অন্যরকম বিয়ে.

অন্যরকম বিয়ে.

বাসর ঘরে বসে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করছে জান্নাত। জান্নাতের ইচ্ছের বিরুদ্ধে হয়েছে বিয়েটা। মনে মনে ভাবতে লাগলো যাকে চিনি না কখনো দেখিনি তার সম্পর্কে কিছুই জানি না কিভাবে সারা জীবন কাটাবো।
বিয়ে নিয়ে কত শত ইচ্ছে ছিলো, কত প্লানিং ছিল কিন্তু বিয়েটা খুব সাধারণভাবে সম্পন্ন হলো। বিয়েতে বাধ্য হয়ে তাকে বোরকা ও পড়তে হলো, “স্বপ্ন ছিলো রাণীর মত সাজবে “। সব স্বপ্নগুলো যেন হাতছানি দিয়ে চলে গেলো আর রেখে গেল শুধু মায়া কান্না। হঠাৎ কে যেন দরজা খুলে ভিতরে ঢুকল!!!!

আব্দুল্লাহ (জান্নাতের স্বামী) : আসসালামু আলাইকুম।

জান্নাত চোখের পানি মুছে তার দিকে তাকালো এবং বিড়বিড় করে সালামের উত্তর দিলো.. তার দিকে কিচ্ছুক্ষণ তাকিয়ে জান্নাত মনে মনে বলতে লাগলো, “এইতো পুরো হুজুর, কত বড় বড় দাড়ি, গাল দেখা যায় না দাড়ির জন্য, প্যান্টটা ও কত উপরে পড়েছে, ক্ষ্যাত!!!

আব্দুল্লাহ বলল ‘”আমরা দুই রাকাত স্বলাত পড়ব, আসুন। আল্লাহর কাছে দোয়া করি আমাদের এই নতুন জীবনের জন্য।

জান্নাত : নাহ, এখন আমার ভালো লাগছে না!!
কথাটা বলা মাত্রই জান্নাত কাথা মুড়িয়ে শুয়ে পড়ল। আব্দুল্লাহ আবার বলতে চেয়েও আর পারেনি তাই একাই স্বলাত আদায় করল।

ফজরের স্বলাতের জন্য জান্নাতকে বেশ কয়বার ডেকেছে আব্দুল্লাহ কিন্তু সে উঠে নি।
হঠাৎ মধুর এক আওয়াজ শুনে ঘুম ভেঙে গেল জান্নাতের, তাকিয়ে দেখলো আব্দুল্লাহ কোরআন তেলাওয়াত করছে. বাহ!বেশ ভালো লাগছে শুনতে! এতো সকালে এই লোক কোরআন পড়ছে। সবাই তো এখন ঘুমে আচ্ছন্ন থাকে। আব্দুল্লাহ কোরআন পড়ে উঠে গেল। জান্নাত উঠে বসল এবং তাকে প্রশ্ন করল, “আপনি সারারাত ঘুমাননি? এত সকাল সকাল কোরআন পড়ছেন..
আব্দুল্লাহ : জ্বী ঘুমিয়েছি। এখন তো আমার রবের ডাকে সাড়া দেয়ার সময়। ফজরের সময় হয়েছে স্বলাত পড়বেন না?
জান্নাত না করতে পারলো না সে উঠে স্বলাত পড়ল। অনেকদিন পর ফজরের স্বলাত পড়ল।

সকালে নাস্তা করতে গিয়ে দেখল আব্দুল্লাহ আগেই সব তৈরী করে রেখেছে, জান্নাত অবাক হয়ে ভাবতে লাগল এই হুজুর আবার রান্নাও করে!!..

আব্দুল্লাহ জান্নাতকে বলল আপনি খেয়ে নিন আমার দেরি হচ্ছে আমি গেলাম। আসসালামু আলাইকুম। জান্নাত আর তাকে পাল্টা প্রশ্ন করে নি সে খেয়েছে কিনা? অবশ্য, সে না খেয়েই চলে গেল।জান্নাত নাস্তা খেয়ে জানালার পাশে বসে বসে ভাবছে কিভাবে কাটবে তার জীবন? হঠাৎ তার নজর পড়ল একটি বইয়ের দিকে ‘”আসল বাড়ির ঠিকানা”‘ বইটি পড়ার আগ্রহ জাগল। বইটি হাতে নিয়ে পড়া শুরু করল এক এক পৃষ্ঠা যেন তাকে হাশরের ময়দানে নিয়ে যাচ্ছিল। বইটি সে একটানা পড়ে শেষ করল, বইটি পড়ে জান্নাত খুব ভয় পেয়ে গেল এতো ভয় হয়ত সে রাতে ভুত এফএম শুনেও পায়নি। ভয়ে তার চোখ দিয়ে পানি ঝরতে লাগল আসলেই তো দুনিয়া কিছুই না,মরতে তো একদিন হবেই কি হবে সেদিন। সে তো কোন ভালো কাজ ও করেনি তাহলে কি সে জাহান্নামী!!! নামাজ ঠিক মত পড়েনি, কারো সাথে ভালো আচারণ ও করেনি, পর্দা? তা নিয়ে তো ভেবেও দেখেনি। যে পার্থিব সুখে তালাশে সে ছিল তা তো নিতান্তই মিথ্যে ব্যতীত আর কিছুনা!!..

আর কিছু না ভেবে ওজু করে ২রাকাত নফল নামাজ পড়তে বসল, এতো বেশি অনুতপ্ত হয়ে কান্না শুরু করল যে তার কান্নাই থামছিল না। হঠাৎ, কলিংবেল বেজে উঠল,। জান্নাত উঠে দাঁড়াল চোখ মুছে দরজা খুলল, আব্দুল্লাহ প্রবেশ করেই বলল আসসালামু আলাইকুম। এই বলে জান্নাতকে একটি ফুল দিল কিন্তু জান্নাত তা নিলো না। আব্দুল্লাহ ফুলটি টেবিলে রেখে দিয়ে রান্না ঘরে চলে গেল। জান্নাত পরে ফুলটি হাতে নিয়ে মুচকি হাসতে লাগল,।আব্দুল্লাহ জানালা দিয়ে দেখল এবং খুব খুশি হল। ”আব্দুল্লাহ রান্না করতে ভালোই জানে মা বাবা মরার পর থেকে একাই থাকত তাই সব রান্না তার আগে থেকেই জানা ছিল”। আব্দুল্লাহ জান্নাতের প্রিয় খাবারগুলো তৈরী করে এবং জান্নাতকে ডাকে কিন্তু জান্নাত আসেনা, আব্দুল্লাহ রুমে গিয়ে বলে, “বেগম সাহেবা, আমি কি আপনার ৫মিনিট সময় নষ্ট করতে পারি “? জান্নাত হ্যাঁ না কিছু বলে না। আব্দুল্লাহ জান্নাতের হাত ধরে টেনে নিয়ে যায় টেবিলের দিকে, জান্নাত দেখে অবাক যে সব খাবার তার পছন্দের।
-“আপনি কিভাবে জানেন এগুলো আমার প্রিয় খাবার?
“-কি করব বলেন, প্রেমে পড়লে সবকিছুই করতে হয়।

-মজা করবেন না,বলেন কিভাবে জানেন এসব?

-সকালে মাকে কল দিয়ে জেনে নিয়েছি আপনার কি কি পছন্দ? আপনি তো আর কথা বলেন না তাই আর কি করার?. বসুন না, খেয়ে বলুন কেমন হয়েছে?

-ও আচ্ছা। খেতে বসল দুইজনেই, খাবার বেশ মজাদার হয়েছে, জান্নাত চুপচাপ খেতে লাগল আর আব্দুল্লাহ তাকে বেশ ভালো ভালো গল্প শুনাতে লাগল কিছু গল্প শুনে জান্নাত খুব হাসল এরপর জান্নাত লক্ষ্য করল আব্দুল্লাহ তার হাসি দেখে তার দিকে তাকিয়ে আছে, জান্নাত হাসি বন্ধ করে রুমে চলে গেল। আব্দুল্লাহ রুমে যেতেই জান্নাত তাকে প্রশ্ন করে, আমি অনেক গুনাহ করেছি আল্লাহ কি আমাকে ক্ষমা করবেন? আব্দুল্লাহ একটু অবাক হল “অবশ্যই,আল্লাহর কাছে যে বান্দা তার ভুলের জন্য অনুতপ্ত হয়ে মাফ চায় আল্লাহ তাকে মাফ করে দেন, হোক তার গুনাহ পাহাড় সমান “।

জান্নাত তার কথা শুনে বলল আপনি কি এমন আরো কিছু কথা বলতে পারবেন? আব্দুল্লাহ বেশ খুশি হয়ে বলল, বেগম সারা রাত,সারা জীবন বলতে রাজি..আব্দুল্লাহ বলা শুরু করল, জান্নাত খুব মনোযোগ দিয়ে শুনতে লাগল…..রাত কিভাবে পার হয়ে গেল কেউ টের পেল না… ফজরের আযান দিল দুইজনে উঠে নামাজ পড়ল একসাথে।

আজ জান্নাত নাস্তা বানিয়ে আব্দুল্লাহকে ডাকল, আব্দুল্লাহ বলে উঠল, বেগম আপনি এতো কষ্ট করলেন কেন?? আমি নিজেই করে নিতাম,…খাওয়া শুরু করল, খাবারে এতো লবণ হয়েছে যে তা খাওয়া অযোগ্য ছিল তাও আব্দুল্লাহ খাবাবের খুব প্রশংসা করল এবং বলল আমি গেলাম আমার দেরি হচ্ছে। আসসালামু আলাইকুম। ভালোবাসা কবুল করবেন কবে বেগম? এই বলেই আব্দুল্লাহ চলে গেল।

জান্নাত বসে খাওয়া শুরু করল আর সাথে সাথে মুখ থেকে ফেলে দিল “ছিঃ, এতো লবণ?!! না জানি উনি কিভাবে খেয়েছে!.. সত্যি,হয়ত ভালোবাসে।

জান্নাত দুপুরে রান্নার প্রস্তুতি নিচ্ছে রেসিপি বই দেখে চেষ্টা করছে হঠাৎ বেল বেজে উঠল। দরজা খুলে দেখল একটা ছেলে, “ম্যাডাম, আমি আব্দুল্লাহ স্যারের অফিসের পিয়ন স্যার আপনার জন্য এই গিফট গুলো পাঠিয়েছেন “।

জান্নাত গিফট গুলো খুলে দেখ একটি লাল গোলাপ, দুইটি চকোলেট, একটি বোরকা সাথে একটি ছোট নোট, “”আসসালামু আলাইকুম, আজ বিকেলবেলা কি বাইরে ঘুরতে যেতে পারি? যদি আপনার ইচ্ছে থাকে বোরকা পড়ে রেডি থাকবেন বেগম,.আমি বাসার নিচে অপেক্ষা কবর। 💜 জান্নাত খুব খুশি হয় এবং ভাবতে লাগে হয়ত তার সুখ আব্দুল্লাহর সাথেই।

জান্নাত আছরের স্বলাত পড়েই খুব সুন্দর করে সাজগোছ করে এবং আব্দুল্লাহর দেয়া সে বোরকা পরে এবং জানালার পাশে বসে আব্দুল্লাহর অপেক্ষা করতে লাগে।। কিন্তু আব্দুল্লাহর কোন খবর নাই বিকেল শেষ সন্ধ্যা হয়ে গেল.. জান্নাত তাকে কল দিচ্ছে কিন্তু তার ফোন বন্ধ।

রাত ৮টা বেজে গেল কিন্তু আব্দুল্লাহর কোন খবর নেই। হঠাৎ বাসার ল্যান্ডলাইনে কল আসে, জান্নাত ফোন ধরে তার ১০সেকেন্ডের মধ্যে ফোন হাত থেকে পড়ে যায় এবং জান্নাত মাটিতে বসে পড়ে। জান্নাতের দুই চোখ বয়ে অঝোরে অশ্রু ঝরতে থাকে,,,,…. “আমি তাকে হারিয়ে ফেলেছি… আল্লাহ প্রথম পরিক্ষা হিসেবে আমার স্বামী নিয়েছে.. আলহামদুলিল্লাহ্‌ হয়ত আল্লাহ এটাই উত্তম ভেবেছেন, এই দুনিয়ায় হল না হয়ত জান্নাতে আমাদের একত্রিত করবেন আল্লাহ “.. এসব বলে নিজেকে স্থির করতে চাইলেন কিন্তু মন মানে না কান্না থামেই না। জান্নাত নামাজে দাঁড়িয়ে গেল আর দুই চোখ বয়ে কান্না, সেজদায় লুটে গেলেন। কান্না থামছেই না খালি মনে হচ্ছে, এই স্বল্পদিনের সংসারে তাকে আমি কখনো হাসাতেও পারিনি কিন্তু সে আমার জন্য কত কি করল…..

হঠাৎ, রুমে সামনে কারো ছায়া দেখা যাচ্ছে কিন্তু রুমে লাইট অফ থাকার কারণে তার চেহারা দেখা যাচ্ছে না। জান্নাত উঠে দাঁড়ায় রুমের লাইট অন করে দেখে আব্দুল্লাহ সামনে দাঁড়িয়ে আছে মাথায়, হাতে ব্যান্ডেজ লাগালো। জান্নাত অবাক হয়ে গেল, সে স্বপ্ন দেখছে না তো.. আব্দুল্লাহ জান্নাতের হাত ধরে বলে, আলহামদুলিল্লাহ্‌ আল্লাহ আমাকে জীবিত রেখেছেন।
জান্নাত আব্দুল্লাহকে ধরে আবার কান্না শুরু করে এবং বলে আমি ভেবেছি আমি আপনাকে হারিয়ে ফেলছি… আলহামদুলিল্লাহ্‌ আল্লাহ হয়ত এর মাধ্যমে আমার ধৈর্য্য পরিক্ষা করেছেন।..

এরপর থেকে তারা শুরু করে তাদের সুন্দর ছোট একটি সংসার 💜..

আল্লাহ সবাইকে ধৈর্য্য ধারণের তৌফিক দিক।

গল্পের বিষয়:
ইসলামিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত