সমরকন্দ এলাকায় একজন বিখ্যাত মস্তবড় ডাকাত ছিল, যার নাম ফুজাইল ডাকাত। সেই সময়ে এলাকার নাম করা “ফুজাইল ডাকাত ” কে সব মানুষ চিনত। সমরকন্দ ও আবয়ুর্দের রাস্তায় ডাকাতি করতেন। এ রাস্তা দিয়ে যেই যেত ‘ফুজাইল ডাকাত’ তখন তাদের কাছে থাকা সব কিছু ছিনতাই করে নিতেন। সমস্ত এলাকার মানুষ তার ভয়ে তটস্থ থাকত। কারন ফুজাইল ডাকাত হলো ছোটো-ছোটো ডাকাতদের সর্দার।
তিনি যখন যুবক ছিলেন তখন এক রূপবতী যুবতীর প্রেমে পড়েছিলেন । যুবতীর রূপের ঝলকে তিনি নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিলেন। তারপর ফুজাইল ডাকাত সেই মেয়েটিকে প্রেমের প্রস্তাব পাঠায়, মেয়েটি তখন তার প্রেমের ডাকে সাড়া দিয়েছিল, কারন মেয়েটির পক্ষে তার প্রেমের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেওয়া অসম্ভব ছিল কেননা ফুজাইল ছিল এলাকার নাম করা ডাকাতদের সর্দার।
তারা একে অপরের প্রেমে হাবুডুবু খেতে থাকেন। সুন্দরী মেয়ের প্রেমে উন্মাদ,টগবগে যৌবনের অধিকারী ডাকাত ফুজাইলের মনে আল্লাহর ভয়র ছিটেফোঁটাও ছিল না। ছিল না কোনো চিন্তা আখিরাত, কিয়ামত ও দোজখের। যুবতীর প্রেম ছিল তাঁর নেশা আর রাতের আঁধারে ডাকাতি ছিল তাঁর পেশা।
বেশ অনেক দিন হয়ে গেল , কেউ কারও সাথে দেখাসাক্ষাৎ করতে পারছেন না। প্রেমিকার মুখখানা দেখার জন্য মনটা ছটফট করছিল ফুজাইল ডাকাতের। হৃদয়ের না বলা কথাগুলো বুকের ভেতর অস্থিরতা শুরু করে দিয়েছিল।
ফুজাইল ডাকাত ছুটলেন প্রেমিকার বাড়ির উদ্দেশে। বাড়ির পাশে চলে এলেন। বাড়ির পাঁচিল টপকে ভেতরে প্রবেশ করতে গেলেন।
এমন সময় সেই ডাকাতের কানে এসে পৌঁছল সুমধুর কন্ঠে কারও কুরআন তিলাওয়াতের আওয়াজ। কে তার দিলখুশ আওয়াজে তিলাওয়াত করে চলছে সুরা হাদিদের ষোল নং আয়াতখানা-আয়াতটি ছিল
যারা মুমিন, তাদের জন্যে কি আল্লাহর স্মরণে এবং যে সত্য বাণী অবর্তীর্ণ হয়েছে, তার কারণে হৃদয় বিগলিত হওয়ার সময় আসেনি ?”
সম্বিত ফিরে পেলেন ফুজাইল ডাকাত। আল্লাহর এই বাণী তাঁর হৃদয়ের বদ্ধ দুয়ারে সজোরে আঘাত করতে সক্ষম হলো। এক আঘাতেই বদ্ধ দুয়ারের কপাট খুলে ফেলল ! মর্মে মর্মে মহাবাণীর এ মহাসুর তাঁর হৃদয়ে বাজতে লাগল সুমধুর। তিনি নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলেন না; পাপাচারিতার কালোজাল ছিন্ন করে মনের অজান্তেই বলে উঠলেন, ‘হ্যাঁ, অবশ্যই সময় এসেছে!’ পাঁচিলের উপর থেকেই ফিরে এলেন ফুজাইল ডাকাত। পাঁচিলঘেরা বাড়ির ভেতর প্রেয়সীর সাথে দেখা করার ইচ্ছা সেখানেই দাফন করলেন। আল্লাহর এই কালাম তাঁর বুকের ভেতর তোলপাড় সৃষ্টি করে ফেলেছে। গোনাহের আতিশয্যে তাঁর মৃত অন্তর জিন্দা হয়ে ওঠেছে। তাওবার জন্য তাঁর মনটা আঁতিউঁতি করতে শুরু করেছে।
ফেরার পথে রাত নেমে এল। পাপের পাহাড় মাথায় নিয়ে, অশ্রু টলোমল চোখে, দিকভ্রম ফুজাইল ডাকাত হেঁটে চলছেন। অবশেষে একটি স্থানে এসে ঠাঁই নিলেন। এসে দেখলেন সেখানে একটি ব্যাবসায়ী কাফেলা আশ্রয় নিয়েছে, এবং তাদের মধ্যে কেউ একজন বলাবলি করছে আমাদের কাছে তো অনেক জিনিসপত্র রয়েছে, শুনেছি নাকি এই এলাকায় একজন মস্ত বড় ডাকাত আছে যার নাম ফুজাইল ডাকাত, আমাদের এখানে আশ্রয় নেওয়া কি ঠিক হবে?
আবার তাদের মধ্যে কেউ কেউ বাধা দিয়ে বলছে, এখন সফর করা মোটেই নিরাপদ নয়; যদি কোনো ভাবে আমরা ফুজাইল ডাকাতের খপ্পরে পড়ি তাহলে আমাদের সব জিনিসপত্র ডাকাতি করে নেবে !
ব্যবসায়ীদের কথাগুলো শুনে ফুজাইল ডাকাত শুনতে পেলেন ফলে তার মন ছোটো হয়ে গেল,তিনি নীজেকে মনে করছিলেন। তিনি তখন মনে মনে বললেন, ‘ইয়া আল্লাহ! এই লোকগুলো কী বলে! আমি কি এতটাই বিপজ্জনক?! এতটাই কি ভয়ংকর ? ফুজাইল নামটা কি এ পথ অতিক্রমকারী ব্যবসায়ী কাফেলার আরাম হারাম হয়ে যাওয়ার উপকরণ?!’ তিনি এটাও ভাবলেন, ‘নিশ্চয় এদের কথা থেকে শিক্ষা নেয়ার জন্যে আল্লাহ আমাকে এখানে পাঠিয়েছেন। নইলে সম্পূর্ণ কাকতালীয়ভাবে এদের সাথে আমার এখানে জড়ো হওয়ার আর কোনো কারণ আছে?’
ফুজাইল ডাকাত মনে মনে বললেন, ‘যাহ! আর ডাকাতি করব না; বাকি জীবন বাইতুল্লাহর ছায়ায় আল্লাহর ইবাদতে কাটিয়ে দেব। কিশোরীর প্রেম বাদ দিয়ে আল্লাহর প্রেমে পাগল হয়ে যাব।’
সকাল হলেই ফুজাইল ডাকাত মক্কার উদ্দেশে রওয়ানা হলেন। ক্রমাগত কয়েকদিন সফর করে অবশেষে মক্কায় এসে পৌঁছলেন ফুজাইল ডাকাত। আল্লাহ-রাসুলের প্রেমে মত্ত হয়ে আল্লাহর ঘরের অবস্থানস্থল মক্কা আর রাসুলের ধূলি ধূসরিত মদিনায় জীবনযাপন করতে লাগলেন।
জানেন কে এই ফুজাইল ডাকাত? ইনি হলেন হিজরি দ্বিতীয় শতকের নামকরা মুহাদ্দিস ইমাম ফুজাইল ইবনে ইয়াজ (মৃত্য-১৮৭ হি.) রহ.। আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক, সুফইয়ান ইবনে উয়াইনা, আব্দুর রহমান বিন মাহদি, আবদুর রাজ্জাক ও ইমাম শাফিয়ি প্রমুখ বড় বড় মুহাদ্দিসদের উস্তাদ। ফুজাইল ডাকাত থেকে ইমাম ফুজাইল বিন ইয়াজ হয়ে গেলেন। যাঁর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিলো কুরআনের একটুকরো বাণী।
——–
সূত্রঃسير أعلام النبلاء ৮/৪২২, ইমাম শামসুদ্দিন যাহাবি রহ.।