স্রষ্টায় ফেরা

স্রষ্টায় ফেরা

আবু সালেহ চেয়ারে বসে ঝিমুচ্ছেন। আর মাত্র ক’দিন পর রমজান মাস শুরু হবে। ধর্মপ্রাণ মানুষ আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য দিনরাত ইবাদত বন্দেগীতে মশগুল থাকবেন। ছোট ছোট শিশুকিশোর থেকে শুরু করে বৃদ্ধ-বৃদ্ধা সকলে রোযা-নামাযে ব্যস্ত সময় পার করবেন।
আবু সালেহ একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করেন। মাস শেষে ভালো সম্মানীও পান। সংসারে তার এক ছেলে, এক মেয়ে। ছেলে, মিনহাজ ইন্টারমিডিয়েট ফার্স্ট ইয়ারে পড়ছে। আর মিথিলা পড়ছে নবম শ্রেণিতে।

সহধর্মিনী রেশমা সিদ্দিকাও তার মনেরমতো। পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায় করেন। স্বামীকে মনেপ্রাণে ভালোবাসেন। কিন্তু স্বামীর প্রতি তার একটাই অসন্তোষ। স্বামী পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়েন না। আবার রমজান মাসের রোযাও রাখেন না। বিয়ের পর দীর্ঘ বিশ বছর অতিক্রম হলো। প্রায়শই নামাযের সময় হলে আবু সালেহ নিজেকে আড়াল করতে চান। কখনও ঘুমের ভান করেন। কখনও আবার নামাযের সময় গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েন।

প্রথম প্রথম অনেক অনুনয় বিনয় করেছেন। কিন্তু কিছুতেই স্বামীকে নামায- রোযায় ফিরাতে সক্ষম হননি।

এমনও অনেকদিন কেটেছে, স্ত্রী তাকে নামায আদায় করতে কড়া কড়া কথাও বলেছেন। আবু সালেহ নীরব থেকেছেন।

‎স্ত্রী ব্যর্থ হয়ে ফিরে গিয়ে মেয়েকে সাথে নিয়ে নামায আদায় করেছেন।
ছেলেও অনেকটা বাবার মতো হয়েছে। বাবার মতো জীবনযাপনে অভ্যস্ত সে। সারাদিন পড়াশুনা, খেলাধুলা আর আমোদ-প্রমোদেই কাটে তার।
সন্ধ্যায় আযান দিলে ঘরে ফিরে আসে। মা আর ছোটবোনকে নামায পড়তে দেখে পড়ার টেবিলে নিশ্চুপ বসে থাকে সে।

নামায শেষে রেশমা সিদ্দিকা ছেলের পাশে বসে আফসোসের গলায় বললেন,
‎- বাবা, কাল থেকে তোমার ফার্স্ট ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষা শুরু হচ্ছে। কলেজ থেকে এসে লাঞ্চ সেরে মাঠে চলে গেলে। এখন ক্লান্ত হয়ে বাসায় ফিরলে। নামাযও পড়লে না। তোমার ছোটবোনকে দেখো, আমার সাথে পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায় করে। এ বয়সে সব রোযা রাখে। তোমাকে এত বুঝিয়েও কোন কাজের কাজ হচ্ছে না। বলি কী! নিজের সবকিছুতে একটু পরিবর্তন আনো। এভাবে চলতে থাকলে তো তোমার রেজাল্ট ভালো হবে না। ভালো মানুষও হতে পারবে না। নামায-কালাম পড়লে সবকিছুতে বরকত পাবে, বুঝলে?
মায়ের কথায় মাথানিচু করে ‎মিনহাজ বলল,
– মা, আমি তোমার কথামতো চলবো। পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায় করবো। আর এবারের সবগুলো রোযাই রাখবো, ইনশাল্লাহ।
ছেলের এমন আশ্বাসে রেশমা সিদ্দিকা খুব খুশি হলেন। কিন্তু তিনি শুধু আশ্বাসেই শান্তি পেতে চান না। এভাবে মিনহাজের বাবা তো প্রায় তাকে কথা দেয়। কিন্তু কথা রাখে না।
মনের মাঝে অনিশ্চয়তা রেখে মুখে হাসির অভিনয়ে বললেন,
– বাবা, তোমার কথা শুনে আমি খুব খুশি হয়েছি। দুইদিনের দুনিয়ার সামান্য সুখের জন্য আমরা সব করতে পারি। কিন্তু যেখানে অনন্তকাল ধরে থাকতে হবে, সেখানে কী নিয়ে যাব! সে চিন্তা আমরা করতে চাই না! যাই হোক,
তুমি বাথরুমে গিয়ে ভালোভাবে ফ্রেশ হয়ে এসে কিছুক্ষণ পড়ো। এরপর এশার নামায আমাদের সাথে একসাথে পড়বে।
– ‎ঠিক আছে, মা। আমি আজ থেকে তোমার আদর্শে চলবো।
রেশমা সিদ্দিকা আজ সবচেয়ে সুখী। ছেলে তার কথামতো চলবার অঙ্গীকার করেছে। তাও এখন থেকে। মনে মনে সে আল্লাহর কাছে পরম কৃতজ্ঞতায় সন্তুষ্টি জানায়। মায়ের মুখে হাসি দেখে মিনহাজেরও ভালো লাগে।
মাকে কক্ষ ছেড়ে চলে যেতে দেখে মিনহাজ বাথরুমের দিকে যায়।

সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা বাজছে। আবু সালেহ এইমাত্র ঘরে প্রবেশ করেছেন। পোশাক পাল্টিয়ে ফ্রেশ হয়ে বেডরুমের ফ্যানের নিচে এসে বসলেন। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেন। কারো কোন সাড়া শব্দ না পেয়ে নামাযের কক্ষের দিকে এগিয়ে আসেন।
ছেলে- মেয়ে ও স্ত্রীকে নামায পড়তে দেখে খুশি মনে আবার বেডরুমে চলে আসেন তিনি।
মাথানিচু করে ভাবতে লাগলেন,
– আমার ঘরের সবাই নামায পড়ছে। আর আমি এখানে বসে আছি! মৃত্যুর পর আমার কাজের হিসাব তো আমাকেই দিতে হবে। না, কাল থেকেই আমি নামায- রোযা শুরু করবো।

নামায শেষে বেডরুমে আসেন রেশমা সিদ্দিকা। স্বামীকে দেখে হাসিমাখা মুখে বললেন,
– তুমি কখন এলে?
– এই তো ৩০/৪০ মিনিট হবে। তোমাদেরকে নামাযে দেখে এখানে এসে বসে রইলাম।
– আমাদের সাথে নামায পড়লে তো আরো ভালো হতো।
– আগামীকাল থেকে পড়বো।
– আগামীকাল কেন?
– কাল থেকে রমজান শুরু তো। রোযাও রাখবো। নামাযও পড়বো।
-ঠিক আছে। এখন খাবে, চল।
– মিনহাজ-মিথিলা কোথায়?
– ওরা খাবার টেবিলে। আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে।
– তাহলে চল।

এই বলে তারা খাবার টেবিলের দিকে চলে আসে। খাবার খেয়ে সবাই মিলে টিভি সেটের সামনে বসে টিভি দেখছে। হঠাৎ মিনহাজ “ব্যথা! ব্যথা!” বলে চিৎকার করতে থাকে।

ছেলের আর্তনাদে বাবা-মা দু’জনেই দিশেহারা হয়ে পড়েন। রেশমা সিদ্দিকা ও মিথিলা যেখানে ব্যথা বলছে সেখানে ভালোভাবে মালিশ করতে লাগলো। মিনহাজ একবার বলছে, পিঠে ব্যথা। আবার বলছে, পেটে ব্যথা।

ছেলেকে ছটফট করতে দেখে আবু সালেহ ভাবতে লাগলেন,
– এখন কী করা যায়! হঠাৎ তার মনে হলো- ব্যথা এক স্থানে স্থির নয়। এটা গ্যাস্ট্রিকের ব্যথা হতে পারে।

এই ভেবে তিনি মিনহাজকে একটি গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ খাইয়ে দিলেন। ওষুধ খাওয়ার পরও মিনহাজের ব্যথা কমছে না। সে আরো অস্থির হয়ে কাঁদতে থাকে। ওর অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে এখনই মারা যাবে।
আবু সালেহ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলেন,
‎ – রাত এগারোটা পঁয়তাল্লিশ মিনিট বাজে। এতো রাতে কী করা যায়!
‎হঠাৎ মাথায় এলো- প্রথমে চট্টগ্রাম মেডিক্যালে নিয়ে যাই। সেখানে অভিজ্ঞ ডাক্তার থাকবে।
এই ভেবে সিএনজি যোগে তারা চট্টগ্রাম মেডিক্যালে আসে।
মিনহাজকে জরুরী ইউনিটে ভর্তি করানো হলো। কর্তব্যরত ডাক্তার রোগীর লক্ষণ দেখে চিকিৎসা সেবা দিতে থাকেন। কিছুক্ষণ পর একটু ভালো লাগতে শুরু করলে তাকে নিয়ে আবার বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দেন তারা। কিন্তু বাসায় এসেও মিনহাজ আগের মতো “ব্যথা! ব্যথা!” বলে আর্তনাদ করতে লাগলো।
ছেলেকে এরকম ভেঙ্গে পড়তে দেখে বাবা-মা দু’জনেই দিক্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে এদিকওদিক ছুটোছুটি শুরু করেন। হঠাৎ রেশমা সিদ্দিকার মনে হলো ডাক্তার বলেছেন,
– গ্যাস্ট্রিকের ব্যথা। যদি গ্যাস্ট্রিকের ব্যথাই হয়, তাহলে জোর করে বমি করাতে হবে। পেট ক্লিয়ার হলে আস্তে আস্তে ব্যথাও কমে যাবে।

এরপর মিনহাজকে বাথরুমে নিয়ে গিয়ে বমি করানোর চেষ্টা চললো। বেশ কয়েকবার বমি করার পর মিনহাজ ক্লান্ত শরীরে খাটের ওপর বালিশ মুড়িয়ে শুয়ে থাকবার চেষ্টা করলো।

মিনহাজের বাবা, আবু সালেহ ততক্ষণে ওযু করে জায়নামাজে বসে আল্লাহর দরবারে ছেলের রোগমুক্তির জন্য দু’হাত তুলে কান্না করছেন। তিনি আল্লাহর কাছে অঙ্গীকার করলেন,
” আর কখনও নামায- রোযাসহ ইসলামের পথ ছাড়বেন না।

একটুপর সাহরি খাওয়ার সময় হলো। জায়নামাজ থেকে ওঠে ছেলের কাছে আসেন তিনি। ছেলের মুখ দেখে তার খুব ভালো লাগে। মিনহাজ যেন পুরোপুরিভাবে সুস্থ। আরো কাছে এসে বললেন,
– বাবা, এখন কেমন লাগছে?
– ভালো।
– ব্যথা?
– একদম নেই।
আবু সালেহ স্ত্রী রেশমা সিদ্দিকার দিকে তাকিয়ে বললেন,
– জানো, আমি আল্লাহর কাছে আমাদের ছেলের জন্য দোয়া করেছি। আল্লাহ মনে হয় তা কবুল করেছেন। আজ থেকে আমিও তোমাদের দলে যোগ দিলাম। আমি রোযা রাখবো। নামায পড়বো।
পাশ থেকে মিনহাজ বলল,
– বাবা আমিও রোযা রাখবো।
– না, তুমি তো এখনও দুর্বল। আগে সুস্থ হও।তারপর রাখতে পারবে।
– না বাবা, আমি রোযা রাখবো। আমার এখন তেমন খারাপ লাগছে না। তাছাড়া মানুষের মৃত্যুর তো কোন সময়-অসময় নেই। আজ রোযা না রেখে যদি মরে যায়, তো আল্লাহর কাছে কী জবাব দেবো?

রেশমা সিদ্দিকা পরম মমতায় ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
পাশ থেকে মিনহাজের বাবা বললেন,
– তুমি একদম খাঁটি কথা বলেছো। আজ আমি খুব কাছ থেকে বুঝেছি, মানুষ বিপদে পড়লে কতোটা অসহায় হয়। আর এ সময় সত্যিকার অর্থে মহান স্রষ্টায়ই আমাদের সাহায্য করতে পারেন।
রেশমা সিদ্দিকা মিনহাজের দিকে তাকিয়ে বললেন,
– দুপুরে বাইরে কি খেয়েছিলে, বাবা?
– খেলা শেষে আমরা সব বন্ধুরা মিলে চটপটি খেয়েছিলাম।
– ‎মনে হয়,তা-ই এমন হয়েছে।
আবু সালেহ শক্তকন্ঠে বললেন,
– এ কেমন কথা! চটপটির কী এমন ক্ষমতা আছে যে কারোর পেটে অসুখ করে দিতে পারে! যদি তাই থাকতো তাহলে তো ওর সব বন্ধুরই এমন অসুখ হতো। এটা আসলে মহান আল্লাহ কর্তৃক আমাদের জন্য পরীক্ষামাত্র।
মিথিলা ব্যস্ত গলায় বলল
– মা,বাবা, টেবিলে খাবার রেডি। তাড়াতাড়ি এসো। সাহরি খাওয়ার সময় হয়ে গেছে।

গল্পের বিষয়:
ইসলামিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত