যরত হূদ (আঃ) দুর্ধর্ষ ও শক্তিশালী ‘আদ জাতির প্রতি প্রেরিত হয়েছিলেন। আল্লাহর গযবে ধ্বংসপ্রাপ্ত বিশ্বের প্রধান ছয়টি জাতির মধ্যে কওমে নূহ-এর পরে কওমে ‘আদ ছিল দ্বিতীয় জাতি। হূদ (আঃ) ছিলেন এদেরই বংশধর। ‘আদ ও ছামূদ ছিল নূহ (আঃ)-এর পুত্র সামের বংশধর এবং নূহের পঞ্চম অথবা অষ্টম অধঃস্তন পুরুষ। ইরামপুত্র ‘আদ-এর বংশধরগণ ‘আদ ঊলা’ বা প্রথম ‘আদ এবং অপর পুত্রের সন্তান ছামূদ-এর বংশধরগণ ‘আদ ছানী বা দ্বিতীয় ‘আদ বলে খ্যাত।‘আদ ও ছামূদ উভয় গোত্রই ইরাম-এর দু’টি শাখা। সেকারণ ‘ইরাম’ কথাটি ‘আদ ও ছামূদ উভয় গোত্রের জন্য সমভাবে প্রযোজ্য।
এজন্য কুরআনে কোথাও ‘আদ ঊলা’ (নাজম ৫০) এবং কোথাও ‘ইরাম যাতিল ‘ইমাদ’ (ফজর ৭) শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে।‘আদ সম্প্রদায়ের ১৩টি পরিবার বা গোত্র ছিল।আম্মান হ’তে শুরু করে হাযারামাউত ও ইয়ামন পর্যন্ত তাদের বসতি ছিল।তাদের ক্ষেত-খামারগুলো ছিল অত্যন্ত সজীব ও শস্যশ্যামল। তাদের প্রায় সব ধরনের বাগ-বাগিচা ছিল। তারা ছিল সুঠামদেহী ও বিরাট বপু সম্পন্ন।আল্লাহ তা‘আলা তাদের প্রতি অনুগ্রহের দুয়ার খুলে দিয়েছিলেন। কিন্তু বক্রবুদ্ধির কারণে এসব নে‘মতই তাদের কাল হয়ে দাঁড়ালো।তারা নিজেরা পথভ্রষ্ট হয়েছিল ও অন্যকে পথভ্রষ্ট করেছিল।তারা শক্তি মদমত্ত হয়ে ‘আমাদের চেয়ে শক্তিশালী আর কে আছে’ (ফুছছিলাত/হামীম সাজদাহ ১৫) বলে ঔদ্ধত্য প্রদর্শন করতে শুরু করেছিল।
তারা আল্লাহর ইবাদত পরিত্যাগ করে নূহ (আঃ)-এর আমলে ফেলে আসা মূর্তিপূজার শিরক-এর পুনরায় প্রচলন ঘটালো। মাত্র কয়েক পুরুষ আগে ঘটে যাওয়া নূহের সর্বগ্রাসী প্লাবনের কথা তারা বেমালুম ভুলে গেল।ফলে আল্লাহ পাক তাদের হেদায়াতের জন্য তাদেরই মধ্য হ’তে হূদ (আঃ)-কে নবী হিসাবে প্রেরণ করলেন।উল্লেখ্য যে, নূহের প্লাবনের পরে এরাই সর্বপ্রথম মূর্তিপূজা শুরু করে।হযরত হূদ (আঃ) ও কওমে ‘আদ সম্পর্কে পবিত্র কুরআনের ১৭টি সূরায় ৭৩টি আয়াতে বর্ণিত হয়েছে।
হূদ (আঃ)-এর দাওয়াতের ফলশ্রুতি:
হযরত হূদ (আঃ) স্বীয় কওমে ‘আদকে শিরক পরিত্যাগ করে সার্বিক জীবনে তাওহীদ প্রতিষ্ঠার আহবান জানান। তিনি তাদেরকে মূর্তিপূজা ত্যাগ করার এবং যুলুম ও অত্যাচার পরিহার করে ন্যায় ও সুবিচারের পথে চলার উদাত্ত আহবান জানান।কিন্তু নিজেদের ধনৈশ্বর্যের মোহে এবং দুনিয়াবী শক্তির অহংকারে মদমত্ত হয়ে তারা নবীর দাওয়াতকে প্রত্যাখ্যান করে।তারা বলল, তোমার ঘোষিত আযাব কিংবা তোমার কোন মু‘জেযা না দেখে কেবল তোমার মুখের কথায় আমরা আমাদের বাপ-দাদার আমল থেকে চলে আসা উপাস্য দেব-দেবীদের বর্জন করতে পারি না।বরং আমরা সন্দেহ করছি যে, আমাদের দেবতাদের নিন্দাবাদ করার কারণে তাদের অভিশাপে তোমাকে ভূতে ধরেছে ও মস্তিষ্ক বিকৃত হয়ে তুমি উন্মাদের মত কথাবার্তা বলছ।
তাদের এসব কথার উত্তরে হযরত হূদ (আঃ) পয়গম্বর সূলভ নির্ভীক কণ্ঠে জবাব দেন যে, তোমরা যদি আমার কথা না মানো, তবে তোমরা সাক্ষী থাক যে, একমাত্র আল্লাহ ছাড়া তোমাদের ঐসব অলীক উপাস্যদের আমি মানি না।তোমরা ও তোমাদের দেবতারা সবাই মিলে আমার অনিষ্ট সাধনের চেষ্টা কর।তাতে আমার কিছুই হবে না আল্লাহর হুকুম ছাড়া। তিনিই আমার পালনকর্তা।তাঁর উপরেই আমি ভরসা রাখি। যারা সরল পথে চলে, আল্লাহ তাদের সাহায্য করেন।অহংকারী ও শক্তি মদমত্ত জাতির বিরুদ্ধে একাকী এমন নির্ভীক ঘোষণা দেওয়া সত্ত্বেও তারা তাঁর কেশাগ্র স্পর্শ করার সাহস করেনি।বস্ত্ততঃ এটা ছিল তাঁর একটি মু‘জেযা বিশেষ। এর দ্বারা তিনি দেখিয়ে দিলেন যে, তাদের কল্পিত দেব-দেবীদের কোন ক্ষমতা নেই।অতঃপর তিনি বললেন, আমাকে যে সত্য পৌঁছানোর দায়িত্ব আল্লাহ পাক দিয়েছেন, সে সত্য আমি তোমাদের নিকটে পৌঁছে দিয়েছি।এক্ষণে যদি তোমরা তা প্রত্যাখ্যান করতেই থাক এবং হঠকারিতার উপরে যিদ করতে থাক, তাহ’লে জেনে রেখ এর অনিবার্য পরিণতি হিসাবে তোমাদের উপরে আল্লাহর সেই কঠিন শাস্তি নেমে আসবে, যার আবেদন তোমরা আমার নিকটে বারবার করেছ।
অতএব তোমরা সাবধান হও। এখনো তওবা করে আল্লাহর পথে ফিরে এসো।কিন্তু হতভাগার দল হযরত হূদ (আঃ)-এর কোন কথায় কর্ণপাত করল না।তারা বরং অহংকারে স্ফীত হয়ে বলে উঠলো, ‘আমাদের চেয়ে বড় শক্তিধর (এ পৃথিবীতে) আর কে আছে’? (হা-মীম সাজদাহ ৪১/১৫)। ফলে তাদের উপরে এলাহী গযব অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠলো।
মুহাম্মাদ ইবনু ইসহাক বলেন, কওমে ‘আদ-এর অমার্জনীয় হঠকারিতার ফলে প্রাথমিক গযব হিসাবে উপর্যুপরি তিন বছর বৃষ্টিপাত বন্ধ থাকে। তাদের শস্যক্ষেত সমূহ শুষ্ক বালুকাময় মরুভূমিতে পরিণত হয়। বাগ-বাগিচা জ্বলে-পুড়ে ছারখার হয়ে যায়।এতদসত্ত্বেও তারা শিরক ও মূর্তিপূজা ত্যাগ করেনি। কিন্তু অবশেষে তারা বাধ্য হয়ে আল্লাহর কাছে বৃষ্টি প্রার্থনা করে। তখন আসমানে সাদা, কালো ও লাল মেঘ দেখা দেয় এবং গায়েবী আওয়ায আসে যে, তোমরা কোনটি পসন্দ করো? লোকেরা কালো মেঘ কামনা করল।তখন কালো মেঘ এলো। লোকেরা তাকে স্বাগত জানিয়ে বলল, هَذَا عَارِضٌ مُّمْطِرُنَا ‘এটি আমাদের বৃষ্টি দেবে’।
জবাবে তাদের নবী হূদ (আঃ) বললেন,
بَلْ هُوَ مَا اسْتَعْجَلْتُمْ بِهِ رِيْحٌ فِيْهَا عَذَابٌ اَلِيْمٌ، تُدَمِّرُ كُلَّ شَيْءٍ بِأَمْرِرَبِّهَا… (الأحقاف ২৪-২৫)-
‘বরং এটা সেই বস্ত্ত যা তোমরা তাড়াতাড়ি চেয়েছিলে। এটা এমন বায়ু যার মধ্যে রয়েছে মর্মন্তুদ আযাব’। ‘সে তার প্রভুর আদেশে সবাইকে ধ্বংস করে দেবে…’। ফলে অবশেষে পরদিন ভোরে আল্লাহর চূড়ান্ত গযব নেমে আসে।
সাত রাত্রি ও আট দিন ব্যাপী অনবরত ঝড়-তুফান বইতে থাকে।মেঘের বিকট গর্জন ও বজ্রাঘাতে বাড়ী-ঘর সব ধ্বসে যায়, প্রবল ঘুর্ণিঝড়ে গাছ-পালা সব উপড়ে যায়, মানুষ ও জীবজন্তু শূন্যে উত্থিত হয়ে সজোরে যমীনে পতিত হয় (ক্বামার ৫৪/২০; হাক্বক্বাহ ৬৯/৬-৮) এবং এভাবেই শক্তিশালী ও সুঠাম দেহের অধিকারী বিশালবপু ‘আদ জাতি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস ও নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।আল্লাহ বলেন, এছাড়াও তাদের জন্য রয়েছে চিরস্থায়ী অভিসম্পাৎ দুনিয়া ও আখেরাতে (হূদ ১১/৬০)।আয়েশা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যখন মেঘ বা ঝড় দেখতেন, তখন তাঁর চেহারা বিবর্ণ হয়ে যেত এবং বলতেন হে আয়েশা! এই মেঘ ও তার মধ্যকার ঝঞ্ঝাবায়ু দিয়েই একটি সম্প্রদায়কে ধ্বংস করা হয়েছে।
যারা মেঘ দেখে খুশী হয়ে বলেছিল, ‘এটি আমাদের জন্য বৃষ্টি বর্ষণ করবে’। রাসূলের এই ভয়ের তাৎপর্য ছিল এই যে, কিছু লোকের অন্যায়ের কারণে সকলের উপর এই ব্যাপক গযব নেমে আসতে পারে।যেমন ওহোদ যুদ্ধের দিন কয়েকজনের ভুলের কারণে সকলের উপর বিপদ নেমে আসে। যেদিকে ইঙ্গিত করে আল্লাহ বলেন,
وَاتَّقُوْا فِتْنَةً لاَّتُصِيْبَنَّ الَّذِيْنَ ظَلَمُوْا مِنْكُمْ خَاصَّةً وَاعْلَمُوْآ أَنَّ اللهَ شَدِيْدُ الْعِقَابِ- (الأنفال ২৫)-
‘আর তোমরা ঐসব ফেৎনা থেকে বেঁচে থাক, যা বিশেষভাবে কেবল তাদের উপর পতিত হবে না, যারা তোমাদের মধ্যে যালেম। আর জেনে রাখো যে, আল্লাহর শাস্তি অত্যন্ত কঠোর’ (আনফাল ৮/২৫)। উল্লেখ্য যে, গযব নাযিলের প্রাক্কালেই আল্লাহ স্বীয় নবী হূদ ও তাঁর ঈমানদার সাথীদের উক্ত এলাকা ছেড়ে চলে যাবার নির্দেশ দেন ও তাঁরা উক্ত আযাব থেকে রক্ষা পান (হূদ ১১/৫৮)। অতঃপর তিনি মক্কায় চলে যান ও সেখানেই ওফাত পান। তবে ইবনু কাছীর হযরত আলী (রাঃ) থেকে বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেন যে, হূদ (আঃ) ইয়ামনেই কবরস্থ হয়েছেন।
আল্লাহ সর্বাধিক অবগত।