সমস্ত প্রশংসা মহান প্রভুর প্রতি। যিনি আমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন এবং অসংখ্য নিয়ামত দান করেছন।
মানুষের হৃদয়ের সব উচ্চারণ নিঃশব্দেই হয়। এই সব নিঃশব্দ উচ্চারণের নাম ভাব। ধ্বনির মাধ্যমে ভাব গুলো সশব্দে প্রকাশ হয়ে ভাষায় পরিণত হয়। মনের ভাব প্রকাশ করার একমাত্র উপাদান হলো ধ্বনি। তাহলে ধ্বনি তৈরি হলো কি করে? এই প্রশ্নের জবাব পাওয়া যায় পবিত্র কোরআনে। মহান আল্লাহ বলেন ‘আমিই মানুষকে সৃষ্টি করেছি এবং তাকে ভাব প্রকাশ করতে শিখিয়েছি’(১)। ভাব প্রকাশ করতে শিখানো মানে ভাষা শিখানো।
ভাষা মহান আল্লাহর অপার নেয়ামত। মানুষ জন্মসূত্রে মা ও মাতৃভূমি থেকে যে ভাষা লাভ করে সেটাই তার মাতৃভাষা। ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা। মানব জীবনের এমন কোনো বিষয় নেই যা ইসলামের আলোচনার অন্তর্ভুক্ত নয়। ইসলামের দৃষ্টিতে মাতৃভাষার গুরুত্ব অপরিসীম।
পৃথিবীতে হাজার হাজার ভাষা বিদ্যমান। পবিত্র কোরআনের ভাষ্য অনুযায়ী ভাষা বৈচিত্র্য মহান আল্লাহর অনুপম নিদর্শন। কোরআনে ইরশাদ হয়েছে ‘আর তার নিদর্শনাবলির মধ্যে রয়েছে মহাকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র্য’ (২)। মানুষের মাতৃভাষার ভিন্নতাও কুদরতের এক বিস্ময়কর নিদর্শন। তাই কারো মাতৃভাষাকে অপমান করা আল্লাহর নিদর্শনকে অপমান করার শামিল।
মহান আল্লাহ যুগে যুগে বিভিন্ন জাতির কাছে অসংখ্য নবী রাসূলকে তাদের মাতৃভাষায় প্রেরণ করেছেন। আল্লাহ বলেছেন ‘আমি সকল নবী রাসূলকে তাদের স্বজাতির ভাষাভাষী করেই পাঠিয়েছি, যাতে তাদেরকে পরিষ্কার বোঝাতে সক্ষম হয়’(৩)।
শুধু নবী প্রেরণের ক্ষেত্রেই নয় আসমানী গ্রন্থ সমূহ নাযিলের ক্ষেত্রেও নবী এবং তার স্বজাতির মাতৃভাষাকেই আল্লাহ প্রাধান্য দিয়েছেন। হযরত আব্বাস (রাঃ) প্রমুখ থেকে বর্ণিত আছে যে, আল্লাহ তা’য়ালা নবীগনের প্রতি যত গ্রন্থ অবতীর্ণ করেছেন সবগুলোর আসল ভাষা ছিলো আরবী। জিবরাঈল (আঃ) সংশ্লিষ্ট নবীর ভাষায় অনুবাদ করে নবীগণের নিকটে বর্ণনা করেছেন এবং তারা নিজ নিজ মাতৃভাষায় তা উম্মতের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন'(৪)।
উদাহরণ স্বরূপ হযরত ঈসা (আঃ) এর জাতির মাতৃভাষা ছিলো সুরিয়ানি, এ ভাষায় তাঁর প্রতি ইঞ্জিল অবতীর্ণ হয়। হজরত মূসা (আ.)-এর সম্প্রদায়ের ভাষা ছিল ইবরানি, এ ভাষায় তাওরাত নাজিল হয়। হজরত দাউদ (আ.)-এর গোত্রের ভাষা ছিল ইউনানি, তাই যাবুর ইউনানি বা আরামাইক ভাষায় অবতীর্ণ হয় (৫)। মহানবী (সাঃ) এর মাতৃভাষা আরবী হওয়ায় একমাত্র পবিত্র কোরআন সরাসরি আরবী ভাষায় নাযিল হয়েছে। আল্লাহ বলেন ‘নিশ্চয়ই আমি একে (কোরআন) অবতীর্ণ করেছি আরবী ভাষায়, যাতে তোমার বুঝতে পারো’ (৬)।
সকল মাতৃভাষাই আল্লাহর সৃষ্টি। তাই আল্লাহর কাছে সব ভাষাই সমান। এক ভাষা অন্য ভাষার উপর শ্রেষ্ঠ নয়। মহানবী (সাঃ) বলেছেন ‘তোমারা তিন কারণে আরবী ভাষাকে ভালোবাসবে আমি আরবী ভাষী, কোরআনের ভাষা আরবী, এবং জান্নাতের ভাষাও আরবী’ (৭)। সুতরাং এই তিন কারণ ছাড়া আরবী ভাষা ও আরবীয়দের প্রতি ভালোবাসাকে স্বজাতি ও নিজ মাতৃভাষার উপর প্রাধান্য দেয়ার কোনো সুযোগ ইসলামে নেই।
মহানবী (সাঃ) বিদায় হজ্জের ভাষণে বলেছেন ‘অনারবের উপর আরবীয়দের কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই’ (৮)। এই কারণে রাসূল (সাঃ) এর ভাষা এবং গ্রন্থ আরবী হওয়ায় সত্ত্বেও ধর্মীয় জ্ঞান প্রচারের ক্ষেত্রে আরব আনারবের পার্থক্য বিলুপ্ত হয়ে গেছে।’ প্রত্যেক দেশ ও জাতির মধ্যে এমন আলেম সৃষ্টি হয়েছে, যারা কোরআন ও হাদিসের শিক্ষাকে জাতির কাছে নিজ নিজ মাতৃভাষায় অত্যন্ত সহজভাবে পৌঁছে দিয়েছেন। ফলে প্রত্যেক জাতির মাতৃভাষায় পয়গাম্বর প্রেরণের যে প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি হতে পারতো, তা অর্জিত হয়ে গেছে’ (৯)।
ইসলামে মাতৃভাষার গুরুত্বের প্রতি কোরআন হাদিসের মাধ্যমে এতো জোর দেয়ার পরেও কোনো মুসলিম ব্যক্তি বা জাতি যদি খোদার কুদরতের নিদর্শন তথা স্বীয় মাতৃভাষার প্রতি সম্মান প্রদর্শন না করে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য জ্ঞাপন করতে চায় তবে তাদেরকে বিখ্যাত সাহিত্যিকের ভাষায় স্বরণ করাতে চাই ‘মাতার অবহেলা কিংবা অসম্মান যেমন পাপ মাতৃভাষার অবহেলাও তেমনই গুরুতর অপরাধ’ (১০)।
টীকাঃ-
১. সূরা আররহমান ২-৪ নং আয়াত।
২. সূরা রূম ২২ নং আয়াত।
৩. সূরা ইবরাহীম ৪নং আয়াত।
৪. এই রেওয়ায়েতটি আল্লামা সুয়ূতীর ইতক্বান গ্রন্থে এবং তাফসীরে মাআরেফুল কোরআান পৃঃ ৭১২ এ উল্লেখ আছে।
৫. মাজমূ‘ ফাতাওয়া ৬/৫২২।
৬. সূরা ইউসুফ ২নং আয়াত।
৭. সহিহ বুখারী।
৮. সহিহ বুখারী।
৯. তাফসীরে মাআরিফুল কোরআন সূরা রূমের ভাব অনুসারে।
১০. সৈয়দ ইসমাইল হোসেন শিরাজী।