পড়, তোমার প্রভুর নামে। শিক্ষার এই মহান বাণী নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিলো শিক্ষা ও উন্নয়নের ধর্ম ইসলাম। নবী মুহাম্মদ (সা.) সূচনা করে ছিলেন তার নবুওয়তি জীবনের।
পড়, তোমার প্রভুর নামে। শিক্ষার এই মহান বাণী নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিলো শিক্ষা ও উন্নয়নের ধর্ম ইসলাম। নবী মুহাম্মদ (সা.) সূচনা করে ছিলেন তার নবুওয়তি জীবনের। একটি সভ্য ও সুন্দর পৃথিবী গড়ার লক্ষ্যে আল্লাহতায়ালা যুগে যুগে মানব জাতির শিক্ষকরূপে নবীদেরকে প্রেরণ করেন।
প্রথম নবী হজরত আদম (আ.) থেকে শুরু করে হজরত মুহাম্মদ (সা.) পর্যন্ত সব নবীই ছিলেন শিক্ষার আলোয় আলোকিত এবং সু-শিক্ষার ধারক ও বাহক। মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন সে ধারার সর্বশেষ ও সর্বোত্তম প্রেরিত পুরুষ। তার মাধ্যমে ঐশী শিক্ষা পূর্ণতা লাভ করে। তিনি তার কার্যকর ও বাস্তবমুখী শিক্ষানীতি ও পদ্ধতির মাধ্যমে আরবের মূর্খ ও বর্বর একটি জাতিকে পৃথিবীর নেতৃত্বের আসনে সমাসীন করান এবং ইসলামের মহান বার্তা ছড়িয়ে দেন পৃথিবীর আনাচে কানাচে।
হজরত রাসূল (সা.)-এর শিক্ষা মিশন সম্পর্কে আল্লাহতায়ালা কোরআনে কারিমে বলেন, ‘তিনিই সেই পবিত্র সত্ত্বা। যিনি নিরক্ষর লোকদের মধ্য থেকে একজনকে নবী করে পাঠিয়েছেন। যিনি তাদেরকে তার আয়াতসমূহ পাঠ করে শোনাবেন, তাদেরকে পবিত্র করবেন, তাদের শিক্ষা দেবেন কিতাব ও প্রজ্ঞা। যদিও ইতোপূর্বে তারা ভ্রান্তিতে (অজ্ঞতায়) মগ্ন ছিলো।’ -সূরা জুমা : ০২
তিনি নিজেই বলেন, ‘নিশ্চয় আমি শিক্ষকরূপে প্রেরিত হয়েছি।’ -সুনানে ইবনে মাজাহ : ২২৯
তার অনুপম শিক্ষানীতি ও পদ্ধতিতে মুগ্ধ ছিলেন তার পুণ্যাত্মা সাহাবি ও শিষ্যগণ। হজরত মুয়াবিয়া (রা.) বলেন, ‘তার জন্য আমার বাবা ও মা উৎসর্গিত হোক। আমি তার পূর্বে ও পরে তার চেয়ে উত্তম কোনো শিক্ষক দেখিনি। আল্লাহর শপথ! তিনি কখনো কঠোরতা করেননি, কখনো প্রহার করেননি, কখনো গালমন্দ করেননি।’ -সহিহ মুসলিম
আর কেনোই বা তিনি শ্রেষ্ঠতম শিক্ষক হবেন না, যখন স্বয়ং আল্লাহতায়ালা তাকে সর্বোত্তম শিক্ষা ও শিষ্টাচার শিখিয়েছেন। রাসূল (সা.) বলেন, ‘আমাকে আমার প্রভু শিক্ষা দিয়েছেন, সুতরাং আমাকে তিনি সর্বোত্তম শিক্ষা দিয়েছেন। আমার প্রভু আমাকে শিষ্টাচার শিখিয়েছেন সুতরাং তিনি সর্বোত্তম শিষ্টাচার শিখিয়েছেন।’
তাই শিক্ষা ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সাফল্যের জন্য সর্বোত্তম শিক্ষকের শিক্ষাদান পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে। নিম্নে রাসূল (সা.)-এর অনুসৃত কয়েকটি শিক্ষাপদ্ধতি তুলে ধরা হলো।
উপযুক্ত পরিবেশে শিক্ষাদান : শিক্ষাদানের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ অপরিহার্য। কোলাহলপূর্ণ বিশৃঙ্খল পরিবেশ শিক্ষার বিষয় ও শিক্ষক উভয়ের গুরুত্ব কমিয়ে দেয়। রাসূলুল্লাহ (সা.) শিক্ষাদানের জন্য উপযুক্ত পরিবেশের অপেক্ষা করতেন। হজরত জারির ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত। ‘নিশ্চয় বিদায় হজের সময় রাসূল (সা.) তাকে বলেন, মানুষকে চুপ করতে বল। অতপর তিনি বলেন, আমার পর তোমরা কুফরিতে ফিরে যেয়ো না ……।’ -সহিহ বোখারি : ৭০৮০
অর্থাৎ রাসূল (সা.) শ্রোতা ও শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিকভাবে স্থির হওয়ার এবং মনোসংযোগ স্থাপনের সুযোগ দিতেন। অতপর উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি হলে শিক্ষাদান শুরু করতেন।
থেমে থেমে পাঠদান : রাসূলুল্লাহ (সা.) পাঠদানের সময় থেমে থেমে কথা বলতেন। যেনো তা গ্রহণ করা শ্রোতা ও শিক্ষার্থীদের জন্য সহজ হয়। খুব দ্রুত কথা বলতেন না যেনো শিক্ষার্থীরা ঠিক বুঝে উঠতে না পারে আবার এতো ধীরেও বলতেন না যাতে কথার ছন্দ হারিয়ে যায়। বরং তিনি মধ্যম গতিতে থেমে থেমে পাঠ দান করতেন। হজরত আবু বাকরাহ (রা.) থেকে বর্ণিত। রাসূল (সা.) বলেন, ‘তোমরা কী জানো- আজ কোন দিন? …এটি কোন মাস? …এটি কী জিলহজ নয়? …এটি কোন শহর?’ -সহিহ বোখারি : ১৭৪১
প্রতিটি প্রশ্নের পর রাসূলুল্লাহ (সা.) চুপ থাকেন এবং সাহাবারা উত্তর দেন আল্লাহ ও তার রাসূল ভালো জানেন।
ভাষা ও দেহভাষার সমন্বয় : রাসূলুল্লাহ (সা.) কোনো বিষয়ে আলোচনা করলে, তার দেহাবয়বেও তার প্রভাব প্রতিফলিত হতো। তিনি দেহ-মনের সমন্বিত ভাষায় পাঠ দান করতেন। কারণ, এতে বিষয়ের গুরুত্ব, মাহাত্ম্য ও প্রকৃতি সম্পর্কে শ্রোতা শিক্ষার্থীগণ সঠিক ধারণা লাভে সক্ষম হয় এবং বিষয়টি তার অন্তরে গেঁথে যায়। যেমন, তিনি যখন জান্নাতের কথা বলতেন, তখন তার দেহে আনন্দের স্ফূরণ দেখা যেতো। জাহান্নামের কথা বললে ভয়ে চেহারার রঙ বদলে যেতো। যখন কোনো অন্যায় ও অবিচার সম্পর্কে বলতেন, তার চেহারায় ক্রোধ প্রকাশ পেতো এবং কণ্ঠস্বর উঁচু হয়ে যেতো। হজরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, ‘রাসূল (সা.) যখন বক্তব্য দিতেন- তার চোখ লাল হয়ে যেতো, আওয়াজ উঁচু হতো এবং ক্রোধ বৃদ্ধি পেতো। যেনো তিনি (শত্রু) সেনা সম্পর্কে সতর্ককারী।’ -সহিহ মুসলিম : ৪৩
গল্প বলার মিষ্টি ভঙ্গি : গল্প-ইতিহাস জ্ঞানের সমৃদ্ধ এক ভাণ্ডার। শিক্ষার প্রয়োজনে শিক্ষককে অনেক সময় গল্প-ইতিহাস বলতে হয়। রাসূল (সা.) ও পাঠদানের সময় গল্প বলতেন। তিনি গল্প বলতেন অত্যন্ত মিষ্টি করে। এমন মিষ্টি ভঙ্গি গল্প-ইতিহাস স্বপ্রাণ হয়ে উঠতো। জীবন্ত হয়ে উঠতো শ্রোতা-শিক্ষার্থীর সামনে। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘দোলনায় কথা বলেছে তিনজন। হজরত ঈসা ইবনে মরিয়ম (আ.) …। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, আমি (মুগ্ধ হয়ে) রাসূল (সা.)-এর দিকে তাকিয়ে থাকলাম। তিনি আমাকে শিশুদের কাজ সম্পর্কে বলছিলেন। তিনি তার মুখে আঙুল রাখলেন। এবং তাতে চুমু খেলেন।’ -মুসনাদে আহমদ : ৮০৭১
অর্থাৎ তিনি শিশুদের মতো ঠোঁট গোল করে তাতে আঙুল ঠেকালেন।
শিক্ষার্থীর নিকট প্রশ্ন করা : রাসূল (সা.) পাঠদানের সময় শিক্ষার্থীদের নিকট প্রশ্ন করতেন। যেনো তারা প্রশ্ন করতে এবং তার উত্তর খুঁজতে অভ্যস্ত হয়। কেননা নিত্যনতুন প্রশ্ন শিক্ষার্থীকে নিত্যনতুন জ্ঞান অনুসন্ধানে উৎসাহী করে। হজরত মুয়াজ ইবনে জাবাল (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) জিজ্ঞেস করেন, হে মুয়াজ! তুমি কী জানো বান্দার নিকট আল্লাহর অধিকার কী? তিনি বলেন, আল্লাহ ও তার রাসূল ভালো জানেন। রাসূল (সা.) বলেন, তার ইবাদত করা এবং তার সঙ্গে কোনো কিছুকে শরিক না করা।’ -সহিহ বোখারি : ৭৩৭৩
বিষয়বস্তুর গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন করা : বিষয়বস্তুর গুরুত্ব সম্পর্কে ধারণা থাকলে শিক্ষার্থী শ্রেণী কক্ষে অনেক বেশি মনোযোগী হয়। একাগ্র হয়ে শিক্ষকের আলোচনা শোনে। রাসূল (সা.) পাঠদানের সময় বিষয়বস্তুর গুরুত্ব ফুটিয়ে তুলতেন। হজরত সাঈদ ইবনে মুয়াল্লা (রা.) থেকে বর্ণিত। রাসূল (সা.) তাকে বলেন, ‘মসজিদ থেকে বের হওয়ার পূর্বে আমি তোমাদেরকে কোরআনের সবচেয়ে মহান সূরাটি শিক্ষা দেবো। তিনি বলেন, আমি যখন বের হওয়ার ইচ্ছে করলাম রাসূল (সা.) আমার হাত ধরে বললেন, তোমাকে বলিনি! মসজিদ থেকে বের হওয়ার আগে তোমাকে কোরআনে সবচেয়ে মহান সূরা শিক্ষা দেবো। অতপর তিনি বলেন, আলহামদুলিল্লাহি রাব্বিল আলামিন।’ -সহিহ বোখারি : ৪৪৭৪
অর্থাৎ রাসূল (সা.) তাকে সূরা ফাতেহা শিক্ষা দেন।
আগ্রহী শিক্ষার্থী নির্বাচন : রাসূলুল্লাহ (সা.) বিশেষ বিশেষ শিক্ষাদানের জন্য আগ্রহী শিক্ষার্থী নির্বাচন করতেন। যেনো শেখানো বিষয়টি দ্রুত ও ভালোভাবে বাস্তবায়িত হয়। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত। রাসূল (সা.) বলেন, আমার উম্মতের মধ্য থেকে কে পাঁচটি গুণ ধারণ করবে এবং তার ওপর আমল করবে? তিনি বলেন, আমি বলি, আমি হে আল্লাহর রাসূল! তখন তিনি আমার হাত ধরলেন এবং হাতে পাঁচটি বিষয় গণনা করলেন। -মুসনাদে আহমদ : ৮০৯৫
উপমা দিয়ে বোঝানো : নবী করিম (সা.) অনেক সময় কোনো বিষয় স্পষ্ট করার জন্য উপমা ও উদাহরণ পেশ করতেন। কেননা উপমা ও উদাহরণ দিলে যে কোনো বিষয় বোঝা সহজ হয়ে যায়। হজরত সাহাল ইবনে সাদ (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন রাসূল (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘আমি ও এতিমের দায়িত্ব গ্রহণকারী জান্নাতে এমনভাবে অবস্থান করবো। হজরত সাহাল (রা.) বলেন, রাসূল (সা.) তার শাহাদত ও মধ্যমা আঙুলের প্রতি ইঙ্গিত করেন।’ -সহিহ বোখারি : ৬০০৫
শিক্ষার্থীর প্রশ্নগ্রহণ এবং প্রশ্নের জন্য প্রসংশা করা : শ্রেণীকক্ষে শিক্ষকের আলোচনা শুনে শিক্ষার্থীর মনে প্রশ্ন জাগতে পারে। এসব প্রশ্নের সমাধান না পেলে অনেক সময় পুরো বিষয়টিই শিক্ষার্থীর নিকট অস্পষ্ট থেকে যায়। সে পাঠের পাঠোদ্ধার করতে পারে না। আর প্রশ্নের উত্তর দিলে বিষয়টি যেমন স্পষ্ট হয়, তেমনি শিক্ষার্থী জ্ঞানার্জনে আরো আগ্রহী হয়। রাসূল (সা.) শিক্ষাদানের সময় শিক্ষার্থীর প্রশ্ন গ্রহণ করতেন এবং প্রশ্ন করার জন্য কখনো কখনো প্রশ্নকারীর প্রসংশাও করতেন। হজরত আবু আইয়ুব আনসারি (রা.) থেকে বর্ণিত। ‘এক ব্যক্তি রাসূল (সা.) কে প্রশ্ন করে, আমাকে বলুন! কোন জিনিস আমাকে জান্নাতের নিকটবর্তী করে দিবে এবং কোন জিনিস জাহান্নাম থেকে দূরে সড়িয়ে নিবে। নবী করিম (সা.) থামলেন এবং তার সাহাবাদের দিকে তাকালেন। অতপর বললেন, তাকে তওফিক দেওয়া হয়েছে বা তাকে হেদায়েত দেওয়া হয়েছে।’ –সহিহ মুসলিম : ১২
লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, রাসূল (সা.) প্রশ্নটি শুনেই সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দেননি। বরং তিনি চুপ থাকেন এবং সাহাবিদের দিকে তাকিয়ে তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন এবং প্রশ্নকারীর প্রশংসা করেন। যাতে প্রশ্নটির ব্যাপারে সকলের মনোযোগ সৃষ্টি হয় এবং সকলেই উপকৃত হতে পারে।
আমলের মাধ্যমে শিক্ষাদান : শিক্ষার সবচেয়ে কার্যকর মাধ্যম হলো প্রাক্টিক্যাল বা প্রয়োগিক শিক্ষা। রাসূল (সা.) অধিকাংশ বিষয় নিজে আমল করে সাহাবিদের শেখাতেন। শেখাতেন হাতে-কলমে। এজন্য হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হলো কোরআন। রাসূল (সা.) বলেন, ‘তোমরা নামাজ আদায় কর, যেমন আমাকে আদায় করতে দেখো।’ -সুনানে বায়হাকি : ৩৬৭২
বিবেকের মুখোমুখি করা : বিবেক মানুষের বড় রক্ষক। বিবেক জাগ্রত থাকলে মানুষ নানা অপরাধ থেকে বেঁচে যায় এবং বিবেকলুপ্ত হলে অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। তাই মানুষকে সঠিক পথে পরিচালিত করার একটি সহজ উপায় হলো- মানুষের বিবেক ও মনুষ্যত্ব জাগিয়ে তোলা। রাসূল (সা.) বিবেক ও মনুষ্যত্ব জাগিয়ে তোলার মাধ্যমেও মানুষকে শিক্ষাদান করেছেন। যেমন- এক যুবক রাসূল (সা.) কে বললো। হে আল্লাহর রাসূল! আমাকে ব্যভিচারের অনুমতি দিন। তার কথা শুনে উপস্থিত লোকেরা মারমুখি হয়ে উঠলো এবং তিরস্কার করলো। রাসূল (সা.) তাকে কাছে ডেকে নিলেন এবং বললেন, তুমি কী তোমার মায়ের ব্যাপারে এমনটি পছন্দ কর? সে বললো, আল্লাহর শপথ না। আল্লাহ আমাকে আপনার জন্য উৎসর্গিত করুন। রাসূল (সা.) বললেন, কেউ তার মায়ের ব্যাপারে এমন পছন্দ করে না। এরপর রাসূল (সা.) একে একে তার সব নিকট নারী আত্মীয়ের কথা উল্লেখ করেন এবং সে না উত্তর দেয়। এভাবে রাসূল (সা.) তার বিবেক জাগ্রত করে তোলেন। -মুসনাদে আহমদ : ২২২১১
রেখাচিত্রের সাহায্যে স্পষ্ট করা : কখনো কখনো কোনো বিষয়কে স্পষ্ট করার জন্য রাসূল (সা.) রেখাচিত্র ও অঙ্কনের সাহায্য নিতেন। যেনো শ্রোতা ও শিক্ষার্থীর স্মৃতিতে তা রেখাপাত করে। হজরত আবু মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, ‘রাসূল (সা.) একটি চারকোণা দাগ দিলেন। তার মাঝ বরাবর দাগ দিলেন। যা তা থেকে বের হয়ে গেছে। বের হয়ে যাওয়া দাগটির পাশে এবং চতুষ্কোণের ভেতরে ছোট ছোট কিছু দাগ দিলেন। তিনি বললেন, এটি মানুষ। চতুষ্কোণের ভেতরের অংশ তার জীবন এবং দাগের যে অংশ বের হয়ে গেছে সেটি তার আশা।’ -সহিহ বোখারি : ৬৪১৭
এভাবে রাসূল (সা.) রেখাচিত্রের সাহায্যে মানুষের জীবন ও জীবনের সীমাবদ্ধতার বিষয় স্পষ্ট করে তুললেন।
বার বার পাঠে উদ্বুদ্ধকরণ : রাসূলে আকরাম (সা.) শিক্ষার্থীদের মেধা ও স্মৃতিশক্তির ওপর নির্ভর না করে বার বার পাঠ করতে উদ্বুদ্ধ করতেন; বরং বার বার পাঠ করে কঠিন বিষয়কে আয়ত্ব করতে বলতেন। হজরত আবু আইয়ুব আনসারি (রা.) থেকে বর্ণিত। রাসূল (সা.) বলেন, ‘তোমরা কোরআনের ব্যাপারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হও। সেই সত্ত্বার শপথ যার হাতে আমার জীবন তা উটের চেয়ে দ্রুত স্মৃতি থেকে পলায়ন করে।’ –সহিহ বোখারি : ৫০৩৩
আশা ও ভয়ের মাধ্যমে সচেতনতা সৃষ্টি : রাসূলে আকরাম (সা.) শ্রোতা ও শিক্ষার্থীদের অনাগত জীবন সম্পর্কে যেমন আশাবাদী করে তুলতেন, তেমনি তার চ্যালেঞ্জ ও সমস্যা সম্পর্কে সচেতন করে তুলতেন। যেমন- হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, ‘রাসূল (সা.) একটি ভাষণ দিলেন। আমি এমন ভাষণ আর শুনিনি। তিনি বলেন, আমি যা জানি তা যদি তোমরা জানতে তবে অল্প হাসতে এবং বেশি কাঁদতে।’ -সহিহ বোখারি : ৪৬২১
হজরত আবু জর গিফারি (রা.) থেকে বর্ণিত। রাসূল (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি ‘লা ইলাহা ইল্লাহ’ বললো এবং তার ওপর মৃত্যুবরণ করলো, তবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। আমি বললাম, যদি সে ব্যভিচার করে এবং চুরি করে? রাসূল (সা.) বলেন, হ্যাঁ। যদি সে ব্যভিচার করে এবং চুরি করে।’ -সহিহ বোখারি : ৫৪২৭
মুক্ত আলোচনা ও মতবিনিময়ের মাধ্যমে শিক্ষাদান : মুক্ত আলোচনা ও মতবিনিময়ের মাধ্যমে বহু জটিল ও দুর্বোধ্য বিষয় সহজ হয়ে যায় এবং উত্তম সমাধান পাওয়া যায়। রাসূলুল্লাহ (সা.) ও বহু বিষয় মুক্ত আলোচনা ও মতবিনিময়ের মাধ্যমে শিক্ষাদান করতেন। সমাধান বের করতেন। যেমন, হুনায়নের যুদ্ধের যুদ্ধলব্ধ সম্পদ বণ্টন নিয়ে আনসার সাহাবায়ে কেরামের মাঝে অসন্তোষ দেখা দিলে রাসূল (সা.) তাদের সঙ্গে মুক্ত আলোচনা করেন। একইভাবে বদর যুদ্ধের বন্দিদের ব্যাপারে সাহাবিদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। -সহিহ বোখারি ও মুসলিম
গুরুত্বপূর্ণ কথার পুনরাবৃত্তি : রাসূল (সা.) তার পাঠদানের গুরুত্বপূর্ণ অংশ তিন বার পর্যন্ত পুনরাবৃত্তি করতেন। হজরত আনাস ইবনে মালেক (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, ‘রাসূল (সা.) তার কথাকে তিনবার পুনরাবৃত্তি করতেন যেনো তা ভালোভাবে বোঝা যায়।’ -শামায়েলে তিরমিজি : ২২২
ভুল সংশোধনের মাধ্যমে শিক্ষাদান : রাসূলুল্লাহ (সা.) ভুল সংশোধনের মাধ্যমে শ্রোতা ও শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দিতেন। হজরত আবু মাসউদ আনসারি (রা.) থেকে বর্ণিত। এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নিকট অভিযোগ করে যে, হে আল্লাহর রাসূল! আমি নামাজে অংশগ্রহণ করতে পারি না। কারণ অমুক ব্যক্তি নামাজ দীর্ঘায়িত করে ফেলে। আমি উপদেশ বক্তৃতায় রাসূল (সা.) কে সেদিনের তুলনায় আর কোনোদিন বেশি রাগ হতে দেখিনি। রাসূল (সা.) বলেন, ‘হে লোক সকল! নিশ্চয় তোমরা অনীহা সৃষ্টিকারী। সুতরাং যে মানুষ নিয়ে (জামাতে) নামাজ আদায় করবে, সে তা যেনো হাল্কা করে (দীর্ঘ না করে)। কেননা তাদের মধ্যে অসুস্থ্য, দুর্বল ও জুল-হাজাহ (ব্যস্ত) মানুষ রয়েছে। -সহিহ বোখারি : ৯০
শাস্তিদানের মাধ্যমে সংশোধন : গুরুতর অপরাধের জন্য রাসূলুল্লাহ (সা.) কখনো তার শিষ্য ও শিক্ষার্থীদের শাস্তি প্রদান করে সংশোধন করতেন। তবে রাসূল (সা.) অধিকাংশ সময় শারীরিক শাস্তি এড়িয়ে যেতেন। ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করতেন। যেমন উপযুক্ত কারণ ব্যতীত তাবুক যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করায় হজরত কাব ইবনে মালেক (রা.) সহ কয়েকজনের সঙ্গে রাসূল (সা.) কথা বলা বন্ধ করে দেন। যা শারীরিক শাস্তির তুলনায় অনেক বেশি ফলপ্রসূ ছিলো।
রাসূল (সা.)-এর শিক্ষাদান পদ্ধতির সামান্য কিছু দৃষ্টান্ত এখানে তুলে ধরা হলো। এ বিষয়ে প্রাজ্ঞ পণ্ডিতদের দীর্ঘ কলেবরের স্বতন্ত্র বই রয়েছে।
শিক্ষাদান পদ্ধতিতে রাসূল (সা.)-এর সাফল্য সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায় পবিত্র কোরআনের একটি আয়াত থেকে। তাহলো, ‘স্মরণ করো! তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ। যখন তোমরা ছিলে পরস্পরের শত্রু। অতপর আল্লাহতায়ালা তোমাদের অন্তরে ভালোবাসা সঞ্চার করলেন। তার অনুগ্রহে তোমরা ভাই ভাইয়ে পরিণত হলে। প্রকৃতার্থে তোমরা অবস্থান করছিলে অগ্নিকুণ্ডের প্রান্ত সীমায়। অতপর আল্লাহ তোমাদেরকে সেখান থেকে উদ্ধার করলেন। এভাবে আল্লাহতায়ালা তোমাদের জন্য তার নিদর্শন স্পষ্ট করে বর্ণনা করেন, যাতে তোমরা সঠিক পথের সন্ধান পাও। -সূরা আল ইমরান : ১০৩
অর্থাৎ রাসূল (সা.) পতন্মুখ একটি জাতিকে তার কার্যকর শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে পৃথিবীর নেতৃত্বের আসনে সমাসীন করান। তার শিক্ষা ও সাফল্য শুধু ইহকালীন সাফল্য বয়ে আনেনি; বরং তার পরিব্যপ্তি ছিলো পরকালীন জীবন পর্যন্ত। সুতরাং মুসলিম উম্মাহকে যদি তার হারানো ঐতিহ্য ফিরে পেতে হয় এবং উভয় জগতের সাফল্য অর্জন করতে হয়, তবে অবশ্যই রাসূল (সা.)-এর শিক্ষাদান পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে।