আমি ছিলাম ক্লাসের সবচেয়ে বুদ্ধিমতী মেয়ে। সবাই এমনটা ই ভাবতো আর আমি নিজেও। ভার্সিটির প্রায় সব ছেলেকেই আমি দৌড়ের উপর রাখতাম, নাকানিচুবানি খাওয়াতাম। বুদ্ধির পাশাপাশি আমি যথেষ্ট স্মার্ট আর সুন্দরী ছিলাম। কেউ কখনো আমার সাথে যুক্তিতে পারতো না। মনে আছে একবার একটি ছেলেকে গোহারান হারিয়েছিলাম। এতোটুকু বলেই নিজের বোতল থেকে কয়েক ঢোক পানি খেলো নেহা। আর আমি মুনিয়া। নেহা আর আমার মেয়ে একই ক্লাসে পড়ে। আজ নেহা আমাকে তার ভার্সিটি লাইফের গল্প শোনাচ্ছে। আবার শুরু করলো নেহা, ভার্সিটিতে ক্লাসের পর যা সময় পেতাম পুরোটা সময় ভার্সিটি দাপিয়ে বেড়াতাম। এ কাজে আমার দোসর ও ছিলো অনেক। এভাবে স্রোতে গা ভাসিয়ে চলে যাচ্ছিলো আমার দিন।
একদিন বাসায় ফিরছিলাম বাসে করে। আমার পাশের সিটে একটা মেয়ে বসেছিলো। আপাদমস্তক কালো বোরকায় ঢাকা। কোলের ওপর একটি বই।তন্ময় হয়ে বইয়ে ডুবে আছে। আমি বেশ অবাক হলাম। আমার কাছে বোরকাওয়ালী মানেই ক্ষ্যাত, ব্যাকডেটেড, ওরা চিন্তাই করতে পারেনা। আর বই পড়াতো অনেক দূর। আমার বেশ কৌতুহল হলো। আমি মেয়েটিকে বললাম, ‘এক্সকিউজ মি! আপনার বইটা দেখতে পারি।?’ মেয়েটি বলে, ‘আসসালামু আলাইকুম। হ্যাঁ, অবশ্যই পারেন আপু।’ এই বলে সে বইটা আমার হাতে দিলো। আমি বইটা উল্টেপাল্টে দেখলাম। বইটার নাম ছিলো ‘বাইবেল কোরআন ও বিজ্ঞান ‘ লিখেছেন খ্যাতিমান ফরাসি বিজ্ঞানী ড. মরিস বুকাইলি। মেয়েটি হয়তো বুঝতে পেরেছিলো আমার কৌতুহল। বললো, ‘ আপু আপনি চাইলে নিজের কাছে রেখে পড়তে পারেন। শেষ হলে আমাকে ফেরত দিলে হবে।’ এই বলে আমার হাতে একটি কাগজ এগিয়ে দিলো ‘এটা আমার ফোন নাম্বার।’ আমি ইতস্তত করে কাগজটি নিলাম। আসলে অপরিচিত কেউ আগে কখনো আমার সাথে এতো ফ্রেন্ডলি কথা বলেনি।
-আমি মারিয়া। আপনি?
-আমি নেহা।
– আচ্ছা পরে কথা হবে। আসি তবে। আসসালামু আলাইকুম।
-ওয়ালাইকুমুসসালাম
এর পর মেয়েটি নেমে গেলো। আমি মুসলিম ছিলাম। এ ও জানতাম মুসলিমদের ধর্মগ্রন্থ কুরআন। কিন্তু কুরআন সম্পর্কে কোনো আইডিয়া ছিলো না। কিন্তু বাসায় কাউকে কুরআন পড়তে দেখিনি কখনো। এই বইয়ের নাম দেখেই বইটি পড়তে আমার আগ্রহ জন্মেছিলো।
বাসায় এসে ফ্রেশ হয়ে বসলাম বই নিয়ে। পরের দিন ভার্সিটি গেলাম না। বইয়ের মধ্যে ডুবে ছিলাম। অসাধারণ একটি বই ছিলো। আল্লাহ বইয়ের লেখক আর যে আমাকে বইটি দিয়েছিলো উভয়কেই উত্তম প্রতিদান দিক। কুরআনের আলোচনা টুকু পড়ে আমি অভিভূত হয়ে গিয়েছিলাম। কুরআনের সাথে বিজ্ঞানের অধুনা আবিষ্কার গুলোর এতো মিল দেখে আমিতো অবাক। বইটা টানা দুবার পড়লাম। এরপর আমার কুরআন পড়ার ইচ্ছে হলো। কুরআন তো আরবি ভাষায় লিখা এদিকে আমি আরবি জানিনা। দুঃখ লাগলো খুব। মাকে জিজ্ঞেস করলাম বাসায় কোনো বাংলা অনুবাদ আছে কিনা কুরআনের। মা বললো নেই। ভাবলাম, কেমন মুসলিম আমরা? আমাদের বাসায় কুরআনের একটি বাংলা অনুবাদ ও নেই। হঠাৎ মনে পড়লো মারিয়ার কথা। ওকে ফোন দিলাম। পরিচয় দিতেই ও খুব খুশি হলো। বললাম ও আমাকে কুরআনের বাংলা অনুবাদ ম্যানেজ করে দিতে পারবে কিনা। সে বললো পারবে। সাথে এটাও বললো, কুরআনকে কুরআনের ভাষায় পড়তেই সুবিধা। সঠিক মর্মটা উপলব্ধি করতে কুরআন আরবি ভাষাতেই পড়া উচিত।
দুই মাস পর কুরআনের পুরোটা বাংলা অনুবাদ আমি পড়ে শেষ করেছি। মারিয়ার সাহায্যে আরবি শিক্ষার কোর্সে ভর্তি হয়েছি। নিয়মিত নামাজ পড়ার চেষ্টা করছি। ছোট ছোট কিছু সুরা মুখস্থ করেছি। আর ও শিখার চেষ্টা চলছে, আলহামদুলিল্লাহ। আআপাদমস্তক বোরকা পড়া মানে আমার কাছে এখন ব্যাকডেটেড নয়। আপাদমস্তক বোরকাতে নিজেকে এখন ঝিনুকে আবৃত মুক্তা মনে হয়। এখন মারিয়া আমার সবচেয়ে প্রিয় বান্ধবী। আগের সঙ্গ আমি ত্যাগ করেছি। নিজেকে আর ক্লাসের সবচেয়ে বুদ্ধিমতী মেয়ে মনে হয় না। আমি যে কিছুই জানিনা। পুরো ভার্সিটি আর দাপিয়ে বেড়ায় না। কুরআনের আলোয় এখন আমি অন্য এক মানবী।
গল্পের বিষয়:
ইসলামিক