যখন কোনো খাঁটি পীর কাউকে মুরীদ করতে চান তখন এই মুরীদের পরীক্ষা নিয়ে থাকেন। পীরের মুরীদের কঠিন পরীক্ষা নেয়া প্রয়োজন। আজ পীরের মুরীদের কঠিন পরীক্ষা সম্পর্কে একটি ছোট গল্প বলব।
গল্প শুরু: এক বুযুর্গ ছিলেন। তাঁর কাছে যে ব্যক্তি মুরীদ হতে আসত তিনি তার কাছে খাদেমকে দিয়ে খাবার পাঠিয়ে দিয়ে খাদেমকে বলতেন, “এই ব্যক্তি যখন খাবার খেয়ে সারবে তখন অবশিষ্ট খাবার আমাকে এনে দেখাবে।” খাদেম তাই করত। বেঁচে থাকা খাবার শায়খ পরীক্ষা করতেন। তিনি দেখতেন বাস্তবে তার খাবার বাঁচানোর প্রয়োজন ছিল কিনা? আর ভাত যতটুকু বেঁচেছে তরকারী সেই পরিমাণ বেঁচেছে কিনা? যতটুকু দিয়ে সেই ভাতটুকু খাওয়া চলে। যদি তা না হতো তবে তিনি বলে দিতেন, “তোমার মধ্যে শৃঙ্খলা নেই। সুতরাং তোমার মেজাজের সঙ্গে আমার মেজাজের মিল হবে না। তাই তোমাকে মুরীদ করতে পারব না।” (আল এফাযাতুল ইয়াউয়্যাহ; খন্ড ৭, পৃষ্ঠা- ১৩২)
হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে- (আন্ নাজরু শিফাউন্) অর্থাৎ, দৃষ্টিতে আরোগ্য হয়। এর অর্থ শুভ দৃষ্টি। মুর্শিদকে দেখলে মৃত অন্তর সজীব হয় বা রোগাক্রান্ত অন্তর আরাম বোধ করে এবং চিন্তিত হৃদয়ের চিন্তা দূর হয়। মুর্শিদের আসল এবং প্রকৃত রূপ যে দেখে, সে মরে না। যেমন আজরাঈল (আঃ)-এর আসল রূপ যে দেখে, সে বাঁচে না।
হযরত খিজির (আঃ)-এর ঘটনা গভীরভাবে চিন্তা করুন। সংক্ষেপে তা হল এই যে, হযরত খিজির (আঃ) সতর্কতামূলকভাবে হযরত মূসা (আঃ)-কে অঙ্গীকার করিয়ে নিয়েছিলেন যে, আমার কোনো কাজে আপনি আপত্তি করবেন না। যদি করেন তাহলে আমার থেকে আলাদা হয়ে যাবেন। হযরত মূসা (আঃ) বললেন, ইনশা আল্লাহ আমি অবশ্যই এ কথায় বহাল থাকব। অতঃপর হযরত খিজির (আঃ) নদীর তীরে গেলেন। সেখান থেকে মালিকের অনুমতি ছাড়াই একটি নৌকা নিয়ে নদী পার হলেন এবং পরে স্বীয় লাঠির আঘাতে নৌকাটি ভেঙে নদীতে ডুবিয়ে দিলেন।
হযরত মূসা (আঃ) দেখলেন এটা সম্পূর্ণ শরিয়তবিরোধী কাজ। কারণ মালিকের অনুমতি ছাড়া কোনো জিনিস নেওয়া অবৈধ। তদুপরি উহা ভেঙে ডুবিয়ে দেয়া হয়েছে এবং অদৃশ্য করে ফেলা হয়েছে। একই ঘটনায় তিন চারটি নিষিদ্ধ কর্ম বা হারাম কাজ হল, তাই হযরত মূসা (আঃ) আপত্তি উত্থাপন করলেন যে, আপনি এসব শরিয়তবিরোধী কাজ করেছেন। তখন হযরত খিজির (আঃ) বললেন, আমার কাছ থেকে আপনি এখনি বিদায় হোন। হযরত মূসা (আঃ) বিনীতভাবে অপরাধ ক্ষমা চাইলেন এবং কথা দিলেন, আর এমন হবে না।
অতঃপর সেখান থেকে এগিয়ে পথে একটি ছেলেকে স্বীয় লাঠির আঘাতে খিজির (আঃ) মেরে ফেললেন। হযরত মূসা (আঃ) আবারও এতে আপত্তি করেন। নূরানী বক্ষ হযরত খিজির (আঃ) রেগে গিয়ে বললেন, আপনি আমার থেকে বিদায় হোন। হযরত মূসা (আঃ) আবারও ক্ষমাপ্রার্থী হলেন। হযরত খিজির (আঃ) তাঁকে নিয়ে এগিয়ে গেলেন। পথে একটি ভাঙা দেয়াল পেয়ে দিনব্যাপী মেরামত করে দিলেন। এ কাজ কেউ তাঁকে করতেও বলেনি বা এজন্য তিনি কোনো পারিশ্রমিকও পাননি। একান্ত স্বেচ্ছায় কাজটি করেছেন। মূসা (আঃ) আবার প্রতিবাদ করলেন, নূরানী বক্ষ হযরত খিজির (আঃ) তাঁকে আলাদা হতে বললেন, এবার আপনার বিদায়ের পালা। কারণ আমার কাজ আপনার অপছন্দ এবং আপনি গোপন জ্ঞান সম্পর্কে অজ্ঞ। প্রকৃতপক্ষে জাগতিক নবীর ধৈর্যও নেই।
তখন হযরত মূসা (আঃ) আরজ করলেন, আপনি নৌকা ভাঙলেন, এর রহস্য কী? উত্তর দিলেন, জনৈক জালিম বাদশা আসছিল, সে নৌকার মাঝি-মাল্লা সকলকে ধরে নিয়ে যেত। তাই এটাকে ডুবিয়ে দিয়েছি যেন বেচারার নৌকা নিজেই পেয়ে যায় এবং এ নৌকা দ্বারা ঐ গরিবরা তাদের জীবিকা অর্জন করতে পারে। নাবালকটাকে হত্যা করার রহস্য হল ছেলেটা ডাকাত হত, তার পিতা-মাতাকে কষ্ট দিত এবং আল্লাহর অবাধ্য হত। এজন্য আমি তাকে হত্যা করেছি। অতঃপর তার আর একটি ভগ্নি জন্মগ্রহণ করবে এবং তার আওলাদদের মধ্যে সত্তর জন নবী জন্ম নিবেন।
আর দেয়াল মেরামতের মাধ্যমে আমি জনৈক অনাথকে সাহায্য করেছি। এ দেয়ালের নিচে তার পিতার অনেক সম্পদ লুকায়িত আছে। এ দেয়ালটি পড়ে গেলে সে সম্পদ অন্যে নিয়ে যেত। আক্ষেপ এ সব বিষয়ে আপনি মোটেই অবহিত নন এবং আপনার কোনো অদৃশ্য জ্ঞানও নেই। আপনি যদি আমার কাজে আপত্তি উত্থাপন না করতেন, তাহলে অনুরূপ হাজারও বিষয়ে আপনাকে শিক্ষা দিতাম।
এখানে চিন্তার বিষয় এই যে, হযরত মূসা (আঃ) নবী হয়েও নিজের ওয়াদা ভঙ্গ করেছেন এবং আপত্তি উত্থাপন করেছেন। প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ তা’য়ালা গোপন জ্ঞান শিক্ষার জন্য নূরানী বক্ষ হযরত খিজির (আঃ)-এর নিকট তাঁকে প্রেরণ করেছিলেন। এতদসত্ত্বেও তিনি বাহ্যিক শরিয়তের অনুসরণ করেন এবং নূরানী বক্ষ হযরত খিজির (আঃ)-এর কার্যাদি খারাপ ও দোষণীয় মনে করেন। তিনি এটা চিন্তাই করেননি যে, যেহেতু আল্লাহ আমাকে তাঁর কাছে পাঠিয়েছেন, সেহেতু তাঁর তাক্লীদ বা অনুসরণ করা আমার কর্তব্য এবং তাঁর সাথে বিরোধ করা অনুচিত।
আল্লাহর অলীগণ সব সময়ই মঙ্গল করে থাকেন। তাঁরা যেখানে থাকেন সেখানে আল্লাহর রহমত অবতীর্ণ হয়। হাদীস শরীফে আছে যে, আল্লাহর অলীগণ পানাহার ও কথা বলার সময় রহমত নাযিল হয়। অতএব তাঁদের সব কথাই রহমত মিশ্রিত। তাঁরা যদি কাউকে মারেনও তাও রহমত