রমযান মাসের দিনে সিয়াম ও রাতে কিয়াম: গুনাহ মোচন এবং জান্নাতে প্রবেশের এক অবারিত সুযোগ
(সাথে রয়েছে তারবীহর সালাত সম্পর্কে কিছু কথা)
▬▬▬▬🌐🔶🌐▬▬▬▬
নি:সন্দেহে রমাযান মাস পাপ-পঙ্কিলতা থেকে পরিশুদ্ধি অর্জনের মাধ্যমে জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভ এবং চির সুখের নীড় জান্নাতে প্রবেশের এক অতুলনীয় সুযোগ। কেবল সৌভাগ্যবানরাই এই সুযোগ লাভ করে ধন্য হয়। তাই আসুন আমরা এ মাসের প্রতিটি মুহূর্তকে যথাসম্ভব কাজে লাগিয়ে সেই সৌভাগ্যবানদের দলভুক্ত হওয়ার চেষ্টা করি। আল্লাহ তাওফিক দান করুন। আমীন।
🌀 ১) রমাযান মাসে সিয়াম পালন করা গুনাহ মোচনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মাধ্যম:
আবু হুরায়রা (রা:) হতে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
مَنْ صَامَ رَمَضَانَ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ
“যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ও সাওয়াবের আশায় রমাযান মাসে রোযা রাখবে তার পূর্বের সমস্ত গুনাহ মোচন করে দেয়া হবে।” [বুখারী ও মুসলিম]
🌀 ২) রমাযান মাসে সিয়াম পালন করা জান্নাতে প্রবেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মাধ্যম:
▪ক) আবু হুরায়রা (রা:) হতে বর্ণিত। এক বেদুইন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নিকট এসে বলল, আমাকে এমন একটি আমলের কথা বলুন যা করলে আমি জান্নাতে যেতে পারব। তিনি বললেন:
تعبد الله لا تشرك به شيئاً ، وتقيم الصلاة المكتوبة ، وتؤدي الزكاة المفروضة ، وتصوم رمضان . قال : والذي نفسي بيده لا أزيد على هذا . فلما ولى قال النبي صلى الله عليه وسلم : من سره أن ينظر إلى رجل من أهل الجنة فلينظر إلى هذا
– আল্লাহর ইবাদত করবে এবং তার সাথে অন্য কাউকে শরীক করবে না।
– ফরয সালাত আদায় করবে।
– ফরয যাকাত প্রদান করবে।
– এবং রমাযান মাসে রোযা রাখবে।”
লোকটি বলল: ঐ স্বত্বার শপথ করে বলছি যার হাতে আমার প্রাণ, আমি এর চেয়ে বেশি কিছুই করব না।
অত:পর লোকটি চলে গেলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন: “কেউ জান্নাতি লোক দেখতে চাইলে যে যেন এ লোকটিকে দেখে।” [সহীহ বুখারী, অধ্যায়: যাকাত। সহীহ মুসলিম, অধ্যায়: ঈমান]
▪খ) মুআয বিন জাবাল (রা:) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন: আমরা এক সফরে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাথে ছিলাম। পথে চলতে চলতে আমি তাঁর নিকটে এসে পৌঁছলাম।
এসে তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম: হে আল্লাহর নবী, আমাকে এমন আমলের কথা বলুন যার মাধ্যমে আমি জান্নাতে যেতে পারব এবং জাহান্নাম থেকে দূরে থাকতে পারব।
তিনি বললেন:
لقد سألت عن عظيم وإنه ليسير على من يسره الله عليه، تعبد الله ولا تشرك به شيئاً، وتقيم الصلاة ، وتؤتي الزكاة، وتصوم رمضان، وتحج البيت
“তুমি অনেক বড় জিনিসের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেছ। তবে আল্লাহ তাআলা যার জন্যে সহজ করে দেন তার জন্য তা সহজ।
– আল্লাহর ইবাদত করবে এবং তার সাথে কোন কিছুকে শরীক করবে না।
– সালাত কায়েম করবে।
– যাকাত প্রদান করবে।
– রমাযান মাসে রোযা রাখবে।
– এবং কাবা ঘরের হজ্জ সম্পাদন করবে… ।”
[মুসনাদ আহমাদ, ৫/২৩১, সুনান তিরমিযী, ঈমান অধ্যায়। ঈমাম তিরমিযী বলেন: “হাদিসটি হাসান সহীহ]
🌀 ৩) তারাবীহর সালাত আদায় করা গুনাহ মোচনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপায়:
আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
مَنْ قَامَ رَمَضَانَ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ
“যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ও সওয়াবের আশায় রমাযানে কিয়ামুল লাইল বা তারাবীহর নামায আদায় ররে তার পূর্বের সমস্ত গুনাহ মোচন হয়ে যাবে।” (বুখারী ও মুসলিম)
🌐 তারবীহর সালাত সম্পর্কে কিছু কথা:
▪ ক) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ফরজ হওয়ার আশংকায় দুই বা তিন রাতের বেশি জামাআতের সাথে আদায় করেন নি:
উম্মুল মুমেনীন আয়েশা (রা:) হতে বর্ণিত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একরাতে নামায আদায় করলেন। অন্যান্য লোকেরাও তার সাথে নামায আদায় করলেন। পরের রাতেও তিনি নামায পড়লেন। তাতে প্রচুর পরিমাণ লোকের সমাগম হল। অতঃপর তৃতীয় বা চতুর্থ রাতে নামাযের জন্য লোকজন একত্রিত হল কিন্তু তিনি বাড়ি থেকে বের হলেন না। সকাল হলে তিনি বললেন:
« قَدْ رَأَيْتُ الَّذِى صَنَعْتُمْ وَلَمْ يَمْنَعْنِى مِنَ الْخُرُوجِ إِلَيْكُمْ إِلاَّ أَنِّى خَشِيتُ أَنْ تُفْرَضَ عَلَيْكُمْ
“তোমরা রাতে যা করেছ তা আমি দেখেছি। কিন্তু এ নামায তোমাদের উপর ফরয হয়ে যেতে পারে এ আশংকায় তোমাদের নিকট আসা হতে বিরত ছিলাম।” এটা ছিল রমাযান মাসে। [বুখারী, অধ্যায়: তাহাজ্জুদ। মুসলিম, অধ্যায়: মুসাফিরদের নামায]
অন্য বর্ণনায় রয়েছে, তিনি বলেছেন: “আর যদি এটা ফরয করে দেয়া হয় তবে তোমরা তা পালন করতে পারবে না।” [বুখারী,অধ্যায়: তারাবীহর নামায। মুসলিম, অধ্যায়: মুসাফিরদের নামায]
▪ খ) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রাতের নফল সালাত কত রাকআত কিভাবে পড়তেন?
আবু সালাম আব্দুর রাহমান উম্মুল মুমেনীন আয়েশা (রা:)কে জিজ্ঞেস করলেন: রমাযান মাসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নামায কেমন ছিল? তিনি বললেন:
مَا كَانَ يَزِيدُ فِى رَمَضَانَ ، وَلاَ فِى غَيْرِه عَلَى إِحْدَى عَشْرَةَ رَكْعَةً ، يُصَلِّى أَرْبَعًا فَلاَ تَسَلْ عَنْ حُسْنِهِنَّ وَطُولِهِنَّ ، ثُمَّ يُصَلِّى أَرْبَعًا فَلاَ تَسَلْ عَنْ حُسْنِهِنَّ وَطُولِهِنَّ ثُمَّ يُصَلِّى ثَلاَثًا
“তিনি রমাযান বা অন্য কোনো মাসে এগার রাকআতের বেশি সালাত পড়তেন না। (দুই সালামে) চার রাকআত পড়তেন এত সুন্দর এবং দীর্ঘ করে সে ব্যাপারে প্রশ্ন করবেন না। তারপর পূণরায় চার রাকআত পড়তেন এত সুন্দর করে ও দীর্ঘ করে যে, সে ব্যাপারে প্রশ্ন করবেন না। এরপর তিন রাকআত (বিতর) পড়তেন।” [সহীহ বুখারী, অধ্যায়: তারাবীহর সালাত। অনুচ্ছেদ: রমাযান মাসে রাতের সালাত পড়ার ফযিলত]
▪ গ) উমর (রা:) এর যুগে পুনরায় জামাআত বদ্ধ ভাবে তারাবীহর সালাত চালু হয়:
আব্দুর রাহমান বিন আব্দুল কাদেরী বলেন:
রমাযানের এক রাতে আমি উমর (রা:) এর সাথে মসজিদের উদ্দেশ্যে বের হলাম। সেখানে গিয়ে দেখলাম লোকজন বিচ্ছিন্নভাবে নামায পড়ছে। কেউ একাকী নামায আদায় করছে। কেউবা কয়েকজনকে নিয়ে জামাআত করছে।
এ অবস্থা দেখে উমর (রা:) বললেন: এ সমস্ত লোককে একজন কারীর পেছনে নামায পড়ার জন্য একত্রিত করা হলে তা হবে অতি উত্তম। অতঃপর তিনি এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন এবং উবাই ইবনে কাব (রা:) এর পেছনে নামায পড়ার জন্য লোকজনকে একত্রিত করার ব্যবস্থা গ্রহণ করলেন।
এরপর আর এক রাতে তাঁর সাথে বের হলাম। এ সময় লোকেরা তাদের উক্ত কারীর পেছনে জামআতবদ্ধ হয়ে নামায আদায় করছিলেন। এটা দেখে উমর (রা:) বললেন: “এ নতুন পদ্ধতিটি কত চমৎকার! যারা এখন ঘুমাচ্ছে (কিন্তু শেষ রাতে আদায় করবে) তারা এখন যারা পড়ছে তাদের চেয়ে উত্তম। এ সময় মানুষ প্রথম রাতেই কিয়ামুল লাইল করত।” [সহীহ বুখারী, অধ্যায়: ইতিকাফ, সহীহ মুসলিম, অধ্যায়: ইতিকাফ।]
দুআ করি, আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে মাহে রামাযানে বেশি বেশি নেকির কাজ সম্পাদন করে জান্নাতুল ফিরদাউসের অধিকারী বানিয়ে দিন। আমীন।
والله أعلم بالصواب
▬▬▬▬🌐🔶🌐▬▬▬▬