সুদ। হাদীস শরীফের ভাষায়-‘যে ঋণ কোন মুনাফা টেনে আনে তাই সুদ।’ ইসলামের দৃষ্টিতে এর চেয়ে জঘন্য ও খারাপ কাজ আর নেই। এটি এমন একটি আর্থিক ব্যবস্থা যা ধনীকে আরো ধনী এবং গরীবকে আরো গরীব বানাতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। আল্লাহর মনোনীত ধর্ম ইসলামে এটি অর্থনীতির বিষফোড়া হিসেবে খ্যাত। সুদ ইসলাম ধর্মে হারাম ঘোষণা করেছে। মহান আল্লাহ তায়ালার সুস্পষ্ট ঘোষণা হল-‘আল্লাহ ক্রয়-বিক্রয়কে হালাল এবং সুদকে হারাম করেছেন’ (সুরা বাকারাহ : ২৭৫)। অন্যত্র আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন-‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা চক্রবৃদ্ধিহারে সুদ খেয়ো না। আর আল্লাহকে ভয় কর যাতে তোমরা কল্যাণ লাভ করতে পার’ (সুরা আল ইমরান : ১৩০)।
আল্লামা ইবনুল আসির বলেন-‘আকদের বাইরে মূল মালের অতিরিক্ত অংশকে সুদ বলে।’ সুদ দুই ধরনের। প্রথমটি হল-ঋণ দিয়ে বিলম্বে পরিশোধের শর্তে বিনিময় ছাড়া বেশি গ্রহণ বা প্রদান করা। আইয়্যামে জাহেলিয়্যাতের যুগে যার প্রচলন ছিল খুব বেশি। বর্তমানে আমাদের সমাজেও তা অহরহ পাওয়া যাচ্ছে। শুধু তাই নয়, এটার ভয়ংকর রূপ হলো সুদসহ ঋণ সময়মত পরিশোধ করতে না পারলে সুদ বাড়িয়ে দেয়ার শর্তে মেয়াদ বাড়িয়ে দেয়া। আর তাইতো আল্লাহর অমোঘ ঘোষণা-‘আল্লাহ সুদকে নিশ্চিহ্ন করেন এবং সদকা সমূহকে কে বর্ধিত করেন’ (সুরা বাকারা : ২৭৬)। আল্লাহ তায়ালা সুদকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার অর্থ হল-তিনি সুদী মাল-সম্পদের বরকত নষ্ট করে দেন। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) হতে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেন, ‘সুদ যদিও বেশি দেখা যায় কিন্তু তার চূড়ান্ত পরিণতি কমের দিকে।’ হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, সুদ আখেরাতের বরকত নষ্ট করে দেয়।
সুদের দ্বিতীয় প্রকারটি হল-দুটি বস্তু নগদে লেনদেন করার সময় কম বেশি করা। যেমন ১ কেজি চালের বিনিময়ে দেড় কেজি চাল গ্রহণ করা। হাদীসে এটাকে হারাম হিসেবে সাব্যস্ত করেছে। চার মাযহাবের ইমামগণের মতেও এটা হারাম। ওলামায়ে কেরামগণ ঐক্যবদ্ধ যে এ জাতীয় সুদ পবিত্র ধর্ম ইসলাম হারাম ঘোষণা করেছে। যা মহান আল্লাহ তায়ালার এই আয়াতের মাধ্যমে প্রতীয়মান হয়। আল্লাহ বলেন-‘আর তোমরা যদি সুদ পরিত্যাগ না কর, তবে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের সাথে যুদ্ধ করতে প্রস্তুত হয়ে যাও’ (সুরা বাকারা : ২৭৯)। বর্তমান সময়ে এ প্রকার সুদের লেনদেন খুব কমই পরিলক্ষিত হয়। তবে, প্রথম প্রকার সুদের প্রচলন সর্বত্রই পরিলক্ষিত হচ্ছে। যা বিভিন্ন ব্যাংক বা অর্থনৈতিক এনজিও প্রতিষ্ঠানের সাথে আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে হচ্ছে। তাই আমাদের কাছে স্পষ্ট হওয়া দরকার ব্যাংকে টাকা রাখার পদ্ধতি এবং তা হতে লাভ গ্রহণ করার রীতিনীতি সমূহ। সকল উলামায়ে কেরামগণ ঐক্যবদ্ধ যে, সুদ গ্রহণের শর্তে সুদী ব্যাংকে অথবা যে কোন এনজিও সংস্থার কাছে টাকা আমানত রাখা ও বিনিয়োগ করা হারাম। জায়েজ নেই। এমনকি ব্যাংকের নামের সাথে ইসলাম ব্যবহার করে হলেও যদি নির্দিষ্ট অংশ বা শতকরা সাতভাগ, দশভাগ যাই হোক না কেন নির্ধারণ করে আমানত বা বিনিয়োগ করা হয় তা হলে তা কোনভাবে বৈধ হবে না। যদি নির্দিষ্ট কোন অংশ নির্ধারণ না করে ব্যবসার উদ্দেশ্যে লাভ-ক্ষতির ভিত্তিতে সুদী প্রতিষ্ঠান ছাড়া আমানত বা বিনিয়োগ করা হয় তাহলে তা জায়েজ হবে। আমাদের সমাজে বর্তমান সময়ে পরিলক্ষিত হচ্ছে যে বিভিন্ন ব্যাংকে সুদমুক্ত মনে করে একটি নির্দিষ্ট হারে মুনাফা পাওয়ার আশায় ফিক্সড ডিপোজিট রেখে বৎসর শেষে শুধু লোকশান না হয়ে লাভই আসছে। যা প্রশ্নবিদ্ধ। তার সাথে সময়ের কালক্রমে আলেম সমাজও জড়িত হয়ে পড়েছেন। মনে রাখা দরকার, ব্যবসা থেকে সবসময় লাভ হয় না এবং লাভের পরিমাণ প্রতি বৎসর শেষে একই পরিমাণ হয় না। তাই ব্যাংকে টাকা রাখার আগে ধারণা স্বচ্ছ হওয়া প্রয়োজন। উল্লেখ্য যে, শরীয়ত সম্মত ইসলামি ব্যাংক না থাকলে অন্য ব্যাংকে সুদ গ্রহণ না করার শর্তে নিরাপত্তার জন্য আমানত রাখা বৈধ।
মাযাহিবুল আরবা’য়া বা চার মাযহাবের ইমামগণসহ উলামায়ে কেরামগণ ঐক্যমত যে, সুদ প্রদানের শর্তে ঋণ গ্রহণ বা সুদ গ্রহণের শর্তে ঋণ প্রদান উভয়টি হারাম। তাই আলেম সমাজসহ আপামর জনতা অর্থনৈতিক লেনদেনের ক্ষেত্রে সর্বদা সতর্ক থাকা প্রয়োজন কেননা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-‘সুদের সত্তরটি পাপ রয়েছে। তন্মধ্যে সবচেয়ে নিম্নের বা সহজতরটি হলো ব্যক্তি তার মায়ের সাথে ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়া।’ অন্য এক হাদীসে এসেছে-‘সুদের এক দিরহাম আল্লাহর নিকট ছত্রিশটি যেনা বা ব্যভিচার অপেক্ষা জঘন্য।’
শুধু তাই নয়, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সুদের ব্যাপারে পাঁচ ব্যক্তিকে অভিশম্পাত করেছেন। সুদ গ্রহীতা, সুদ প্রদানকারী, স্বাক্ষীদ্বয় এবং লেখক। এই সুদ ব্যক্তি, সমাজ ও অর্থনৈতিক অবকাঠামোকে বিনষ্ট করে তোলে। সুদের করাল গ্রাসে সুদ দাতা, সুদ গ্রহীতা সকলেই আল্লাহর ক্রোধের শিকার হয়।
সুদের কারণে ভাই-ভাইয়ের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব সম্পর্ক নষ্ট হয়। সুদখোর হিংস্র প্রাণীতে রূপ ধারণ করে। অন্যের অধিকার খর্ব করে। সুদের করাল গ্রাসে গরীব ভিক্ষুকের পর্যায়ে পৌঁছায় আর ধনী আরো ধনী হতে থাকে। সমাজে তৈরি হয় অসামঞ্জস্যতা। মানুষ কৃপণ হয়ে যায়। সর্বোপরি সমাজে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। অর্থনৈতিক ভাবেও সুদের প্রভাব কম নয়। সুদ শোষণের সবচেয়ে বেশি শক্তিশালী মাধ্যম। সুদখোর অলস ও উপার্জন বিমুখ হয়ে যায়। কারণ, পরিশ্রম ছাড়া তার টাকা আসতে থাকে। মরণব্যাধী ক্যানসার যেভাবে মানুষকে খুড়ে খুড়ে খায়, ঠিক তেমনিভাবে সুদ ব্যক্তি, সমাজ ও অর্থনৈতিক অবকাঠামোকে ভেঙ্গে করে দেয় চুরমার। এহেন সমস্যা হতে সংশোধন হওয়া দরকার। আল্লাহর বাণীর আলোকে নিজেকে পরিশোধন করা অধিকতর প্রয়োজন। আল্লাহ বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সুদের যে সমস্ত বকেয়া আছে, তা পরিত্যাগ কর। যদি তোমরা ঈমানদার হয়ে থাক’ (সুরা আল বাকারা : ২৭৮)। আল্লাহ যেন আমাদেরকে সংশোধন হওয়ার তাওফিক প্রদান করেন। (আমিন)