ইতিকাফ : ফযিলত,উপকারিতা ও বিধান

রহমত, মাগফিরাত ও মুক্তির সুমহান বার্তা নিয়ে মুসলিম উম্মাহর মাঝে মাহে রমযান আসে প্রতি বছর। প্রতিটি প্রাপ্তবয়স্ক মুসলিম নর-নারীর জন্যই পবিত্র রমযানের পুরো মাস রোযা পালন করা ফরয। বিশ্ব মুসলিম এ মাসে সিয়াম সাধনার মাধ্যমে আত্মশুদ্ধি, সংযম অবলম্বন, তাকওয়া অর্জন ও অপরের প্রতি সহমর্মিতা প্রদর্শনের কঠোর অনুশীলনে আত্মনিয়োগ করেন। ফলে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে পুণ্যময় পরিবেশ বিরাজ করে। মাহে রমযানের মর্যাদাকে কাজে লাগিয়ে কদর রাত প্রাপ্তির সুনিশ্চিত প্রত্যাশায় সর্বোপরি মহান আল্লাহর একান্ত সান্নিধ্য লাভের জন্য রমযানের শেষ দশকের ইতিকাফকে সুন্নাত করা হয়েছে।
ইতিকাফের পরিচয় :
আরবি ‘ইতিকাফ’ শব্দের অর্থ হলো : অবস্থান করা, বসা, বিশ্রাম করা, সাধনা করা ইত্যাদি।
যে লোক মসজিদে অবস্থান গ্রহণ করেছে তাকে আকিফ্ বা মু’তাকিফ বলা হয়। যেমন আল্লাহর বাণী ‘ওয়া আনতুম আ’কিফুনা ফিল মাসজিদি’ আর তোমরা নামাজের নির্দিষ্ট স্থানসমূহে অবস্থানরত- (সূরা বাকারা : ১৮৭)।
শরীয়তের পরিভাষায়, যে মসজিদে পাঁচ ওয়াক্ত নামায জামাআত সহকারে নিয়মিত আদায় করা হয় এমন মসজিদে আল্লাহর ইবাদতের উদ্দেশ্যে নিয়ত সহকারে অবস্থান করাকে ইতিকাফ বলে। মহানবী সা: নিজে ইতিকাফ করেছেন এবং ইতিকাফ করার জন্য সাহাবাদেরকে উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করেছেন। তিনি বলেন, ‘মসজিদ মুত্তাকিদের ঘর। যে ব্যক্তি ইবাদতের উদ্দেশ্যে মসজিদে অবস্থান করবে আল্লাহ তার প্রতি শান্তি ও রহমত নাজিল করবেন এবং পুলসিরাত পার-পূর্বক বেহেশতে পৌঁছবার জিম্মাদার হবেন।’
ইতিকাফের প্রকারভেদ :
ইতিকাফ ৩ প্রকার। যথা-
১. সুন্নাতে মুআক্কাদাহ আলাল কিফায়া: রমজানের শেষ দশকের ইতিকাফ। অর্থাৎ সাংসারিক যাবতীয় ঝামেলা থেকে মুক্ত হয়ে ২০ রমজানের সূর্য ডোবার আগমুহূর্ত থেকে শাওয়াল মাসের চাঁদ ওঠা পর্যন্ত মসজিদে ইতিকাফ করা। এ ধরনের ইতিকাফকে সুন্নাতে মুয়াক্কাদা কিফায়া বলা হয় অর্থাৎ মহল্লার কোনো একজন ব্যক্তি ইতিকাফ পালন করলে সবার পক্ষ থেকে আদায় হয়ে যায়। কেউ যদি ইতিকাফ না করেন তবে সবাই সুন্নাত ত্যাগের জন্য গুনাহগার হবে। প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা.) পবিত্র মাহে রমজানের শেষ ১০ দিন ইতিকাফ করতেন।
মহানবী (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি রমজান মাসের শেষ ১০ দিন ইতিকাফ করবে, সে দুটি হজ ও দুটি ওমরাহর সমান সওয়াব হাসিল করবে।’ (বায়হাকি)
মহানবী (সা.) আরো বলেন, ‘যে ব্যক্তি ইবাদতের নিয়তে সওয়াবের আশায় ইতিকাফ করে তার যাবতীয় গুনাহ মাফ হয়ে যায়।’ (দায়লামী)
রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি সারাজীবনে একদিন হলেও ইতিকাফ করবে, কিয়ামতের দিন দোজখ তার কাছ থেকে ১৫শ’ বছর পথ দূরে থাকবে।’
২. ওয়াজিব ইতিকাফ :নজর বা মানতের ইতিকাফ ওয়াজিব। যেমন কেউ বলল যে, আমার অমুক কাজ সমাধা হলে আমি এতদিন ইতিকাফ করব- অথবা কোনো কাজের শর্ত উল্লেখ না করেই বলল, আমি এত দিন অবশ্যই ইতিকাফ করব। যতদিন শর্ত করা হবে তত দিন ইতিকাফ করা ওয়াজিব। ওয়াজিব ইতিকাফের জন্য রোজা রাখা শর্ত। কোনো সুন্নাত ইতিকাফ ভঙ্গ করলে তা পালন করা ওয়াজিব হয়ে যায়। যদি নির্ধারিত কোনো সময় বা স্থানের মানত করে তাহলে ওই সময় ও স্থানেই ইতিকাফ করতে হবে।
৩. মুস্তাহাব : রমজানের শেষ ১০ দিন ব্যতিরেকে অন্য যেকোনো সময় মসজিদে ইতিকাফের নিয়তে অবস্থান করা মুস্তাহাব। কোনো ফুকাহা একে নফল ইতিকাফও বলেছেন।
লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য :
রমজান মাসের শেষ দশ দিন ইতিকাফ করার প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে লাইলাতুল কদরপ্রাপ্তির মাধ্যমে মহান আল্লাহর একান্ত সান্নিধ্য লাভ। যে ব্যক্তি উক্ত দিনগুলোতে ইতিকাফ করবে, তিনি নিশ্চয়ই ‘লাইলাতুল কদরের’ ফজিলত লাভ করেই থাকবে।
ইতিকাফের উদ্দেশ্য সম্পর্কে আল্লামা ইবনুল কাইয়্যেম র: বলেছেন, ‘আল্লাহর প্রতি মন নিবিষ্ট করা, তাঁর সাথে নির্জনে বাস করা এবং স্রষ্টার উদ্দেশ্যে সৃষ্টি থেকে দূরে অবস্থান করা যাতে করে তার চিন্তা ও ভালোবাসা মনে স্থান করে নিতে পারে।’
আল্লামা হাফেজ ইবনে রজব র: বলেছেন, ‘ইতিকাফের উদ্দেশ্য হল সৃষ্টির সাথে সাময়িকভাবে সম্পর্ক ছিন্ন করা এবং স্রষ্টার সাথে সম্পর্ক কায়েম করা। আল্লাহর সাথে পরিচয় যত দৃঢ় হবে, সম্পর্ক ও ভালোবাসা ততো গভীর হবে এবং তা বান্দাকে পুরোপুরি আল্লাহর কাছে নিয়ে যাবে।’

ইতিকাফের শর্ত :
ইতিকাফের শর্ত ৭টি। যথা-
১.মুসলমান হওয়া
২. পাগল না হওয়া
৩. বালেগ হওয়া
৪. পাঞ্জেগানা মসজিদে পুরুষদের ইতিকাফ করা। মহিলারা আপন ঘরে পর্দার সঙ্গে ইতিকাফ করা।
৫. ইতিকাফের নিয়ত করা।
৬. ইতিকাফকারী সর্বদা জানাবাত (বা মহিলা হলে হায়েজ নেফাস) থেকে পাক-পবিত্র থাকা ।
৭. রোজা রাখা।
ইতিকাফের নিয়ত :
ইতিকাফ করার উদ্দেশে মসজিদে প্রবেশ করলেই সেটা নিয়ত হয়ে যায়। কেউ চাইলে মুখেও বলতে পারে (জরুরী নয়), ইয়া আল্লাহ, ইতিকাফ করার জন্যে মসজিদে প্রবেশ করছি।
ইতিকাফে করণীয় : ইতিকাফ অবস্থায় করণীয় হচ্ছে- ১. বেশি বেশি আল্লাহর জিকির-আজকার করা, ২. নফল নামাজ আদায় করা, ৩. কোরআন তেলাওয়াত করা, ৪. দ্বীনি ওয়াজ-নসিহত শোনা ও ৫. ধর্মীয় গ্রন্থাবলী পাঠ করা।
ইতিকাফে বর্জনীয় : ইতিকাফ অবস্থায় যেসব কাজ বর্জনীয়- ১. ইতিকাফ অবস্থায় বিনা ওজরে মসজিদের বাইরে যাওয়া, ২. দুনিয়াবি আলোচনায় মগ্ন হওয়া, ৩. কোনো জিনিস বেচাকেনা করা, ৪. ব্যবসা-বাণিজ্যের হিসাব-নিকাশ করা, ৫. ওজরবশত বাইরে গিয়ে প্রয়োজনাতিরিক্ত বিলম্ব করা ও ৬. স্ত্রীর সঙ্গে সহবাস করা। এসব কাজ করলে ইতিকাফ ভঙ্গ হয়ে যায়।
মহিলাদের ইতিকাফ : নারীদের জন্য ইতিকাফ জায়েজ ও বৈধ। ঘরের যে অংশে সাধারণত নামাজ পড়া হয় সেই রকম কোনো অংশকে ইতিকাফের জন্য নির্দিষ্ট করে ঘরেই নারীরা ইতিকাফ করবে। শরয়ী কোনো ওযর ছাড়া সেখান থেকে উঠে অন্যত্র না যাওয়া। (রাতে সেখানেই ঘুমাবেন)। ইতিকাফ অবস্থায় যদি মহিলাদের মাসিক শুরু হয়ে যায় তাহলে ইতিকাফ নষ্ট হয়ে যাবে। তবে ইসলামের প্রথম যুগে মহিলারা অবাধে মসজিদে ইতিকাফ করতেন, বর্তমান সময়ে ফেতনার আশঙ্কায় তা জায়েজ নয় ।
হযরত ওমর ও হযরত আয়শা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিস। তারা বলেন, রাসুল (সা.) রমজানের শেষ দশকে ইতিকাফ করতেন। নবীজীর (সা.) ইন্তেকালের পর তার স্ত্রীগণ ইতিকাফ করতেন। (বুখারী)
ইসলামের দৃষ্টিতে সবচেয়ে উৎকৃষ্ট ইতেকাফ কী?
মসজিদুল হারামে আদায়কৃত ইতিকাফ ইসলামের দৃষ্টিতে সবচেয়ে উৎকৃষ্ট ইতেকাফ। তারপর মসজিদে নববীর ইতিকাফ এবং তারপর বায়তুল মুকাদ্দাস। তারপর উৎকৃষ্ট ইতেকাফ হলো- কোনো জামে মসজিদে ইতিকাফ করা যেখানে রীতিমতো জামাআতে নামায হয়। এরপর মহল্লার মসজিদে।

ইতিকাফের উপকারিতা
১- ইতেকাফকারী এক নামাজের পর আর এক নামাজের জন্য অপেক্ষা করে থাকে, আর এ অপেক্ষার অনেক ফজিলত রয়েছে। আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
المَلاَئِكَةُ تُصَلِّي عَلَى أَحَدِكُمْ مَا دَامَ فِي مُصَلَّاهُ، مَا لَمْ يُحْدِثْ: اللَّهُمَّ اغْفِرْ لَهُ، اللَّهُمَّ ارْحَمْهُ، لاَ يَزَالُ أَحَدُكُمْ فِي صَلاَةٍ مَا دَامَتِ الصَّلاَةُ تَحْبِسُهُ لاَ يَمْنَعُهُ أَنْ يَنْقَلِبَ إِلَى أَهْلِهِ إِلَّا الصَّلاَةُ
নিশ্চয় ফেরেশতারা তোমাদের একজনের জন্য দুআ করতে থাকেন যতক্ষণ সে কথা না বলে, নামাজের স্থানে অবস্থান করে। তারা বলতে থাকে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দিন, আল্লাহ তার প্রতি দয়া করুন, যতক্ষণ তোমাদের কেউ নামাজের স্থানে থাকবে, ও সালাত তাকে আটকিয়ে রাখবে, তার পরিবারের নিকট যেতে সালাত ছাড়া আর কিছু বিরত রাখবে না, ফেরেশতারা তার জন্য এভাবে দুআ করতে থাকবে। [বুখারি : ৬৫৯]
২- ইতেকাফকারী কদরের রাতের তালাশে থাকে, যে রাত অনির্দিষ্টভাবে রমজানের যে কোন রাত হতে পারে। এই রহস্যের কারণে আল্লাহ তাআলা সেটিকে বান্দাদের থেকে গোপন রেখেছেন, যেন তারা মাস জুড়ে তাকে তালাশ করতে থাকে।
৩- ইতিকাফের ফলে আল্লাহ তাআলার সাথে সম্পর্ক দৃঢ় হয়, এবং আল্লাহ তাআলার জন্য মস্তক অবনত করার প্রকৃত চিত্র ফুটে উঠে। কেননা আল্লাহ তাআলা বলেন:
وَمَا خَلَقۡتُ ٱلۡجِنَّ وَٱلۡإِنسَ إِلَّا لِيَعۡبُدُونِ ٥٦ # الذاريات: ٥٦
আমি মানুষ এবং জিন জাতিকে একমাত্র আমারই ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছি। [সূরা আয-যারিয়াত : ৫৬]
আর এ ইবাদতের বিবিধ প্রতিফলন ঘটে ইতিকাফ অবস্থায়। কেননা ইতিকাফ অবস্থায় একজন মানুষ নিজেকে পুরোপুরি আল্লাহর ইবাদতের সীমানায় বেঁধে নেয় এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির কামনায় ব্যকুল হয়ে পড়ে। আল্লাহ তাআলাও তাঁর বান্দাদেরকে নিরাশ করেন না, বরং তিনি বান্দাদেরকে নিরাশ হতে নিষেধ করে দিয়ে বলেছেন :
۞قُلۡ يَٰعِبَادِيَ ٱلَّذِينَ أَسۡرَفُواْ عَلَىٰٓ أَنفُسِهِمۡ لَا تَقۡنَطُواْ مِن رَّحۡمَةِ ٱللَّهِۚ إِنَّ ٱللَّهَ يَغۡفِرُ ٱلذُّنُوبَ جَمِيعًاۚ إِنَّهُۥ هُوَ ٱلۡغَفُورُ ٱلرَّحِيمُ ٥٣ # الزمر: ٥٣
অর্থাৎ: বলুন, হে আমার বান্দাগণ! যারা নিজেদের উপর জুলুম করেছ তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ও না। নিশ্চয় আল্লাহ সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেন। তিনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। [সুরা যুমার : ৫৩]
وَإِذَا سَأَلَكَ عِبَادِي عَنِّي فَإِنِّي قَرِيبٌۖ أُجِيبُ دَعۡوَةَ ٱلدَّاعِ إِذَا دَعَانِۖ فَلۡيَسۡتَجِيبُواْ لِي وَلۡيُؤۡمِنُواْ بِي لَعَلَّهُمۡ يَرۡشُدُونَ ١٨٦ # البقرة: ١٨٦]
আর আমার বান্দারা যখন তোমার কাছে জিজ্ঞেস করে আমার ব্যাপারে- বস্তুত আমি রয়েছি সন্নিকটে। প্রার্থনাকারীর প্রার্থনা কবুল করি যখন সে প্রার্থনা করে। কাজেই তারা যেন আমার হুকুম মান্য করে এবং আমার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে। সম্ভবত তারা পথ প্রাপ্ত হবে। [আল-বাকারা : ১৮৬]
৪- যখন কেউ মসজিদে অবস্থান করা পছন্দ করতে লাগে— যা সম্ভব প্রবৃত্তিকে অভ্যস্ত করানোর মাধ্যমে, কেননা প্রবৃত্তিকে যে বিষয়ে অভ্যস্ত করানো হবে সে বিষয়েই সে অভ্যস্ত হয়ে পড়বে— মসজিদে অবস্থান করা পছন্দ হতে শুরু করলে মসজিদকে সে ভালোবাসবে, সেখানে সালাত আদায়কে ভালোবাসবে। আর এ প্রক্রিয়ায় আল্লাহর সাথে তার সম্পর্ক মজবুত হবে। হৃদয়ে সৃষ্টি হবে নামাজের ভালোবাসা এবং সালাত আদায়ের মাধ্যমেই অনুভব করতে শুরু করবে হৃদয়ের প্রশান্তি। যে প্রশান্তির কথা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এভাবে বলেছিলেন :
«أَرِحْنَا بِهَا يَا بِلَالُ»
নামাজের মাধ্যমে আমাদের শান্তি দাও হে বেলাল। [তাবরানী : ৬২১৫]
৫- মসজিদে ইতিকাফের মাধ্যমে একমাত্র আল্লাহ তাআলার উদ্দেশে নিজেকে আবদ্ধ করে নেওয়ার কারণে মুসলমানের অন্তরের কঠোরতা দূরীভূত হয়, কেননা কঠোরতা সৃষ্টি হয় দুনিয়ার প্রতি ভালোবাসা ও পার্থিবতায় নিজেকে আরোপিত করে রাখার কারণে। মসজিদে নিজেকে আবদ্ধ করে রাখার কারণে দুনিয়ার প্রতি ভালোবাসায় ছেদ পড়ে এবং আত্মিক উন্নতির অভিজ্ঞতা অনুভূত হয়। মসজিদে ইতিকাফ করার কারণে ফেরেশতারা দুআ করতে থাকে, ফলে ইতেকাফকারী ব্যক্তির আত্মা নিম্নাবস্থার নাগপাশ কাটিয়ে ফেরেশতাদের স্তরের দিকে ধাবিত হয়। ফেরেশতাদের পর্যায় থেকেও বরং ঊর্ধ্বে ওঠার প্রয়াস পায়। কেননা ফেরেশতাদের প্রবৃত্তি নেই বিধায় প্রবৃত্তির ফাঁদে তারা পড়ে না। আর মানুষের প্রবৃত্তি থাকা সত্ত্বেও সব কিছু থেকে মুক্ত হয়ে আল্লাহর জন্য একাগ্রচিত্ত হয়ে যায়।
৬- ইতিকাফের মাধ্যমে অন্তরে প্রশান্তি আসে।
৭- বেশি বেশি কোরান তিলাওয়াতের সুযোগ সৃষ্টি হয়।
৮- ঐকান্তিকভাবে তওবা করার সুযোগ লাভ হয়।
৯- তাহাজ্জুদে অভ্যস্ত হওয়া যায়।
১০- সময়কে সুন্দরভাবে কাজে লাগানো যায়।
কুরআন- হাদিসের আলোকে ইতিকাফের ফযিলত :

ইতিকাফ একটি মহান ইবাদত, মদিনায় অবস্থানকালীন সময়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতি বছরই ইতিকাফ পালন করেছেন। দাওয়াত, তরবিয়ত, শিক্ষা ও জিহাদে ব্যস্ত থাকা সত্ত্বেও রমজানে তিনি ইতিকাফ ছাড়েননি। ইতিকাফ ঈমানি তরবিয়তের একটি পাঠশালা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হিদায়েতি আলোর একটি প্রতীক। ইতিকাফরত অবস্থায় বান্দা নিজেকে আল্লাহর ইবাদতের জন্য দুনিয়ার অন্যান্য সকল বিষয় থেকে আলাদা করে নেয়। ঐকান্তিকভাবে মশগুল হয়ে পড়ে আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের নিরন্তর সাধনায়। ইতিকাফ ঈমান বৃদ্ধির একটি মূখ্য সুযোগ। সকলের উচিত এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে নিজের ইমানি চেতনাকে প্রাণিত করে তোলা ও উন্নততর পর্যায়ে পৌঁছে দেয়ার চেষ্টা করা।
আল-কুরআনুল কারিমে বিভিন্নভাবে ইতিকাফ সম্পর্কে বর্ণনা এসেছে, ইবরাহিম আলাইহিস সালাম ও ইসমাইল আলাইহিস সালাম এর কথা উল্লেখ করে এরশাদ হয়েছে :
وَعَهِدۡنَآ إِلَىٰٓ إِبۡرَٰهِ‍ۧمَ وَإِسۡمَٰعِيلَ أَن طَهِّرَا بَيۡتِيَ لِلطَّآئِفِينَ وَٱلۡعَٰكِفِينَ وَٱلرُّكَّعِ ٱلسُّجُودِ ١٢٥ # البقرة: ١٢٥
এবং আমি ইবরাহিম ও ইসমাইলকে আদেশ করলাম, তোমরা আমার গৃহকে তাওয়াফকারী, ইতেকাফকারী ও রুকু-সিজদাকারীদের জন্য পবিত্র করো। [সূরা বাকারা : ১২৫]
ইতিকাফ অবস্থায় স্ত্রীদের সাথে কি আচরণ হবে তা বলতে গিয়ে আল্লাহ তাআলা বলেন :
وَلَا تُبَٰشِرُوهُنَّ وَأَنتُمۡ عَٰكِفُونَ فِي ٱلۡمَسَٰجِدِۗ # البقرة: ١٨٧
আর তোমরা মসজিদে ইতিকাফকালে স্ত্রীদের সাথে মেলামেশা করো না। [সূরা বাকারা : ১৮৭]
ইবরাহিম আলাইহিস সালাম তাঁর পিতা এবং জাতিকে লক্ষ্য করে মূর্তির ভর্ৎসনা করতে গিয়ে যা বলেছিলেন, আল্লাহ তাআলা তা উল্লেখ করে বলেন :
إِذۡ قَالَ لِأَبِيهِ وَقَوۡمِهِۦ مَا هَٰذِهِ ٱلتَّمَاثِيلُ ٱلَّتِيٓ أَنتُمۡ لَهَا عَٰكِفُونَ ٥٢ الانبياء: ٥٢#
যখন তিনি তাঁর পিতা ও তাঁর সম্প্রদায়কে বললেন, এই মূর্তিগুলো কি, যাদের পূজারি (ইতেকাফকারী হয়ে) তোমরা বসে আছ? [সূরা আম্বিয়া : ৫২]
রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অসংখ্য হাদিস ইতিকাফ সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে, তার মধ্য হতে ফজিলত সম্পর্কিত কিছু হাদিস নিম্নে উল্লেখ করা হল।
عَنْ عَائِشَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهَا – زَوْجِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ -: «أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، كَانَ يَعْتَكِفُ العَشْرَ الأَوَاخِرَ مِنْ رَمَضَانَ حَتَّى تَوَفَّاهُ اللَّهُ، ثُمَّ اعْتَكَفَ أَزْوَاجُهُ مِنْ بَعْدِهِ»
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সহধর্মিণী আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন : রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমজানের শেষের দশকে ইতিকাফ করেছেন, ইন্তেকাল পর্যন্ত। এরপর তাঁর স্ত্রীগণ ইতিকাফ করেছেন। [বুখারি : ২০২৪; মুসলিম : ১১৭২]
عَنْ عَائِشَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهَا، قَالَتْ: كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، يَعْتَكِفُ فِي كُلِّ رَمَضَانٍ.
আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন : রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রত্যেক রমজানে ইতিকাফ করতেন। [বুখারি : ২০৪১]
অন্য এক হাদিসে এসেছে—
إِنِّي اعْتَكَفْتُ الْعَشْرَ الْأَوَّلَ، أَلْتَمِسُ هَذِهِ اللَّيْلَةَ، ثُمَّ اعْتَكَفْتُ الْعَشْرَ الْأَوْسَطَ، ثُمَّ أُتِيتُ، فَقِيلَ لِي: إِنَّهَا فِي الْعَشْرِ الْأَوَاخِرِ، فَمَنْ أَحَبَّ مِنْكُمْ أَنْ يَعْتَكِفَ فَلْيَعْتَكِفْ ” فَاعْتَكَفَ النَّاسُ مَعَهُ، قَالَ: «وَإِنِّي أُرِيتُهَا لَيْلَةَ وِتْرٍ، وَإِنِّي أَسْجُدُ صَبِيحَتَهَا فِي طِينٍ وَمَاءٍ» فَأَصْبَحَ مِنْ لَيْلَةِ إِحْدَى وَعِشْرِينَ، وَقَدْ قَامَ إِلَى الصُّبْحِ، فَمَطَرَتِ السَّمَاءُ، فَوَكَفَ الْمَسْجِدُ، فَأَبْصَرْتُ الطِّينَ وَالْمَاءَ، فَخَرَجَ حِينَ فَرَغَ مِنْ صَلَاةِ الصُّبْحِ، وَجَبِينُهُ وَرَوْثَةُ أَنْفِهِ فِيهِمَا الطِّينُ وَالْمَاءُ، وَإِذَا هِيَ لَيْلَةُ إِحْدَى وَعِشْرِينَ مِنَ الْعَشْرِ الْأَوَاخِرِ
আমি (প্রথমে) এ রাতের সন্ধানে প্রথম দশে ইতিকাফ পালন করি। অতপর ইতিকাফ পালন করি মাঝের দশে। পরবর্তীতে ওহির মাধ্যমে আমাকে জানানো হয় যে, এ রাত শেষ দশে রয়েছে। সুতরাং তোমাদের মাঝে যে (এ দশে) ইতিকাফ পালনে আগ্রহী, সে যেন তা পালন করে। লোকেরা তার সাথে ইতিকাফ পালন করল। রাসুল বলেন, আমাকে তা এক বেজোড় রাতে দেখানো হয়েছে এবং দেখানো হয়েছে যে, আমি সে ভোরে কাদা ও মাটিতে সেজদা দিচ্ছি। অতপর রাসুল একুশের রাতের ভোর যাপন করলেন, ফজর পর্যন্ত তিনি কিয়ামুল্লাইল করেছিলেন। তিনি ফজর আদায়ের জন্য দণ্ডায়মান হয়েছিলেন। তখন আকাশ ছেপে বৃষ্টি নেমে এল, এবং মসজিদে চুঁইয়ে চুঁইয়ে পানি পড়ল। আমি কাদা ও পানি দেখতে পেলাম। ফজর সালাত শেষে যখন তিনি বের হলেন, তখন তার কপাল ও নাকের পাশে ছিল পানি ও কাদা। সেটি ছিল একুশের রাত। [মুসলিম : ১১৬৭]
আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহ আনহা হতে বর্ণিত, তিনি বলেন :
«يَعْتَكِفُ فِي كُلِّ رَمَضَانٍ عَشَرَةَ أَيَّامٍ، فَلَمَّا كَانَ العَامُ الَّذِي قُبِضَ فِيهِ اعْتَكَفَ عِشْرِينَ يَوْمًا»
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতি রমজানে দশ দিন ইতিকাফ করতেন, তবে যে বছর তিনি পরলোকগত হন, সে বছর তিনি বিশ দিন ইতিকাফে কাটান। [বুখারি : ২০৪৪]
আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহ আনহা হতে বর্ণিত হাদিসে উভয়টির উল্লেখ পাওয়া যায়। তিনি বলেন :
«يَعْتَكِفُ فِي كُلِّ رَمَضَانٍ عَشَرَةَ أَيَّامٍ، فَلَمَّا كَانَ العَامُ الَّذِي قُبِضَ فِيهِ اعْتَكَفَ عِشْرِينَ يَوْمًا»
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতি রমজানের শেষ দশদিন ইতিকাফ করতেন। তবে যে বছর পরলোকগত হন তিনি বিশ দিন ইতিকাফ করেছেন। [বুখারি : ৩০৯]
আয়শা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন,
«أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ اعْتَكَفَ مَعَهُ بَعْضُ نِسَائِهِ وَهِيَ مُسْتَحَاضَةٌ تَرَى الدَّمَ» ، فَرُبَّمَا وَضَعَتِ الطَّسْتَ تَحْتَهَا مِنَ الدَّمِ
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে তাঁর জনৈকা স্ত্রীও ইতিকাফ করলেন। তখন তিনি ছিলেন ইস্তেহাজা অবস্থায়, রক্ত দেখছেন। রক্তের কারণে হয়তো তাঁর নীচে গামলা রাখা হচ্ছে। [বুখারি : ৩০৯]
রাসুল বলেন—
إِنِّي اعْتَكَفْتُ الْعَشْرَ الْأَوَّلَ، أَلْتَمِسُ هَذِهِ اللَّيْلَةَ، ثُمَّ اعْتَكَفْتُ الْعَشْرَ الْأَوْسَطَ، ثُمَّ أُتِيتُ، فَقِيلَ لِي: إِنَّهَا فِي الْعَشْرِ الْأَوَاخِرِ، فَمَنْ أَحَبَّ مِنْكُمْ أَنْ يَعْتَكِفَ فَلْيَعْتَكِفْ ” فَاعْتَكَفَ النَّاسُ مَعَهُ،
আমি কদরের রাত্রির সন্ধানে প্রথম দশ দিন ইতিকাফ করলাম। এরপর ইতিকাফ করলাম মধ্যবর্তী দশদিন। অতপর ওহি প্রেরণ করে আমাকে জানানো হল যে তা শেষ দশদিনে। সুতরাং তোমাদের যে ইতিকাফ পছন্দ করবে, সে যেন ইতিকাফ করে। ফলে, মানুষ তার সাথে ইতিকাফ যাপন করল। [মুসলিম : ১১৬৭]

ইতেকাফকারীর জন্য যা কিছু বিধিবদ্ধ
১. ইবাদত আদায়, যেমন সালাত, কোরান তিলাওয়াত, জিকির ও দুআ ইত্যাদি। কেননা ইতিকাফের উদ্দেশ্য হল আল্লাহ তাআলার সমীপে অন্তরের একাগ্রতা নিবেদন করা এবং তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হওয়া যা উপরোক্ত ইবাদত আদায় ছাড়া সম্ভব নয়। অনুরূপভাবে যেসব ইবাদতের প্রভাব অন্যদের পর্যন্ত পৌঁছায় যেমন সালামের উত্তর দেওয়া, সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজ থেকে বারণ, প্রশ্নের উত্তর দেওয়া, পথ দেখানো, ইলম শিক্ষা দেওয়া কোরান পড়ানো ইত্যাদিও করতে পারবে। কিন্তু শর্ত হল এগুলো যেন এত বেশি না হয় যে ইতিকাফের মূল উদ্দেশ্যই ছুটে যায়।
২. ইতেকাফকারীর জন্য মুস্তাহাব হল তার ইতিকাফের স্থানে কোন কিছু দ্বারা পর্দা করে নেয়া। কেননা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তুর্কি গম্বুজের ভিতরে ইতিকাফ করেছেন যার দরজায় ছিল চাটাই।
اعْتَكَفَ فِي قُبَّةٍ تُرْكِيَّةٍ، عَلَى سُدَّتِهَا قِطْعَةُ حَصِيرٍ.
৩. ইতেকাফকারী তার প্রয়োজনীয় জিনিস-পত্র সঙ্গে নেবে যাতে নিজের প্রয়োজনে তাকে বারবার মসজিদের বাইরে যেতে না হয়; আবু সাইদ খুদরি রাদিয়াল্লাহু আনহুর হাদিসে এসেছে, তিনি বলেন:
اعْتَكَفْنَا مَعَ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، العَشْرَ الأَوْسَطَ، فَلَمَّا كَانَ صَبِيحَةَ عِشْرِينَ نَقَلْنَا مَتَاعَنَا، فَأَتَانَا رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، قَالَ: «مَنْ كَانَ اعْتَكَفَ، فَلْيَرْجِعْ إِلَى مُعْتَكَفِهِ »
আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে রমজানের মাঝের দশকে ইতিকাফ করলাম, যখন বিশ তারিখ সকাল হল আমরা আমাদের বিছানা-পত্র সরিয়ে নিলাম, তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এসে বললেন : যে ইতিকাফ করেছে সে তার ইতিকাফের স্থানে ফিরে যাবে। [বুখারি : ২০৪০]
ইতিকাফের সময় কি কি কাজ করা যাবে এবং কি কি কাজ করা যাবে না
এক. এতেকাফের মধ্যে যেসব কাজ করা জায়েজ বা করা যাবে
১. প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে মসজিদের ভেতরে ব্যবস্থা না থাকলে বাইরে যাওয়া জায়েয। মনে রাখতে হবে এসব প্রয়োজন এমন স্থানে পূরণ করতে হবে যা মসজিদের নিকটে হয়।
২. ফরয গোসলের জন্যেও ইতেকাফের স্থান থেকে বাইরে যাওয়া জায়েয। তবে মসজিদেই গোসল করার ব্যবস্থা থাকলে সেখানেই গোসল করতে হবে।
৩. খাবার খাওয়ার জন্য মসজিদের বাইরে যাওয়া যায় যদি খাবার নিয়ে আসার মত কেউ না থাকে। খাবার আনার লোক থাকলে মসজিদে খাওয়াই জরুরী।
৪. জুমুআ (ও ঈদে)র নামাযের জন্যেও বাইরে যাওয়া জায়েয।
৫. যদি কোথাও আগুন লাগে, অথবা কেউ পানিতে পড়ে ডুবে যাচ্ছে অথবা কেউ কাউকে মেরে ফেলছে অথবা মসজিদ পুড়ে যাওয়ার আশঙ্কা হয় তাহলে এসব অবস্থায় এতেকাফের স্থান থেকে বাইরে যাওয়া শুধু জায়েযই নয় বরং জরুরী।
৬. জুমুআর নামায আদায়ের জন্য বা কোনো জরুরত পুরণ করার জন্যে বের হলো এবং এ সময়ে সে কোনো রোগীর সেবা করলো অথবা জানাযায় শরীক হলো তাহলে তাতে সমস্যা নেই।
৭. যে কোনো প্রাকৃতিক অথবা শরয়ী প্রয়োজনে মসজিদ থেকে বের হওয়া জায়েয।
৮. যদি কেনাবেচার কোনো লোক না থাকে এবং বাড়ীতে খাবার-দাবার জাতীয় কিছু না থাকে তাহলে প্রয়োজনমত কেনাবেচা করা জায়েয।
৯. আযান দেয়ার জন্যে মসজিদের বাইরে যাওয়া জায়েয।
১০. এতেকাফ অবস্থায় কাউকে দীন সম্পর্কে পরামর্শ অথবা চিকিৎসা সংক্রান্ত পরামর্শ দেয়া জায়েয। বিয়ে করা, ঘুমানো এবং আরাম করা জায়েয।
দুই. এতেকাফে যেসব কাজ করা না জায়েজ বা অবৈধ
১. এতেকাফ অবস্থায় যৌনক্রিয়া করা বা স্ত্রীকে আলিঙ্গন করা হলে এতেকাফ নষ্ট হবে।
২. এতেকাফ অবস্থায় কোনো দুনিয়ার কাজে লিপ্ত হওয়া মাকরূহ।
৩. এতেকাফ অবস্থায় একেবারে চুপচাপ বসে থাকা মাকরূহ। যিকির ফিকির, তেলাওয়াত প্রভৃতিতে লিপ্ত থাকা উচিত।
৪. মসজিদে বেচাকেনা করা। লড়াই-ঝগড়া করা, গীবত করা অথবা কোনো প্রকার বেহুদা কথা বলা মাকরূহ।
৫. কোনো প্রাকৃতিক ও শরয়ী প্রয়োজন ব্যতিরেকে মসজিদের বাইরে যাওয়া অথবা প্রাকৃতিক ও শরয়ী প্রয়োজনে বাইরে গিয়ে সেখানেই থেকে যাওয়া বা অযথা বিলম্ব জায়েয নয়। তাতে এতেকাফ নষ্ট হয়ে যাবে।
কী কী কারণে ই‘তিকাফ ভঙ্গ হয়ে যায়? ১. স্বেচ্ছায় বিনা প্রয়োজনে মাসজিদ থেকে বের হলে ২. কোন শিরক বা কুফরী কাজ করলে। ৩. পাগল বা বেঁহুশ হয়ে গেলে। ৪. নারীদের হায়েয-নিফাস শুরু হয়ে গেলে। ৫. স্ত্রীসহবাস বা যে কোন প্রকার যৌন সম্ভোগ করলে।

ইতেকাফকারীর জন্য যা অনুমোদিত
১. ইতেকাফকারীর জন্য মসজিদে পানাহার ও ঘুমানোর অনুমতি আছে। এ ব্যাপারে সকল ইমামের ঐক্যমত রয়েছে। তবে এ সতর্ক হওয়া উচিত; কেননা আল্লাহর প্রতি একাগ্রচিত্ত এবং একনিষ্ঠভাবে মনোনিবেশের জন্য কম খাওয়া কম ঘুমানো সহায়ক বলে বিবেচিত।
২. গোসল করা, চুল আঁচড়ানো, তেল ও সুগন্ধি ব্যবহার, ভাল পোশাক পরা, এসবের অনুমতি আছে। আয়েশা রাদিয়াল্লাহ আনহার হাদিসে এসেছে :
«أَنَّهَا كَانَتْ تُرَجِّلُ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، وَهِيَ حَائِضٌ وَهُوَ مُعْتَكِفٌ فِي المَسْجِدِ وَهِيَ فِي حُجْرَتِهَا يُنَاوِلُهَا رَأْسَهُ»
তিনি মাসিক অবস্থায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাথার কেশ বিন্যাস করে দিতেন, যখন রসুল মসজিদে ইতিকাফরত অবস্থায় থাকতেন, আয়েশা রাদিয়াল্লাহ আনহা তার কক্ষে থাকা অবস্থায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাথার নাগাল পেতেন। [বুখারি : ২০৪৬]
৩. ইতেকাফকারীর পরিবার তার সাথে সাক্ষাৎ করতে পারবে, কথা বলতে পারবে, কেননা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্ত্রীগণ ইতিকাফকালীন তার সাথে সাক্ষাৎ করতেন। কিন্তু সাক্ষাৎ দীর্ঘ না হওয়া বাঞ্ছনীয়।
ইতেকাফকারী যা থেকে বিরত থাকবে
১. ওজর ছাড়া ইতেকাফকারী এমন কোন কাজ করবে না যা ইতিকাফকে ভঙ্গ করে দেয়, আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَلَا تُبۡطِلُوٓاْ أَعۡمَٰلَكُمۡ ٣٣ $ محمد: ٣٣
তোমরা তোমাদের কাজসমূহকে নষ্ট করো না। [সূরা মুহাম্মদ : ৩৩]
২. ঐ সকল কাজ যা ইতিকাফের উদ্দেশ্যকে ব্যাহত করে, যেমন বেশি কথা বলা, বেশি মেলামেশা করা, অধিক ঘুমানো, ইবাদতের সময়কে কাজে না লাগানো ইত্যাদি।
৩. ইতেকাফকারী মসজিদে অবস্থানকালে ক্রয়-বিক্রয় করবে না, কেননা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদে ক্রয়-বিক্রয় করতে নিষেধ করেছেন।
«نَهَى رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَنِ الْبَيْعِ وَالِاشْتِرَاءِ فِي الْمَسْجِدِ»
এমনিভাবে যা ক্রয় বিক্রয়ের কাজ বলে বিবেচিত যেমন বিভিন্ন ধরনের চুক্তিপত্র, ভাড়া, মুদারাবা, মুশারাকা, বন্দক রাখা ইত্যাদি। কিন্তু যদি মসজিদের বাহিরে এমন ক্রয়-বিক্রয় হয় যা ছাড়া ইতেকাফকারীর সংসার চলে না তবে তা বৈধ বলে বিবেচিত হবে। [মুসনাদে আহমদ : ৬৯৯১]
মসজিদে পারতপক্ষে বায়ু ত্যাগ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহুর হাদিসে এসেছে, যখন বেদুইন লোকটি মসজিদে প্রস্রাব করেছিল তখন রাসুল বলেছিলেন :
«إِنَّ هَذِهِ الْمَسَاجِدَ لَا تَصْلُحُ لِشَيْءٍ مِنْ هَذَا الْبَوْلِ، وَلَا الْقَذَرِ إِنَّمَا هِيَ لِذِكْرِ اللهِ عَزَّ وَجَلَّ، وَالصَّلَاةِ وَقِرَاءَةِ الْقُرْآنِ»
মসজিদ প্রস্রাব, ময়লা-আবর্জনার উপযোগী নয়, বরং মসজিদ অবশ্যই আল্লাহর জিকির এবং সালাত ও কোরান তিলাওয়াতের জন্য। [মুসলিম : ২৮৫]
৪. ইতিকাফ অবস্থায় যৌন স্পর্শ নিষেধ, এ ব্যাপারে সকল আলেমের ঐকমত্য রয়েছে। তবে অধিকাংশ আলেমের মতে বীর্যস্খলনের দ্বারাই কেবল ইতিকাফ ভঙ্গ হয়।
রাসুল [সা.] কীভাবে ইতেকাফ করতেন?
১. আয়েশা রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন : রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মৃত্যু-পূর্ব পর্যন্ত রমজানের শেষ দশ দিনে এতেকাফ পালন করেছেন। [বোখারি : ২০২৬।]
২. এতেকাফরত অবস্থাতেও রাসুল পাক-পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতার প্রতি গুরুত্বারোপ করতেন।
৩. এতেকাফকালীন রাসুল কোন অসুস্থ ব্যক্তির দর্শনে যেতেন না, অংশ নিতেন না কোন জানাজায়, বর্জন করতেন স্ত্রী সংস্পর্শ বা সহবাস। আয়েশা রা. বলেন : এতেকাফকারীর সুন্নত হচ্ছে অসুস্থের দর্শনে গমন না করা, জানাজায় অংশ না নেয়া, নারী সংসর্গ ও সহবাস বর্জন করা এবং অত্যবশ্যকীয় কোন প্রয়োজন ব্যতীত এতেকাফ হতে বের না হওয়া। [আবু দাউদ : ২৪৭৩।]
৪. রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অত্যবশ্যকীয় কোন কারণ ব্যতীত এতেকাফগাহ হতে বের হতেন না। আয়েশা রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন : রাসুল এতেকাফরত অবস্থায় কোন কারণ ব্যতীত গৃহে প্রবেশ করতেন না। [বোখারি : ২০২৯।]
৫. এতেকাফরত অবস্থায় রাসুলের স্ত্রী-গণ তার সাথে সাক্ষাৎ করতেন এবং কথোপকথন করতেন তার সাথে। সাফিয়া রা. বলেন : রাসুল এতেকাফরত অবস্থায় আমি তার সাথে সাক্ষাতের জন্য এলাম, তার সাথে আলাপ করে অত:পর চলে এলাম…। [বোখারি : ৩০৩৯।] প্রমাণ করে, এতেকাফরত অবস্থাতেও রাসুল স্ত্রী-গণের সংবাদ নিয়েছেন। এতেকাফের ফলে যে মূর্খরা তাদের পরিবার-পরিজনের কথা ভুলে যায়, তারা এ থেকে শিক্ষা নিতে পারে।
শেষ কথা : ইতিকাফ করার মাধ্যমে মহান আল্লাহর একান্ত সান্নিধ্য লাভের সুযোগ পাওয়া যায়। তাই সবার উচিত যথা নিয়মে ইতিকাফ করা।

গল্পের বিষয়:
ইসলামিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত