হযরত ইউসুফ (আঃ) এর জীবনী অষ্টম পর্ব

হযরত ইউসুফ (আঃ) এর জীবনী অষ্টম পর্ব

হযরত ইউসুফ (আঃ) এর জীবনী

অষ্টম পর্ব

দাওয়াতের মূলনীতিঃ হিকমত ও বিচক্ষণতা

দাওয়াতের মূলনীতি অনুযায়ী, হিকমত ও বিচক্ষণতাকে কাজে লাগিয়ে সর্বপ্রথম তাদের অন্তরে আস্থা সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে একটি মু‘জিযার কথা উল্লেখ করলেন যে, তোমাদের জন্যে প্রত্যহ যেই খাদ্য তোমাদের বাসা, কারাগার কিংবা অন্য কোনো জায়গা থেকে আসে, তা আসার আগে আমি তোমাদেরকে খাদ্যের প্রকার, গুণাগুণ, পরিমাণ সম্পর্কে বলে দিব। আর এটা কোনো ভবিষ্যৎ কথন, জ্যোতিষবিদ্যা কিংবা অতীন্দ্রিয়বাদের ভেলকি নয়, বরং আমার পালনকর্তা ওহীর মাধ্যমে আমাকে তা বলে দেন বলেই আমি তা তোমাদেরকে বলে দিতে পারি। পবিত্র কুরআনের নিম্নেবর্ণিত আয়াতে এ বিষয়টি ব্যক্ত করা হয়েছে,

قَالَ لَا یَاْتِیْكُمَا طَعَامٌ تُرْزَقٰنِهٖۤ اِلَّا نَبَّاْتُكُمَا بِتَاْوِیْلِهٖ قَبْلَ اَنْ یَّاْتِیَكُمَا ؕ ذٰلِكُمَا مِمَّا عَلَّمَنِیْ رَبِّیْ ؕ اِنِّیْ تَرَكْتُ مِلَّۃَ قَوْمٍ لَّا یُؤْمِنُوْنَ بِاللهِ وَهُمْ بِالْاٰخِرَۃِ هُمْ کٰفِرُوْنَ○

অর্থঃ ইউসুফ আ. বললেন, তোমাদেরকে প্রত্যহ যে খাদ্য দেয়া হয়, তা তোমাদের কাছে আসার আগেই আমি তার ব্যাখ্যা তোমাদেরকে বলে দিব। এ জ্ঞান আমাকে আমার রব শিক্ষা দিয়েছেন। (সূরা ইউসুফ, আয়াত: ৩৭)

এরপর ইউসুফ আ. প্রথমে তাদের কাছে কুফরের নিন্দা এবং কাফেরদের ধর্মের প্রতি স্বীয় বিমুখতা বর্ণনা করলেন। অতঃপর আরো বললেন যে, আমি নবী পরিবারেরই একজন এবং তাঁদেরই সত্য দীনের অনুসারী। আমার পিতৃপুরুষ হচ্ছে ইবরাহীম, ইসহাক ও ইয়াকূব আ.। (সূরা ইউসুফ, আয়াত: ৩৭-৩৮)

এরপর বললেন যে, আল্লাহ তা‘আলার সাথে খোদায়ী গুণাবলীতে কাউকে শরীক বা অংশীদার সাব্যস্ত করা আমাদের জন্য মোটেই বৈধ নয়। আর এ দীনে হক্বের তাওফীক অর্জন আমাদের প্রতি এবং সব লোকের প্রতি আল্লাহর তা‘আলার অনুগ্রহ। কিন্তু অধিকাংশ লোক কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে না।

অতঃপর হযরত ইউসুফ আ. কয়েদীদের প্রশ্ন করলেন, আচ্ছা, তোমরাই বলো, অনেক পালনকর্তার উপাসক হওয়া ভালো, নাকি এক আল্লাহর দাস হওয়া ভালো, যিনি সবার উপর পরাক্রমশালী। তারপর অন্য এক পন্থায় মূর্তিপূজার অনিষ্টতা বর্ণনা করে বললেন, তোমরা এবং তোমাদের পিতৃপুরুষেরা কিছু সংখ্যক প্রতিমাকে পালনকর্তা রূপে গ্রহণ করে নিয়েছো। অথচ এদের মধ্যে এমন কোনো সত্তাগত গুণ নেই যে, এদেরকে সামান্যতম শক্তি ও ক্ষমতার অধিকারী মনে করা যেতে পারে। কারণ, এরা সবাই যে চেতনা ও অনুভূতিহীন এটা চাক্ষুষ বিষয়। অবশ্য এদের সত্য উপাস্য হওয়ার অপর একটি উপায় ছিল এই যে, আল্লাহ তা‘আলা এদের উপাসনার জন্য নির্দেশ নাযিল করতেন। এমতাবস্থায় চাক্ষুষ অভিজ্ঞতা, যুক্তি ও বিবেক বুদ্ধি যদিও এদের খোদায়ী স্বীকার করে না, কিন্তু আল্লাহ পাকের নির্দেশের কারণে আমরা চাক্ষুষ অভিজ্ঞতা ও যুক্তি প্রমাণ ছেড়ে তাঁর নির্দেশ পালন করতাম। কিন্তু এখানে এরূপ কোনো নির্দেশও নেই। কেননা, আল্লাহ তা‘আলা এসব কৃত্রিম উপাস্যের ইবাদত করার ব্যাপারে কোনো যুক্তি-প্রমাণ কিংবা হুকুমও নাযিল করেননি। বরং তিনি একথাই বলেছেন যে, ইবাদত গ্রহণের অধিকার আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো নেই। অতঃপর হযরত ইউসুফ আ. তাদেরকে নির্দেশ দিলেন যে, আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো ইবাদত করো না। আমার পিতৃপুরুষেরা এ সত্য দীনই আল্লাহ পাকের পক্ষ থেকে প্রাপ্ত হয়েছেন। কিন্তু অধিকাংশ লোক এ সত্য জানে না। এ সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে রয়েছে,

یٰصَاحِبَیِ السِّجْنِ ءَاَرْبَابٌ مُّتَفَرِّقُوْنَ خَیْرٌ اَمِ اللهُ الْوَاحِدُ الْقَهَّارُ○ مَا تَعْبُدُوْنَ مِنْ دُوْنِهٖۤ اِلَّاۤ اَسْمَآءً سَمَّیْتُمُوْهَاۤ اَنْتُمْ وَ اٰبَآؤُكُمْ مَّاۤ اَنْزَلَ اللهُ بِهَا مِنْ سُلْطٰنٍ ؕ اِنِ الْحُكْمُ اِلَّا لِلّٰهِ ؕ اَمَرَ اَلَّا تَعْبُدُوْۤا اِلَّا اِیَّاهُ ؕ ذٰلِکَ الدِّیْنُ الْقَیِّمُ وَلٰکِنَّ اَكْثَرَ النَّاسِ لَا یَعْلَمُوْنَ○

অর্থঃ (ইউসুফ আ. বললেন,) হে কারাগারের সঙ্গীদ্বয়! পৃথক পৃথক অনেক উপাস্য ভালো, না পরাক্রমশালী এক আল্লাহ? তোমরা আল্লাহকে ছেড়ে কেবল কতগুলো নামের উপাসনা করো, যে নামগুলো তোমরা এবং তোমাদের বাপ দাদারা সাব্যস্ত করে নিয়েছ। আল্লাহ তা‘আলা এদের ব্যাপারে কোনো প্রমাণ অবতীর্ণ করেননি। আল্লাহ ছাড়া কারো বিধান দেয়ার ক্ষমতা নেই। তিনি আদেশ দিয়েছেন যে, তোমরা-তিনি ছাড়া অন্য কারো ইবাদত করো না। এটাই সরল সঠিক দীন। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ তা জানে না।

দীন প্রচার, দীনী দাওয়াত ও তাবলীগের কাজ সম্পন্ন করার পর ইউসুফ আ. কয়েদীদের স্বপ্নের দিকে মনোযোগ দিলেন এবং বললেন, তোমাদের একজন মুক্তি পাবে এবং চাকুরীতে পুনর্বহাল হয়ে বাদশাহকে শরাব পান করাবে। আর অপরজনের অপরাধ প্রমাণিত হবে এবং তাকে শুলে চড়ানো হবে। তখন পাখিরা তার মাথার মগজ ঠোকরিয়ে খাবে। নিম্নোক্ত আয়াতে এ কথা ব্যক্ত করা হয়েছে,

یٰصَاحِبَیِ السِّجْنِ اَمَّاۤ اَحَدُكُمَا فَیَسْقِیْ رَبَّهٗ خَمْرًا ۚ وَ اَمَّا الْاٰخَرُ فَیُصْلَبُ فَتَاْكُلُ الطَّیْرُ مِنْ رَّاْسِهٖ ؕ

অর্থঃ ইউসুফ আ. বললেন, হে কারাগারের সঙ্গীদ্বয়! তোমাদের একজন আপন মনিবকে শরাব পান করাবে এবং অপরজনকে শুলে চড়ানো হবে। অতঃপর তার মস্তক থেকে পাখি আহার করবে।
বিশিষ্ট তাফসীর বিশারদ আল্লামা ইসমাঈল ইবনে কাসীর রহ. বলেন, উভয় কয়েদীর স্বপ্ন পৃথক পৃথক ছিল। প্রত্যেকটির ব্যাখ্যা নির্ধারিত ছিল এবং এটাও নির্দিষ্ট ছিল যে, যে ব্যক্তি বাদশাহকে শরাব পান করাতো, সে খালাস পেয়ে চাকুরীতে পুনর্বহাল হবে এবং অপরজন তথা বাবুর্চিকে শুলে চড়ানো হবে। কিন্তু ইউসুফ আ. পয়গাম্বরসূলভ অনুকম্পার কারণে নির্দিষ্ট করে বলেননি যে, তোমাদের অমুককে শুলে চড়ানো হবে। যাতে সে এখন থেকেই চিন্তান্বিত না হয়ে পড়ে। বরং তিনি সংক্ষেপে বলেছেন যে, একজন মুক্তি পাবে এবং অপরজনকে শুলে চড়ানো হবে। সবশেষে ইউসুফ আ. বললেন, আমি তোমাদের স্বপ্নের ব্যাখ্যা দিয়েছি, তা নিছক অনুমান-ভিত্তিক নয়; বরং এটাই আল্লাহ তা‘আলার অটল ফয়সালা।

অতঃপর যে ব্যক্তি সম্পর্কে ধারণা ছিল যে, সে মুক্তি পাবে, তাকে ইউসুফ আ. বললেন, যখন তুমি খালাস পেয়ে কারাগারের বাইরে যাবে এবং শাহী দরবারে পৌঁছাবে, তখন তুমি বাদশাহর কাছে আমার বিষয়ে আলোচনা করবে যে, এ নিরপরাধ লোকটি কারাগারে পড়ে রয়েছে।

নির্দিষ্ট সময়ে লোকটি মুক্তি পেল। কিন্তু মুক্তি পেয়ে সে ইউসুফ আ. এর কথা ভুলে গেল। ফলে ইউসুফ আ. এর মুক্তির ব্যাপারটি আরো বিলম্বিত হয়ে গেল। তাতে করে আরো কয়েক বছর তাঁকে কারাগারে কাটাতে হলো। নিম্নেবর্ণিত আয়াতে এ কথাই উল্লেখ করা হয়েছে,

وَقَالَ لِلَّذِیْ ظَنَّ اَنَّهٗ نَاجٍ مِّنْهُمَا اذْكُرْنِیْ عِنْدَ رَبِّکَ ۫ فَاَنْسٰهُ الشَّیْطٰنُ ذِكْرَ رَبِّهٖ فَلَبِثَ فِی السِّجْنِ بِضْعَ سِنِیْنَ○

অর্থঃ তাদের দু’জনের মধ্যে যে ব্যক্তি সম্পর্কে ধারণা ছিল যে, সে মুক্তি পাবে ইউসুফ আ. তাকে বললেন, আপন মনিবের কাছে আমার কথা আলোচনা করবে। অতঃপর শয়তান তাকে মনিবের কাছে তার আলোচনার কথা ভুলিয়ে দিল। ফলে তিনি কয়েক বছর কারাগারে কাটালেন। (সূরা ইউসুফ, আয়াত: ৪২)

অত্র আয়াতের بِضْعَ শব্দটি তিন থেকে নয় পর্যন্ত সংখ্যা বুঝায়। কোনো কোনো তাফসীরবিদ বলেন, এ ঘটনার পর আরও সাত বছর তাঁকে জেলে থাকতে হয়েছে।

গল্পের বিষয়:
ইসলামিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত