কোনো এক সময় আরবের এক মরুভূমির পার্শ্বে একটি ছোট্ট রাজ্য ছিল। সেই রাজ্যটি চলত এক অদ্ভুত নিয়মে। প্রতি দশ বছর পর পর ওই রাজ্যে রাজা বদল হতো এবং প্রজাদের ভোটেই রাজার নির্বাচন সম্পন্ন হতো। নির্বাচিত রাজা তার দশ বছরের শাসনকালে যা ইচ্ছে করতে পারত। প্রজাদের কাছে তাকে কোনো জবাবদিহি করতে হতো না। তাকে প্রথম দিনই বলে দেয়া হতো যে, তোমার এই দশ বছরের শাসনকালে তুমি সম্পূর্ণ স্বাধীন। যেমন খুশি তেমন দেশ চালাতে পারবে, রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে যত টাকা ইচ্ছা ব্যয় ও ভোগ করতে পারবে।
কিন্তু দশ বছর ফুরিয়ে গেলে তোমার ঠিকানা হবে পার্শ্ববর্তী মরুভূমির শুষ্ক প্রান্তর। সেখানে ছায়া নেই, পানি নেই এবং খাবার নেই। রোদে পুড়ে ক্ষুধা ও পিপাসায় ছটফট করে তোমাকে মরতে হবে। এসব কথা শুনেও যে ব্যক্তি রাজি হতো এবং যার ভেতরে শাসকসুলভ প্রয়োজনীয় যোগ্যতার পরিচয় পাওয়া যেত, তাকেই সিংহাসনে বসানো হতো।
রাজার অভিষেক হতো মহা ধুমধামে। আবার যেদিন তার দিন ফুরিয়ে যেত, সেদিনও তাকে হাত-পা বেঁধে অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে রেখে আসা হতো মরুভূমির নির্দিষ্ট জায়গায় একই রকম ধুমধামের সাথে। সেখানে তাকে একটা লোহার খুঁটিতে শিকল দিয়ে বেঁধে আসা হতো। তারপর অত্যন্ত কঠোর পাহারা বসানো হতো যাতে সে কখনো ছুটে লোকালয়ে আসতে না পারে এবং লোকালয়ের কেউ গিয়ে তাকে খাবার- দাবার দিয়ে আসতে না পারে। ক্ষমতা গ্রহণের প্রথম দিনই নতুন রাজাকে একবার ওই বিরাণ জায়গাটা দেখিয়ে আনা হতো, যেখানে এর আগে বহু রাজা মারা গেছে এবং তাদের অনেকের কংকাল ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে।
এভাবেই শত শত বছর ধরে চলছিল ক্ষমতার পালাবদল। কিন্তু এক সময় দেশটিতে রাজার আকাল পড়ল। মেয়াদ ফুরানো রাজার করুণ পরিণতি দেখে ওই সিংহাসনটির ব্যাপারে এমন আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল যে, কেউ আর এখন রাজা হতে চায় না। দশ বছর আরাম আয়েশে কাটানোর পর এমন ভয়ঙ্কর অপমৃত্যুর পথ কেউ যে বেছে নেবে না, এটাই স্বাভাবিক। এ অবস্থায় প্রজারা বাধ্য হয়ে বিদেশি পর্যটকদের কাছে ধর্ণা দিতে লাগল সিংহাসনে বসার জন্য। কিন্তু শর্ত শুনে বিদেশিরাও রাজা হতে চাইল না।
অবশেষে অনেক খোঁজাখুঁজির পর একজনকে পাওয়া গেল। সে অত্যন্ত ধীরস্থির মস্তিষ্কে সব নিয়ম ও শর্ত জেনে সিংহাসনে বসতে রাজি হল। সিংহাসনে বসে প্রথমদিনই নতুন রাজা মনোযোগ দিল মরুভূমির যে জায়গাটিতে দশ বছর পর তাকে বসবাস করতে হবে, সে জায়গাটির উন্নয়নের দিকে। রাজা সিদ্ধান্ত নিল, যত টাকা লাগে লাগুক, প্রয়োজনে বিদেশি ইঞ্জিনিয়ার ও কারিগর এনে সেখানে আরামদায়ক একটি বাড়ি বানাতে হবে।
যেই কথা সেই কাজ। রাজা বিদেশ থেকে ইঞ্জিনিয়ার, কারিগর ও যন্ত্রপাতি আমদানি করল। তারপর কিছু বিশ্বস্ত লোককে কাজে লাগিয়ে সেই মরুভূমিতে শ্যামল শস্যক্ষেত ও ফলফুলে সুশোভিত বাগানে পরিণত করল। পরিকল্পনা অনুযায়ী সে স্থানে পুকুর, খাল ও নিজের বসবাসের জন্য বিশাল এক প্রাসাদ নির্মাণ করল।
গোটা পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের সময় রাজা একটি কথা সব সময় মনে রেখেছিল। কথাটি হল, নির্দিষ্ট দশ বছরের শাসনকালে তার পূর্ণ স্বাধীনতা রয়েছে এবং রাজ্যের সমস্ত ধনভাণ্ডার ও জনশক্তি তার নিয়ন্ত্রণাধীন। এগুলোকে ব্যবহার করে সে ইচ্ছা করলে তা দশ বছরের শাসনকাল ভোগবিলাসে মত্ত হয়ে কাটিয়ে দিতে পারে। আবার ইচ্ছে করলে ওই সম্পদকে কাজে লাগিয়ে ওই মেয়াদকালে কিংবা তার পরবর্তী সময় এই দুটো সময়কেই আরামদায়ক বানাতে পারে। নতুন রাজা এই দ্বিতীয় চিন্তাটাই বাস্তবায়ন করল যা তার আগের রাজাদের মাথায়ই আসেনি। যাই হোক, দেখতে দেখতে রাজা তার দশ বছরের শাসন পূর্ণ করল। দেশের মানুষ তার শাসনকালে অত্যন্ত সুখী ছিল এবং অনেকেই তাকে আরো একটি মেয়াদের জন্য ক্ষমতায় রাখতে আগ্রহী ছিল। কিন্তু দেশের নিয়মকানুন ছিল অলংঘনীয়।
তাই মেয়াদ পূর্তি হতে নিয়ম অনুযায়ী রাজধানীতে বিশাল জনসমাগম হল। সবাই মিছিল সহকারে রাজাকে সেই মরুভূমিতে নিয়ে চলল। এ সময় একটা ব্যাপার দেখে সবাই বিস্মিত হয়ে গেল, যা আগের কোনো রাজার বেলায় দেখা যায়নি। ব্যাপারটা হল, এই রাজা মিছিলকারীদের সঙ্গে মরুভূমিতে যাওয়ার সময় এমন আমোদ- ফূর্তি করে যাচ্ছিল যা সত্যিই অভাবনীয়। কেননা এর আগে প্রত্যেক রাজাকে দড়ি দিয়ে বেঁধে মরুভূমিতে নেয়া হতো। কেউ স্বেচ্ছায় যেতে চাইত না। কিন্তু এই বিদেশি রাজা মিছিলকারীদের সঙ্গে হাসতে হাসতে মরুভূমির দিকে এগিয়ে গেল!
যখন মিছিলটি মরুভূমির কাছে গিয়ে পৌঁছল তখন সবার চক্ষু ছানাবড়া হয়ে গেল! ধূ ধূ প্রান্তরের পরিবর্তে সেখানে তারা একটা সুন্দর বাগান ও নয়নাভিরাম প্রাসাদ
দেখতে পেল। সবাই অবাক হয়ে রাজাকে জিজ্ঞেস করল- এসব কোত্থেকে এল? রাজা জবাব দিল, ‘আমি আমার রাজত্বের পরবর্তী সময়ের কথা ভুলে যাইনি। তাই রাজ্য শাসনকালে এসব তৈরি করে রেখেছি।’ রাজার কথা শুনে প্রজাদের মুখে হাসি দেখা গেল। কারণ তারা চাচ্ছিল এ রাজাই বাকি সময় দেশ চালাক। কিন্তু কঠিন নিয়মের কারণে তারা এ কথা মুখেও আনতে পারছিল না। অবশেষে রাজার বুদ্ধিতে তাদের মনের আশা পূরণ হল আর রাজাও করুণ মৃত্যু থেকে রেহাই পেল।