তাবুক যুদ্ধে মুনাফিকদের কার্যাবলী

তাবুক যুদ্ধে মুনাফিকদের কার্যাবলী
এক দিকে প্রচণ্ড গরম, অপর দিকে মৌসুমের ফসল -খেজুর কাটার সময় অতি সন্নিকটে, এমনি প্রতিকুল মুহূর্তে যখন মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তার সাহাবীগণ রাযি. রোমীয় সৈন্যবাহিনীর বিরুদ্ধে তাবুক যুদ্ধের দীর্ঘ সফরের প্রস্তুতি গ্রহণ করছিলেন, তখন মুনাফিকরা সাধারণ লোকদেরকে অত্যাধিক গরম দীর্ঘ সফরের কষ্ট ক্লেশ ও প্রতিপক্ষের প্রবল শক্তিশালী হওয়া ইত্যাদির ভয় দেখিয়ে যুদ্ধে না যাওয়ার ব্যাপারে প্ররোচিত করছিল। এ উদ্দেশ্যে তারা এক ইয়াহুদীর বাড়ীতে একত্রিত হয়ে শলা-পরামর্শও করল। সংবাদ পেয়ে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উক্ত ইয়াহুদীর বাড়ী জ্বালিয়ে দেয়ার আদেশ দেন। মুনাফিক নেতা আব্দুল্লাহ বিন উবাই প্রথমে তার অনুসারী বিরাট দল নিয়ে যুদ্ধে যাওয়ার প্রস্তুতি দেখিয়েও রওয়ানা হওয়ার মূহুর্তে পিছু টান দেয়।
তাবুক যুদ্ধে যাওয়ার সময় মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আলী রাযি. কে আহলে বাইতের দেখা শুনা করার জন্য মদীনায় রেখে গিয়ে ছিলেন। তখন মুনাফিকরা বলাবলি করতে লাগলো যে, আলীর রাযি. প্রতি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অসন্তুষ্ট তাই তাকে যুদ্ধে নিয়ে যাননি। শেরে খোদা হযরত আলী রাযি. একথা শুনে তক্ষুনি যুদ্ধ সাজে সজ্জিত হয়ে জরুফ নামক স্থানে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মনযিলে গিয়ে উপস্থিত হলেন এবং জিজ্ঞাসা করলেন যে, মুনাফিকরা এমন বলাবলি করছে। আপনি কি সত্যিই এজন্য আমাকে মদীনায় রেখে এসেছেন ? মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন- তারা মিথ্যা বলছে আমি আমার পরিবার পরিজনের জন্য তোমাকে আমার স্থলাভিষিক্ত করে এসেছি। হে আলী! তুমি কি আমার জন্য এরূপ হতে সন্তুষ্ট নও যেরূপ ছিলেন হযরত হারুন আ., হযরত মুসা আ. এর জন্য। অবশ্য আমার পর আর কোন নবী নেই। তখন হযরত আলী রাযি. মদীনায় ফিরে এলেন।
তাবুক যুদ্ধে যাওয়ার সময় পথিমধ্যে একবার মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উট হারিয়ে গেলে এক মুনাফিক বলতে লাগলো মুহাম্মদ নবী হওয়ার দাবী করে এবং লোকদেরকে ‘আসমানের সংবাদ শোনায়। অথচ স্বীয় উটের সংবাদ তার জানা নেই। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ এক ব্যক্তি এরূপ বলছে আমি আল্লাহর শপথ করে বলছি আমার মাওলা আমাকে যা জানান তা ছাড়া আমার কিছুই জানা নেই। আর উটের সংবাদ আমাকে আল্লাহ তা’আলা জানিয়ে দিয়েছেন। উপত্যকার একটি ঘাটিতে গাছের সাথে তার দড়ি পেঁচিয়ে যাওয়ার সে আটকে রয়েছে কেউ গিয়ে নিয়ে এস।
এক দল মুনাফিক পথিমধ্যে মুসলমানদের হীনবল করার উদ্দেশ্যে তাদের এই বলে ভয় দেখাচ্ছিল যে, তোমরা কি রোমীয় সৈন্যদের বীরদের আরব যোদ্ধাদের ন্যায় অপরিপক্ক ভেবেছ? মাথা দেখে নিও। সবাইকে রশি দিয়ে বেধে রেখে দেবে। তাদের মধ্যে হতে একজন মুনাফিক বলল তোমরা সাবধানে কথা বলো তোমাদের উপর না জানি একশ করে চাবুক মারার আদেশ হয় এবং আমাদের সম্পর্কে কুরআন নাযিল হয় যে তাতে আমাদের এই কথোপকথন প্রকাশ করে দেয়া হয়। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আম্মার রাযি. কে তাদের নিকট জিজ্ঞাসা করার জন্য পাঠালেন তারা সবাই মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দরবারে উপস্থিত হয়ে বলতে লাগলো যে, আমরা ঠাট্টা বশতঃ পরস্পর এরূপ বলছিলাম।
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে হত্যার লোমহর্ষক ষড়যন্ত্রঃ তাবুক হতে প্রত্যাবর্তনের পর কতিপয় মুনাফিক গোপনে পরামর্শ করলো যে, যখন মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পাহাড়ের উঁচু সরু পথে আরোহণ করবেন, তখন ধাক্কা দিয়ে নীচে ফেলে তাকে হত্যা করা হবে। এ উদ্দেশ্যে উল্লেখিত ষড়যন্ত্রকারীরা হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সঙ্গে সঙ্গে চলতে লাগলো। ওহীর মাধ্যমে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের এ ষড়যন্ত্র সম্পর্কে অবহিত হয়ে গিয়েছিলেন। অতঃপর তিনি পাহাড়ের সুরু রাস্তার নিকট পৌঁছে বললেন- যার ইচ্ছে হয় সে এই পর্বত উপত্যকার প্রশস্ত রাস্তা দিয়ে যেতে পারে- অথবা পাহাড়ের উপর সরুপথ দিয়ে যেতে পারে, এই বলে নিজে পাহাড়ের উপর সরু রাস্তা দিয়ে যেতে লাগলেন। ষড়যন্ত্রকারী দল মোক্ষম সুযোগ বুঝে রাত্রির অন্ধকারে মুখোশ পরিধান করে এই সরুপথ দিয়ে ‘আসতে লাগল।
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সঙ্গে তখন ছিলেন শুধু হযরত হুযাইফা রাযি. ও হযরত আম্মার রাযি. হযরত হুযাইফা রাযি. পিছনে ছিলেন। হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উক্ত সুরু পথে আরোহণ করলে পিছন হতে উল্লেখিত অভিশপ্ত দলের আগমনের আওয়াজ শোনা গেল। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর চেহারায় তখন ক্রোধের লেলিহান শিখা জ্বলছিল। তিনি তাদেরকে পেছনে বিতাড়িত করার আদেশ করলেন। হযরত হুযাইফা রাযি. পিছন ফিরে তাদের উটের মুখে তীর নিক্ষেপ করলেন। যখন তারা হযরত হুযাইফার রাযি. সম্মুখে উপস্থিত হল তখন তারা ঘটনা জানাজানি হয়ে গেছে ভেবে তারা ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে দ্রুত গতিতে পিছনে ফিরে কাফেলার সাথে মিলিত হয়ে গেল। হযরত হুযাইফা রাযি. তাদের বিতাড়িত করে ফিরে এলে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দ্রুত উট চালানোর আদেশ করেন।
অতঃপর সরু রাস্তা অতিক্রম করে উপত্যকা ঘুরে আসা কাফেলার অপেক্ষায় রইলেন। হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত হুযাইফা রাযি. কে জিজ্ঞাসা করলেন তুমি ঐ দলটিকে চিনেছ? তিনি আরজ করলেন সওয়ারী কার কার ছিল তা তো চিনেছি। কিন্তু আরোহণকারীদের চিনতে পারিনি। হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞাসা করলেন- তুমি তাদের উদ্দেশ্য বুঝেছ? তিনি আরজ করলেন, না। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন- তাদের উদ্দেশ্য ছিল আমাদেরকে পাহাড়ের উপর হতে ফেলে দিয়ে হত্যা করা। আর বললেন যে, ঘটনা এখন কারো নিকট প্রকাশ করো না। আল্লাহ তা’আলা আমাকে তাদের উদ্দেশ্য ও সকলের নাম জানিয়ে দিয়েছেন। ইনশাল্লাহ সকালে প্রকাশ করে দেবো।
ইবনে ইসহাক রহ. বর্ণনা করেন যে, সকালে উঠে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নাম উল্লেখ পূর্বক তাদের বক্তব্য তুলে ধরলেন। তাদের মধ্যে হতে ‘জুল্লাস’ নামক মুনাফিক বলেছিল- “আজকের রাতে আমরা মুহাম্মাদকে পাহাড়ের উপর হতে নিক্ষেপ করেই ছাড়ব। যদিও মুহাম্মদ ও তার সাহাবীরা রাযি. আমাদের চেয়ে উত্তম হোক না কেন। আমরা ছাগলের পাল আর তারা আমাদের চেয়ে উত্তম হোক না কেন। আমরা ছাগলের পাল আর তারা আমাদের রাখাল। আমরা তো নির্বোধ আর তারা বুঝি খুব বুদ্ধিমান।”
আব্দুল্লাহ বিন উয়াইনা তার সঙ্গীদের বলেছিল- “আজকের রাতটি জাগ্রত থাকতে পারলে তোমরা চিরদিন শান্তিতে থাকতে পারবে। আজ তোমাদের শুধু একটিই কাজ এই ব্যক্তিকে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হত্যা করে ফেল।” হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে জিজ্ঞাসা করলেন- “আমি নিহত হলে তোমার কি লাভ হতো?” সে তখন কাকুতি-মিনতি শুরু করলে হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে ছেড়ে দেন। মুররা বিন রাবী বলেছিল আমরা একটি মানুষকে (অর্থাৎ মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে হত্যা করতে পারলে সবাই পরিত্রাণ পেয়ে যাবো। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বার জনের প্রত্যেকের কথোপকথন ও তাদের অন্তরের কুমতলব বলে দেন।
হিসন বিন নামীরকে হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞাসা করলেন যে তুমি এরূপ কেন করেছিলে ? সে উত্তর দিল আমার বিশ্বাস ছিল না যে আপনি এই ষড়যন্ত্র অবগত হবেন। এখন বুঝতে পারছি যে, আপনি সত্যিই আল্লাহর নবী। এত দিন আমি আন্তরিকভাবে মুসলমান ছিলাম না। এখন অন্তর হতে ঈমান এনেছি। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে ক্ষমা করে দেন। কিন্তু মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের কাউকে হত্যার আদেশ করেননি। কারণ দয়ার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ব্যক্তিগত কোন ব্যাপারে কখনো কারো নিকট হতে কোনরূপ প্রতিশোধ গ্রহণ করেননি। তাছাড়া কাফিরদের নিকট মুসলমান বলে পরিচিত মুনাফিকদের হত্যা না করার কতগুলো রাজনৈতিক কারণও ছিল। যথাঃ
১. যুদ্ধ ক্ষেত্রে মুসলমানদের দল ভারী দেখিয়ে কাফিরদের ভীতি প্রদর্শন করা।
২. শত্রুরা যাতে এই বলে বদনাম রটাতে না পারে যে, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বীয় লোকদেরকে হত্যা করে।
৩. তাছাড়া মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জীবদ্দশায় মুনাফিকরা বিভিন্ন ষড়যন্ত্র করলেও তাতে ইসলামের তেমন ক্ষতি করতে পারত না। কেননা তাদের সব ষড়যন্ত্রই আল্লাহ তা’আলা ওহীর মাধ্যমে হুজুরসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে অবগত করে দিতেন। তাই মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জীবদ্দশায় মুনাফিকদের হত্যা করা হতো না।
এরূপ আরো কতগুলো দীনী ও রাজনৈতিক বিশেষ হিকমতের কারণে তাদের সম্পূর্ণ পরিচয় জানা থাকা স্বত্বেও মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের বাহ্যিক ঈমানের উপর ভিত্তি করেই কিছু বলতেন না বরং তাদের সাথে মুসলমানদের মত আচরণ করতেন। দলীয় প্রমাণাদি দিয়ে তাদেরকে সত্য বুঝাতে চেষ্টা করতেন। তবে তাদের সাথে এতটা আন্তরিকতা প্রদর্শন করতেন না, যা হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর স্বভাব ছিল। বরং কিছুটা কর্কশ ও বিমাতা সুলভ আচরণই করতেন এবং কোন কোন ক্ষেত্রে তাদের শাসাতেন। কোন ধরনের পরামর্শ সভায় তাদের উপস্থিতি মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অত্যন্ত অপ্রিয় ছিল।
গল্পের বিষয়:
ইসলামিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত