এ হচ্ছে নবুওয়্যাতের শান! নবীগণ দুঃখ-কষ্টে শুধু সবরই করেন না, বরং সর্বক্ষেত্রে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের দিক প্রতিফলিত করেন। এজন্যই তাদের এমন কোনো অবস্থা নেই, যেখানে তাঁরা আল্লাহ তা‘আলার প্রতি শোকরগুযার নন। অথচ সাধারণত এরূপ ক্ষেত্রে মানুষের অবস্থা এর বিপরীত হয়। তারা আল্লাহ তা‘আলার নি‘আমতরাজি পেয়েও সেই নিয়ামতের কথা উল্লেখ করতে চায় না, কিন্তু কোনো সময় সামান্য কষ্ট পেলে, জীবনভর তা গেয়ে বেড়ায়। কুরআন পাকে এ বিষয়ের প্রতি অভিযোগ করে বলা হয়েছে,
“নিশ্চয় মানুষ তার পালনকর্তার প্রতি খুবই অকৃতজ্ঞ।” (সূরা আদিয়াত, আয়াত: ৬)
অপর আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, “আমার খুব কম সংখ্যক বান্দাই আমার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে থাকে।”
অতঃপর পিতা-মাতা ও ভাইদের সাথে সাক্ষাতের ফলে যখন ইউসুফ আ. এর জীবনে শান্তি এলো, তখন তিনি সরাসরি আল্লাহ তা‘আলার প্রশংসা, গুণকীর্তন ও দু‘আয় মশগুল হয়ে গেলেন। তিনি বললেন, “নিশ্চয় আমার রব যা চান, তা নিপুণতার সাথে সম্পন্ন করেন। তিনি তো সর্বজ্ঞ প্রজ্ঞাময়। হে পালনকর্তা! আপনি আমাকে রাজ্য দান করেছেন এবং আমাকে স্বপ্নের তা‘বীর শিক্ষা দিয়েছেন। হে আসমান ও যমীনের স্রষ্টা! আপনিই আমার অভিভাবক ইহকাল ও পরকালে। আপনি আমাকে মুসলিমরূপে মৃত্যু দান করুন এবং আমাকে বিশিষ্ট নেককার বান্দাদের মধ্যে শামিল করুন।” (সূরা ইউসুফ, আয়াত: ১০০-১০১)
হযরত ইউসুফ আ. এর ঘটনায় একটি চরম বিস্ময়কর ব্যাপার এই যে, একদিকে তাঁর পিতা আল্লাহর নবী ইয়াকুব আ. তাঁর বিরহ ব্যথায় অশ্রু বিসর্জন করতে করতে অন্ধ হয়ে গেলেন এবং অপরদিকে ইউসুফ আ. স্বয়ং নবী ও রাসূল পিতার প্রতি স্বভাবগত মুহাব্বত ও ভালোবাসা ছাড়া তাঁর অধিকার সম্পর্কেও সচেতন ছিলেন। কিন্তু লম্বা চল্লিশ বৎসর সময়ের মধ্যে তিনি একবারও বিরহ-যাতনায় অস্থির ও পেরেশান পিতাকে কোনো উপায় স্বীয় কুশল-সংবাদ পৌঁছানোর কথা চিন্তাও করলেন না। সংবাদ তখনও অসম্ভব কোনো বিষয় ছিল না, যখন তিনি গোলাম হয়ে মিসরে পৌঁছলেন। আযীযে মিসরের ঘরে তাঁর সর্বপ্রকার স্বাধীনতা ও সুযোগ-সুবিধার সামগ্রী বিদ্যমান ছিল। তখন কারো মাধ্যমে পত্র অথবা খবর পৌঁছিয়ে দেয়া তার পক্ষে তেমন কঠিন কোনো ব্যাপার ছিল না। এমনিভাবে কারাগারের জীবনেও যে সংবাদ এদিক-সেদিক পৌঁছানো যায়, তা সবারই জানা। তারপর বিশেষ করে আল্লাহ তা‘আলা যখন তাঁকে সসম্মানে কারাগার থেকে মুক্তি দেন এবং মিসরের শাসনক্ষমতা তাঁর হাতে আসে, তখনও নিজে গিয়ে পিতার কাছে উপস্থিত হওয়াটাই তাঁর সর্বপ্রথম কাজ ছিল। এটা কোনো কারণে সমীচীন না হলে, কমপক্ষে দূত প্রেরণ করে পিতাকে নিরুদ্বেগ করে দেওয়া তো ছিল তাঁর জন্যে নেহায়েত মামুলি ব্যাপার।
কিন্তু আল্লাহর পয়গাম্বর ইউসুফ আ. এরূপ ইচ্ছা করেছিলেন বলেও কোথাও বর্ণিত নেই। নিজে ইচ্ছা করা তো দূরের কথা, যখন খাদ্যশস্য নেওয়ার জন্য ভাইয়েরা প্রথমবার আগমন করলো, তখনও আসল ঘটনা প্রকাশ না করে তাদেরকে বিদায় করে দিলেন। অতঃপর তারা দ্বিতীয়বার আগমন করলে, তখনও আসল ঘটনা বর্ণনা না করে উল্টো বিনয়ামীনকে আটকে রাখলেন।
এমতাবস্থায় কোনো বিবেকসম্পন্ন মানুষের কাছ থেকেও কল্পনা করা যায় না। অথচ আল্লাহ তা‘আলার মনোনীত পয়গাম্বর হয়ে তিনি তা কীরূপে বরদাশত করলেন? এর জবাব হচ্ছে, ঘটনার পরস্পরায় একথা স্বাভাবিকভাবেই পরিষ্কার হয়ে যায় যে, আল্লাহ পাক বিশেষ হিকমত ও রহস্যের অধীনে হযরত ইউসুফ আ. কে এসব প্রকাশে বিরত রেখেছিলেন। তাফসীরে কুরতুবীতে এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট বর্ণনা এসেছে যে, আল্লাহ তা‘আলা ওহীর মাধ্যমে ইউসুফ আ. কে নিজের সম্পর্কে কোনো সংবাদ ঘরে প্রেরণ নিষেধ করে দিয়েছিলেন।
বিশ্ব পালনকর্তার প্রকৃত রহস্য একমাত্র তিনিই জানেন। মানুষের পক্ষে তা উপলব্ধি করা অসম্ভব। তবে মাঝে মাঝে কোনো বিষয় কারো বোধগম্য হয়েও যায়। এখানে বাহ্যত ইয়াকুব আ. এর পরীক্ষাকে পূর্ণতা দান করাই ছিল আসল রহস্য। এজন্যই ঘটনার শুরুতে যখন ইয়াকুব আ. বুঝতে পেরেছিলেন যে, ইউসুফ আ. কে বাঘে খায়নি, বরং এটা তার ভাইদের কারসাজি, তখন স্বাভাবিকভাবেই সেখানে পৌঁছে সরেযমীনে তদন্ত করা তাঁর কর্তব্য ছিল কিন্তু আল্লাহ পাক তাঁর দিলকে এদিকে যেতে দেননি। অতঃপর হঠাৎ করে লম্বাদিন পর তিনি নিজ ছেলেদেরকে বললেন, “তোমরা যাও, ইউসুফ ও তার ভাইকে তালাশ করো। বস্তুত আল্লাহ তা‘আলা যখন কোনো কাজ করার ইচ্ছা করেন, তখন তার কারণাদি এমনিভাবে সন্নিবেশিত করে দেন। সুতরাং ঘটনার পূর্বাপর সবই মহান আল্লাহর হুকুমে তাঁরই কুদরতের রহস্য বাস্তবায়নের জন্য হয়েছে বলে বিশ্বাস করতে হবে।
সূরা ইউসুফের সর্বশেষ আয়াতে আলোচিত কাহিনী সম্পর্কে পরিশিষ্টরূপে ইরশাদ হয়েছে,
لَقَدْ کَانَ فِیْ قَصَصِهِمْ عِبْرَۃٌ لِّاُولِی الْاَلْبَابِ ؕ مَا کَانَ حَدِیْثًا یُّفْتَرٰی وَلٰکِنْ تَصْدِیْقَ الَّذِیْ بَیْنَ یَدَیْهِ وَتَفْصِیْلَ كُلِّ شَیْءٍ وَّهُدًی وَّرَحْمَۃً لِّقَوْمٍ یُّؤْمِنُوْنَ○
অর্থঃ তাদের (পয়গাম্বরগণের) কাহিনীতে বুদ্ধিমানদের জন্য উপদেশের উপাদান রয়েছে। এ কুরআন কোনো মনগড়া কথা নয়, বরং তা আগেকার গ্রন্থে যা আছে তার সমর্থন এবং সব কিছুর বিশদ বিবরণ, হিদায়াত ও রহমত ঈমানদারদের জন্য। (সূরা ইউসুফ, আয়াত: ১১১)
উক্ত আয়াতে বর্ণনা করা হয়েছে যে, উল্লিখিত পয়গাম্বরগণের কাহিনীতে বুদ্ধিমানদের জন্য উপদেশের উপাদান রয়েছে। এর দ্বারা সব পয়গাম্বরের কাহিনীও উদ্দেশ্য হতে পারে যা এই সূরায় এ যাবত বর্ণিত হয়েছে। এখানে উপদেশের উপাদান বিশেষত এই যে, আলোচিত ঘটনায় এ বিষয়টি পূর্ণরূপে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, আল্লাহ তা‘আলা তাঁর অনুগত বান্দাদেরকে কীভাবে সাহায্য ও সহযোগিতা করেন এবং কূপ থেকে বের করে রাজসিংহাসনে বসান আর অপবাদ থেকে মুক্তি দিয়ে উচ্চ মর্তবার শিখরে কীভাবে পৌঁছে দেন। পক্ষান্তরে চক্রান্ত ও প্রতারণাকারীদেরকে পরিণামে কীরূপ অপমান ও লাঞ্ছনার সম্মুখীন করেন।
উল্লেখিত আয়াতের পরবর্তী অংশে বলা হয়েছে যে, এ কাহিনীতে কোনো মনগড়া কথা নয়, বরং আগে অবতীর্ণ কিতাবসমূহের সমর্থনকারী। এ কথার তাৎপর্য হচ্ছে, তাওরাত ও ইনজীলেও কাহিনী বর্ণিত হয়েছে, যেমন বর্ণিত হয়েছে কুরআনে। এ সম্পর্কে হযরত ওয়াহহাব ইবনে মুনাব্বিহ রহ. বলেন, “পৃথিবীতে যতগুলো আসমানী কিতাব ও সহীফা নাযিল হয়েছে, তার প্রত্যেকটিতেই ইউসুফ আ. এর ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে।” (তাফসীরে মাযহারী)
শাইখ আবু মানসূর রহ. বলেন, সম্পূর্ণ সূরা ইউসুফ এবং এতে সন্নিবেশিত কাহিনী বর্ণনা করার উদ্দেশ্য হচ্ছে, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তাসাল্লী, সান্তনা প্রদান করা যে, কাফিরদের হাতে আপনি যেসব নির্যাতন ভোগ করছেন, পূর্ববর্তী নবীগণও আ. তদ্রুপ কষ্ট ভোগ করেছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আল্লাহ পাক বেদীনদের মুকাবিলায় পয়গাম্বরগণকেই বিজয়ী করেছেন। আপনার ব্যাপারটি ও সেরূপই হবে।
গল্পের বিষয়:
ইসলামিক