খোদাভীতি ও পরহেযগারি

খোদাভীতি ও পরহেযগারি
তাকওয়া ও খোদাভীতি ইসলামের মৌলিক শিক্ষার মধ্যে গণ্য। এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, আল্লাহ তাআলার আযাব ও আখেরাতের জবাবদিহিতাকে স্মরণ করে সকল প্রকার মন্দকর্ম থেকে বিরত থাকা এবং আল্লাহ পাকের সমস্ত বিধানাবলি মেনে চলা। অর্থাৎ যে বিষয়গুলি আল্লাহ পাক আমাদের উপর ফরজ করেছেন এবং আমাদের প্রত্যেকের জন্য প্রত্যেকের উপর যে হকসমূহ আল্লাহ পাক নির্ধারণ করে দিয়েছেন তা আন্তরিকভাবে আদায় করা এবং আল্লাহ তাআলার নিষেধ-করা বিষয় থেকে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করা। কোরআন ও হাদীসের বহু জায়গায় বহুবার তাকওয়া অর্জনের উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। আল্লাহ পাক এরশাদ করেন,
يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ حَقَّ تُقَاتِهِ وَلَا تَمُوتُنَّ إِلَّا وَأَنْتُمْ مُسْلِمُونَ
হে ঈমানদারগণ! আল্লাহকে ভয় করো যেমন ভয় করা উচিৎ (এবং শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করা পর্যন্ত তাকওয়া ও খোদাভীতির ছায়াতলে দ্বীনের হুকুম-আহকাম মেনে চলতে থাকো,) যেন আল্লাহ তাআলার আনুগত্যে নিমগ্ন
অবস্থায় তোমাদের মরণ হয়। সূরা আলে ইমরান ৩/১০২
অন্য আয়াতে বলেন,
فَاتَّقُوا اللَّهَ مَا اسْتَطَعْتُمْ وَاسْمَعُوا وَأَطِيعُوا
আল্লাহ তাআলাকে যথাসম্ভব ভয় করো এবং তাঁর হুকুম-আহকাম (আলেমগণের কাছ থেকে) শোনো ও মানো। সূরা তাগাবুন ৬৪/১৬
আরেকটি আয়াতে আল্লাহ পাক বলেন,
يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ وَلْتَنْظُرْ نَفْسٌ مَا قَدَّمَتْ لِغَدٍ وَاتَّقُوا اللَّهَ إِنَّ اللَّهَ خَبِيرٌ بِمَا تَعْمَلُونَ
হে ঈমানদারগণ! তোমরা খোদাভীতির গুণ অর্জন করো, আর আগামী দিনের জন্য কী আমল করেছো তা ভেবে দেখো। সুতরাং আল্লাহকে ভয় করো, যিনি তোমাদের কাজকর্ম সম্পর্কে অবগত। সূরা হাশর ৫৯/১৮
যারা আল্লাহ তাআলাকে ভয় করে এবং তাকওয়ার যিন্দেগী গড়ে তোলে, দুনিয়াতেই আল্লাহ পাক তাদের প্রতি বিশেষ দয়া ও করুণার আচরণ করে থাকেন। আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন,
وَمَنْ يَتَّقِ اللَّهَ يَجْعَلْ لَهُ مَخْرَجًا. وَيَرْزُقْهُ مِنْ حَيْثُ لَا يَحْتَسِبُ
যার দিলে খোদার ভয় রয়েছে এবং যে তাকওয়ার জীবন যাপন করে, আল্লাহ পাক তাকে সমস্যা থেকে উত্তরণের পথ খুলেই দেন এবং এমন উপায়ে জীবিকা দান করেন, যা তার কল্পনাতেও আসে না। সূরা তালাক ৬৫/২-৩
যাদের জীবন তাকওয়াপূর্ণ তারা আল্লাহপাকের ওলী ও দোস্ত। কোনো কিছুতে তাদের দুঃখ-ভয় থাকে না। আল্লাহ পাক বলেন,
أَلَا إِنَّ أَوْلِيَاءَ اللَّهِ لَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُونَ
ওহে! যারা আল্লাহর ওলী, তাদের কোনো দুঃখ-দুশ্চিন্তা নেই। তারা হলো সত্যিকারের ঈমান ও তাকওয়ার অধিকারী। দুনিয়া ও আখেরাতের উভয় জীবনে তাদের জন্য সুসংবাদ ! সূরা ইউনুস ১০/৬২
আখেরাতে মুত্তাকী পরহেজগার ব্যক্তি কী অশেষ নেয়ামত লাভ করবে তার সামান্য ঝলক রয়েছে সামনের আয়াতে। আল্লাহ পাক বলেন,
قُلْ أَؤُنَبِّئُكُمْ بِخَيْرٍ مِنْ ذَلِكُمْ لِلَّذِينَ اتَّقَوْا عِنْدَ رَبِّهِمْ جَنَّاتٌ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا وَأَزْوَاجٌ مُطَهَّرَةٌ وَرِضْوَانٌ مِنَ اللَّهِ وَاللَّهُ بَصِيرٌ بِالْعِبَادِ
(হে নবী!) আপনি বলুন, আমি কি তোমাদেরকে সেই বস্তুর কথা বলবো, যা তাবৎ পৃথিবীর সমুদয় কাম্য বস্তু হতেও উত্তম? শোনো তাহলে, এমন জান্নাত ও বাগানবাড়িসমূহ, যা তাকওয়া অবলম্বনকারীদের জন্য তাদের প্রতিপালকের নিকট প্রস্তুত রয়েছে, যার পাদদেশ দিয়ে নহরমালা প্রবহমান। মুত্তাকীরা অনন্তকাল সেখানে অবস্থান করবে। সেখানে থাকবে তাদের জন্য পূতপবিত্র সঙ্গিনী, আর থাকবে আল্লাহ পাকের পক্ষ হতে বিশেষ রেজা ও সন্তুষ্টি। আর বান্দাদের তাকওয়ার বিষয়ে আল্লাহ তাআলা খুবই অবগত। সূরা আলে ইমরান ৩/১৫
আরেকটি আয়াতে আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন,
وَإِنَّ لِلْمُتَّقِينَ لَحُسْنَ مَآبٍ. جَنَّاتِ عَدْنٍ مُفَتَّحَةً لَهُمُ الْأَبْوَابُ. مُتَّكِئِينَ فِيهَا يَدْعُونَ فِيهَا بِفَاكِهَةٍ كَثِيرَةٍ وَشَرَابٍ. وَعِنْدَهُمْ قَاصِرَاتُ الطَّرْفِ أَتْرَابٌ .هَذَا مَا تُوعَدُونَ لِيَوْمِ الْحِسَابِ إِنَّ هَذَا لَرِزْقُنَا مَا لَهُ مِنْ نَفَادٍ
এটা সুনিশ্চিত যে, মুত্তাকীদের জন্য রয়েছে উত্তম ঠিকানা, চিরবসন্তময় বেহেশত-বাগান। দরজাগুলি পূর্ব হতেই তাদের আগমন-অপেক্ষায় উন্মুক্ত। সেখানে তারা হেলান দিয়ে বসে নানারকম ফলফলাদি ও কোমল পানীয় তলব করতে থাকবে, পাশে থাকবে তাদের আনত নয়না সমবয়সী প্রিয়তমাগণ। হিসাবের দিনটি সামনে রেখে তোমাদেরকে এ-অপূর্ব নেয়ামতের প্রতিশ্রুতি দেয়া হচ্ছে। নিশ্চয় এটা হবে আমার দেয়া এমন রিযিক ও নেয়ামত, যা কখনো শেষ হবার নয়। সূরা সাদ ৩৮/৪৯-৫৪
কোরআন শরীফের এক জায়গায় আল্লাহ পাক এ সুসংবাদ দান করেছেন যে, তাকওয়াবান ব্যক্তি স্বীয় প্রতিপালকের একান্ত নৈকট্যপূর্ণ সম্মান লাভ করবে। এরশাদ হচ্ছে,
إِنَّ الْمُتَّقِينَ فِي جَنَّاتٍ وَنَهَرٍ. فِي مَقْعَدِ صِدْقٍ عِنْدَ مَلِيكٍ مُقْتَدِرٍ
মুত্তাকীদের নিবাস হবে স্বর্গীয় উদ্যান ও নহরমালার উপর। বিশ্বজগতের পূর্ণ ক্ষমতাধর মালিকের নিকট তাদের জন্য থাকবে সম্মানজনক আসন। সূরা কামার ৫৪/৫৪-৫৫
তাকওয়া হলো আল্লাহ পাকের নিকট ইজ্জত ও সম্মানের মানদ-। আল্লাহ পাক বলেন,
إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللَّهِ أَتْقَاكُمْ
তোমাদের মাঝে যে অধিক তাকওয়াবান, সে-ই আল্লাহ পাকের নিকট অধিক মর্যাদাবান। সূরা হুজুরাত ৪৯/১৩
একটি হাদীসে নবীজী ইরশাদ করেন,
إِنَّ أَوْلَى النَّاسِ بِي الْمُتَّقُونَ مَنْ كَانُوا وَحَيْثُ كَانُوا
আমার সবচেয়ে আপন ও প্রিয়জন হলো যে তাকওয়াবান। এখন সে যেই দেশের, যে বংশের বা যে গোত্রেরই হোক না কেন। মুসনাদে আহমদ, হাদীস নং ২২০৫২
খোদাভীতি, পরকালভাবনা ও তাকওয়া হলো সকল নেক কাজের সূতিকাগার। যার ভিতর যত বেশী তাকওয়া থাকবে, তার ভিতর তত বেশী ভালো গুণ একত্রিত হবে, সে তত বেশী মন্দ থেকে দূরে থাকতে পারবে। হাদীস শরীফে এসেছে,
يَا رَسُولَ اللَّهِ، إِنِّي قَدْ سَمِعْتُ مِنْكَ حَدِيثًا كَثِيرًا أَخَافُ أَنْ يُنْسِيَنِي أَوَّلَهُ آخِرُهُ، فَحَدِّثْنِي بِكَلِمَةٍ تَكُونُ جِمَاعًا قَالَ: اتَّقِ اللَّهَ فِيمَا تَعْلَمُ. هَذَا حَدِيثٌ لَيْسَ إِسْنَادُهُ
بِمُتَّصِلٍ، وَهُوَ عِنْدِي مُرْسَلٌ
এক সাহাবী নবীজীর নিকট আরজ করলেন, হে আল্লাহর রাসুল! আমি আপনার বহু উপদেশ ও নসীহত শুনেছি। আমার আশংকা, এই সবগুলি আমি স্মরণ রাখতে পারবো না। সুতরাং আমাকে এমন একটি পূর্ণাঙ্গ উপদেশ দান করুন, যা আমার পুরো জীবনের জন্য যথেষ্ট হয়ে যাবে। নবীজী বললেন, নিজের জানাশোনা মতো আল্লাহকে ভয় করতে থাকো এবং তাকওয়ার সঙ্গে জীবন যাপন করো। সুনানে তিরমিযি, হাদীস নং ২৬৮৩
অর্থাৎ যদি এই একটি উপদেশ স্মরণ রাখো এবং তদনুযায়ী আমল করো তবে তা-ই পুরো জীবনের জন্য যথেষ্ট।
একটি হাদীসে এসেছে,
مَنْ خَافَ أَدْلَجَ، وَمَنْ أَدْلَجَ بَلَغَ المَنْزِلَ
যার ভিতর আল্লাহর ভয় আছে, সে তো ভোরে ভোরে সৎপথে চলতে শুরু করবে। আর যে ভোরে ভোরে আগেভাগে চলতে শুরু করে, সে যথাসময়ে লক্ষ্যে পৌঁছে যায়। সুনানে তিরমিযী, হাদীস নং ২৪৫০
আল্লাহর ভয়ে গড়িয়ে-পড়া অশ্রু-ফোঁটার অনেক মূল্য। নবীজী এরশাদ করেন,
لَيْسَ شَيْءٌ أَحَبَّ إِلَى اللهِ مِنْ قَطْرَتَيْنِ وَأَثَرَيْنِ، قَطْرَةٌ مِنْ دُمُوعٍ فِي خَشْيَةِ اللهِ، وَقَطْرَةُ دَمٍ تُهَرَاقُ فِي سَبِيلِ اللهِ، وَأَمَّا الأَثَرَانِ: فَأَثَرٌ فِي سَبِيلِ اللهِ، وَأَثَرٌ فِي فَرِيضَةٍ مِنْ فَرَائِضِ اللَّهِ.
আল্লাহর নিকট দুটি ফোঁটা ও দুটি চিহ্নের চেয়ে প্রিয় কিছু নেই। দুটি ফোঁটার একটি হলো আল্লাহর ভয়ে গড়িয়েপড়া অশ্রু, দ্বিতীয়টি হলো, আল্লাহর রাস্তায় শরীর থেকে টপকে পড়া লহু। আর যে দুটি চিহ্ন আল্লাহর নিকট খুবই প্রিয়, তার একটি হলো আল্লাহর পথে হয়ে যাওয়া ক্ষত চিহ্ন, অপরটি হলো, নামায আদায়ের কারণে পড়া কপাল ও পায়ের কালো চিহ্ন। সুনানে তিরমিযী, হাদীস নং ১৬৬৯
এক হাদীসে এসেছে,
لاَ يَلِجُ النَّارَ رَجُلٌ بَكَى مِنْ خَشْيَةِ اللهِ
যে ব্যক্তি আল্লাহ তাআলার ভয়ে কান্নাকাটি করে, সে কখনো জাহান্নামী হতে পারে না। সুনানে তিরমিযী, হাদীস নং ১৬৩৩ মোটকথা, আল্লাহর ভয় এবং আখেরাতের ফিকির যার ভিতর এসে যায়, তার জীবন স্বর্ণপ্রসূ হয়ে যায়।
প্রিয় ভাই ও বোন!
দেখুন, দুনিয়ার জীবনের হাতেগণা কয়টি দিন যদি আমরা আল্লাহ তাআলাকে ভয় করে ভালোমন্দ বেছে চলি, তাহলে মৃত্যুর পর আমাদেরকে কোনো দুঃখে-কষ্টে পড়তে হবে না। আল্লাহ পাকের অনুগ্রহ এবং দয়ায় অনন্তকাল চিরসুখে থাকতে পারবো। কিন্তু আল্লাহ না করুন, যদি খোদার ভয় এবং আখেরাতের ফিকির আমাদের অন্তরে না থাকে আর আমরা দুনিয়ার জীবনের তুচ্ছ ভোগবিলাসে মত্ত হয়ে ভেসে চলি, তবে আখেরাতের জীবনে নিদারুণ দুঃখ-দুর্দশা পোহাতে হবে, চিরদিন রক্তকান্নায় বুক ভাসাতে হবে।
তাকওয়া অর্জনের উপায় তাকওয়া অর্জনের সবচে কার্যকর মাধ্যম হলো ঐ আল্লাহ ওয়ালাদের সান্নিধ্য ও সাহচর্য গ্রহণ করা, যারা আল্লাহ তাআলাকে ভয় করে, তাঁর হুকুম-আহকাম মেনে চলে। দ্বিতীয় একটি মাধ্যম হলো, নির্ভরযোগ্য কিতাবাদি পাঠ করা। তৃতীয় উপায় হলো, একান্তে বসে মৃত্যুচিন্তা করা, নেক কাজের সওয়াব এবং বদকাজের আযাবের ধ্যান করা, কবরের জগতে আমার কী অবস্থা হবে, হাশরের ময়দানে সকলের সামনে আমার ব্যাপারে কী ফয়সালা হবে, যখন আল্লাহ পাকের সম্মুখে আমাকে হাজির করা হবে এবং আমলনামা আমার সামনে তুলে ধরা হবে, তখন আমি কী জবাব দেবো? কোখায় মুখ লুকাবো ইত্যাদি চিন্তা করা। কিছু দিন এই পদ্ধতি অবলম্বন করলে তাকওয়া নসীব হবে ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ পাক আমাদের সকলকে তাকওয়া নসীব করুন। আমীন।
গল্পের বিষয়:
ইসলামিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত