)
– না কাকা, এই খে’পত আধা পোয়ার মত হইবু। আর দুই এক খেপ ইয়ানদি মারি চা’ই। আঁ’র মনে ক’জ্জে ভালা হইবু। (না, এই খেপে আধা পোয়া হবে। আরও দুই এক খেপ ফেলে দেখি, আমার মনে হয় ভালো পোনা পাওয়া যাবে)
আবার জাল ফেলে। আবার তোলে। সময় গড়িয়ে যায়। এক সময় নৌকা এগিয়ে যায় সামনে। আরও উজানের দিকে। আরও বেশী ডিম উঠবে। আরো বেশী টাকা পাবে। হাজার হাজার মানুষ হালদা নদীর বুকে উৎসবে মেতেছে। সবাই খুশী। একজন অন্যজনকে ডেকে তাদের আনন্দ প্রকাশ করছে। একসময় লোকজন নদীর উত্তর পাড় ধরে দূর থেকে চিৎকার করছে। চিৎকার চেঁচামেচি ক্রমশঃ ঘনিয়ে আসছে। গুঞ্জন উঠছে—ভাঙছে-রে ভাঙছে—–সব ভাঙছে—-মানুষ খাইলো—-নৌকা খাইলো—ভিটা মাটি খাইলো।
কেউ আসল ঘটনা বুঝে উঠতে পারছে না। এখন ডিম তোলার সময়। কোন দিকে কি হলো সেই খবর নেওয়ার সময় নাই। প্রথম জো-এর পোনার দামও বেশী, কদরও বেশী। প্রথম জো-তে এবার ভালো ডিম ধরা পরেছে। সবাই খুশী। আস্তে আস্তে পূর্বাকাশ ফর্সা হয়ে আসছে। অনেকেই যে যার মত বালতি ভর্তি ডিম নিয়ে ছুটছে কুয়োর দিকে। হরির নৌকাটা ভাটির টানে দ্রুত ডোমখালীর বাঁকে পৌঁছতেই নিজের গ্রামটাকে অচেনা লাগছে। অশথ গাছটা মুখ থুবড়ে পরে আছে নদীতে। মা শীতলার ছোট মন্দিরের বেদীটাও নেই। নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। সূর্যের রক্তিম আভায় অদূরে চোখ পরতেই বুঝতে পারল তার টিনের দো-চালা ঘরটাও নেই। ছেলে মেয়ে আর বউয়ের জন্য বুকটা মোচড় দিয়ে উঠল।
ঘাটে নৌকা বেঁধে পাড়ে উঠে দেখল সব শেষ। অদুরে ছেলে মেয়েগুলো তার মা’কে জড়িয়ে ধরে বসে আছে। যেখানে এখনও ভাঙন শুরু হয়নি।