ইউসুফ আ. এর উপর চুরির অপবাদ

ইউসুফ আ. এর উপর চুরির অপবাদ
এ পর্যায়ে ইউসুফ আ. এর ভায়েরা ক্ষোভ প্রকাশ করে বললো, সে যদি চুরি করে থাকে, তাতে আশ্চর্যের কিছুই নেই। কারণ, তার এক সহোদর ভাইও এরআগে চুরি করেছিল। নিম্নোক্ত আয়াতে একথা বিবৃত হয়েছে,
قَالُوْۤا اِنْ یَّسْرِقْ فَقَدْ سَرَقَ اَخٌ لَّهٗ مِنْ قَبْلُ ۚ
অর্থঃ তারা বললো, সে যদি চুরি করে থাকে, তবে তার এক ভাইও তো এরআগে চুরি করেছিল। (সূরা ইউসুফ, আয়াত: ৭৭)
এভাবে ইউসুফ আ. এর ভাইয়েরা স্বয়ং ইউসুফ আ. এর প্রতি চুরির অপবাদ আরোপ করলো! এতে ইউসুফ আ. এর শৈশবকালীন একটি ঘটনার প্রতি ইঙ্গিত ছিল। সেই ঘটনা হচ্ছে, এখানে বিনয়ামীনের বিরুদ্ধে চুরির অভিযোগ উত্থাপনের জন্য যেভাবে কৌশল করা হয়েছে, তখনও হুবহু এমনিভাবে ইউসুফ আ. এর বিরুদ্ধেও তার অজান্তে চুরির অপবাদ দিয়ে চক্রান্ত করা হয়েছিল। তখন এই ভাইয়েরা ভালোভাবেই জানত যে, উক্ত অভিযোগের ব্যাপারে ইউসুফ আ. সম্পূর্ণ নির্দোষ। বরং যারা অপবাদ দিয়েছে, তারাই কুচক্রী। কিন্তু এখন বিনয়ামীনের প্রতি আক্রোশের বসে সেই ঘটনাটিকে চুরি আখ্যা দিয়ে ইউসুফ আ. কে তাতে অভিযুক্ত করে দিল। সেই চুরির অপবাদের ঘটনার বিবরণ সম্পর্কে বিভিন্ন রিওয়ায়াত রয়েছে। ইমাম ইসমাঈল ইবনে কাসীর রহ. হযরত মুহাম্মাদ ইবনে ইসহাক ও মুজাহিদ রহ. এর বরাত নিয়ে বর্ণনা করেছেন যে, ইউসুফ আ. এর জন্মের পর কিছু কালের মধ্যেই বিনয়ামীন জন্মগ্রহণ করে। তাকে প্রসবের পর তাদের জননীর মৃত্যু হয়। তাতে ইউসুফ ও বিনয়ামীন উভয়েই মাতৃহীন হয়ে পড়েন। তখন তাদের লালন-পালন ফুফুর কোলে সম্পন্ন হতে থাকে।
আল্লাহ তা‘আলা হযরত ইউসুফ আ. কে শিশুকাল থেকেই এমন অপরূপ সৌন্দর্য দান করেছিলেন যে, তাঁকে যে-ই দেখত, সে-ই তাঁর সীমাহীন স্নেহ-মায়ার বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে যেত। ফুফুর অবস্থাও ছিল তা-ই। তিনি এক মুহূর্তের জন্যও তাঁকে দৃষ্টি থেকে দূর হতে দিতেন না এবং দিতে পারতেন না। এদিকে পিতা ইয়াকূব আ. এর অবস্থাও এর চাইতে কম ছিল না। কিন্তু ছোট শিশু হওয়ার কারণে কোনো মহিলার রক্ষণাবেক্ষণে থাকা জরুরী। বিধায় তাঁকে ফুফুর হাতে সমর্পণ করে দেন। অতঃপর ইউসুফ আ. যখন চলাফেরার বয়সে পৌঁছলেন, তখন পিতা ইয়াকূব আ. তাঁকে নিজের কাছেই রাখতে চাইলেন। ফুফুকে একথা জানালে প্রথমে তিনি আপত্তি করলেন। অতঃপর অধিক পীড়াপীড়িতে বাধ্য হয়ে ইউসুফ আ. তঁর পিতার হাতে সমর্পণ করলেন।
কিন্তু বাহ্যত তাকে দিলেও মন থেকে তাকে দূরে রাখতে পারছিলেন না। তাই কোনো কৌশলে তাকে ফেরত নেওয়ার জন্য গোপনে একটি ফন্দি আঁটলেন। ফুফু স্বীয় পিতা হযরত ইসহাক আ. এর কাছ থেকে একটি হার পেয়েছিলেন। এটি অত্যন্ত মূল্যবান ছিল। ফুফু এই হারটিই এক সময়ে চুপিসারে ইউসুফ আ. এর জামার নীচে কোমরে বেঁধে দিলেন। কিছু সময় পরে হযরত ইউসুফ আ. গেলে, ফুফু জোরেশোরে প্রচার শুরু করলেন যে, তার হারটি চুরি হয়ে গেছে। তখন তল্লাশী করার পর ইউসুফ আ. এর কাছ থেকে তা বের হলো। তাতে ইয়াকূবী শরী‘আতের বিধান অনুযায়ী, ফুফু ইউসুফকে গোলাম করে নিজের নিকট রাখার অধিকার পেলেন।
ইয়াকূব আ. যখন দেখলেন যে, আইনত ফুফু ইউসুফের মালিক হয়ে গেছেন, তখন তিনি দ্বিরুক্তি না করে ইউসুফকে তার হাতে সমর্পণ করলেন। এরপর যতদিন ফুফু জীবিত ছিলেন, ইয়াকূব আ. ইউসুফ আ. কে ততদিন ফুফুর কাছে রেখেছিলেন। ফুফুর মৃত্যুর পর ইউসুফ আ. কে নিজের কাছে নিয়ে আসেন। এ ছিল সেই ঘটনা, যাতে ইউসুফ আ. মিথ্যা চুরির অপরাধে অভিযুক্ত হয়েছিলেন। এরপর বিভিন্ন ঘটনায় সবার কাছেই এ সত্য দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে, ইউসুফ আ. তো চুরি করেনই নি, এমনকি তাঁর চরিত্র এমন নিষ্কলুষ যে, সে ধরনের কোনো সন্দেহ থেকেও তিনি মুক্ত ছিলেন। বরং ফুফুর আদরই তাঁকে ঘিরে এ চক্রান্তজাল সৃষ্টি করেছিল।
এ সত্য ভাইদেরও জানা ছিল। তাই ইউসুফ আ. কে কোনো চুরির ঘটনার সাথে জড়িত করা তাদের পক্ষে কিছুতেই উচিত ছিল না। কিন্তু তাঁর ব্যাপারে তাদের বৈরিভাব অদ্যাবধি বিরাজমান ছিল। সেই সাথে তাঁর সহোদর ভাইয়ের (কল্পিত) চুরির ঘটনায় ক্ষিপ্ত হয়ে গিয়েছিল। যার কারণে ইউসুফ আ. এর প্রতি চুরির অপবাদ তাদের মুখ দিয়ে বের হয়ে গিয়েছিল। ইউসুফ আ. ভাইদের কথা শুনে তা মনে মনেই রাখলেন। কিন্তু মুখে কিছু প্রকাশ করলেন না। পবিত্র কুরআনে নিম্নোক্ত আয়াতে বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে,
فَاَسَرَّهَا یُوْسُفُ فِیْ نَفْسِهٖ وَلَمْ یُبْدِهَا لَهُمْ ۚ
অর্থঃ ইউসুফ আ. (তা শুনেও) প্রকৃত ব্যাপার নিজের মনে গোপন রাখলেন এবং তাদের কাছে ব্যক্ত করলেন না। (সূরা ইউসুফ, আয়াত: ৭৭)
তবে তখন তিনি মনে মনে এ কথা বললেন,
قَالَ اَنْتُمْ شَرٌّ مَّکَانًا ۚ وَاللهُ اَعْلَمُ بِمَا تَصِفُوْنَ○
অর্থঃ তোমরা লোক হিসাবে নিতান্ত মন্দ। অবশ্যই আল্লাহ খুব অবগত রয়েছেন সে ব্যাপারে, যা তোমরা বর্ণনা করো। (সূরা ইউসুফ, আয়াত: ৭৭)
গল্পের বিষয়:
ইসলামিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত