গত ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬ সুবহে সাদিকের সময় উপমহাদেশের অন্যতম প্রবীণ আলেমে দ্বীন, হাজার হাজার আলিমদের উস্তাদ, ছারছীনা দারুসসুন্নাত আলীয়া মাদরাসার সাবেক ভাইস প্রিন্সিপাল আল্লামা মোস্তফা হামিদী ইন্তেকাল করলেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সুবাদে তার ইন্তেকালের খবর দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল দেশ-বিদেশে। পরদিন থেকে মানুষ পঙ্গপালের মতো ছুটল তার নিজবাড়ি কুমিল্লার চারিজানিয়ায়। আল্লামা মোস্তফা হামিদী কুমিল্লা জেলার নাঙ্গলকোট উপজেলার চারিজানিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ছোটবেলা থেকেই প্রখর মেধার অধিকারী ছিলেন আল্লামা মোস্তফা হামিদী। তিনি ছিলেন ইলমের সমুদ্র। ছারছীনা মাদরাসায় অধ্যয়ন করার সুবাদে হুজুরকে কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। হুজুর আমাদের খণ্ডকালীন ক্লাস নিতেন। ছাত্রদের সাথে তিনি ছিলেন বন্ধুবৎসল। আমি ২০০০-২০০১ শিক্ষাবর্ষে কামিল অধ্যয়ন করি। হুজুর তখন চাকুরী থেকে অবসর নিয়েছিলেন। তারপরও থেমে থাকেনি তার দারসে হাদীসের শিক্ষাদান। ইলমের খাজানা উজাড় করে ঢেলে দিয়েছেন প্রিয় ছাত্রদের বুকে বুকে।
হুজুরের আবাসিক রুম ছিল দরবার এলাকায়। দরবার এলাকায় ফুলবাগান, কবুতর আর পাখিদের কল কাকলীতে এক মায়াবী পরিবেশ বিরাজমান। ছারছীনা দরবার শরীফের প্রতিষ্ঠাতা শাহ সুফী নেছার উদ্দীন আহমদ (র.) আবু জাফর ছালেহ (র.) ও বর্তমান পীর সাহেব হুজুর শাহ মোহাম্মদ মোহেবুল্লাহ এর রূহানীয়তের বরকত রয়েছে সেখানে। এই নীরব নিঃস্তব্ধ স্নিগ্ধময় জান্নাতি পরিবেশে হুজুর দিনরাত কিতাব অধ্যয়নে মশগুল থাকতেন। ক্লাস, নামাজ, খানাপিনা এসব প্রত্যহিক রুটিন ছাড়া অলটাইম তার চোখ কিতাবের পৃষ্ঠায় নিবিষ্ট থাকত। কিতাব অধ্যয়নে তার মতো এতো ধৈর্যশীল আমি আর কাউকে দেখিনি। এমন অনেক রাত ছিল-বাদ এশা তিনি কিতাব অধ্যয়নে বসে সারারাত পার করে দিয়েছেন। ইলমের মধু আহরণ করতে করতে রাত কিভাবে পার হয়ে যেত হুজুর টেরই পেতেন না।
হুজুর একদিকে যেমন ছিলেন উঁচুস্তরের আলিম, অন্যদিকে ইলমে তাসাউফের ক্ষেত্রে ছিলেন একজন উঁচুস্তরের কামিল ওলী। তিনি এতো সাদাসিধে সহজ-সরল জীবন-যাপন করতেন তার চাল-চলনে টের পওয়া যেত না তিনি যে ইলমের দরিয়ায় হাবুডুবু খাচ্ছেন। তবে কঠিন রিয়াজত মোরাকাবা মোশাহায় তিনি যে মগ্ন থাকতেন তা তার চেহারায় অনুমেয় হতো। নিয়মিত তাহাজ্জুদ, কোরআন তিলাওয়াত, দুরুদ শরীফ পাঠ, জিকির-আযকার ও তরীকার সবক তাঁর এসব নিত্যদিনের রুটিনে কোন ব্যত্যয় ঘটতো না। মাথায় কালো পাগড়ী, পরনে ঢিলাঢালা সেকাব্বন ও পাজামা, পায়ে প্লাস্টিকের কালো সু পরিধান করতেন।
আল্লামা মোস্তফা হামিদী হুজুর তার ছাত্রাবস্থাইও উস্তাদগণের প্রিয়পাত্র হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর ছারছীনা মাদরাসায় অধ্যয়নকালে একদিন শাহ সুফী আবু জাফর মোহাম্মদ সালেহ (র.) মাদরাসার তৎকালীন হেড মুহাদ্দিস আল্লামা নিয়াজ মাখদুম খোতানী (র.)-কে বললেন-হে নিয়াজ মাখদুম! তুমি তোমার মতো ইলমের উত্তরাধিকার কাউকে বানাতে পেরেছো কি? আল্লামা নিয়াজ মাখদুম (র.) তখন মোস্তফা হামিদী হুজুরকে দেখিয়ে বললেন-আমার আসনে আমি মোস্তফা হামিদীকে রেখে যাচ্ছি।
হুজুর একেবারে অল্প খেতেন। অল্প খাবার, অল্প নিদ্রা, অল্প কথাবার্তা বলা-এসব যে একজন ওলীর বৈশিষ্ট্য তা হুজুরের বাস্তব জীবনের সাথে মিলে যায়। রাতে হুজুর খুব অল্প নিদ্রা যেতেন। কথাবার্তাও কম বলতেন।
আমরা ছারছীনা মাদরাসায় অধ্যয়নকালে দেখেছি হুজুরের সেবক খাদিম ছিল না বললেই চলে। কারণ তিনি নিজ হাতে কার্য সম্পাদনে আগ্রহী ছিলেন। ছাত্ররা এগিয়ে গিয়ে যেটুকু খেদমত করার সুযোগ পেত এর বাইরে সবকিছু নিজেই করতে পছন্দ করতেন।
দেশের বিভিন্ন প্রান্তে তিনি ওয়াজ-মাহফিলে অতিথি হয়ে অংশগ্রহণ করতেন। ছারছীনা থেকে ঢাকা কিংবা কুমিল্লায় তার বাড়ি কিংবা বাড়ি থেকে সিলেট সফরকালে প্রায়ই তার কোন সফরসঙ্গী থাকত না।
হুজুর প্রায়ই সিলেট সফর করতেন। সিলেটের প্রতি ছিল তার আলাদা টান। তিনি সিলেটের কুলাউড়ায় বেশি সফর করতেন। কুলাউড়ার আল্লামা নিজাম উদ্দীন বিশকুটি ছাহেব কিবলা (র.)-এর দাদা আল্লামা আব্দুল্লাহ ভাদেশ্বরী (র.)-এর লিখিত তাসাউফ বিষয়ক দুর্লভ গ্রন্থ ‘মিরআতুস্ সুলুক’ হজরত মোস্তফা হামিদী হুজুর বঙ্গানুবাদ করেন।
হজরত নিজাম উদ্দীন বিশকুটি ছাহেব কিবলার প্রধান খলিফা হজরত মাওলানা শাহ সুফী আব্দুর রহিম (র.)-এর সাথে তার আত্মিক সম্পর্ক ছিল। আব্দুর রহিম ছাহেবকে হুজুর খুবই মহব্বত করতেন। আব্দুর রহিম ছাহেবের সুযোগ্য সন্তান সুবহানীঘাট কামিল মাদরাসার উপাধ্যক্ষ মাওলানা আবু সালেহ মো. কুতবুল আলম বর্ণনা করেন-আব্দুর রহিম ছাহেবের ইন্তেকালের খবর পেয়ে আল্লামা মোস্তফা হামিদী হুজুর কুমিল্লা থেকে কুলাউড়ার উদ্দেশ্যে রওয়ানা করে পরদিন এসে তাদের বাড়ি পৌছেন এবং হজরতের জানাযা না পেয়ে খুবই আফসোস করলেন। অতঃপর জিয়ারত করে দীর্ঘক্ষণ মোরাকাবা করলেন। জিয়ারত থেকে ফিরে এসে মাওলানা আব্দুর রহিম ছাহেবের জান্নাতের আলা মাকামে অবস্থান করার কথা বর্ণনা করলেন। তখন সে মজলিসে উপস্থিত ছিলেন হুজুরের একান্ত শাগরিদ ও ছাত্র কুলাউড়া দক্ষিণবাজার জামে মসজিদের খতিব মাওলানা ফয়জুর রহমান।
হামিদী হুজুরের জীবনে অনেক কারামত সংঘটিত হয়েছিল। হুজুর নিজ জবানে আমাদের কাছে বর্ণনা করেন-মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিবাহিনী হুজুরের বুকে একেবারে কাছ থেকে গুলি ছুঁড়ে। আল্লাহর অশেষ মেহেরবাণীতে হুজুরের বুকে গুলি নিক্ষেপকারী সৈনিকের হাত কেঁপে গুলি বুক বরাবর ছুঁয়ে ছুয়ে যায় কিন্তু বুকে বিদ্ধ হয়নি একটুও। এভাবে পরপর কয়েকবার বুলেট নিক্ষেপ করেও তারা হুজুরকে হত্যা প্রচেষ্টা থেকে ব্যর্থ হয়।
নিজের শায়েখ ও পীর মুরশিদের প্রতি হুজুরের ছিল অগাধ শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা আর সর্বোচ্চ সম্মান। হুজুরের এলাকার নাম চারিজানিয়া। হুজুর হাসি মুখে আমাদের ক্লাসে বলতেন-চারিজানিয়ার ব্যাখ্যা জানো-চার জন ব্যক্তি-দাদা হুজুর শাহ নেছার উদ্দীন (র.), মরহুম হুজুর আবু জাফর ছালেহী (র.), বর্তমান হুজুর শাহ মোহাম্মদ মোহেবুল্লাহ, আর তৃতীয় ব্যক্তি আমি মোস্তফা হামিদী। ছারছীনার বর্তমান পীর ছাহেব কিবলা শাহ মোহাম্মদ মোহেবুল্লাহর সাথে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে মাহফিলে সফর সঙ্গী হতেন তিনি। পীর ছাহেব হুজুরের ছেলে শাহ্ ছাহেবদ্বয়কেও হুজুর যথাযথ সম্মান করতেন। এতো উঁচু পর্যায়ের একজন আলিম অথচ তার বিনয়ীভাব আচার ব্যবহার ছিল মাটির মতো। অহংকার আত্মগৌরবের কালিমা তাকে স্পর্শ করেনি।
বর্তমান তথ্য প্রযুক্তির যুগে ইন্টারনেটেও হুজুর কিতাব অধ্যয়ন করতেন। ছারছীনা মাদরাসার মুফাস্সির মাওলানা আ.জ.ম. ওহীদুল আলম এর রুমে ল্যাপটপে ‘মাকতাবাতে শামেলা’ পড়তেন।
ইন্তিকালের মাত্র কয়েকদিন পূর্বে হুজুর কুমিল্লায় সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হলেন। পরদিন উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে ঢাকা স্থানান্তর করা। ঢাকায় হুজুরের সফল অপারেশন হয়। মোটামোটি সুস্থ হয়ে বাড়িতে ফিরে আসেন। বাড়িতে এসে অসুস্থ্য অবস্থায়ও কুরআন তিলাওয়াত, জিকির-আযকার, অজীফা, তাহাজ্জদ নামাজ আদায়ের রুটিনে কোন ব্যত্যয় ঘটেনি।
আমরা ছারছীনা অধ্যয়নকালে মাঝে মধ্যে হুজুর মাগরিবের নামাজের ইমামতি করতেন। ফরজ, সুন্নত ও আওয়াবীন নামাজ বাদে হুজুর জিকির করাতেন। হুজুরের জিকিরের সেই সুর লহরী এখনো আমার কর্ণকুহরে ভেসে আসে।
হুজুরের নামাজ আদায় আমি স্বচক্ষে দেখেছি। এতো বিনয়ী খুশু খুদু ও ধীরস্থীরভাবে নামাজ আদায় করতেন যা দেখে অন্তর চক্ষুটা শীতল হয়ে যেত। হুজুর খুব ধীর পায়ে হাঁটতেন। যেন রাস্তায় সবচেয়ে ক্ষুদ্র প্রাণী পিঁপড়াও যাতে কষ্ট না পায়। হুজুর সাদা রং বেশি পছন্দ করতেন তাই অধিকাংশ সময়ই সাদা পাঞ্জাবি পরতেন। মাথায় কালো পাগড়ি, হুজুরের খয়েরী রংয়ের জায়নামাজটা আজও আমার চোখের সামনে ভেসে উঠে। আমরা যখন মসজিদ থেকে বের হয়ে রুমে চলে আসতাম অতঃপর কোন প্রয়োজনে ক্যান্টিন, লাইব্রেরী কিংবা দোকানের দিকে অগ্রসর হতাম তখন হুজুর জায়নামাজ হাতে মসজিদ থেকে ধীর পায়ে বের হয়ে আসতেন।
ব্যক্তি জীবনে হুজুর
হুজুরের আত্মবিশ্বাস ছিল প্রবল আর স্বপ্ন ছিল আকাশের মতো বিশাল। হুজুর তার বাড়িতে চারিজিনিয়া ছালেহীয়া ইউনিভার্সিটির ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন এবং ভবনের কাজও অনেকটা সম্পন্ন করে যান। হুজুর বলতেন-মাওলানা ভাসানী যদি তার বাড়িতে ভাসানি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে যেতে পারলেন-তাহলে আমার বাড়িতে আমি বিশ্ববিদ্যালয় কেন প্রতিষ্ঠা করতে পারব না, আমার বিশ্ববিদ্যালয় একদিন পূর্ণতা লাভ করবে ইনশাআল্লাহ। যেই কথা সেই কাজ। হুজুর ইন্তেকাল করলেন ২০১৬ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর। তার পরদিন আমরা সিলেট থেকে একটি ভাড়া করা গাড়ি নিয়ে হুজুরের জানাযায় শরীক হতে কুমিল্লা যাওয়ার প্রস্তুতি শুরু করলাম। পরে খবর পেলাম জানাযা বিকেল ৪ টায় অনুষ্ঠিত হবে। বিধায় আমরা রাতে ঠিক মতো বিশ্রাম নিয়ে পরদিন ফজরের পূর্বেই রওয়ানা হলাম কুমিল্লার উদ্দেশ্যে। কুমিল্লা আলিয়া মাদরাসায় যাত্রা বিরতি করে জোহরের নামাজ ও দুপুরের আপ্যায়ন শেষ করে রওয়ানা হলাম হুজুরের বাড়ির উদ্দেশ্যে।
কুমিল্লা থেকে গাড়ি ছাড়ার প্রায় ঘন্টাখানেক পর যখন হুজুরের গ্রামের রাস্তা চারিজানিয়ায় পৌঁছলাম-তখন চোখে পড়ল শুধু গাড়ি আর গাড়ি। কোন অবস্থাতেই জ্যাম ঢেলে গাড়ি নিয়ে আর সম্মুখে অগ্রসর হওয়া সম্ভবপর হয়নি। বাধ্য হয়ে আমরা হেঁটে রওয়ানা হলাম হুজুরের বাড়ি ও জানাযাস্থলের দিকে। মানুষের ভীড় এতো বেশি ছিল যে, হেঁটে হেঁটে অগ্রসর হওয়াটাও নাভিশ্বাস ছিল। শেষ পর্যন্ত অনেক কষ্টের পর দেখা পেলাম জানাযাস্থল, হুজুরের বাড়ির মসজিদ, মাদরাসা, শোকার্ত মানুষ। কোন রকমে ভীড় ঢেলে লাশের কাছে পৌছলাম। সুবহানাল্লাহ হুজুর যেন দিব্যি আরামে ঘুমাচ্ছেন। ইন্তেকালের পরেও হুজুরের মুখে মুচকি হাসি। দু’দিনের লাশ। অথচ বরফের কফিন ছাড়াই একেবারে টাটকা তরতাজা লাশ কফিন দিয়ে মোড়ানো। একজন সত্যিকার নায়েবে নবী, একজন নবী প্রেমিক ওলীর লাশ যে পচে না-গলে না তার বাস্তব প্রমাণ স্বচক্ষে দেখলাম। মুখে স্পষ্ট মুচকি হাসি এটাই প্রমাণ দেয়-জান্নাতের ফেরেশতারা হুজুরকে আহলান সাহলান জানিয়ে নিতে এসেছিলেন আর ইন্তেকালের পূর্বে জান্নাতে তার অবস্থান (বালাখানা, হুর গেলমান) দেখে মুচকি হাসছিলেন। একজন সত্যিকার নায়েবী নবী, একজন অলি আল্লাহর মৃত্যু তো এমনই হবে।
‘মাউতুল আলিমে মাউতুল আলম’-একজন সত্যিকার আলিমের মৃত্যু একটি একটি পৃথিবীর মৃত্যু বটে। আল্লামা মোস্তফা হামিদী চলে গেলেন তার অনন্তকালের দিকে। একটি জ্ঞানের সমুদ্রকে আমরা হারালাম। হারালাম একটি পৃথিবীকে। ওগো মাবুদ! আল্লামা মোস্তফা হামিদীর স্থান তোমার কুদরত থেকে পূর্ণ করে দাও। আর আমাদেরকে তার রূহানী ফায়েজ দানে ধন্য কর। আমিন। ইয়া রাব্বাল আলামীন। বিহুরমাতি সায়্যিদিনা নাবিয়্যিনা মোহাম্মাদিন ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লিম।
গল্পের বিষয়:
ইসলামিক