মুসলিম বিশ্বে আজ পর্যন্ত যতগুলো মর্মান্তিক ও হৃদয়বিদারক ঘটনা সংঘটিত হয়েছে তার মধ্যে ইমাম হোসাইন রাঃ এর শাহাদাত এর ঘটনা হচ্ছে সবচেয়ে মর্মান্তিক ও হৃদয়বিদারক। রাসুল সাঃ এর মৃত্যুর মাত্র ৫০ বছরের মাথায় তারই প্রাণপ্রিয় দৌহিত্র এর এই পরিনতি সমগ্র মুসলিম বিশ্বের মানুষকে করেছে মর্মাহত। ইমাম হোসাইন রাঃ এর শাহাদতে চোখের পানি ঝরেনি এমন মুসলমান একটিও ছিলনা। আজও সেই কারবালার কাহিনী পড়ে চোখের পানি আটকিয়ে রাখতে পারে এমন মুমিন মুসলমান একটিও পাওয়া যাবে না।
ইমাম হোসাইন রাঃ এর শাহাদাত যেমন মুসলমানদের অন্তরের এক প্রচণ্ড আবেগের বিষয়, ঠিক তেমনি তার এই শাহাদাতের ঘটনাকে কেন্দ্র করে নন মুসলিমরা মুসলমানদেরকে বিব্রত করারও চেষ্টা করে। আবার কোন কোন মুসলমান অতিরিক্ত আবেগতাড়িত হয়ে এমন কিছু আচরণ ও বক্তব্য দিয়ে থাকেন যা বিদাত ও শিরক এর পর্যায়ে পড়ে যায়। ফলে তার ঈমান ও আমল নিয়ে সংসয় সৃষ্টি হয়। তাই একজন মুসলমানের জন্য ইমাম হোসাইন রাঃ এর শাহাদাত ও এর প্রকৃত ইতিহাস জানা খুবই জরুরী। আলোচ্য প্রবন্ধে আমরা চেষ্টা করব গ্রহণযোগ্য সূত্র থেকে তথ্য সংগ্রহ করে তা কোনরুপ পরিবর্তন ছাড়াই সম্পূর্ণ আবেগের উর্দ্ধে থেকে নিরপেক্ষতার সাথে পাঠকের সামনে তুলে ধরতে – ইনশাআল্লাহ।
ইমাম হোসাইন রাঃ এর জীবন বৃত্তান্ত ও রাসুল সাঃ এর ভবিষ্যৎবানী
তিনি ছিলেন হুসাইন ইবনে আলী ইবনে আবদুল মুত্তালিব ইবনে হিশাম আল কুরাইশী আল হাশেমী। তার উপনাম আবদুল্লাহ। রাসুল সাঃ এর কন্যা ফাতিমাতুয যাহারা – এর ছেলে কারবালার শহীদ দৌহিত্র।
কাতাদা বলেনঃ হিজরি সন শুরুর ছয় বছর সারে পাঁচ মাসের মাথায় ইমাম হোসাইন রাঃ জন্মগ্রহণ করেন। আর চুয়ান্ন বছর সারে ছয় মাস বয়সে ৬১ হিজরির মুহাররাম মাসের ১০ তারিখে আশুরার দিন শুক্রবার তিনি শাহাদাতবরণ করেন। দুনিয়াতে রাসুল সাঃ এর পুস্পকলি ছিলেন ইমাম হাসান ও হোসাইন রাঃ। সুনান ইবনে মাজাতে এসেছে “…আবু হুরাইরা রাঃ হতে, রাসুল সাঃ বলেছেন, যে ব্যক্তি হাসান ও হোসাইনকে ভালবাসে সে আমাকেই ভালবাসে এবং যে ব্যক্তি তাদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে সে আমার প্রতিই বিদ্বেষ পোষণ করে” (তাহকীক আলবানীঃ হাসান)।
সহিহ বুখারিতে এসেছে – “ইবনে উমর থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আবু বাকর রাঃ বলেছেন, মুহাম্মাদ সাঃ এর সন্তুষ্টি তার পরিবারবর্গের (প্রতি সদাচারন) এর মাধ্যমে অর্জন কর” ইমাম হোসাইন রাঃ শাহাদাত এর ভবিষৎবাণী হাদিস এ উল্ল্যেখ পাওয়া যায়। ইমাম আহমেদ আব্দুস সালাম … আনাস রাঃ সুত্রে বর্ণনা করেন। একদা বৃষ্টি বর্ষণের দায়িত্বে নিয়োজিত ফেরেশতা রাসুল সাঃ এর নিকট আগমনের অনুমতি প্রার্থনা করলেন। তিনি তাকে আসার অনুমতি দিলেন। রাসুল সাঃ উম্মে সালমাকে বললেনঃ দরজার দিকে লক্ষ্য রাখবে, কেউ যেন প্রবেশ করতে না পারে। কিছুক্ষণ পর শিশু হোসাইন ইবনে আলী এসে ফাক দিয়ে দরজা অতিক্রম করে ভিতরে প্রবেশ করেন এবং রাসুল সাঃ এর ঘাড়ে চেপে বসেন। ফেরেশতা জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কি একে খুব বেশি ভালবাসেন? রাসুল সাঃ বললেনঃ হ্যাঁ। ফেরেশতা বললেন, আপনার উম্মতই একে হত্যা করবে। যদি আপনি দেখতে চান তবে আমি সেই স্থানও আপনাকে দেখাতে পারি। যেখানে তাকে হত্যা করা হবে। এরপর হাত বাড়িয়ে ফেরেশতা এক মুঠো লাল মাটি এনে দিলেন। উম্মে সালমা সেই মাটি আপন কাপড়ের আচলে বেধে রাখলেন।
আনাস রাঃ বলেন, আমরা প্রায়ই শুনতাম যে, হোসাইন কারবালায় শহীদ হবেন। বাইহাকী একাধিক সূত্রে আমারার মাধ্যমে এ হাদিস বর্ণনা করেছেন। অনেকের মতে আমারার হাদিস গ্রহণযোগ্য নয়। কিন্তু বাইহাকী আরও অন্যান্য সুত্রের মাধ্যমেও অনুরুপ হাদিস বর্ণনা করেছেন। আল্লাহর নির্ধারিত যে ভবিষ্যৎবানী রাসুল সাঃ করেছেন, তা যে সত্য হবে এতে তো কোনই সন্দেহ নেই। কিন্তু এই ঘটনার যে দীর্ঘ প্রেক্ষাপট ছিল এবং যার ফলশ্রুতিতে রাসুল সাঃ এর ভবিষ্যৎবানী যে অবশাম্ভাবী হয়ে উঠেছিল তা আমরা নিম্নে আলোচনা করবো ইনশাআল্লাহ।
হযরত আলী রাঃ এর খিলাফাত
হযরত আলী রাঃ এর খিলাফাত গ্রহনের পর যখন সকলের বায়াত সুসম্পন্ন হয় তখন হযরত তালহা রাঃ, হযরত জুবায়ের রাঃ এবং বড় বড় আরো সাহাবী তার সাথে সাক্ষাত করে ‘হদ’ তথা শরীয়ত নির্ধারিত দণ্ডবিধি প্রতিষ্ঠা এবং হযরত ওসমান রাঃ এর খুনের বদলা নেবার দাবী জানান।
হযরত আলী রাঃ এই বলে তাদেরকে বোঝাতে চান যে সন্ত্রাসীদের সাঙ্গ-পাঙ্গ আছে এবং তাদের অনেক সাহায্যকারীও আছে। তাই এই মুহূর্তে এই কাজ বিপদজনক। ফলে এখন তা সম্ভব নয়। তিনি আরও বলেন, আমাকে তোমরা কিছুটা অবকাশ দাও। আমি বিষয়গুলা নিয়ে চিন্তা করি। হিজরি ৩৬ সালে আলী রাঃ তার খেলাফার শুরু করেন। এরপর তিনি বিভিন্ন শহরে গভর্নর নিয়োগ শুরু করেন। যার মধ্যে সিরিয়াও ছিল। সে সময় সিরিয়ার গভর্নর ছিলেন হযরত মুয়াবিয়া রাঃ। মুয়াবিয়া যেমন ছিলেন প্রজ্ঞাবান তেমনি ছিলেন রাজনৈতিক ক্ষুরধার সম্পন্ন ব্যক্তি। তিনি যেকোন সমস্যা আঁচ করতে পারলেই পূর্ব থেকেই তার সমাধানের পথ করে রাখতেন। মুয়াবিয়া রাঃ এর সাথে আলী রাঃ এর দ্বন্দের মূল কারণ ছিল, মুয়াবিয়া রাঃ এর অনুসৃত স্বেচ্ছাচারী রাজনীতি।
মুসলমানদের বিজয় নিশান যখন উর্দ্ধোমুখি। একের পর এক বিজিত দেশগুলো যখন মুসলমানরা দখল করে নিচ্ছে আর সেই দেশগুলোর ধনসম্পদ আরবের কোষাগারে জমা হচ্ছে, তখন মুসমমানরা আরাম আয়েশ আর বিলাসী জীবনের প্রতি ঝুঁকতে থাকে। কিন্তু তাদের এই বিলাসিতার বড় বাধা ছিলেন হযরত আলী রাঃ। কারণ তিনি ছিলেন অত্যন্ত পরিশ্রমী ও নিষ্ঠাবান শাসক। বিলাসিতার সাথে তার কোন সম্পর্ক ছিল না। তার কঠোর নীতি শুধুমাত্র অন্যদের জন্য নয় বরং তার নিজের পরিবার পরিজন, বন্ধু বান্ধব ও সহযোগীদের জন্যও কার্যকর হত।
যেমন একটি প্রসিদ্ধ ঘটনা হল, তারই সহোদর ভাই আকীল যখন তার প্রাপ্য অংশের পর অতিরিক্ত কিছু অংশ বাইতুল মাল থেকে দেবার অনুরোধ করল তখন আলী রাঃ তা দিতে অস্বীকৃতি জানান। ফলে আকীল মুয়াবিয়া রাঃ কাছে গেলেন। মুয়াবিয়া তাকে তিন লক্ষ দিনার দিলেন। এর প্রতিক্রিয়ায় আকীল যে মন্তব্য করেন তাপ্রবাদের মত খ্যাতি লাভ করে। “আমার ভাই আমার আখেরাতের জন্য ভাল আর মুয়াবিয়া আমার দুনিয়ার জন্য ভাল।”
এরকম সুবিধাভোগী হাজার হাজার লোক আলী রাঃ এর সঙ্গ ত্যাগ করে পরিতোষের আশায় মুয়াবিয়া রাঃ এর দলে ভিড়ে।
কিশোর বয়সে ইসলাম গ্রহনের কারনে এবং রাসুল সাঃ এর একান্ত সান্নিধ্যে থাকার কারণে ইসলামের সকল হুকুম আহাকাম আলী রাঃ অস্থি মজ্জার মধ্যে মিশে গিয়েছিলো। সাদা সিধে জীবন যাপনই তার চরিত্রের ভূষণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ইসলামের সর্বোচ্চ গুণাবলী সম্পন্ন হওয়া সত্ত্বেও বৈরি পরিবেশ পরিস্থিতির কারণে হযরত আলী রাঃ তার পুর্ববর্তী দুই খলিফা হযরত আবু বাকার রাঃ ও হযরত ওমর রাঃ এর মতো সফল হতে পারেননি। অপরদিকে ইসলামের শেষ দিকে ইসলাম গ্রহনের কারণে মুয়াবিয়া বেশি সময় রাসুল সাঃ এর সহচার্জ পান নাই। ফলে দীর্ঘ সময় ইসলামের সুবার তিনি পাননি।
মুয়াবিয়া রাঃ এর অনুসৃত স্বেচ্ছাচারী রাজনীতির কথা আলী রাঃ জানতেন এবং তিনি এও জানতেন যে মুয়াবিয়া সিরিয়াতে বেশ জনপ্রিয়। কিন্তু এই ধরনের স্বেচ্ছাচারিতা ইসলামে গ্রহণযোগ্য নয়। তাই তিনি অন্যান্য গভর্নরদের সাথে সাথে মুয়াবিয়া রাঃ কেও সিরিয়ার পদ থেকে অপসারণ করেন। তিনি সেখানে সহল ইবনে হুনাইফকে নতুন গভর্নর নিয়োগ করেন। সহল যখন সিরিয়ার পথে রওনা হন তখন পথিমধ্যে তাবুকে মুয়াবিয়ার ঘোড় সওয়ারের সঙ্গে তার দেখা হয়। সহল মুয়াবিয়াকে আমিরুল মুমীনিন হযরত আলী রাঃ এর বার্তা জানালে মুয়াবিয়া তা অস্বীকার করেন। ফলে সহল হযরত আলী রাঃ এর কাছে ফিরে আসেন এবং বিস্তারিত জানান। অপরদিকে মিশরবাসী তাদের নতুন গভর্নর কায়স ইবনে সাদ এর বায়াত গ্রহন করলেও কিছু কিছু লোক ওসমান রাঃ এর হত্যাকারীদের হত্যা না করা পর্যন্ত বায়াত করবেন না বলে জানায়। বসরাবাসীও একই কথা বলে। ফলে বিভিন্ন এলাকাতে ফিতনা ও অস্থিরতা বিস্তার লাভ করে এবং পরিস্থিতি অবনতি হতে থাকে। এহেন পরিস্থিতিতে আলী রাঃ সিরিয়ার সাথে লড়াই করতে সংকল্পবদ্ধ হন।
অপরদিকে হযরত আয়শা রাঃ মক্কা থেকে হজ্জ পালন করে মদিনা ফিরার সময় পথিমধ্যে জানতে পারেন যে হযরত ওসমান রাঃ শহীদ হয়েছেন। ফলে তিনি আবার মক্কাতে ফিরে আসেন এবং ওসমান রাঃ এর কিসাস এর জন্য জনমত গড়তে থাকেন। হযরত আলী রাঃ এর উপর চাপ প্রয়োগের জন্য তিনি বসরা অভিমুখেও যাত্রা করেন। কিন্তু সেখানে মুনাফিক আবদুল্লাহ বিন সাবার এজেন্ত হাকিম বিন জাবাল তার দল নিয়ে হযরত আয়শা রাঃ এর উপরে আক্রমন করে। বিভিন্ন ঘটনা প্রবাহে পরিস্থিতি জটিল আকার ধারন করে এবং যুদ্ধ ব্যপকহারে ছড়িয়ে পড়ে।
এহেন পরিস্থিতিতে হযরত আলী রাঃ সিরিয়া অভিযান স্থগিত রেখে বসরা অভিমুখে রওনা হন। যখন আলী ও আয়শা রাঃ এর আলোচনা যখন একটি চূড়ান্ত রুপের দিকে যাচ্ছিল তখন ইসলামের শত্রু মুনাফিক আবদুল্লাহ বিন সাহার অনুসারীরা মরণ কামড় দেয়। রাতের অন্ধকারে ষড়যন্ত্রকারীদের চরম রক্তক্ষয়ী আক্রমনে উভয় পক্ষে ভুল বোঝবুঝির সৃষ্টি হয় এবং প্রচুর মুসলমান শহীদ হয়। যার মধ্যে হযরত আয়শা রাঃ এর পক্ষে ৯ হাজার এবং হযরত আলী রাঃ এর পক্ষে ১ হাজার জন শহীদ হন। মুনাফিকদের ষড়যন্ত্রে এই প্রথম এক মুসলমান ভাই এর হাতে অন্য মুসলমান ভাই এর রক্ত ঝরলো। ইতিহাসে এই যুদ্ধ জঙ্গে জামাল বা উটের যুদ্ধ নামে খ্যত। আমাদের আলোচনার বিষয় বস্তু এটি নয় বলে এই যুদ্ধের বিস্তারিত বর্ণনা এখানে করা হলোনা। শুধুমাত্র সার্বিক পরিস্থিতি অনুধাবনের জন্য আমরা প্রয়োজনীয় বিষয় সংক্ষেপে বর্ণনা করব। জঙ্গে জামালের পর হযরত আলী রাঃ এর সবচেয়ে বড় কাজ হয়ে দাড়ায় আমীর মুয়াবিয়াকে তার হাতে বায়াত গ্রহন করানো। এজন্য তিনি তার রাজধানী মদিনা থেকে কুফাতে স্থানান্তরিত করেন।
কিন্তু মুনাফিক আব্দুলাহ বিন সাবার অনুসারীরা কখনই চাইতো না যে আলী ও মুয়াবিয়ার মধ্যে কোন সমঝোতা হোক। আর হযরত আলী রাঃ এর চারপাশে এইসব মুনাফিকরা এমনভাবে গেড়ে বসে ছিল যে তিনি সহজেই এদেরকে সরাতে পারছিলেন না। তিনি খুব ভালভাবেই উপলব্ধি করতে পারছিলেন যে মুসলিম উম্মার ঐক্য ছাড়া এহেন পরিস্থিতিতে ওসমান রাঃ এর কিসাস নেয়া সম্ভব না। তাই আমীর মুয়াবিয়ার বাইয়াত নেয়া জরুরী ছিল।
হিজরি ৩৭ সনের ১লা সফর আমীর মুয়াবিয়ার সাথে আলী রাঃ এর যুদ্ধ হয়। যদিও এর মাঝে অনেক আলাপ আলোচনা ও সমঝোতার চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু মুনাফিকদের কারণে তা সফল হইনি। ইতিহাসে এই যুদ্ধ সিফফিন এর যুদ্ধ বা জঙ্গে সিফফিন নামে পরিচিত। মুসলিম বিশ্বকে স্থায়ীভাবে বিভক্ত করার এক আত্মঘাতী ষড়যন্ত্র ছিল এই যুদ্ধ। মুনাফিকদের ষড়যন্ত্রে এই যুদ্ধে আলী ও মুয়াবিয়ার মধ্যে কোন প্রকার সমঝোতা সম্ভব হইনি। ফলে উভয় পক্ষই সমঝোতা ছাড়াই তাদের স্ব স্ব স্থানে ফিরে যায়। কুফায় রাজধানী স্থাপনের পরও তিনি কুফাবাসীদের পক্ষ থেকে কোন সহযোগিতা পাচ্ছিলেন না। এদিকে বিভিন্ন প্রদেশে হযরত ওসমান রাঃ কিসাস এর ব্যপারে দ্বিধা বিভক্ত জনগণ আলী রাঃ এর উপর অসন্তুষ্ট হতে লাগল। আর এই সুযোগকে যথাযথভাবে কাজে লাগান আমীর মুয়াবিয়া। শুধুমাত্র ইরাক ও ইরান ব্যতিত অন্যান্য সকল অঞ্চলে আমীর মুয়াবিয়া তার শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। ইয়েমেন, হিজায, সিরিয়া, ফিলিস্থিন, মিশর প্রভৃতি অঞ্চল তখন তার অধীনে। এভাবে চার বছর কেটে যায়। ৪০ হিজরির ১৭ই রমজান শুক্রবার খারিজীদের ষড়যন্ত্রে ফজরের নামাজের সময় হযরত আলী রাঃ শহীদ হন।
হযরত মুয়াবিয়া রাঃ এর শাসনকাল
রাসুল সাঃ ভবিষৎবাণী করেছিলেন যে, তার মৃত্যুর পর খেলাফতের শাসন চলবে ৩০ বছর। তারপর শুরু হবে রাজতন্ত্র। হযরত হাসান রাঃ এর খেলাফত শেষ হবার সাথে সাথে রাসুল সাঃ এর উল্লেখিত ৩০ বছরের খেলাফত সম্পন্ন হয়। আমীর মুয়াবিয়ার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, দূরদর্শিতা ও যেকোন ঘটনা থেকে শিক্ষা গ্রহন তাকে সবসময়ই রাজনীতির ময়দানে এগিয়ে রাখত। তার এ যোগ্যতা সম্পর্কে তিনি ভালভাবেই অবগত ছিলেন। তিনি বলতেনঃ ৪টি কারণে আলী আমার কাছে পরাভূত হয়েছে।
১। আলী নিজের গোপন কথা কারো কাছ থেকে লুকাতে পারতেন না। কিন্তু আমি গোপন কথা কারো কাছে প্রকাশ করতাম না।
২। আলী অত্যান্ত ভাবলেশহীন ও নিশ্চিন্ত মানুষ ছিলেন। কোন বিপদে পুরোপুরি আক্রান্ত না হলে তিনি আত্মরক্ষার ব্যবস্থা গ্রহন করতেন না। আর আমি আগে থেকেই বিপদের মোকাবেলা করার জন্য প্রস্তুত থাকতাম।
৩। তার বাহিনী তার নির্দেশ মানত না। আর আমার বাহিনী আমার নির্দেশ অমান্যের সাহস পেতনা।
৪। তিনি ছিলেন কুরাইশ সমর্থন থেকে বঞ্ছিত আর আমি ছিলাম কুরাইশ সমর্থনপুষ্ট।
স্বয়ং আলী রাঃ মুয়াবিয়ার সাফল্যের স্বীকৃতি দিতেন। তিনি বলতেন, ”মুয়াবিয়া জনগণকে নিজের দিকে আকৃষ্ট করার অসাধারন ক্ষমতা রাখে। কাজেই তার ব্যপারে সাবধান থেকো।” মুয়াবিয়া ছিলেন মুসলমানদের মধ্যে প্রথম রাজা বা বাদশা। তার মাধ্যমে রাজত্ব যুগের শুরু। কিন্তু তিনি ছিলেন রাজাদের মধ্যে উত্তম রাজা। হযরত আলী রাঃ মৃত্যুর পর ইমাম হাসান রাঃ ৬ মাসের মত খেলাফত পরিচালনা করেন। কিন্তু তার অধিনে তখন পুরা মুসলিম বিশ্ব ছিল না। বেশির ভাগই ছিল আমীর মুয়াবিয়ার অধীনে।
অনেকের মতে, হযরত আলী রাঃ এর খেলাফতকালে আমীর মুয়াবিয়া তার সিরিয়ার গভর্নর পদ নিরাপদ রাখার জন্যই হযরত ওসমান রাঃ এর কিসাসের দাবী করেছিলেন। তিনি ওসমান রাঃ এর রক্তাক্ত জামা ও তার স্ত্রী হযরত নায়েলার বিচ্ছিন্ন আঙ্গুলগুলো ঝুলিয়ে রেখে সিরিয়াবাসীর মধ্যে প্রতিহিংসার আগুন জ্বালিয়ে ছিলেন। ফলে সিরিয়াতে তিনি ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠেন। এতে তিনি অন্যান্য অঞ্চল ও আরববাসীরও সমর্থন খুব সহজে লাভ করেন। ফলে এই সকল রাজনৈতিক প্যাঁচে আলী রাঃ এর পক্ষে মুয়াবিয়াকে ক্ষমতাচ্যুত করা সম্ভব হয়নি।
হযরত আলী রাঃ এর মৃত্যুর পরে ইমাম হাসান রাঃ খেলাফত গ্রহন করেন। কিন্তু পুরো পরিস্থিতি তার অনুকুলে ছিলনা। এহেন অবস্থায় আমীর মুয়াবিয়া এক বিশেষ রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় দেন। তিনি ইমাম হাসান রাঃ কে একটি চিঠি লেখেনঃ
“খোদাভীতি ও নিষ্কলুষ নৈতিকতার দিক দিয়ে খেলাফতের জন্য আপনার চেয়ে যোগ্য ব্যক্তি আর কেউ নাই। আমি যদি নিশ্চিন্ত হতাম যে, দেশ শাসনের কাজটাও আপনি সুচারুরূপে করতে পারবেন, তবে আমিই সর্বপ্রথম আপনার হাতে বায়াত করতাম। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে আপনার পক্ষে খেলাফতের দাবী ত্যাগ করাটাই সমীচীন হবে। এর বিনিময়ে আপনি যা চাইবেন আমি তাই আপনার সামনে পেশ করব।” এই চিঠির সাথে আমীর মুয়াবিয়া তার নিজের সিলমোহর যুক্ত একটি সাদা কাগজ পাঠিয়ে জানালেন এই কাগজে ইমাম হাসান যা লেখে দিবেন আমি তা মেনে নিব। আমীর মুয়াবিয়ার চিঠি ও তার উপস্থাপনা ইমাম হাসানকে মুগ্ধ করে। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় তিনি মুয়াবিয়ার প্রস্তাব গ্রহণ করাই শ্রেয় মনে করেন। তিনি আমীর মুয়াবিয়াকে চারটি শর্ত দেন। যা মুয়াবিয়া বিনা বাক্যে মেনে নেন।হিজরি ৪১ সালে আমীর মুয়াবিয়া হাজার হাজার মুসলমানের উপস্থিতিতে সর্বসম্মত খলিফা নির্বাচিত হন। তার হাতে সর্বপ্রথম বায়াত নেন ইমাম হাসান রাঃ। ইতিহাসে এই সালকে বলা হয় ‘আমুল-জামাআহ’ বা ঐক্যের বছর।
কিন্তু ইমাম হোসাইন রাঃ মুয়াবিয়ার হাতে বায়াত অস্বীকার করেন। এ ব্যপারে মুয়াবিয়ার পক্ষ থেকে চাপ সৃষ্টি করা হলে হাসান রাঃ বলেন, আপনি ওর উপর চাপ দিবেন না। কেননা আপনার হাতে বায়াত এর চেয়ে তার কাছে তার আত্মমর্যাদা অধিক প্রিয়। একথা শুনে মুয়াবিয়া নীরব হয়ে যান এবং এ ব্যপারে আর কিছু বলেননি। পরবর্তীতে ইমাম হোসাইন রাঃ মুয়াবিয়ার কাছে বায়াত নেন বলে জানা যায়।
আমীর মুয়াবিয়া ২০ বছরব্যাপী তার শাসনকাল পরিচালনা করেন। এ সময় তিনি ইসলামী রাষ্ট্রের আয়তন বৃদ্ধি করেন। তিনি নৌ-বাহিনী প্রতিষ্ঠা করেন এবং রোমান খ্রিস্টানদেরকে পরাজিত করেন। মুসলমানদের মধ্যে তিনিই প্রথম ডাক প্রথার প্রচলন করেন। এক কথায় বলা যায়, মুয়াবিয়ার শাসন আমল ইসলামের অন্যতম স্বর্ণযুগ ছিল।
হিজরি ৫০ সনের একটি ঘটনা। মুগীরা ইবনে শুবা তখন কুফার গভর্নর। মুয়াবিয়া মুগীরাকে বরখাস্ত করার চিন্তা করছেন। বিষয়টা মুগীরা আঁচ করতে পারে। তিনি কুফা থেকে দামেস্কে চলে আসেন। এসে মুয়াবিয়াকে বলেন, আমি মদিনাতে হযরত ওসমান রাঃ এর শাহাদাতের ঘটনা দেখেছি। খিলাফতকে কেন্দ্র করে মুসলমানদের মধ্যে যে দাঙ্গা হাঙ্গামা শুরু হয়েছিল তা আমি এখনও ভুলতে পারি নাই। আমার মতে, আপনি আপনার পুত্র ইয়াযিদকে পরবর্তী খলীফা মননয়ন করেন। এর মধ্যে মুসলিম উম্মার কল্যাণ নিহিত রয়েছে। মুগীরার কথাটি মুয়াবিয়ার পছন্দ হল। তিনি মুগীরাকে স্বস্থানে বহাল রাখলেন।
ইয়াযিদকে খলীফা করার বিষয়টি মুয়াবিয়া আগে কখনও চিন্তা করেননি। মুগীরার কথা শুনার পর প্রথমবার তিনি বিষয়টা নিয়ে চিন্তা করলেন। যদিও প্রথমে তিনি বিষয়টা নিয়ে দ্বিধান্বিত ছিলেন কিন্তু মুগীরা তাকে এ বিষয়ে উৎসাহিত করলো এবং আশ্বস্ত করতে লাগলো যে সকলেই ইয়াযিদের নিকট বায়াত গ্রহণ করবে। এই কু-পরামর্শের মাধ্যমে মুগীরা আসলে তার কুফার গভর্নর পদ রক্ষা করেন। এরপর মুগীরা দামেস্ক থেকে কুফাতে এসে ইয়াযিদের ব্যাপারে জনমত সৃষ্টি করতে থাকেন। ইয়াযিদকে খলীফা করার ব্যপারে মুয়াবিয়া তড়িঘড়ি সিদ্ধান্ত নেয়া ঠিক মনে করেননি। তাই তিনি বিভিন্ন অঞ্চলের নেতৃস্থানীয়দের সাথে এ ব্যপারে আলাপ আলোচনা করেন। সকলেই এ ব্যপারে তাকে সমর্থন দেয়। শুধু বাকি থাকে মক্কা মদিনার নেতৃবৃন্দ।
কিন্তু মক্কা মদিনার নেতৃবৃন্দ এ ব্যপারে আপত্তি তোলেন। তাদের বক্তব্য ছিল আবদুল্লাহ ইবনে ওমর, আবদুল্লাহ ইবনে জুবায়ের, আব্দুর রাহমান ইবনে আবু বাকার, ইমাম হোসাইন রাঃ এর মত সাহাবিরা তখনও জীবিত। ধার্মিকতা ও প্রসাসনিক দক্ষতার দিক থেকে তারা ইয়াযিদের থেকে অনেক বেশি যোগ্য। তাছাড়া পিতা কতৃক পুত্রের মনোনয়ন নিঃসন্দেহে ইসলামী আদর্শ বিরোধী।
এখানে উল্লেখ্য যে, সে সময় সকলেই জানত যে ইমাম হাসান ও মুয়াবিয়ার মধ্যে সন্ধির আর একটি শর্ত ছিল, মুয়াবিয়ার পর ইমাম হাসান মুসলিম উম্মার পরবর্তী খলীফা হবেন। কিন্তু এই শর্তটি ইমাম হাসান লিখিত চুক্তির মধ্যে লিপিবদ্ধ করাননি। ইমাম হাসানের মৃত্যুর পর যখন মুয়াবিয়া ইয়াযিদকে পরবর্তী খলীফা করার ব্যপারে জনমত তৈরির চেষ্টা করছিলেন তখন মদিনাবাসীর অনেকেই তা গ্রহণ করতে পারছিলেন না। কিন্ত তীক্ষ্ণ বুদ্ধি সম্পন্ন মুয়াবিয়া বিষয়টি আঁচ করতে পেরে তাদেরকে আয়ত্তে আনার জন্য বিভিন্ন উপঢৌকন ও ঋণ বিতরন শুরু করেন। কিন্তু আবদুল্লাহ ইবনে জুবায়ের ও হোসাইন ইবনে আলী রাঃ এই ধরনের আচরণ মেনে নিতে পারেননি।
সেই বছরই আমীর মুয়াবিয়া হজ্জ সম্পন্ন করেন এবং ইয়াযিদের ব্যপারে সংখ্যাগরিষ্ঠদের বায়াত গ্রহণ করেন। শুধু তিন চারজন ব্যক্তি অর্থাৎ আবদুল্লাহ ইবনে জুবায়ের, হোসাইন ইনবে আলী ও প্রমুখ ব্যতিত বাকি সকলেই বায়াত সম্পন্ন করেন। মুয়াবিয়া তাদেরকে তাদের অবস্থার উপর ছেড়ে দেন এবং বায়াতের ব্যপারে তাদের উপর চাপ প্রয়োগ করেননি। এরপর তিনি দামেস্কে ফিরে আসেন।
হিজরি ৬০ সনের রজব (৬৮০ খ্রীঃ এর এপ্রিল) মাসের প্রথমদিকে মুয়াবিয়া অসুস্থ হয়ে পরেন। তিনি ইয়াযিদকে অসিওত করে বলেনঃ আমার মৃত্যু ঘনিয়ে এসেছে। আমাকে বল, তুমি আমার পরে মুসলমানদের সাথে কিরুপ আচরণ করবে? ইয়াযিদ উত্তর দেয়ঃ আমি আল্লাহর কিতাব ও রাসুলের সুন্নত অনুসরন করব।
মুয়াবিয়াঃ সুন্নতে সিদ্দিকীর উপর আমল করা উচিত। কেননা হযরত আবু বাকার রাঃ মুরতাদদের সাথে লড়েছেন এবং এমন অবস্থায় ইন্তেকাল করেছেন যে সমস্ত উম্মত তার উপর সন্তুষ্ট ছিল।
ইয়াযিদঃ না, শুধু আল্লাহর কিতাব ও রাসুলের সুন্নতই যথেষ্ট।
মুয়াবিয়াঃ বৎস! সিরাতে ওমরের অনুসরন কর। কেননা তিনি শহরগুলো আবাদ করেছেন। সেনাবাহিনী শক্তিশালী করেছেন এবং তাদের মধ্যে গনিমতের মাল বিতরন করেছেন।
ইয়াযিদঃ না, শুধু আল্লাহর কিতাব ও রাসুলের সুন্নতই যথেষ্ট।
মুয়াবিয়াঃ বৎস! সিরাতে ওসমানকে অনুসরণ করবে। কেননা তিনি তার জীবনে মানুষের অভূতপূর্ব কল্যাণ সাধন করেছেন এবং আল্লাহর পথে অকাতরে ধন সম্পদ বিলিয়েছেন।
ইয়াযিদঃ না, শুধু আল্লাহর কিতাব ও রাসুলের সুন্নতই যথেষ্ট।
মুয়াবিয়া এই সকল কথা শুনে বলেনঃ তোমার এই সমস্ত কথাই আমার এ বিশ্বাস জন্মেছে যে, তুমি আমার উপদেশ অনুযায়ি কাজ করবে না। হে ইয়াযিদ! তুমি ধম্ভ করোনা। আমি তোমাকে আমার আনুগত্যের অঙ্গীকার করছি এবং সকল লোক তোমার আনুগত্যের অঙ্গীকার করেছে।
এইবার একটা জরুরী কথা শোন। আবদুল্লাহ ইবন ওমরের পক্ষ থেকে তোমার ভয়ের কোন কারণ নেই। কারণ সে দুনিয়া বিমুখ। হোসাইন ইবনে আলীকে কুফাবাসীরা অবশ্যই তোমার বিপক্ষে দাড় করাবে। যদি তুমি তার উপর জয়ী হও তাহলে তাকে হত্যা করো না বরং তার সাথে আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রেখ। আবদুল্লাহ ইবন জুবায়ের হচ্ছে ফেরেকবাজ। কাবুতে পেলে তাকে হত্যা করবে। সব সময় মক্কা ও মদিনাবাসীর সাথে সৌজন্যমূলক ব্যবহার করবে। কুফাবাসী যদি প্রতিদিন তাদের কর্মকর্তা পরিবর্তন করতে বলে তাহলে তাই করবে। সিরিয়াবাসীকে সবসময় সাহায্যকারী মনে করবে এবং তাদের বন্ধুত্বের উপর ভরসা রাখবে। এরপর মুয়াবিয়ার অবস্থার দ্রুত অবনতি হতে থাকে। হিজরি ৬০ সনের ২২ রজব তিনি ইন্তেকাল করেন।
ইয়াযিদ ইবনে মুয়াবিয়ার সিংহাসন গ্রহণ
মুয়াবিয়ার মৃত্যুর পর ইয়াযিদ সিংহাসনে আহরণ করেন। যেহেতু তার বাবা পূর্ব থেকেই সকল বিষয় তার জন্য নির্ধারণ করে রেখেছিলেন তাই সিংহাসন আহরণে তাকে বেগ পেতে হইনি। ইয়াযিদ ছিল সাহিত্যপ্রেমী ও শিকারী। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার খুব কাছে ছিল বলে তার রাজনীতি সম্পর্কে কিছু ধারণা ছিল। কিন্তু তার বাবার মত তীক্ষ্ণবুদ্ধি ও দূরদৃষ্টি তার ছিলনা।
ইসলামী খেলাফতে দ্বীনদার ও যোগ্যতাই যেখানে খলীফা হবার মাপকাঠি সেখানে ইয়াযিদের মত কম যোগ্যতাসম্পন্নকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় মেনে নেয়া ছিল খুবই দুরুহ। কিন্তু আমীর মুয়াবিয়া এমনভাবে তার ছেলের সিংহাসন আহরণের ব্যবস্থা করেছিলেন যে অনেকের মনে ক্ষোভ থাকলেও প্রকাশ্যে কেও তার বিরোধিতা করেনি। খেলাফতের যোগ্যতা যে ইয়াযিদের ছিলনা তা তার পরবর্তী শাসন আমলের মধ্যেই প্রমানিত হয়েছে। বিদ্রোহ দমনের নামে যত্রতত্র আক্রমন, গনহত্যা, তার কর্মচারী কর্মকর্তাদের সদাচারের পরিবর্তে স্বেচ্ছাচারিতার অবাধ অনুমতি, ইমাম হোসাইন রাঃ কে হত্যা ও মক্কা মদিনাতে আক্রমন; এই সব নিয়েই ইয়াযিদের তিন বছরের শাসন আমল কেটে যায়। ক্ষমতা গ্রহনের পর ইয়াযিদ মদিনার গভর্নর ওলীদ ইবনে উকবাকে আমীর মুয়াবিয়ার ইন্তেকালের খবর জানিয়া চিঠি লিখেন আর নির্দেশনা দেন হযরত হোসাইন ইবনে আলী, আবদুল্লাহ ইবনে ওমর ও আবদুল্লাহ ইবনে জুবায়েরের কাছ থেকে অবিলম্বে বায়াত আদায় কর। তারা বায়াত না করা পর্যন্ত তাদেরকে যেতে দিও না।
ইয়াযিদের চিঠি পাওয়া মাত্রই ওলীদ মদিনার পূর্বতন শাসক মারওয়ান ইবনে হাকামকে ডেকে চিঠি দেখান ও পরামর্শ চান। মারওয়ান বলেন, এই সাহাবিত্রয়দেরকে ডেকে বায়াতে বাধ্য করা উচিত। আবদুল্লাহ ইবনে ওমার ক্ষমতার দাবিদার নয়। তো উনি যদি বায়াত নাও নেন তাতে ক্ষতি নাই। ক্ষতির আশংকা আছে ইমাম হোসাইন ও আবদুল্লাহ ইবনে জুবায়ের এর পক্ষ থেকে। কাজেই তাদেরকে এক্ষুণি ডাকুন এবং বায়াত নিতে বাধ্য করুন। যদি রাজি হয় ভাল নতুবা তাদেরকে জীবিত বাইরে যেতে দিবেন না। ওলীদ একজন বালককে দিয়ে ইমাম হোসাইন ও আবদুল্লাহ ইবনে জুবায়েরকে ডেকে পাঠালেন। অসময়ে ডাক পেয়ে দুইজনেই অনুমান করলেন যে মনে হয় আমীর মুয়াবিয়া মারা গেছেন এবং তাদেরকে বায়াতের জন্য ডাকা হচ্ছে। ইমাম হোসাইন কয়েকজন লোক সাথে নিয়ে ওলীদের কাছে গেলেন। লোকদেরকে বললেন, ”তোমরা দরজার উপর বসে থাকবে। যদি আমি তোমাদেরকে ডাকি অথবা আমি উচ্চ কণ্ঠে কথা বলি তাহলে ভিতরে চলে আসবে। আর এধরনের কিছু না হলে দরজা থেকে সরবে না যতক্ষণ আমি বাইরে না আসি।”
নিজের অনুগতদেরকে পাহারাতে রেখে ইমাম হোসাইন রাঃ ভিতরে অবস্থানরত ওলীদ ও মারওয়ানের কাছে গেলেন। ওলীদ তাকে মুয়াবিয়া রাঃ এর ইন্তেকালের খবর জানালেন এবং ইয়াযিদের চিঠি পড়ে শুনালেন। ইমাম হোসাইন রাঃ ইন্নালিল্লাহ পড়লেন এবং মুয়াবিয়ার জন্য দোয়া করলেন এরপর বললেন আমার মত ব্যক্তি গোপনে বায়াত করতে পারেনা। আপনি এই উদ্দেশ্যে সাধারন মানুষের সমাবেশ আহবান করুন। আমিও তাদের সাথে আসব। সকলে যা সমীচীন মনে করবে সেটাই হবে। ইমাম হোসাইনের এহেন উত্তরে ওলীদ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল এবং তাকে যাবার অনুমতি দিল। ইমাম হোসাইন চলে যাবার পর মারওয়ান ওলীদকে বললঃ তুমি হোসাইনকে চলে যাবার অনুমতি দিয়ে ভুল করলে। বিনা সংঘাতে তুমি আর হোসাইনকে বাগে আনতে পারবে না। ওলীদ বললঃ তুমি বল কি? তুমি কি সত্যি চাও আমি হোসাইনকে হত্যা করি? আল্লাহর কসম, কেয়ামতের দিন যাকে হোসাইনের খুনি হিসাবে আসামী করা হবে তার আর নিস্তার থাকবে না।
এদিকে আবদুল্লাহ ইবনে জুবায়ের ওলীদের কাছ থেকে একদিনের সময় চাইলেন এবং রাতের মধ্যেই মদিনা ত্যাগ করে মক্কার উদ্দ্যেশে রওনা হলেন। ওলীদ তার খোজে কয়েকজন লোক পাঠালো কিন্তু তারা তাকে খুজে পেলনা। পরদিন রাতে ইমাম হোসাইনও তার পরিবার নিয়ে মক্কার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। এর কিছুদিন পর আবদুল্লাহ ইবনে ওমর ও আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাসও মক্কায় চলে আসেন। এদিকে ইয়াযিদ হারিস ইবনে হুরকে মক্কার শাসনকর্তা নিয়োগ করেন। ইতোমধ্যে আবদুল্লাহ ইবনে সাফওয়ান ইবনে উমাইয়া; যিনি ছিলেন মক্কার গন্যমান্য ব্যক্তিদের অন্যতম। তিনি আবদুল্লাহ ইবনে জুবায়ের এর হাতে বায়াত নেন। এরপর মক্কার গন্যমান্য ও অভিজাত প্রায় দুই হাজার ব্যক্তিও আবদুল্লাহ ইবনে জুবায়েরের হাতে বায়াত নেন। আবদুল্লাহ ইবনে জুবায়ের হারিসকে বন্দী করে মক্কার শাসনভার নিজের হাতে তুলে নেন। ইমাম হোসাইন রাঃ মক্কাতে অবস্থান করলেও তিনি ও তার পরিবার আবদুল্লাহ ইবনে জুবায়েরের কাছে বায়াত নেননি। আবদুল্লাহ ইবনে জুবায়েরও তাদেরকে বায়াত নিতে বলেননি।
আবদুল্লাহ ইবনে জুবায়ের এর সাথে ইমাম হোসাইন এর প্রায়ই দেখা হত এবং তারা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনাও করতেন। অবস্থা এমন মনে হতো, যেন ইবনে জুবায়ের জনগণের কাছ থেকে প্রকৃত অর্থে খিলাফতের বায়াত গ্রহণ করেননি বরং তার বায়াতের উদ্দেশ্য ছিল ইয়াযিদের খিলাফতের স্বীকৃতি না দেয়া। এদিকে ইবনে জুবায়ের ও ইমাম হোসাইন এর মক্কায় গমনের ঘটনা ওলীদ ইয়াযিদকে অবগত করেন। ইয়াযিদ সঙ্গে সঙ্গে ওলীদ ইবনে উতবাকে পদচ্যুত করে তার স্থানে আমর ইবনে আসকে মদিনার গভর্নর নিয়োগ করেন। অপরদিকে ইয়াযিদ মক্কায় হারিসের অবস্থা অবগত হয়ে আমর ইবনে আসকে অবিলম্বে মক্কায় গিয়ে আবদুল্লাহ ইবনে জুবায়েরকে গ্রেফতারের নির্দেশ দেন। আমর ইবনে আস এক বিশাল বাহিনী মদিনাতে প্রেরণ করেন। কিন্তু সেই যুদ্ধে আবদুল্লাহ ইবনে জুবায়ের জয়ী হন এবং মদিনা থেকে আগত সেনাবাহিনীর সেনাপতিকে বন্দী করেন।
কুফাবাসীর দাওয়াতি চিঠি
রাসুল সাঃ এর দৌহিত্র হোসাইন রাঃ ছিলেন সকলের কাছে শ্রদ্ধার পাত্র। পিতা আলী রাঃ এর সহচার্জে থেকে তিনি ধর্মীয় জ্ঞানে হয়েছিলেন অভিজ্ঞ তেমনি বিভিন্ন যুদ্ধেও তিনি তার পিতার সাথে অংশগ্রহণ করে হয়েছিলেন সমরবিদ। তিনি জঙ্গে জামাল অর জঙ্গে সিফফিন এও অংশগ্রহণ করেন। পিতার মৃত্যুর পর বড় ভাই ইমাম হাসান রাঃ যখন মুয়াবিয়ার সাথে সন্ধি করেন তখন তিনি তা মেনে নিতে পারেননি। কিন্তু ভাইএর উপর তিনি কোন কথা বলেননি। মুয়াবিয়ার খেলাফতের সময় তারা দুই ভাই নিয়মিত মুয়াবিয়ার দরবারে যাতায়াত করতেন। মুয়াবিয়াও তাদেরকে যথাযথ সন্মান করতেন। একদিন মুয়াবিয়া দুই ভাইকে দুই লক্ষ দিরহাম প্রদান করলেন এবং বললেন, হিন্দের ছেলের পক্ষ থেকে আপনারা তা গ্রহণ করুন। আল্লাহর কসম! আমার পূর্বে ও পরে কেও আপনাদের এমনভাবে দিবেনা। তখন হোসাইন রাঃ বললেন, আল্লাহর কসম! আপনি ও আপনার পূর্বে ও পরে কেও আমাদের চেয়ে উত্তম কাউকে দিতে পারবেন না।
ইমাম হাসানের মৃত্যুর পরেও ইমাম হোসাইন প্রতি বছর তার অনুসারীদের নিয়ে মুয়াবিয়ার কাছে যেতেন।
মুয়াবিয়ার মৃত্যুর পর ইমাম হোসাইন যখন প্রতিকূল পরিবেশে মদিনা থেকে মক্কায় গেলেন ইয়াযিদের কাছ থেকে বায়াত এড়ানোর জন্য, তখন এ খবর পৌঁছে গেল কুফাবাসীর কাছে। কুফাবাসী তখন বারংবার ইমাম হোসাইনকে চিঠি লিখে আহবান জানাতে লাগলো কুফাতে আসার জন্য। যদিও তারা মুয়াবিয়ার সময় থেকেই ইমাম হোসাইনকে আহবান জানাচ্ছিল। কিন্তু ইমাম হোসাইন তাদেরকে বলতেন, ধৈয্য ধারণ কর, অপেক্ষা কর। ইমাম হাসান ও মুয়াবিয়ার মধ্যে যে চুক্তি ছিল তা তিনি যথাযথভাবে মেনে চলতেন।
সমগ্র ইরাকের মধ্যে কুফাবাসীই ইমাম হোসাইনের বেশী ভক্ত ছিল। তাই তারা সর্বসম্মতক্রমে ইমাম হোসাইনকে একটি পত্র লিখলো। “আল্লাহ আপনাকে শান্তিতে ও নিরাপদে রাখুন। আল্লাহর শোকর তিনি আপনার সেই দুশমনকে চিরনিদ্রায় শায়িত করেছেন। যে চরম দাম্ভিক ও অত্যাচারী ছিল (হযরত মুয়াবিয়া রাঃ)। জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাদের উপর শাসন চালিয়েছেন। পুর্নবান লোকদের হত্যা করেছে এবং দুষ্ট লোকদের সাথী বানিয়েছে। আপনি চলে আসুন, যাতে আপনার সাহায্যে ও নেতৃত্বে আমরা সত্যের উপর ঐক্যবদ্ধ হতে পারি। কুফার শাসক নুমান ইবনে বশীর সরকারী ভবনে আছেন। তার পিছনে আমরা জুম্মার নামাযও পড়িনা। আপনি আসছেন জানতে পারলে আমরা তাকে সিরিয়া পাঠিয়ে দিব।
আল্লাহ ছাড়া আর কেও শক্তি ও সামর্থের যোগান দিতে সক্ষম নন।” এরকম শত সহস্র চিঠি ইরাকবাসী ইমাম হোসাইনকে পাঠাতে লাগলো। প্রতিটি চিঠিতেই কুফাতে আমন্ত্রন। “জীবনের শপথ। কুফাবাসী শুধু আপনাকেই চায়। আপনার জন্য বাহিনী প্রস্তুত” ইত্যাদি। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, এমন উপচে পড়া আবেগ পরিপূর্ণ চিঠির পরও কুফাবাসী ইমাম হোসাইনকে দেয়া ওয়াদা রক্ষা করেনি। কুফাবাসীর অগনিত চিঠি পেয়েও ইমাম হোসাইন রাঃ তার পিতা ও ভাইয়ের প্রতি কুফাবাসীর ওয়াদা ভঙ্গের ঘটনা খুব ভালভাবে ওয়াকিবহাল ছিলেন। তাই তিনি সম্পূর্ণ পরিস্থিতি সচেতনতার সাথে পর্যবেক্ষণ করছিলেন এবং প্রকৃত অবস্থা বোঝার জন্য তার চাচাত ভাই মুসলিম ইবনে আকিলকে কুফাতে প্রেরণ করেন। যাতে তিনি নিশ্চিত হতে পারেন যে, কুফাবাসীর প্রকৃত অবস্থা কি? তার সমর্থকের সংখ্যা আসলে কত এবং কিভাবে তারা তাকে সাহায্য সহযোগিতা করতে চায়।
মুসলিম ইবনে আকিলের কুফা গমন
মুসলিম ইবনে আকিল কুফাতে গিয়ে মুখতার বিন আবি উবাইদের বাড়িতে উঠলেন। সেখানে হযরত আলী রাঃ এর পুরান ভক্তরা মুসলিমের কাছে দলে দলে আসতে লাগলো। তিনি সকলকে ইমাম হোসাইন রাঃ এর চিঠি পড়ে শুনাতে লাগলেন। তারা সকলে কেঁদে কেঁদে তাদের আবেগ উজাড় করে প্রকাশ করতে লাগলো এবং অঙ্গিকার করলো যে ইমাম হোসাইন রাঃ এর নিরাপত্তা ও জয়ের জন্য তারা প্রয়োজনে জীবন বিসর্জন দিতেও কুণ্ঠিত হবেনা। মাত্র কয়েকদিনের মধ্যে আঠার হাজার মতান্তরে ত্রিশ হাজার কুফাবাসী মুসলিম ইবনে আকিলের হাতে ইমাম হোসাইনের আনুগত্যে বায়াত করলো। অবস্থা অনুকূলে দেখে মুসলিম ইমাম হোসাইনকে চিঠি লিখলেনঃ “আঠার হাজার ব্যক্তি বায়াত করেছেন। আপনি নির্দ্বিধায় চলে আসুন। কুফাবাসী আপনার সমর্থক এবং মুয়াবিয়ার বংশধরকে কোন অবস্থাতেই ক্ষমতায় দেখতে চায়না।”
এ সময় কুফার শাসক ছিলেন রাসুল সাঃ এর বিশিষ্ট সাহাবী নুমান বিন বশীর রাঃ। তিনি ছিলেন অপেক্ষাকৃত নমনীয় ও উদার প্রকৃতির শাসক। ইমাম হোসাইন রাঃ এর প্রতি জনগনের বায়াত গ্রহনের খবর জানাজানি হবার পর তিনি মসজিদের মিম্বারে দাড়িয়ে জনগণকে বিভেদ, বিশৃঙ্খলা না করার জন্য বক্তব্য দেন। কিন্তু তার এ ধরণের নরম বক্তব্য উগ্রপন্থী উমাইয়া বংশভুতদের পছন্দ হচ্ছিল না। তারা ইয়াযিদকে লিখে পাঠায়ঃ “…মুসলিম ইবনে আকিল কুফাতে এসেছে এবং জনগণ তার হাতে বায়াত হচ্ছে। কিন্তু নুমান বিন বশীর তা থেকাতে পারছেনা। আপনি যদি কুফার উপর অধিকার টিকিয়ে রাখতে চান, তাহলে এখানে কঠোর ও দৃঢ়চেতা ব্যক্তিকে শাসক হিসাবে পাঠান। যিনি আপনার প্রতিটি আদেশকে কার্যকরী করবেন এবং আপনার শত্রুদের কঠোর হাতে দমন করবেন। এ ধরণের চিঠি যখন ইয়াযিদ একের পর এক পেতে লাগলো, তখন তিনি তার বিশ্বস্ত খ্রিস্টান সহযোগী ইবনে সারজোনের মতামত চাইলেন। সারজোন বলল, বসরার শাসক উবাইদুল্লাহ ইবনে যিয়াদকে কুফার শাসক নিযুক্ত করুন। উনি এই পরিস্থিতি সামাল দিতে পারবেন। ইয়াযিদ তার পরামর্শ গ্রহণ করল এবং উবাইদুল্লাহ ইবনে যিয়াদকে বসরার পাশাপাশি কুফারও শাসক নিযুক্ত করলেন।
মুসলিম ইবনে আকিল এর শাহাদাত
ইয়াযিদ এর চিঠি পেয়ে ইবনে যীয়াদ বসরার দায়িত্ব তার ভাইয়ের উপর অর্পণ করে কুফার উদ্দেশ্যে রওনা হলেন। রওনা হবার পূর্বে বিদায়ী ভাষণে তিনি বসরাবাসীকে এমনভাবে শাষান যে, কেউ যদি তার ভাইয়ের নির্দেশ অমান্য করে তবে তাকে হত্যা করা হবে। মূলত বসরাবাসী যাতে ইমাম হোসাইনকে সহযোগিতার বাসনা না দেখায় সেজন্যই তিনি এই ধরণের বক্তব্য দেন। ভিতু বসরাবাসীও এতে ভয় পেয়ে যায় এবং ইমাম হোসাইন হতে মুখ ফিরিয়ে নেয়।
মধ্য দুপুরে ইবনে যীয়াদ কুফাতে প্রবেশ করেন। এ সময় তার মাথায় কালো পাগড়ী বাধা ছিল। আর মুখ ছিলো কাপড় দিয়ে ঢাকা। তার সাথে ছিল বসরার খ্যাতনামা ব্যক্তি শারিফ বিন আওয়ার ও মুনফির বিন জারুদ। ইতিমধ্যে কুফাবাসী জেনে গিয়েছিলো যে ইমাম হোসাইন রাঃ কুফাতে আসছেন। ইবনে যীয়াদকে দেখে সকলেই মনে করেছিল ইমাম হোসাইন রাঃ কুফাতে চলে এসেছেন। চারিদিক হতে আকাশ বাতাস মুখরিত করে শ্লোগান দেয়া হলোঃ “মারহাবা, হে রাসুলে খোদার নাতী, মারহাবা হে রাসুল এর দৌহিত্র।”
ইবনে যীয়াদ নির্বিকার। সে চুপচাপ গভর্নর ভবনে হাজির হলেন। তার পিছনে চলছে বিপুল সংখ্যক কুফাবাসী। শোরগোল দেখে নুমান বিন বশীরও মনে করলেন, হোসাইন ইবনে আলী মনে হয় চলে এসেছেন। তিনি গভর্নর ভবনের গেট বন্ধ করে দিলেন এবং ছাদে চলে গেলেন। এরপর বললেনঃ “আল্লাহর কসম, আমি আমার এই দায়িত্ব আপনার হাতে সোপর্দ করব না। আপনার সাথে আমার যুদ্ধের ইচ্ছা নেই। আল্লাহর দোহাই, আপনি চলে যান। গভর্নর ভবনে ঢুকবেন না।” ইবনে যীয়াদ তাকে ধমক দিলেন এবং দরজা খুলতে বললেন। জনতার মধ্যে এক ব্যক্তি ইবনে যীয়াদকে চিনতে পারল। সে বলল, এ তো ইমাম হোসাইন নন, এত ইবনে যীয়াদ। ইতোমধ্যে নুমান বিন বশীরও ইবনে যীয়াদ চিনতে পারল এবং তাড়াতাড়ি দরজা খুলে দিল। ইবনে যীয়াদকে দেখে জনগণ বিক্ষিপ্ত হয়ে চলে গেল।
এদিকে এহেন পরিস্থিতি দেখে ইবনে যীয়াদ বিচলিত হয়ে পড়লো। কিভাবে এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে আনবে তা চিন্তা করতে লাগল? পরদিন ভোরে ইবনে যীয়াদ ঘোষণা দিলেন সকলেই যেন বাধ্যতামূলকভাবে মসজিদে সমবেত হয়। আদেশ অনু্যায়ী সকলেই মসজিদে উপস্থিত হল। যথারীতি ইবনে যীয়াদ মিম্বারে দাড়িয়ে ভাষণ শুরু করলেন। “আমিরুল মুমিনিন আমাকে কুফার গভর্নর নিযুক্ত করেছেন। তিনি আমাকে নির্যাতনকারীদের প্রতি সুবিচার, অনুগতদের প্রতি অনুগ্রহ ও সদাচার এবং অবাধ্য ও বিশ্বাসঘাতকদের প্রতি কঠোর আচরণের নির্দেশ দিয়েছেন। আমি এই নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করব। বন্ধুদের প্রতি আমার আচরণ হবে স্নেহ বতসল আর যে ব্যক্তি আমার হুকুম অমান্য করবে আমি তাকে আমার তরবারী কত ধারালো এবং আমার বেত্রাঘাত কেমন যন্ত্রণাদায়ক তা দেখিয়ে দেব। সুতরাং সবার নিজ নিজ প্রানের প্রতি সদয় হওয়া উচিত।”
ইবনে যীয়াদ মিম্বার থেকে নামলেন। নুমান বিন বশীর কালবিলম্ব না করে তার আবাসভুমি সিরিয়ার উদ্দ্যেশে রওনা হলেন। ইবনে যীয়াদ শহরের সকল গন্যমান্য ব্যক্তিদেরকে সমবেত করে বললেনঃ ”তোমরা নিজ নিজ মহল্লার প্রতি লক্ষ্য রাখো। বিদেশী মুসাফির বা সন্দেহভাজন কাউকে দেখলে আমার কাছে ধরে নিয়ে আসবে। আর কেউ যদি এই আদেশ পালনে ব্যর্থ হয় বা মহল্লার কেও যদি আমিরুল মুমিনিনের বিরুদ্ধে কিছু করে তাহলে ওই মহল্লার প্রধানকে তার বাড়ির দরজার উপর প্রকাশ্যে ফাঁসি দেয়া হবে এবং ওই মহল্লার লোকেদের ভাতা বন্ধ করে দেয়া হবে।
ইতিমধ্যে ইবনে যীয়াদ খবর পেলেন মুসলিম ইবনে আকিল কুফার এক শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তি হানী বিন উরওয়া মুরাদীর কাছে লুকিয়ে আছেন। গুপ্তচরের মাধ্যমে ইবনে যীয়াদ নিশ্চিত হবার পর তিনি হানীকে গ্রেফতার করে আনলেন এবং মুসলিমকে তার হাতে তুলে দিতে বললেন। কিন্তু হানী তাতে অস্বীকৃতি জানায়। ফলে ইবনে যীয়াদ হানীকে ব্যপক প্রহার করে আধ মরা করে ফেলে। এ খবর মুসলিমের কাছে পৌঁছলে তিনি চিন্তা করলেন আর বসে থাকা সম্ভব নয়। তিনি বের হয়ে এলেন এবং তার হাতে বায়াতকৃত সকলকে ইবনে যীয়াদ এর বিরুদ্ধে যুদ্ধে আহবান জানালেন। কিন্তু মাত্র চার হাজার সাথী ব্যতিত আর কেও তার সাথে শরিক হল না।
মুসলিম তার সমর্থকদেরকে নিয়ে ইবনে যীয়াদের বাস ভবন ঘেরাও করল। এ সময় ইবনে যীয়াদের সাথে তার নিরাপত্তার ৩০ জন ও শহরের গন্যমান্য ২০ জন লোক উপস্থিত ছিল। অবস্থা বেগতিক দেখে ইবনে যীয়াদ তার সাথে উপস্থিত বিভিন্ন গোত্রের গন্যমান্যদেরকে বলল, আপনারা আপনাদের গোত্রের লোকেদের বুঝান, অর্থের লোভ দেখান এবং বলেন ইয়াযিদের বিশাল বাহিনী কুফা অভিমুখে রওনা হয়েছে। তোমরা তো তাদের সাথে যুদ্ধে পারবেনা। পরাজিত হলে তোমাদের ভাতা ও সকল সুবিধা বন্ধ হয়ে যাবে। অতএব তোমরা মুসলিমের পক্ষ ত্যাগ কর। অভাগা, স্বার্থপর কুফাবাসীর মধ্যে এসব কথা প্রভাব বিস্তার করল। তারা একে একে মুসলিমকে ত্যাগ করা শুরু করল। অবস্থা এমন দাড়ালো যে, তার পক্ষ তো দুরের কথা তাকে পথ দেখাবার মত একজনও অবশিষ্ট রইলো না।
ক্লান্তি আর হতাশায় মুসলিমের শরীর ভেঙ্গে পরেছে। কি করবেন বুঝতে পারছেন না। উদ্ভ্রান্তের মত এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছেন। একটি ঘরের দরজায় এসে টোকা দিলেন। এক বৃদ্ধা দরজা খুললেন। তিনি তাকে তার মুসিবতের কথা খুলে বললেন। বৃদ্ধার মনে দয়া হল। তিনি মুসলিমকে এক প্রকোষ্ঠে লুকিয়ে রাখলেন। এদিকে ইবনে যীয়াদ এশার নামাজের পর মসজিদে ঘোষণা দিলেন যে মুসলিম ইবনে আকিলকে যে আশ্রয় দিবে তাকে হত্যা করা হবে। ইবনে যীয়াদের পুলিশ বাহিনী প্রতিটি বাসাতে তল্লাশী করা শুরু করল। বৃদ্ধার ছেলে ভয় পেয়ে সরকারী লোকদেরকে মুসলিমের কথা জানিয়ে দিল।
ইবনে যীয়াদ মুসলিমকে গ্রেফতারের জন্য মুহাম্মাদ ইবনে আশআসকে পাঠালো। ইবনে আশআস ৭০ জন পুলিশকে নিয়ে মুসলিমের অবস্থান স্থলটি ঘিরে ফেলল। মুসলিম একাই ৭০ জনের সাথে দীর্ঘক্ষণ বিরত্বের সাথে লড়তে থাকল। এক পর্যায়ে ইবনে আশআস মুসলিমকে বললঃ আমি আপনাকে নিরাপত্তা দিচ্ছি। আপনি আমাদের সাথে আসুন। আপনি তো আমাদের পর নন। মুসলিম ছিলেন আঘাতে জর্জরিত। তিনি ইবনে আশআসের কাছে নিজেকে সপে দিলেন। পথে যেতে যেতে মুসলিম ইবনে আশআসকে বললেনঃ আমি জানি তুমি আমাকে বাচাতে পারবে না। তবে আমরা একটা দরখাস্ত আছে। তুমি তা অবশ্যই গ্রহণ কর। কাওকে পাঠিয়ে আমার অবস্থা আমার ভাই হোসাইনকে জানিয়ে দাও। আর তাকে বল, তিনি যেন কুফাবাসীর ধোকাতে না পড়েন। তিনি যেন পরিবার নিয়ে মক্কায় ফিরে যান। মুহাম্মাদ ইবনে আশআস ওয়াদা করলো যে এই পয়গাম তিনি ইমাম হোসাইন এর কাছে পৌঁছে দিবেন। ইবনে আশআস তার ওয়াদা পালন করেছিলেন।
মুসলিমকে ইবনে যীয়াদ এর সামনে আনা হল। এক কথা দু কথায় দুই জনের মধ্যে উত্যক্ত বাক্য বিনিময় শুরু হল। উত্তেজনার চরম মুহূর্তে ইবনে যীয়াদ বুকাইর বিন ইমরানকে নির্দেশ দিলেন মুসলিমকে ছাদের উপর নিয়ে সবার সামনে তরবারী দিয়ে তার মস্তক আলাদা করে দিতে। বুকাইর হুকুম মতো কাজ করল। এ সময় মুসলিম আল্লাহু আকবর ধ্বনি, তওবা ইস্তেগফারা ও দুরুদ পড়তে লাগলেন। ৬০ হিজরির ৯ই জিলহজ্জ ইবনে যীয়াদের নির্দেশে মুসলিম বিন আকিল শহীদ হন। এর পরপরই ইবনে যীয়াদ মুসলিম এর আশ্রয়দাতা হানীকেও শহীদ করে।
দুইজনকে শহীদ করার পর ইবনে যীয়াদ ইয়াযিদকে চিঠি লেখেনঃ “আমিরুল মুমিনিন ইয়াযিদ এর রাজত্বে ব্যাঘাত সৃষ্টিকারীদেরকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হয়েছে। তাদেরকে হত্যা করা হয়েছে এবং তাদের মাথা আপনার দরবারে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে। পত্র বাহক খুবই বিশ্বস্ত। তার মাধ্যমে বিস্তারিত জানতে পারবেন”
ইবনে যীয়াদের চিঠি পেয়ে ইয়াযিদের আনন্দ আর দেখে কে? তৎক্ষণাৎ সে ইবনে যীয়াদকে চিঠির জবাব লিখলঃ “তোমার চিঠি এবং হানী ও মুসলিমের মাথা পেয়েছি। তুমি অত্যন্ত বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছ। তুমি তোমার দায়িত্ব পালনে কোন ত্রুটি করনি। আমি শুনেছি হোসাইন কুফা অভিমুখে রওনা হয়েছে। তুমি কঠোর পাহাড়ার ব্যবস্থা কর। কারো বিরুদ্ধে বিদ্রোহের অভিযোগ প্রমানিত হলে তাকে হত্যা কর। তবে কেও তোমার বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ না করলে তার বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরনা।
ইমাম হোসাইন রাঃ এর কুফার উদ্দ্যেশে যাত্রা
মুসলিম ইবনে আকিল এর প্রথম চিঠিটি ইতিমধ্যে ইমাম হোসাইন রাঃ এর কাছে পৌঁছে। এরপর থেকেই তিনি ইরাক যাত্রার প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকেন। ইমাম হোসাইনের ইরাক যাত্রার খবর যখন মক্কায় ছড়িয়ে পড়লো তখন তার বন্ধুবান্ধব আসতে লাগল এবং এ যাত্রা না করার জন্য অনুরোধ করতে লাগল।
সে সময় আবদুল্লাহ ইবনে জুবায়ের রাঃ মক্কায় ছিলেন। তিনি ইমাম হোসাইনের কাছে এলেন এবং বললেনঃ “আপনি হেজাজে অবস্থান করে লোকদেরকে খেলাফতের দাওয়াত দিন আর ইরাকবাসীকে লিখুন তারা এখানে এসে আপনাকে সাহায্য করুক। আমরাও আপনাকে যথাসাধ্য সাহায্য করবো।” ইমাম হোসাইন বললেনঃ “আমি আমার আব্বার কাছে শুনেছি, হারাম শরীফের একটি ভেড়া হারাম শরীফের মর্যাদাহানির কারন হবে। আমি সেই ভেড়া হতে চাইনা।” এরপর আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রাঃ, আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাঃ তার কাছে আসলেন। সকলেই তাকে পরামর্শ দিলেন যেন তিনি কুফার উদ্দ্যেশে রওনা না হন। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাঃ বললেনঃ কুফাবাসীর ধৃষ্টতামূলক আচরণ তুমি নিজেই দেখেছ। তারা তোমার বাবাকে শহিদ করেছে। তোমার ভাইকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করেছে। ওদের ওপর নির্ভর করা মোটেও উচিত নয়। ওদের বায়াতের কোন মুল্য নেই।
ইমাম হোসাইন বললেনঃ আপনি যা বললেন তা ঠিক। কিন্তু আমার কাছে মুসলিম ইবনে আকিলের চিঠি আছে। এছাড়া কুফার গণ্যমান্য একশ পঞ্চাশ জনের চিঠি আছে। কুফার বারো হাজার লোক তার হাতে বায়াত নিয়েছে। অতএব আশংকার কারণ নেই। ইবনে আব্বাস বললেনঃ কমপক্ষে যিলহজ্জ মাস শেষ হোক। হজ্জের মৌসুম এসে গেছে। সমগ্র বিশ্বের লোক দলে দলে মক্কায় আসছে আর এ সময় তুমি মক্কা ছেড়ে যাচ্ছ!
ইমাম হোসাইন বললেনঃ বর্তমান পরিস্থিতিতে আর দেরি করা চলে না। আমার শিগ্রই রওনা হওয়া উচিত। এরপর তিনি বললেন আমি ইস্তেখারার নামাজ পরবো এবং আল্লাহর সাহায্য চাইবো। পরের দিন ইবনে আব্বাস আবার আসলেন, বললেনঃ ভাই আমার মন মানছে না। কুফাবাসীর কোন বিশ্বাস নেই। বারো হাজার লোক যদি তোমার বায়াত নিয়ে থাকে তাহলে তাদের প্রথম কর্তব্য হলো, ইয়াযিদের গভর্নরকে কুফা থেকে বের করে দেয়া। রাজকোষের উপর কব্জা নেয়া। এরপর সেখানে যাবার জন্য তোমাকে আহবন জানান। কিন্তু পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে যে তারা কুফার গভর্নরের বিরুদ্ধে কিছুই করতে পারবে না। আমার ভয় হয়, এমতাবস্থায় তারা না ইয়াযিদের পক্ষে তোমার বিপক্ষে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়।
এত কথায়ও ইমাম হোসাইন তার সংকল্প থেকে বিচ্যুত হলেন না। এরপর আসলেন আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়ের রাঃ। তিনি বললেন কোন কোন লোক মন্তব্য করছে যে, আপনি কুফাতে চলে গেলে আমি নাকি খুব খুশি হব। কারণ মক্কায় আমার আর কোন প্রতিদ্বন্দ্বী থাকবে না। এ সকল লোকদেরকে মিথ্যাবাদী প্রমাণিত করার জন্য আমি আন্তরিকতার সাথে বলছি, আপনি মক্কার শাসন ক্ষমতা গ্রহণ করুন। আপনি হাত বাড়িয়ে দিন। আমি আপনার হাতে বায়াত করবো এবং আপনার নির্দেশ পালন করতে যুদ্ধ ক্ষেত্রে গমন করবো। ইমাম হোসাইন রাঃ বললেনঃ আমি ইতিমধ্যে আমার রওনা হবার সংবাদ পাঠিয়ে দিয়েছি। এমতাবস্থায় নিজেকে বিরত রাখা সম্ভব নয়।
শেষ পর্যন্ত হিজরি ৬০ সনের ৩রা যিলহজ্জ রোজ সোমবার ইমাম হোসাইন স্বপরিবারে মক্কা থেকে রওনা দেন। আর ওই তারিখে মুসলিম ইবনে আকিলকে মক্কায় হত্যা করা হয়।
কুফার উদ্দেশ্যে রওনা হবার পর পথিমধ্যে সাফফাহ নামক স্থানে তার সাথে নবী পরিবারের শুভাকাঙ্ক্ষী প্রখ্যাত কবি ফারাযদাকের সাক্ষাত হয়। ইমাম হোসাইন কবির কাছে কুফার অবস্থা জানতে চাইলেন। কবি বললেনঃ জনগণের মন আপনার পক্ষে। কিন্তু তাদের তরবারী বনু উমাইয়ার পক্ষে। আল্লাহর শেষ ফায়সালা যথাসময়ে আকাশ থেকে অবতীর্ণ হয় এবং আল্লাহ যা ইচ্ছা করেন সেটাই করেন। একথা শুনে ইমাম হোসাইন বললেনঃ আপনি ঠিকই বলেছেন। আল্লাহ যা চান তাই করেন। তার সিদ্বান্ত যদি আমাদের পক্ষে হয় তাহলে আমরা শোকর আদায় করবো। আর যদি আমাদের বিপক্ষে হয় তাহলেও আমাদের নিয়ত সৎ। কাজেই তিনি আমাদেরকে সওয়াব থেকে বঞ্চিত করবেন না। ইমাম হোসাইন রাঃ এর একথাতে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, তিনি ক্ষমতা লাভের জন্য নয় বরং দখলদার, অত্যাচারী, পাপাচারী শাসকের হাত থেকে মুসলিম উম্মাহকে রক্ষা করে খেলাফত পুনর্বহাল করতে চেয়েছিলেন। আল্লাহর কাছে দায়মুক্তি হওয়াটাই ছিল প্রকৃত লক্ষ্য।
এরপর তিনি আবার রওনা হলেন। আরো কিছুদূর অগ্রসর হবার পর আওন ও মুহাম্মদ নামক দুজনের সাথে তার দেখা হয়। যারা আবদুল্লাহ ইবনে জাফরের চিঠি মদিনা থেকে বহন করে তার কাছে এনেছিল। মদিনা ত্যাগের সময় ইমাম হোসাইন শুধুমাত্র তার এই ভাই আবদুল্লাহ ইবনে জাফরকে মদিনাতে রেখে এসেছিলেন। আবদুল্লাহ ইবনে জাফরের চিঠিতে লেখা ছিলঃ “… আপনাকে আল্লাহর দোহাই দিয়ে বলছি, আপনি কুফা যাত্রা ত্যাগ করুন এবং মদিনাতে চলে আসুন। আমার আশংকা হয় আপনাকে হত্যা করা হবে। আল্লাহর ওয়াস্তে আপনি এ ব্যপারে তাড়াহুড়ো করবেন না।” এই চিঠির সাথে মদিনার গভর্নর আমর ইবনে সাইদেরও একটি চিঠি ছিল। যেখানে তিনি ইমাম হোসাইনের পূর্ণ নিরাপত্তার কথা ব্যক্ত করেছিলেন।
ঘটনাক্রমে ওই দিনই ইবনে যীয়াদের কাছে ইয়াযিদের চিঠি পৌঁছে। যেখানে ইয়াযিদ উল্লেখ করে যে ইমাম হোসাইন মক্কা থেকে রওনা হয়েছেন। তুমি তোমার নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার কর, যাতে ইমাম হোসাইন যেন কুফাতে পৌছাতে না পারে। এদিকে আবদুল্লাহ ইবনে জাফরের চিঠি পরেও ইমাম হোসাইন তার যাত্রা স্থগিত করলেন না। তিনি বললেনঃ স্বপ্নে রাসুল সাঃ এর সাথে আমার সাক্ষাত হয়েছে। তিনি আমাকে একটা কাজ করার নির্দেশ দিয়েছেন। আমি তো কাজটা করবোই – তাতে তার ফলাফল যাই হোক না কেন। কাজটির কথা এখন পর্যন্ত কাওকে বলিনি, আর কখনও বলব না, যতক্ষণ পর্যন্ত আমার প্রতিপালকের কাছে উপস্থিত না হই।
এরপর তার কাফেলা আবার কুফার উদ্দ্যেশে যাত্রা শুরু করল। সালাবা নামক স্থানে পৌঁছে তিনি শুনতে পান মুসলিম ইবনে আকিলকে হত্যা করা হয়েছে এবং কুফাতে ইমাম হোসাইনের সমর্থক বা সাহায্যকারী বলতে আর কেও নেই। এই সংবাদ পাওয়ার সাথে সাথে কাফেলায় নৈরাশ্য ও বিষাদের ছায়া নেমে আসে এবং তারা সেখান থেকে ফিরে যাবার সংকল্প নেয়। একথা শুনে মুসলিম ইবনে আকিলের ছেলেরা ফিরে না যাবার প্রতিজ্ঞা করে। তারা বলে যতক্ষণ পর্যন্ত তারা মুসলিম এর হত্যার প্রতিশোধ না নিবে ততক্ষন তারা ফিরে যাবে না। প্রয়োজনে তারা প্রান দিতেও প্রস্তুত। তাছাড়া ইমাম হোসাইন মুসলিম ইবনে আলিকের মত নয়। তাকে দেখলে অবশ্যই কুফাবাসী ইমাম হোসাইনের পক্ষ নেবে এবং ইবনে যীয়াদকে বন্ধি করবে। এ সময় ইমাম হোসাইনের কাফেলাতে কয়েকশো লোক ছিল এবং পথিমধ্যে আরও কয়েকশো লোক তাদের সাথে শরিক হয়। কিন্তু সালাবায় এসে যখন তারা মুসলিমের মৃত্যু সংবাদ শুনল তখন একে একে সকলেই চলে যেতে লাগলো। শেষ পর্যন্ত ইমাম হোসাইনের পরিবার ও তার গোত্রের লোকেরাই অবশিষ্ট রইলো। আর তাদের মোট সংখ্যা ছিল সত্তর বা আশির মতো।
ইমাম হোসাইন রাঃ কে বাধা প্রদান
ইবনে যীয়াদ ইয়াযিদের পত্র মারফত ইমাম হোসাইনের যাত্রার সংবাদ অবগত হন। তৎক্ষণাৎ সে হুর ইবনে ইয়াযিদ তামীমীর নেতৃত্বে এক হাজার সদস্যের এক বাহিনী প্রেরন করেন ইমাম হোসাইনকে খোজার জন্য।
যী হাসাম পাহাড়ের পাদদেশে পৌঁছালে ইমাম হোসাইন দেখতে পান একটি সেনাদল বিপরীত দিক থেকে আসছে। বুঝতে বাকি রইলোনা এটা ইবনে যীয়াদের সেনাদল। কিছুক্ষনের মধ্যে হুর তার সেনাদলকে ইমাম হোসাইনের কাফেলার বিপরীত দিকে অবস্থান করাল এবং তাবু স্থাপন করলো। ইমাম হোসাইন তার সাথিদেরকে নির্দেশ দিলেন ওদেরকে এবং ওদের ঘোড়া গুলোকে পানি পান করাও। কারণ ওরা ঠিক দুপুরে এসেছে।
হুরের সেনাদল কিছুক্ষন বিশ্রাম নিল। এর মধ্যে ইমাম হোসাইনের মুয়াজ্জিন যোহরের আজান দিল। আজান শেষ হয়ে ইমাম হোসাইন তাবু থেকে বের হয়ে হুর এর সেনা দলের সামনে এলেন। এরপর আল্লাহর প্রসংসা ও রাসুলের প্রতি দুরুদ পাঠ করে বললেনঃ হে জনমণ্ডলী, আমি তোমাদের কাছে নিজ থেকে আসিনি। বরং তোমাদের বহু দাওয়াতী চিঠি ও আমন্ত্রণের প্রেক্ষিতেই এসেছি। এখন যদি তোমরা আমার সাথে অঙ্গীকারবদ্ধ হয়ে আমাকে পুরোপুরি আশ্বস্ত করো তাহলেই আমি তোমাদের শহরে যাব। আর যদি আমার আগমন তোমাদের কাছে অপছন্দনীয় হয়, তাহলে আমি ফিরে যাব।
ইমাম হোসাইনের এই ভাষণে হুরের বাহিনী নীরব হয়ে গেলো। এরপর তিনি হুরকে জিজ্ঞেস করলেনঃ আপনারা কি আমাদের সাথে নামাজ পড়বেন নাকি আলাদা পড়বেন? হুর জবাব দিলোঃ সবাই এক সাথে পড়ব। নামাজ শেষে যে যার তাবুতে ফিরে গেল। এরপর আসরের ওয়াক্ত হল। সকলেই আবার একসাথে নামাজ আদায় করলো। নামাজ শেষে ইমাম হোসাইন পুনরায় হুরের বাহিনীর উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখলেন। এবার হুর দাড়িয়ে বললঃ আপনি এসব কি চিঠি ও আমন্ত্রণের কথা বলছেন? আমার তো এসবের কিছুই জানিনা।
ইমাম হোসাইন কুফাবাসীর লেখা চিঠি ভর্তি বড় বড় দুইটি ব্যগ হুর ও তার সেনাদলের সামনে ছড়িয়ে দিলেন। হুর বললঃ আমরা এসব চিঠি আপনাকে লিখিনি। আমাদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, আমরা আপনার সাথে থাকবো এবং আপনাকে পাহারা দিয়ে ইবনে যীয়াদের কাছে নিয়ে যাব। ইমাম হোসাইন রাঃ বললেনঃ আমি এ অপমান কখনই সহ্য করব না। তার থেকে ইয়াযীদের কাছে বন্দী অবস্থায় হাজির হব অথবা হেজাজে ফেরত যাব। হুর বললঃ আমি আপনাকে ফেরত যেতে দিব না এবং আপনার সাথে লড়াইও করব না। সবচেয়ে ভাল হয়, আপনি কুফা ও হেজাজের মধ্যবর্তী কোন রাস্তা অবলম্বন করুন। আমি ইবনে যীয়াদকে লিখে পাঠাচ্ছি আপনি ইয়াযিদকে লিখুন। হতে পারে এমন কোন সুরাহা বের হবে যাতে আমাকে আপনার মোকাবেলাতে দাড়াতে না হয়। ইমাম হোসাইন এ প্রস্তাব গ্রহণ করলেন এবং উত্তর দিকে রওনা হলেন। কাদিসিয়ার নিকটে পৌঁছে জানতে পারলেন যে আমর ইবনে সাদ সেখানে একটি বাহিনী নিয়ে অবস্থান করছে। ইমাম হোসাইন সেখান থেকে দশ মাইল চলার পর কারবালা নামক স্থানে উপনীত হন। পিছনে হুরও তার বাহিনী নিয়ে আসছিল।
ইমাম হোসাইনের কারবালায় অবস্থান
এদিকে ইমাম হোসাইনের কথা জানতে পেরে আমর ইবনে সাদ তার চার হাজার সৈন্যের বাহিনী নিয়ে পরের দিনই কারবালাতে চলে আসে। নিজ বাহিনীকে একটি স্থানে অবস্থান করিয়ে তিনি বাহিনী থেকে পৃথক হয়ে ইমাম হোসাইনের দিকে এগিয়ে এলেন। ইমাম হোসাইনকেও ইশারা করলেন এগিয়ে আসার জন্য। ইমাম হোসাইন এগিয়ে গেলে আমর তাকে সালাম দিয়ে বললেনঃ “এতে কোন সন্দেহ নেই যে আপনি ইয়াযিদের চাইতে খিলাফতের অধিক যোগ্য। কিন্তু আপনার বংশে হুকুমত ও খেলাফত আসবে এটা আল্লাহর ইচ্ছা নয়। হযরত আলী রাঃ ও হযরত হাসান রাঃ এর অবস্থা তো আপনি স্বচক্ষে দেখেছেন। আপনি যদি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা লাভের ইচ্ছা পরিত্যাগ করেন তাহলে আপনি মুক্তি পেতে পারেন। অন্যথায় আপনার প্রানের আশংকা রয়েছে। আমরা আপনাকে বন্দী করার জন্য আদিষ্ট হয়েছি।”
ইমাম হোসাইন বললেনঃ আমি তোমাদের জন্য তিনটি প্রস্তাব পেশ করছি। তোমরা আমার জন্য এর যেকোনো একটা মঞ্জুর কর।
১। আমি যেদিক থেকে এসেছি সেদিকেই আমাকে ফিরে যেতে দাও। তাহলে আমি মক্কায় গিয়ে আল্লাহর বন্দেগীতে আত্মনিয়োগ করব।
২। আমাকে কোন একটি সীমান্তের দিকে বেরিয়ে যেতে দাও। তাহলে আমি সেখানে পৌঁছে কাফিরদের সাথে লড়তে লড়তে শাহাদাৎ বরণ করব।
৩। তোমরা আমার রাস্তা ছেড়ে দেও এবং আমাকে সোজা ইয়াযিদের কাছে দামেস্কে যেতে দাও। অবশ্য তোমরা আমার সাথে আসতে পার। আমি ইয়াযিদের কাছে গিয়ে সোজাসুজি তার সাথেই আমার এ ব্যপারে ফয়সালা করে নেব। যেমন আমার বড় ভাই মুয়াবিয়ার সাথে করেছিলেন। আমর ইবনে সাদ একথা শুনে অত্যন্ত সন্তুষ্ট হল এবং বলল আমি আপনার এ ব্যপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দিতে পারতেছিনা। আমি ইবনে যীয়াদকে আপনার প্রস্তাবগুলো লিখে পাঠাচ্ছি। তিনি হয়তো এর কোন একটা মঞ্জুর করবেন।
আমর তখন ইমাম হোসাইনের প্রস্তাবগুলো ইবনে যীয়াদকে লিখে পাঠালেন। আরও লিখলেন … হোসাইন যে প্রস্তাবগুলো দিয়েছেন তাতে ফিতনা-ফ্যাসাদের দরজা সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে যাবে। ইয়াযিদের নিকট পৌঁছে তিনি বায়াত নিবেন এবং এতে বিপদের আশংকা থাকবেনা। ইবনে যীয়াদ প্রস্তাবগুলো নিয়ে যখন চিন্তা ভাবনা করছিল তখন তার পাশে বসা ছিল শীমার যিল জাওশান নামক জনৈক ব্যক্তি। সে বলল, হে আমীর! তোমার জন্য ইমাম হোসাইনকে হত্যা করার এটাই সুবর্ণ সুযোগ। কেননা এতে তোমার উপর কোন অভিযোগ আসবে না। আর যদি ইমাম হোসাইন ইয়াযিদের নিকট পৌঁছে যায় তবে তাকে মুকাবেলায় ইয়াযিদের কাছে তোমার কোন মর্যাদা থাকবে না। কেননা ইয়াযিদের দরবারে ইমাম হোসাইন খুব সহজে তোমার উপরে প্রাধান্য পাবে।
এ কথা শুনে ইবনে যীয়াদ, আমর ইবনে সাদকে লিখে পাঠালঃ তিনটি প্রস্তাবের কোন একটিও গ্রহণ করা যায় না। তবে হ্যাঁ, ইমাম হোসাইন আমার কাছে ইয়াযিদের জন্য বায়াত করবেন। এরপর আমি নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় তাকে ইয়াযিদের কাছে পাঠানোর ব্যবস্থা করব। উত্তর হাতে পাবার পর আমর ইবনে সাদ ইমাম হোসাইনকে বললেন, আমি নিরুপায়। ইবনে যীয়াদ প্রথমে তার হাতে ইয়াযিদের জন্য বায়াত চায়। ইমাম হোসাইন বললেনঃ যীয়াদের হাতে বায়াতের থেকে মৃত্যু ভাল। চিঠি বিনিময়, প্রতাখ্যান ও চাপ সৃষ্টির মধ্য দিয়ে ইমাম হোসাইন ও ইবনে সাদ উভয়েই নিজ নিজ সঙ্গীদের নিয়ে কারবালা অবস্থান করতে লাগল।
ইতিমধ্যে ইবনে সাদের কাছে ইবনে যীয়াদের আরেকটি চিঠি আসে। তাতে লেখাঃ এখনি ইমাম হোসাইনকে বন্দী কর এবং আমার সামনে হাজির কর। প্রয়োজনে তার সাথে যুদ্ধ কর এবং তার মাথা কেটে আমার সামনে হাজির কর।
পত্র পাওয়া মাত্রই ইবনে সাদ দাড়িয়ে যান এবং তার বাহিনীকে প্রস্তুত হবার নির্দেশ দেন। এরপর তিনি ইমাম হোসাইনের কাছে গিয়ে বললেনঃ এই বার্তাবাহক ইবনে যীয়াদের পত্র নিয়ে এসেছে। যদি আমি তা কার্যকর না করি তাহলে আমাকে বন্দি করা হবে। ইমাম হোসাইন বললেনঃ আমাকে আগামীকাল পর্যন্ত সময় দাও। ইবনে সাদ বার্তাবাহক জুওয়ায়রার দিকে তাকালেন। সে বলল, আগামিকাল দূরে নয়। এ সময় পর্যন্ত অবকাশ দেয়া উচিৎ। ইবনে সাদ তাবুতে ফিরে এলেন এবং তার বাহিনীকে বললেন, আজ কোন যুদ্ধ হবে না।
এদিকে ওবাইদুল্লাহ ইবনে যীয়াদ ইবনে সাদকে চিঠি পাঠিয়ে চিন্তা করতে লাগল, ইবনে সাদ যদি আমার এ নির্দেশ অমান্য করে অথবা হোসাইনের দলে ভিড়ে যায় তাহলে আমি খুবই অসুবিধায় পরে যাব। তাই তিনি সাথে সাথে শিমার যিল জাওশানকে ডেকে পাঠালেন এবং বললেন তুমি এক্ষণই কারবালা রওনা হও। যদি ইবনে সাদ যুদ্ধে ইতস্ততা করে তবে তুমি সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব গ্রহণ কর এবং ইমাম হোসাইনকে হত্যা কর। ইবনে যীয়াদের কথা মতো শিমার কারবালার পথে রওনা হল।
পানি বন্ধ
শিমার কারবালা পৌঁছার পর রাতের বেলা ইবনে যীয়াদ হতে আর একটি নির্দেশনা এলো। যদি ইতিমধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়ে না থাকে তাহলে পানি বন্ধ করে দাও। এই নির্দেশ পাওয়া মাত্রই আমর ইবনে সাদ পাঁচশো সৈন্য ফোরাত নদীতে মোতায়েন করে, যাতে ইমাম হোসাইনের কাফেলা পানি সংগ্রহ করতে না পারে। ঘটনাক্রমে ওই দিনই ইমাম হোসাইনের সঙ্গীরা পানি সংগ্রহ করেননি। ফলে তাদের সকল পাত্রই ছিল খালি। ইমাম হোসাইন তার আপন ভাই আব্বাস ইবনে আলীকে পঞ্চাশ জন লোকসহ ফোরাতের দিকে পাঠালেন যেন তারা জোর করে হলেও পানি নিয়ে আসে। কিন্তু জালিমরা তাদেরকে পানি আনতে দিলনা। ফলে ক্রমে ক্রমে ইমাম হোসাইনের সঙ্গীরা পানির পিপাসাতে অস্থির হতে লাগল।
ইমাম হোসাইনের কনিষ্ঠ পুত্র আলী অসুস্থ অবস্থায় তাবুতে শুয়ে ছিল। সে এবং তার বোন উম্মে কুলসুম এই ভেবে ক্রন্দন করতে লাগলো যে সকালে শত্রুরা আক্রমন করবে এবং তাদের সকলকে হত্যা করবে। তাদের কান্নার শব্দ শুনে ইমাম হোসাইন রাঃ তাবুতে প্রবেশ করলেন এবং বললেন শত্রুরা আমাদের কাছেই অবস্থান করছে। তোমাদের কান্নার শব্দে তারা খুশি হবে অন্যদিকে তোমাদের সঙ্গীরা হতাশ হয়ে যাবে। এভাবে অনেক কষ্টে তিনি তাদের কান্না থামালেন।
এরপর তিনি তার সকল সঙ্গীকে নিজের কাছে ডাকলেন এবং বললেনঃ তোমারা এখান থেকে যেদিকে ইচ্ছা চলে যাও। কেও কিছু বলবেনা। কেননা আমিই শত্রুদের লক্ষ্যবস্তু। আমি তোমাদের অনুমতি দিচ্ছি, তোমরা নিজ নিজ প্রান রক্ষা করো। সঙ্গীরা তাকে বললঃ আমরা কখনও আপনাকে ছেড়ে যাবনা। এবং যতক্ষণ আমাদের প্রান আছে ততক্ষন আমরা আপনার খাতিরে যেকোনো কষ্ট সহ্য করবো।
আকিলের সন্তানেরা বললঃ আল্লাহ না করুন, আপনাকে রেখে আমরা যদি চলে যাই, তবে মানুষের কাছে কি জবাব দিব? ফেরত গিয়ে আমরা কোন মুখে বলব যে, আমাদের নেতা, আমাদের প্রিয় চাচাকে শত্রুর মুখে একাকী রেখে চলে এসেছি। তাকে রক্ষা করার জন্য একটি তীরও ছুড়ি নাই। তার ভাগ্যে কি ঘটেছে আমরা জানিনা – একথা আমরা কি করে বলব? আপনার যা পরিনতি হবে আমাদেরও তাই হবে। আপনার পর আমদেরকে যেন আল্লাহ জীবিত না রাখেন। এভাবে এক এক করে সকলেই তাদের আনুগত্যের পক্ষে বক্তৃতা দিন। সবশেষে ইমাম হোসাইন তাবুর বাইরে এলেন। তিনি সঙ্গীদেরকে আদেশ দিলেন, বিক্ষিপ্ত তাবুগুলিকে গুছিয়ে এক জায়গায় আনার জন্য। সকালবেলা এমনভাবে আক্রমন চালাতে হবে যেন তাদের তাবুগুলো তাদের ডানে বামে ও পিছনে থাকে এবং শত্রুরা তাবুর উপর আক্রমন করতে না পারে। এই আদেশ দিয়ে তিনি নিজ তাবুতে ফিরে এলেন এবং সারারাত নামায ও দোয়া ইস্তেগফারা করে কাটালেন। তার সঙ্গীরাও সারারাত নামায ও দোয়া ইস্তেগফারে মসগুল রইলেন। আর এদিকে শত্রুর ঘোড়সওয়ার প্রহরীরা সারারাত তাবুগুলোর চারপাশে টহল দিতে লাগল যাতে কেউ পালিয়ে না যায়।
১০ই মুহাররাম; হৃদয়বিদারক শাহাদতের দিন
১০ই মুহাররাম সকালে রক্তিমাভ লাল সূর্য তখন পূর্ব দিগন্তে। ফজরের নামাজের পর ইমাম হোসাইন রাঃ তার সাথীদের সারিবদ্ধভাবে দাড় করালেন। মাত্র ৩২ জন ঘোড়সওয়ার ও ৪০ জন পদাতিক নিয়ে গঠিত ক্ষুদ্র বাহিনী। ডানদিকে যুবায়ের বিন কাইন এবং বামদিকে হাবিব বিন মুজাইর নিজ নিজ বাহিনীর অধিনায়ক। পতাকা ছোট ভাই আব্বাসের হাতে। পিছনের দিককে নিরাপদ করার জন্য ইমাম হোসাইন নির্দেশ দিলেন পরিখা সদৃশ গভীর গর্ত করে তাতে আগুন জ্বালিয়ে দিতে। যাতে শত্রুরা পিছনদিক হতে আক্রমন করতে না পারে। অপরদিকে শত্রুরাও চার হাজার সৈন্যের বিশাল বাহিনী নিয়ে প্রস্তুত।
যুদ্ধ শুরুর আগে ইমাম হোসাইন শত্রু বাহিনীর উদ্দেশ্যে এক মর্মস্পর্শী ভাষণ দেন। আল্লাহর প্রতি প্রশংসা ও রাসুল এর প্রতি দুরুদ পাঠ করে তিনি বলেনঃ “হে জনমণ্ডলী! তাড়াহুড়ো করোনা। আগে আমার কয়েকটি কথা শোন। তোমাদেরকে বোঝাবার যে অধিকার আমার রয়েছে সেটা প্রয়োগের সুযোগ দাও এবং আমার আগমনের কারনটা শুনে নাও। আমার যুক্তি যদি তোমরা মেনে নাও এবং আমার প্রতি সুবিচার কর, তাহলে তোমরা অত্যন্ত সৌভাগ্যবান মানুষ বলে পরিগনিত হবে। কিন্তু সেজন্য যদি তোমরা প্রস্তুত না হও তবে তাও তোমাদের ইচ্ছা। আল্লাহ আমার একমাত্র সহায়। তিনি সৎ বান্দাদেরকে সাহায্য করে থাকেন।” ইমাম হোসাইনের কথা শুনে তার বোন ও মেয়েরা কান্না শুরু করে দিল। ইমাম হোসাইন তার ভাই আব্বাসকে পাঠালেন তাদেরকে চুপ করাবার জন্য।
কান্নার আওয়াজ থেমে গেলে তিনি আবার বললেনঃ জনমণ্ডলী! তোমরা আমার বংশ পরিচয় ও মান মর্যাদার কথা বিবেচনা কর, যে আমি কে? আমাকে অপমান করা বা হত্যা করা কি তোমাদের শোভা পায়? আমি কি তোমাদের নবীকুল শিরোমণি মুহাম্মাদ সাঃ এর দৌহিত্র এবং তার চাচাত ভাই আলী রাঃ এর ছেলে নই? যিনি সবার আগে কিশোর বয়সেই তার দাওয়াতে সাড়া দিয়ে ঈমান এনেছিলেন? শহীদদের সর্দার হযরত হামযা রাঃ কি আমার পিতার চাচা নন? রাসুল সাঃ এর সেই উক্তি কি তোমাদের মনে নেই? যেখানে তিনি আমাকে আর আমার ভাইকে বেহেশতে যুবকদের নেতা বলেছিলেন? আর যদি আমাকে তোমরা মিথ্যাবাদী মনে কর, তাহলে এখনও তোমাদের মধ্যে অনেকে রয়েছেন যারা আমার সম্পর্কে রাসুল সাঃ এর হাদিস শুনেছেন। তোমরা তাদের কাছে জিজ্ঞেস করতে পার। আমি তোমাদের কাছে জানতে চাই এই হাদিসের উপস্থিতিতেও কি তোমরা আমার রক্ত ঝরান থেকে বিরত থাকবে না? ইমাম হোসাইনের এমন মর্মস্পর্শী ভাষণেও শত্রুপক্ষের মনে বিন্দুমাত্র আবেগের উদ্ভব হল না। শিমার ও তার সমমনা সৈন্যরা যুদ্ধ করার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে।
শত্রুবাহিনীর একমাত্র ব্যক্তি হুর ইবনে ইয়াযিদ তামীমী, যে ব্যক্তি ইমাম হোসাইনকে সর্ব প্রথম মক্কায় যেতে বাধা দিয়েছিল এবং কারবালা পর্যন্ত আটকে রেখেছিল। সে প্রধান সেনাপতি আমর ইবনে সাদের কাছে এসে বললঃ আল্লাহ আমাদের সবাইকে সঠিক পথে পরিচালনা করুন। তোমরা কি সত্যিই এই মানুষটার বিরুদ্ধে লড়াই করবে? বিশেষত সে যখন লড়াই চায় না এবং লড়াই করার মত জনশক্তিও তার নেই। ইবনে সাদ বললঃ হ্যাঁ! আল্লাহর কসম, অবশ্যই লড়াই করব। এমন লড়াই করব যে শত্রুদের মাথা গলা থেকে আলাদা হয়ে যাবে। হুর বললঃ উনার বিকল্প প্রস্তাবগুলো কি গ্রহণ করা যায়না? ইবনে সাদ এবার একটু নরম হয়ে বললঃ আল্লাহর কসম! আমার হাতে ক্ষমতা থাকলে গ্রহণ করতাম। কিন্তু গভর্নর সাহেব যেখানে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন, তা আমি কিভাবে গ্রহণ করি?
এই কথা শুনে হুর আস্তে আস্তে ইমাম হোসাইন রাঃ এর দিকে অগ্রসর হতে শুরু করল। যখন সে দেখলো যে সে তার বাহিনী থেকে বেশ দূরে চলে এসেছে এবং ইমাম হোসাইনের বাহিনীর কাছাকাছি চলে এসেছে তখন সে অকপটে বললঃ এখন জান্নাত ও জাহান্নামের যেকোন একটা বেছে নেবার সময় এসেছে। আমি জান্নাতকে বেছে নিলাম। এই বলে সে ঘোড়া হাকিয়ে ইমাম হোসাইনের কাছে চলে এল। বললঃ “হে রাসুলের নাতী, আল্লাহ আমাকে আপনার জন্য উৎসর্গ করুন। আমি সেই হতভাগা, যে আপনাকে ফিরে যেতে না দিয়ে এই জায়গায় আটকে রেখেছি। আল্লাহর কসম! আমি কখনও কল্পনাও করিনি যে, ওরা আপনার প্রস্তাবগুলো প্রত্যাখ্যান করবে। আমি যদি জানতাম যে তারা এতদূর বাড়াবাড়ি করবে তাহলে আমি কখনই এতবড় অন্যায় করতাম না। এখন আমি আল্লাহর কাছে তওবা করার জন্য আপনার কাছে এসেছি। আমার মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত আপনার প্রান রক্ষা করার জন্য শত্রুদের বিরুদ্ধে লড়ে যাবো। এতে কি আমার তওবা কবুল হবে?”ইমাম হোসাইন বললেনঃ অবশ্যই তোমার দোয়া কবুল হবে এবং আল্লাহ তোমাকে অফুরন্ত অনুগ্রহ দান করবেন।
শিমার যিল জাওশান এবার আমর ইবনে সাদকে বললঃ এখন আর দেরি করছেন কেন? ইবনে সাদ সাথে সাথে তার ধনুকে তীর জুড়ে দিয়ে ইমাম হোসাইনের বাহিনীর দিকে নিক্ষেপ করলেন এবং বললেন তোমারা সাক্ষী থাকো, সর্বপ্রথম আমিই তীর নিক্ষেপ করেছি। এরপর কুফীদের দুই ব্যক্তি বেরিয়ে এলো মল্ল যুদ্ধের জন্য। ইমাম হোসাইনের পক্ষ থেকে এক বীর যোদ্ধা তাদের দুইজনকে হত্যা করলো। এভাবে যুদ্ধ চলতে লাগলো। এতে কুফীদের প্রচুর যোদ্ধা মারা যেতে লাগল। আবদুল্লাহ ইবনে উমায়ের কালবী, বারীর ইবনে হাসীর, হুর ইবনে ইয়াযিদ এবং হাফে ইবনে হেলাল নিজেদের প্রতিপক্ষকে কচুকাটা করেন। এই দৃশ্য দেখে শত্রুবাহিনীর ওমর ইবনে হাজ্জায চিৎকার করে বললঃ হে বাহাদুরবৃন্দ! তোমরা কি জানো কাদের সাথে লড়াই করছো? এরা তো তারা যারা নিজেদের প্রাণ হাতে করে বের হয়েছে। তাদের সাথে মল্ল যুদ্ধ সমীচীন নয়। সম্মিলিতভাবে আক্রমন কর। খোদার কসম! তোমরা পাথর নিক্ষেপ করলেও এরা কেউ বাঁচবেনা। এই বলে সে ইবনে সাদের বাহিনীর ডান দিকের অংশকে নিয়ে ইমাম হোসাইনের ডান দিকের বাহিনীর দিকে অগ্রসর হয়। হোসাইন বাহিনী তাদেরকে বর্শা ও তীরের আঘাতে জর্জরিত করে ফেলে। ফলে শত্রুপক্ষের বহু সংখ্যক সৈন্য হতাহত হয়।
এরই মধ্যে হঠাৎ ইবনে সাদ এর বাহিনীর আবদুল্লাহ ইবনে হাওযা নামক এক ব্যক্তি হোসাইন রাঃ এর সামনে গিয়ে বললঃ তোমাদের মধ্যে হোসাইন কে? কেও উত্তর দিল না। সে আবার জিজ্ঞ্যেস করলো। এবারও কেও জবাব দিল না। তৃতীয়বার জিজ্ঞ্যেস করলে বলা হলোঃ তোমার উদ্দেশ্য কি? ইবনে হাওযা বললঃ হে হোসাইন! আমি তোমাকে জাহান্নামে যাবার জন্য প্রস্তুত হতে বলছি। ইমাম হোসাইন জবাব দিলঃ তুই মিথ্যা বলছিস। আমি পরম করুনাময় আল্লাহর কাছে অবশ্যয় যাবো। তবে তুই কে?সে বললঃ ইবনে হাওযা ইমাম হোসাইন হাত তুলে বললেনঃ হে আল্লাহ! এই পাষণ্ডকে এখনই দোজখে পাঠাও।
ইবনে হাওযা এ কথা শুনে ক্রোধে অধীর হয়ে গেল। কিন্তু কিছু করার আগেই তার ঘোড়া লম্ফ ঝম্ফ করে এমনভাবে ছুটতে লাগলো যে ইবনে হাওযার পা লাগামে আটকে গেল এবং সে ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে ঝুলতে লাগলো। ঘোড়ার ছুটাছুটিতে ইবনে হাওযার মাথা গাছ ও পাথরের সাথে এমনভাবে ধাক্কা খেতে লাগলো যে অল্প কিছুক্ষনের মধ্যেই সে মারা গেল।
ইবনে সাদের বাহিনীর আরেক নরপশু মাসরুক ইবনে ওয়ায়েল অনেকের কাছে ইচ্ছা প্রকাশ করেছিল যে, সে ইমাম হোসাইনের মাথা কাটবে। কিন্তু ইবনে হাওযার শোচনীয় পরিনতি দেখে সে এত ভয় পেল যে, সে হোসাইনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে না বলতে বলতে তৎক্ষণাৎ যুদ্ধ ছেড়ে কুফার পথে রওনা হল। ইমাম হোসাইনের সৈনিকরা জীবনবাজি রেখে যুদ্ধ করছিল। তারা যেদিকে দিয়ে যাচ্ছিল সেদিকে শত্রুদের লাশের স্তুপ হয়ে যাচ্ছিল।
ইয়াযিদ ইবনে কান্দী নামক একজন আমর ইবনে সাদের সাথে কুফা থেকে এসেছিল। ইবনে সাদ ইমাম হোসাইনের প্রস্তাবগুলো প্রত্যাখ্যান করায় সেও হোসাইনের পক্ষে যোগ দেয়। সে হাটু গেড়ে মাটির উপর বসে শত্রু বাহিনীর দিকে তীর নিক্ষেপ করে। তার ছোড়া একশতটি তীরের মধ্যে মাত্র পাঁচটি তীর লক্ষভ্রষ্ট হয়। তার প্রতিটি তীর ছোড়ার সময় ইমাম হোসাইন বলেছিলেনঃ হে আল্লাহ! ওর তীরগুলো লক্ষ্যে পৌঁছে দাও এবং এর বদলে ওকে জান্নাতবাসী কর।
শিমার যত সহজে জয় আশা করেছিলো বাস্তবে যে তা তত সহজ নয়, তা সে উপলব্ধি করলো। অবস্থা বেগতিক দেখে সে আমর ইবনে সাদের বাম দিকের সেনাদলকে নিয়ে চারদিকে থেকে ইমাম হোসাইনের বাহিনীর উপর আক্রমন চালাল। কিন্তু ইমাম হোসাইনের সাথীরা এমন প্রতিরোধ গড়ে তোলে যে এ হামলাও ব্যর্থ হয়। আমর ইবনে সাদ এবার হুসাইন ইবনে নুমাইয়ের নেতৃত্বে পাঁচশো তীরন্দাজের একটি দলকে তীর ছোড়ার জন্য পাঠায়। বৃষ্টির মতো তীর ছুড়ে তারা ইমাম হোসাইনের অনেকগুলো ঘোড়াকে আহত করে। বাধ্য হয়ে ঘোড়সওয়াররা পদাতিকে রুপান্তরিত হয়। এর মধ্যে হুর ইবনে ইয়াযিদের ঘোড়াও ছিল। হুর ঘোড়া থেকে নেমে শত্রুর ভিতরে ঢুকে পড়লেন এবং যতক্ষণ পারলেন শত্রুদেরকে কচুকাটা করলেন। শত্রুরা হুরকে চারদিক থেকে ঘিরে ধরলো এবং তাকে শহীদ করল।
সূর্য তখন মধ্য আকাশে। ইমাম হোসাইনের বাহিনী বীর বিক্রমে লড়ে চলছে। তাদের মধ্য বিন্দুমাত্র ক্লান্তি ও দুর্বলতার লক্ষন নাই। ইবনে সাদের জয়ের লক্ষন তখনও দৃষ্টিসীমার বাইরে। এর কারণ, ইমাম হোসাইনের তাবুগুলো এমনভাবে ফেলে রাখা হয়েছিল যে শত্রুরা শুধুমাত্র একদিকে থেকে আক্রমন করতে পারছিল। অবশেষে ইবনে সাদ হুকুম দিলেন ইমাম হোসাইনের ডানে বামে যে তাবুগুলো আছে তা ফেলে দিতে। কিন্তু তাদের সে কৌশলও ব্যর্থ হয়। তখন তারা তাবুগুলোতে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। এতে ইমাম হোসাইনের বাহিনীর জন্য ভাল হয়। শত্রু আর পিছন থেকে আক্রমন করতে পারলনা।
ইবনে সাদের বাহিনীর যোদ্ধাদের লাশে ময়দান ভরে গেলো। এদিকে ইমাম হোসাইনেরও খুব কম সংখ্যক লোক জীবিত ছিল। ইবনে সাদের বাহিনীর প্রচুর সংখ্যক মারা গেলেও তাদের সংখ্যা এত বেশী ছিলো যে এই সংখ্যাতেও তাদের কমতি অনুভুত হচ্ছিল না। কিন্তু ইমাম হোসাইনের একজন শহীদ হলে তা বিরাট শূন্যতার সৃষ্টি করছিল। সূর্য তখন পশ্চিম আকাশে অনেকটা ঢলে পড়েছে। ইমাম হোসাইন রাঃ তার লোকদের বললেনঃ শত্রুদেরকে বল, আমাদেরকে জোহরের নামায পড়তে দাও। কিন্তু শত্রুরা এ আবেদন অগ্রাহ্য করল। বাধ্য হয়ে লড়াই চলা অবস্থায় “সালাতুল খাওফ” এর নিয়মে নামায পড়া হল।
নামাজের পর আবার দুপক্ষ থেকেই জোরদার আক্রমণ শুরু হল। ইমাম হোসাইনের চারপাশে তখন কয়েকজন মুজাহিদ ব্যতিত বাকী সকলেই শহীদ হয়ে গেছেন। কুফী বাহিনী তখন ক্রমেই প্রবল হয়ে উঠছে। ইমাম হোসাইনের সঙ্গীরা তখন সিধান্ত নিল যে, শত্রুরা ইমাম হোসাইনকে আক্রমণ করার আগে তারা সবাই তার হেফাযতে লড়াই করবে এবং একে একে শহীদ হবেন। তাদের একজন জীবিত থাকা অবস্থায় তারা ইমাম হোসাইনের গায়ে হাত পড়তে দিবেন না। এই সিধান্ত অনুযায়ী এক এক জন করে এগিয়ে গেলো আর শহীদ হল। এবার ইমাম হোসাইন ও তার পরিবার ছাড়া আর কেও জীবিত রইল না। এবার তার পরিবার ও হাশেমী গোত্রের বাকী কয়েকজন তাদের জীবন উৎসর্গ করতে এগিয়ে এলো।
সর্বপ্রথম ইমাম হোসাইনের ১৯ বছরের সুদর্শন পুত্র আলী আকবর ময়দানে নামলেন। তিনি শত্রুদের উপর হামলা করছেন আর কবিতা আবৃত্তি করতে লাগলেন। প্রবল বিক্রমে তিনি মাঠের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ঘুরছিলেন আর তার বিরত্বের সাক্ষর রাখছিলেন। অবশেষে জনৈক মুররা ইবনে মুনাকিয তাকে বর্শার আঘাতে মাটিতে ফেলে দেয়। রক্তপিপাসু জালিমের দল তার উপর ঝাপিয়ে পড়ে আর তাকে টুকরো টুকরো করে ফেলে।
হৃদয় বিদারক এই দৃশ্য দেখে ফুফু যয়নব পাগলের মতো তাবু থেকে বের হয়ে আসেন আর কাঁদতে থাকেন। ইমাম হোসাইন তাকে তাবুর মধ্য ফেরত পাঠান আর ছেলের লাশের টুকরোগুলো ভাইয়ের সাহায্য তুলে নিয়ে তাবুর সামনে রাখেন। আলী আকবরের পরে একে একে মুসলিম ইবনে আকিলের ছেলে আবদুল্লাহ, আবদুল্লাহ ইবনে জাফরের ছেলে আওন ও মুহাম্মাদ ময়দানে শহীদ হন। তারপর ইমাম হাসানের ছেলে তলোয়ার হাতে ময়দানে এলেন। কাসেম এত সুদর্শন ছিল যে তার চেহারা চাদের মতো জ্বলজ্বল করত। আমর ইবনে সাদ ইনবে নুফায়েল আবদী তার ঘাড়ের উপর তরবারি দিয়ে আঘাত করে। কাশেম “চাচা বিদায়” বলে একটা চীৎকার করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। ইমাম হোসাইন এই চীৎকারে আর স্থির থাকতে পারলেন না। তিনি সিংহের মতো গর্জে উঠে কাসেমের হত্যাকারী আমরকে আক্রমণ করেন এবং তার বাহু কেটে ফেলেন। আমর চিৎকার করলে কুফীবাহিনীর অশ্বারোহীরা তাকে রক্ষা করার জন্য ছুটে আসে। কিন্তু বেসামাল অবস্থায় তারা তাকে রক্ষা করার পরিবর্তে নিজেদের ঘোড়ার পায়ের চাপায় মেরে ফেলে।
ইতিমধ্যে ইমাম হোসাইনের আর এক ছেলে আবু বকরকে শত্রুরা তীর মেরে শহীদ করে ফেলে। হযরত আলীর ছেলে আব্বাস যখন দেখলেন, পরিবারের সবাই একে একে জীবন উৎসর্গ করেছেন, তখন তিনি তার সৎ ভাই আবদুল্লাহ, জাফর ও উসমানকে বললেনঃ এখন তোমাদের জীবন উৎসর্গের সময় এসে গেছে। অগ্রসর হও আর আল্লাহর পথে জীবন দাও। ফলে তারাও ময়দানে গেলেন এবং শহীদ হয়ে গেলেন।
সবশেষে ইমাম হোসাইন যখন শত্রুদের উপর অপূর্ব বীরত্ব ও পৌরুষত্ত্যের সাথে আক্রমণ চালালেন তখন তা প্রত্যক্ষ করার মতো তার সঙ্গিদের আর কেও জীবিত ছিলনা। কিন্তু আমর ইবনে সাদ ও শিমার বলাবলি করছিল, আজ পর্যন্ত তারা এমন বীর আর দেখেনি। ইমাম হোসাইনের সর্বাঙ্গ তখন ক্ষত বিক্ষত। তিনি ভীষণ পিপাসার্তও ছিলেন। তিনি তার ভাই আব্বাসকে নিয়ে ফোরাত নদীর দিকে চললেন। শত্রুরা তাকে ঠেকাতে চেষ্টা করল। কিন্তু তিনি যুদ্ধ করতে করতে এগিয়ে গেলেন। নদীর কিনারে পৌঁছে ইমাম হোসাইন যখন পানির পেয়ালা পান করতে উদ্যত হলেন তখন হুসাইন ইবনে নুমাইয়ের নিক্ষিপ্ত তীর তার কণ্ঠনালীতে বিধে। তিনি নিজেই তীরটি বের করে ফেলেন এবং পানি পান না করেই তাবুর কাছে ফিরে আসেন।
এর মধ্যে শিমার কয়েকজন ঘোড়সওয়ারকে নিয়ে ইমাম হোসাইনকে ঘিরে ফেলে। ইমাম হোসাইনও একা তাদেরকে বীরত্বের সাথে মোকাবেলা করতে লাগলেন। ইমাম হোসাইনের শরীর ও মাথা মারাত্মকভাবে আহত হয়েছে কিন্তু তারপরও তিনি বীরত্বের সাথে অস্ত্র চালাচ্ছিলেন। এভাবে অনেক সময় কেটে গেল। শত্রুরা চাইলে অনেক আগেই ইমাম হোসাইনকে শহীদ করে ফেলতে পারত। কিন্তু কেওই তার উপর চূড়ান্ত আঘাত হানার গুনাহ নিজের ঘাড়ে নিতে চাচ্ছিল না। প্রত্যেকে চাচ্ছিল কাজটা অন্য কেউ করুক। আর নিজে তা থেকে মুক্ত থাকুক। এই দেখে শিমার ছয় ব্যক্তিকে সাথে করে রাসুলের প্রাণপ্রিয় দৌহিত্র ইমাম হোসাইন রাঃ এর উপর হামলা চালায়। এদের মধ্যে একজন এমনভাবে তরবারি দ্বারা আঘাত করে যে ইমাম হোসাইন এর বাম হাত দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তিনি ডান হাতে তরবারি তুলতে চেষ্টা করেন কিন্তু তার ডান হাত এমনভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছিল যে তিনি ডান হাতেও তরবারি তুলতে পারছিলেন না। পিছন থেকে সানান ইবনে আনাস নাখাঈ নামে একজন সৈনিক এমন করে তাকে লক্ষ্য করে বর্শা নিক্ষেপ করে যে তা ইমাম হোসাইনের পেট ভেদ করে চলে যায়।
এবার রাসুলের প্রাণপ্রিয় দৌহিত্র মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। পাষণ্ড সানান তখন বর্শা টান দিয়ে বের করে। শহীদ হয়ে গেলেন আহলে বায়াতের শেষ প্রদীপ, জান্নাতে যুবকদের সর্দার ইমাম হোসাইন রাঃ। ইন্না লিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজেউন (নিশ্চয় আমরা আল্লাহরই এবং নিশ্চয়ই আমরা তার দিকে প্রত্যাবর্তনকারী) এরপর শিমার মতান্তরে তার নির্দেশে অন্যকেও ইমাম হোসাইনের পবিত্র দেহ থেকে তার মস্তকটি পৃথক করে ফেলে। এরপর ওবাইদুল্লাহ ইবনে যীয়াদের নির্দেশ পালনার্থে বারজন অশ্বারোহী ইমাম হোসাইনের পবিত্র দেহকে দলিত-মথিত করে।
এরপর তারা এগিয়ে যায় তাবুগুলোর দিকে। সেখানে তারা ইমাম হোসাইন ও তার পরিবারের সমস্ত দ্রব্য সামগ্রী লুটপাট করে। শিমার ইমাম হোসাইনের অসুস্থ ছেলে জয়নাল আবেদিনের দিকে এগিয়ে যায় তাকে হত্যার উদ্যেশে। আমর ইবনে সাদ তাকে ধমক দেয় এবং সকলকে বলে লুটকৃত মাল ফেরত দিতে। ইবনে সাদ নারী ও শিশুদেরকে রক্ষণাবেক্ষণের জন্য তাবুতে রক্ষী নিয়োগ করে। ১০ই মুহাররম, আশুরার দিন, ৬১ হিযরী মোতাবেক ১৯ই অক্টোবর ৬৮০ খ্রিস্টাব্দে জোহরের নামাজের পর মুসলিম ইতিহাসের সবচেয়ে মর্মান্তিক ও হৃদয়বিদারক ঘটনা সংগঠিত হয়। সে সময় ইমাম হোসাইন রাঃ এর বয়স ছিল পঞ্চাশ বছর।
ইমাম হোসাইন ও অন্যান্য শহীদদের মস্তকবিহীন দলিত-মথিত দেহ যখন কারবালার ময়দানে পড়ে রয়েছে তখন তা দেখে তাদের পরিবারের মধ্যে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারনা হয়। ইমাম হোসাইনের বোন জয়নব কেঁদে কেঁদে বলতে লাগলেনঃ “… হে আল্লাহর রাসুল দেখুন আপনার হোসাইন রক্ত ও মাটির মধ্যে টুকরো টুকরো হয়ে মরুভূমিতে পড়ে আছে। তার মেয়েরা বন্দী। তার সন্তানেরা নিহত। তাদের লাশের উপরে ধুলাবালি উড়ছে।
এই মর্মস্পর্শী শোকগাথা শুনে কেওই না কেঁদে পারেনি। এসময় শত্রুদের অনেকেই বুঝতে পেরেছিল যে তারা কত বড় গুনা করে ফেলেছে। কিন্তু তখন আর কিছুই করার নেই। সব শেষ হয়ে গেছে। আমর ইবনে সাদ তার বাহিনী নিয়ে কারবালা থেকে বিদায় নেবার পর নিকটবর্তী গায়েরিয়ার অধিবাসীরা সেখানেই ইমাম হোসাইনকে সমাহিত করেন। ইমাম হোসাইনের ছেলে আলীকে তার পায়ের কাছে দাফন করা হয়। তার পরিবারের অন্যান্য সদস্যদেরকে একসাথে এক কবরে দাফন করা হয়। ইমাম হোসাইনের মাথা সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মতভেদ রয়েছে। কারো মতে তার মাথা মদিনাতে পাঠানো হয়েছিলো এবং সেখানেই দাফন করা হয়। আবার অনেকে অন্যান্য স্থানের নাম উল্ল্যেখ করেছেন।
আহলে বায়াতের কাফেলা সিরিয়ায়
ইমাম হোসাইন এর মৃত্যুর পর তার পরিবারকে বন্দী করা হয় এবং ইবনে যীয়াদের নির্দেশে ইমাম হোসাইনের খণ্ডিত মস্তক ও তার পরিবারকে কুফাতে হাজির করা হয়। পরিবারের সদস্যদের মধ্যে শিশু পুত্র জয়নাল আবেদিন ছাড়া আর কোন পুরুষ সদস্য ছিলনা।
এই কাফেলাকে যখন ইবনে যীয়াদের সামনে বন্দী অবস্থায় হাজির করা হয়, তখন ইবনে যীয়াদকে খুবই উল্লসিত দেখাচ্ছিল। সে কুফাবাসীকে তার ভবনের সামনে আসার অনুমুতি দিল। একটি ট্রেতে করে ইমাম হোসাইনের পবিত্র মস্তককে ইবনে যীয়াদের সামনে রাখা হল। ইবনে যীয়াদ মস্তকটি দেখে মুচকি হাসতে লাগল আর তার ছড়ি দিয়ে বারবার ইমাম হোসাইনের ঠোটে খোচা দিতে লাগলো। ইবনে যীয়াদের ডান পাশে রাসুল সাঃ এর সাহাবী অতীব বৃদ্ধ যায়েদ ইবনে আরকাম রাঃ বসা ছিলেন। ইবনে যীয়াদের এই বেয়াদবি তিনি সহ্য করতে পারলেন না। তিনি চেচিয়ে বললেনঃ তোমার ছড়িটা সরিয়ে নাও। আল্লাহর কসম, আমি স্বচক্ষে বহুবার রাসুল সাঃ কে এই ঠোটে চুমু খেতে দেখেছি।এই বলে তিনি কাঁদতে লাগলেন। ইবনে যীয়াদ বললঃ তুমি থুতুতে বুড়ো হয়ে গেছ বলে তোমাকে ছেড়ে দিলাম। নচেৎ তোমার কল্লাও উড়িয়ে দিতাম। যায়েদ ইবনে আকরাম রাঃ বদদুআ করতে করতে দরবার থেকে উঠে গেলেন।
এরপরদিন ইবনে যীয়াদ আহলে বায়াতের কাফেলাকে দামেস্কে ইয়াযিদের কাছে পাঠিয়ে দেয়। ইয়াযিদের দরবারে বন্দী অবস্থায় হাজির করা হয় আহলে বায়াতের সদস্যদেরকে। আর তার সামলে ট্রেতে রাখা হয় ইমাম হোসাইনের মস্তক। এ দৃশ্য দেখে কেঁদে উঠেন ইমাম হোসাইনের পরিবারের সদস্যরা। বিষয়টি অনুধাবন করতে পেরে ইয়াযিদ মস্তকটি সরিয়ে রাখার নির্দেশ দিলেন। এরপর তিনি উপস্থিত সভাসদবৃন্দদেকে বললেনঃ “ইমাম হোসাইনের মাতা আমার মায়ের চেয়ে উত্তম ছিলেন। তার নানা মুহাম্মাদ সাঃ ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ রাসুল ও মানবজাতির নেতা। কিন্তু তার পিতা আলী ও আমার পিতা মুয়াবিয়ার মধ্যে ঝগড়া হয়েছিলো।
যেভাবে আমার ও হোসাইনের মধ্যে হয়েছে। আলী ও হোসাইন উভয়ই বলতেন, যার বাপ দাদা শ্রেষ্ঠ সেই খলীফা হবেন। কিন্তু কোরআন এর এই আয়াতের দিকে তারা লক্ষ্য করেনি। যাতে বলা হয়েছেঃ ‘ বল, হে সার্বভৌম শক্তির মালিক আল্লাহ! তুমি যাকে ইচ্ছা ক্ষমতা দান কর এবং যার নিকট থেকে ইচ্ছা ক্ষমতা কেড়ে নাও; যাকে ইচ্ছা তুমি পরাক্রমশালী কর; আর যাকে ইচ্ছা তুমি হীন কর। কল্যান তোমার হাতেই; নিশ্চয় তুমি সর্ব বিষয়ে সর্ব শক্তিমান’(৩; ২৬)”। এরপর তিনি ইমাম হোসাইনের পরিবারের কাছে এলেন। তাদের উদ্দ্যেশে বললেনঃ যা কিছু ঘটেছে তা আমার অগোচরে ঘটেছে। আমি ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকলে অবশ্যই হোসাইনকে ক্ষমা করে দিতাম এবং মহানুভবতার পরিচয় দিতাম।”
তিনি জয়নুল আবেদিনের শিকল খুলে দিতে বললেন। এবার তার দিকে এগিয়ে গিয়ে বললেনঃ “ হে আলী তোমার বাবা আমার সাথে আত্মীয়সুলভ আচরণ করেনি। আমার অধিকার নষ্ট করেছে। এ কারণে আল্লাহ তার কি দুর্গতি করেছেন, তা তুমি দেখেছ।”
এরপর তিনি শিমারের দিকে ফিরলেন। বললেনঃ এই সুমাইয়ার বাচ্চাকে আমি কখন নির্দেশ দিয়েছিলাম যে, হোসাইন ইবনে আলীকে হত্যা করো? আমি তোমাদের আনুগত্যে এমনিতেই সন্তুষ্ট। তোমরা হোসাইনকে হত্যা করতে গেলে কেন? ইয়াযিদের এ কথায় শিমার ও তার সঙ্গীরা ধাক্কা খেল। কারন তারা ধারণা করেছিল ইয়াযিদ তাদেরকে পুরস্কৃত করবে বা কোন উপঢৌকন দিবে। কিন্তু ইয়াযিদ তার কিছুই করলো না। বরং উম্মা প্রকাশ করে তাদের সবাইকে ফেরত যেতে বলল।
এরপর ইয়াযিদ আহলে বায়াতের সকলকে তার সন্মানিত মেহমান করে নিজ প্রাসাদে থাকতে দেন। কিছুদিন সেখানে অবস্থান করার পর তিনি তাদেরকে স্ব-সন্মানে মদিনাতে পাঠিয়ে দেন। তিনি ইমাম হোসাইনের পরিবারকে সর্বপ্রকার আর্থিক সাহায্য প্রদান করেন এবং আলী ইবনে হোসাইনকে সর্বপ্রকার সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেন।
ইয়াযিদের আচরণে ইমাম হোসাইনের পরিবার খুশি হয়েছিল। ইমাম হোসাইনের মেয়ে সাকীনা পরে বলেনঃ “ আমি অনেক অকৃতজ্ঞ মানুষ দেখেছি। কিন্তু তাদের কাউকে ইয়াযিদের মতো ভদ্র ও সদাচারী দেখিনি।”
ইমাম হোসাইন রাঃ এর শাহাদতে জড়িতদের করুন পরিণতি
ফোরাত নদীতে পানি পান করতে গিয়ে তীরের আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত ইমাম হোসাইন রাঃ আল্লাহর দরবারে এই বলে মুনাজাত করেছিলেন – হে আল্লাহ! তোমার রাসুলের আদরের দৌহিত্রের সাথে আজ যারা এই অমানবিক আচরণ করেছে তাদের বিরুদ্ধে আমি তোমার দরবারে নালিশ পেশ করছি। তাদেরকে একজন একজন করে তুমি ধ্বংস করে দাও। কাওকে রেহাই দিওনা।
মজলুমের প্রার্থনা কবুল হতে দেরি হয় না। তার উপর রাসুলের দৌহিত্রের পবিত্র কণ্ঠে যে দোয়া বেরিয়েছে তা কবুল না হবার প্রশ্নই উঠেনা। ফলে দেখা গেছে দুনিয়ার বুকেই তাদের কঠিন শাস্তি পেতে হয়েছে। এই পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডে জড়িত কেও রেহাই পায়নি।
কারবালার হত্যাকাণ্ড ও মদিনা আক্রমণের পর ইয়াযিদের বিরুদ্ধে গন বিদ্রোহ সংগঠিত হয়। মাত্র ৩ বছর রাজত্ব করার পর ৪৩ বছর বয়সে সে মারা যায়।
ইবনে কাসীর বলেনঃ ইমাম হোসাইনের শাহাদতের পর যে সকল দুর্যোগ সংগঠিত হবার ঘটনা ইতিহাসে পাওয়া যায় তার বেশির ভাগই সত্য। তার হত্যাকারীদের প্রত্যেকেই কোন না কোন ভাবে আযাব ভোগ করেছে।
ইমাম জাওযী রঃ বর্ণনা করেনঃ একজন বৃদ্ধ লোক ইমাম হোসাইনের হত্যাকাণ্ডে অংশগ্রহন করেছিলো। সে হঠাৎ অন্ধ হয়ে যায়। তখন লোকেরা তাকে জিজ্ঞেস করলে সে বলেঃ আমি স্বপ্নে রাসুল সাঃ কে দেখলাম। তিনি তার জামার হাতা গুটিয়ে আছেন। তার হাতে তলোয়ার রয়েছে এবং সামনে রয়েছে চামড়ার বিছানা, যার উপর মানুষকে হত্যা করা হয়। যার উপর ইমাম হোসাইন রাঃ এর হত্যাকারীদের দশ জনের লাশ জবেহ করা অবস্থায় পড়ে আছে। এরপর তিনি আমাকে ডাকলেন এবং হোসাইনের রক্তে রঞ্জিত একটি লাঠি আমার চোখে লাগিয়ে দিলেন। সকালে যখন আমি ঘুম থেকে উঠলাম তখন আমি অন্ধ।
ইমাম ইবনে জাওযী আরও বর্ণনা করেন, যে ব্যক্তি ইমাম হোসাইনের মাথা মোবারক ঘোড়াতে লোটকিয়েছিল পরে তার অবস্থা এমন দেখা গিয়েছিল যে তার চেহারা আলকাতরার মত বিবর্ণ হয়ে গেছে। তাকে জিজ্ঞেসা করা হল যে তুমি তো আরবের মধ্যে সবচেয়ে সুশ্রী ছিলে। এখন তোমার চেহারা এমন হল কিভাবে? সে বললঃ যেদিন আমি ইমাম হোসাইনের মস্তক ঘোড়ার গলায় লটকিয়ে ছিলাম, সেদিন থেকে যখনই আমি একটু ঘুমিয়ে পড়ি তখন দুজন লোক এসে আমার বাহু ধরে জলন্ত অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করে। যা আমাকে ঝলসে দেয়। এভাবে কিছুদিন চলার পর ঐ ব্যক্তি মারা যায়।
ইবনে জাওযীর আরেক বর্ণনায় এসেছেঃ “এক ব্যক্তিকে নিমন্ত্রন করা হল। উপস্থিত মজলিসে কথা প্রসঙ্গে বলা হল, ইমাম হোসাইনের হত্যায় যারা শরীক ছিল তাদের সকলকেই দুনিয়াতে কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হয়েছে। উপস্থিত লোকটি বললঃ এটা সম্পূর্ণ ভুল কথা। আমি ঐ হত্যাকাণ্ডে শরিক ছিলাম কিন্তু আমার কিছু হইনি। সেই ব্যক্তি মজলিস শেষে বের হলে আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায়। সুদ্দি রঃ বলেনঃ আমি নিজেই প্রত্যুষে যখন তাকে দেখি তখন সে কয়লায় পরিনত হয়েছে।”
যে ব্যক্তি ইমাম হোসাইনকে তীর মেরেছিলো এবং তাকে পানি পানের সুযোগ দেয়নি, আল্লাহ তার উপর পিপাসার এমন শাস্তি প্রদান করেন যে, কোনভাবেই তার পিপাসা দূর হচ্ছিল না। যত পানিই সে পান করুক না কেন কোনভাবেই তার পিপাসা দূর হচ্ছিল না। এভাবে চললে চলতে এক সময় সে তার পেট ফেটে মারা যায়।
ইমাম হোসাইনের শাহাদতের মাত্র পাঁচ বছর পরে হিজরি ৬৬ সালে মূকতার সাকাফী যখন ইমাম হোসাইনের হত্যাকারীদের কিসাস গ্রহণের ইচ্ছা প্রকাশ করেন তখন সর্ব সাধারন তাকে সমর্থন প্রদান করে। ফলে কিছুদিনের মধ্যে তিনি বিপুল শক্তি অর্জন করেন এবং কুফা ও ইরাকের উপর আধিপত্য বিস্তার করেন। দেশের ক্ষমতা লাভের পর তিনি সাধারণ ঘোষণা প্রদান করেন যে, ইমাম হোসাইনের হত্যাকারী ছাড়া বাকী সকলের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেয়া হল। তিনি একদিনে যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ২৪০ জনকে হত্যা করেন।
আমর ইবনে হাজ্জাজ ইমাম হোসাইনের হত্যাকারী ছিলো। সে কুফা থেকে পালিয়ে বাঁচতে চেয়েছিল। কিন্তু সে মুকতারের লোকের হাতে নিহত হয়। মূকতার বাহিনী শীমারকে হত্যা করে তার লাশ কুকুরকে দিয়ে খাওয়ায়।
ওবাইদুল্লাহ ইবনে যীয়াদও মুখতারের সেনপতি আল-আশতারের হাতে নিহত হয় এবং মাথা মুখতারের কাছে পাঠানো হয়।
আমর ইবেন সাদ ও তার ছেলেকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। ইমাম হোসাইনের হত্যাকারীদের মধ্যে যারা পালিয়ে বেচে যায় মুখতার তাদের বাড়িঘর সব জ্বলিয়ে পুড়িয়ে দেয়।
ইবনে যীয়াদ ও আমর ইবনে সাদ এর মাথা কেটে মূকতার ইমাম হোসাইনের ছেলে জয়নুল আবেদিনের কাছে পাঠিয়ে দেন। জয়নুল আবেদিন তা দেখে সিজদায় চলে যান এবং বলেনঃ “আল্লাহর শোকর, যিনি আমার শত্রুদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিয়েছেন।”
মোট কথা ইমাম হোসাইন রাঃ এর বিরুদ্ধে যুদ্ধে ও ষড়যন্ত্রে অংশগ্রহণকারী প্রত্যেককেই আল্লাহ ধ্বংস করে দেন।
— আমিন