বাণিজ্যে গিয়ে বণিক হলেন দরবেশ

দেশজুড়ে রত্নবণিকের নাম। সবাই চেনেন, সম্মান করেন। মণি-মানিক্যের ব্যবসায় ধনী হয়েছেন। একদিন রোমে গেলেন বাণিজ্যে।

রোম রাজার মন্ত্রী তার বন্ধু। সেখানেই উঠলেন। মন্ত্রী বন্ধু ঘোড়া সাজিয়ে বললেন, বেড়িয়ে আসি চলো।

বণিক বন্ধুকে নিয়ে এক মহা-অনুষ্ঠানে এলেন, দেখলেন মণি, মুক্তা, হীরা খচিত এক মন্দির। সুসজ্জিত একদল সৈনিক এলো। কুচকাওয়াজ করে বলল কী যেন। এরপর এলেন একদল চুল পাকা মানুষ। তারাও মন্দির ঘুরে কী যেন পড়লেন। এরপর বহু পণ্ডিত এসে একই রেওয়াজ করলেন।

এরপর সাজুগুজু করে অনেক রূপসী কন্যা এলেন। সবার হাতে মণি-মুক্তা ভর্তি সোনার থালা। তারা মন্দিরের চারপাশ ঘুরে বিদায় নিল। সব শেষে এলেন রোম সম্রাট। ভেতরে গেলেন। বেরিয়ে গেলেন খানিক পর।

মন্ত্রী বন্ধু রত্নবণিক হোসাইন বসরি। আশ্চর্য হল এসব দেখে। বন্ধুর কাছে জানতে চাইল। কী করল ওরা? বলল-ই বা কী? সম্রাটের যুবক শাহজাদা ছিলেন। মরে গেছেন অল্প বয়সে। বছর বছর তারই স্মরণ অনুষ্ঠান করেন সম্রাট। রোমীয় ভাষায় তার জন্য প্রার্থনা করা হল। এ মন্দিরে রয়েছে হীরা-মুক্তা খচিত শাহজাদার সমাধি।

সৈনিক দল প্রার্থনায় বলেছে হে রাজকুমার, বাহুবলে যদি আমরা তোমাকে ফেরাতে পারতাম, তোমার জন্য প্রাণ উৎসর্গ করতাম। হায়! যিনি তোমাকে ডেকে নিয়েছেন, তার সঙ্গে সংগ্রাম চলে না। এরপর ছিল জ্ঞানীদের প্রার্থনা।

হে রাজপুত্র, যদি জ্ঞান-বিজ্ঞান, পাণ্ডিত্য দিয়ে ফেরানো যেত তোমাকে, তোমার জন্য তবে তাই করতাম। সম্মানিত বুড়ো মানুষগুলো বলেছেন, যদি প্রার্থনা করে হে রাজবংশ তোমাকে ফিরে পেতাম, তবে আজীবন তোমার জন্য প্রার্থনাই করতাম।
সুন্দরী কন্যাদের প্রার্থনা ছিল, হে প্রভু ধন-সম্পদ সৌন্দর্য দিয়ে যদি তোমাকে ফিরে পেতাম, তবে তাই করতাম তোমার জন্য। হায়! যিনি কেড়ে নেন প্রাণ, তার কাছে ধন-সম্পদ, ঐশ্বর্য, রূপ, মাধুর্যের কানাকড়ি মূল্য নেই।

সবশেষে সম্রাট বলেছেন, হে প্রিয় পুত্র, তোমার বাবার হাতে আর কী ক্ষমতা আছে? সৈন্য সামন্ত পাণ্ডিত্য। ধন-সম্পদ এবং সৌন্দর্য দিয়ে যদি মরণ বিপদ হটানো যেত, তাই করতাম। হায়! এ ঘটনা যিনি ঘটিয়েছেন তোমার পিতাসহ বিশ্ব জগৎ তার শক্তি বাহুর কাছে দুর্বল। এসব বলে পুত্র স্মরণ অনুষ্ঠান করেন প্রতি বছর।

হোসাইন বণিক বিমর্ষ হলেন বন্ধুর কথায়। হৃদয়জুড়ে হাহাকার এলো। জীবনে এলো বৈরাগ্য ভাব। অস্থির হলেন হোসাইন। মন টিকল না বাণিজ্যে। ফিরে এলেন বসরায়। মনে মনে পণ করলেন। আর সংসারে জড়াবেন না। মগ্ন হলেন মাবুদের সাধনায়। লোকসঙ্গ ছেড়ে দিলেন। খুঁজে নিলেন নির্জনতা।

অনেক অনেক বছর গেল এভাবে। এরপর ধর্মসভা শুরু করলেন। সপ্তাহে একদিন। বয়ান করতেন সাধারণের জন্য। তার সভায় নিয়মিত আসতেন তাপসী রাবেয়া বসরী। ধর্ম সভায় হোসাইন একদিন চুপ থাকলেন। উপদেশ দিলেন না একটিও।

রাবেয়া সেদিন ছিলেন না তাই। গণ্যমান্যরা বললেন, এক বৃদ্ধার জন্য আমরা বঞ্চিত হব কেন? হোসাইন বললেন, হায়! যে শরবত হস্তির জন্য তৈরি করেছি, পিঁপড়ের মুখে সেটাকি দিতি পারি!
তাপসী উপস্থিত হলে তাকে কেন্দ্র করেই বয়ান করতেন।

কখনও দিপ্ত কণ্ঠে বলতেন, হে শ্রদ্ধেয়া, তোমার ঐশী আলো থেকেই আমার বয়ানের স্রোতধারা সৃষ্টি। তিনি বলতেন, একজন পবিত্র আত্মা পেলে খুশি হই। বহু মানুষের বয়ান আমি জানি না। একদিন বললেন। হে মানুষ। শোন মন খুলে।

জনতা বলল, আমাদের ঘুমন্ত মন জাগিয়ে দিন। তিনি বললেন, ঘুমন্ত নয়, তোমাদের মরা মন। টোকা খেয়ে ঘুমন্তরা জাগে। জাগে না কখনও মরারা। তোমরা তাই। সম্রাট হাজ্জাজ হোসাইনের সভায় একদিন এলেন।

জনতা ভাবল আজ বোঝা যাবে সম্রাটের জন্য হোসাইন দাঁড়ায় কিনা। বিরতি টানেকিনা বয়ানে। হোসাইন মাবুদের বয়ানে মগ্ন থাকলেন। একই নিয়মে শেষ করলেন সভা। সম্রাট হাজ্জাজ এগিয়ে এসে হোসাইনের হাতে চুমু খেলেন। জনতাকে বললেন, যদি দরবেশ দেখতে চাও তবে হোসাইনকে দেখ।

একদিন দরবেশদের শিক্ষক হজরত আলী হোসাইনের সভায় এলেন। জানতে চাইলেন- তুমি জ্ঞানী নাকি জ্ঞানপ্রার্থী? হোসাইন বিনয়ে বললেন- প্রেরিত নবী মুহম্মদ (সা.) থেকে সত্য পেয়েছি। তাই দাওয়াত দিচ্ছি। জ্ঞানী আমি নই। ইনি দরবেশ এবং সুবক্তা।
চলে যেতে যেতে বললেন আলী। হোসাইন বয়ানই শেষে যখন জানালেন তিনি হজরত আলী। তিনি পেছন পেছন দৌড়ে গেলেন। শিখে নিলেন পবিত্র হওয়ার তরিকা।

ছেলেবেলায় একটি অন্যায় করেছিলেন হোসাইন। মনে হলেই কেঁদে কেঁদে জ্ঞান হারাতেন। নতুন জামা পরলে পিঠে লিখে রাখতেন সে অন্যায়। কেউ যদি জানতে চাইত হোসাইন কেমন আছ? তিনি উত্তর দিতেন, যে মানুস সমুদ্রে এক খণ্ড কাঠ আঁকড়ে আছে সে আর কেমন থাকবে? হোসাইন প্রায় আফসোসের বিলাপ করতেন। হে মাবুদ আমাকে সম্পদ দিয়েছ। হইনি আমি কৃতজ্ঞ। বিপদে ফেলেছ। ধৈর্য ধরিনি। তুমি কত মেহেরবান।

আমার সম্পদ কেড়ে নাওনি। আমার বিপদও স্থায়ী করনি। হে মাবুদ তুমি রহমতের দরিয়া। মৃত্যুর সময় হেসে উঠলেন হোসাইন। কোন পাপ! কোন পাপ বলে! এক বুড়ো ভক্ত স্বপ্নে তাকে জিজ্ঞেস করলেন- জীবনে হাসতে দেখিনি তোমাকে। মরার সময় হাসলে কেন?

তিনি জানালেন এক ঐশ্বরিক বাণী ভেসে এসেছিল কানে। ‘হে মৃত্যু ওকে শক্ত করে বাঁধ। এখনও ওর একটি পাপ আছে।’ এ জন্যই আমি কোন পাপ কোন পাপ? বলেছি। সাধনা করে বান্দারা মাবুদের মন জয় করেন।

এ রকম বান্দারা হেসে হেসেই মরণ বরণ করেন। তাদের জন্য জান্নাতের দরজা খুলে দেন ফেরেশতারা। তিনি জান্নাতের অতিথি হন দম ফুরালে। এমন মর্যাদা এ দুনিয়া থেকেই অর্জন করে বান্দা।

ছেলেবেলা থেকেই আমরাও চেষ্টা করব। ভালো কাজ করব। ভালো কথা বলব। ভালো থাকব। হব পবিত্র। আমার মরণ যেন হয় হেসে হেসে।

হোসাইন বসরির কিছু উক্তিঃ

হে মানুষ। চেয়ে দেখ ছাগল কত হুশিয়ার। রাখালের ডাকে তক্ষুনি ছুটে আসে সবুজ প্রান্তর ছেড়ে। হায় মানুষ! মাবুদের ডাক পেয়ে দুনিয়া ভোগে মজে থাকে। হুকুম দেয়ার আগে হুকুম পালনকারী হও।

দুনিয়ালোভীর তিনটি খেদ থাকে। সব আশা পূরণ না হওয়া। অতৃপ্ত হয়ে হায় হায় করা। আখেরাতের সম্বল সংগ্রহ না করা। জানতে ইচ্ছা করে কি? তোমার মরণ হলে স্বজনরা কেমন করবে? অন্যের মৃত্যুতে দেখবে স্বজন যা করছে, তোমার জন্যও তাই হবে।

“হে মানুষ। পূর্বপুরুষগণ মাবুদের বাণীর ইশারায় জীবন ধারণ করত।
আর তোমরা ওই বাণীর জের-জবর বদলে সংসারের বাণী তৈরি করে নিয়েছ। ভেবে বল কথা। বিপদমুক্ত থাকবে।

মৌনব্রতি হও সুচিন্তার আলোয়। নয়তো কামনা কামড়াবে মনে। শাসন কর চোখ। নয়তো আত্মা কলুষিত হবে।

নিজের কথা বলেন না দরবেশ। যা বলেন আদেশ শোনান মাবুদের। লোকের বলাবলি তোয়াক্কা করেন না। তার উদ্দেশ্য হয় শুধু মাবুদের মন জয় করা।”

গল্পের বিষয়:
ইসলামিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত