কসম খাওয়ার বিভ্রাট (এক)
এক ব্যক্তির বউ রাগ করেছিল। স্বামীর সঙ্গে কথা বলে না। স্বামী অনেক চেষ্টা করেও বউকে কথা বলাতে পারল না। অবশেষে এক রাত্রিতে বিরক্ত হয়ে বউকে বলল, “আজ ফজরের আযান হওয়ার আগে যদি কথা না বল তবে তোমার উপরে তিন তালাক”। কিন্তু তবু বউ কথা বলল না। কারণ বউটি খুব সুন্দরী ছিল। এই স্বামীর ভাত না খাওয়াই তার ইচ্ছা ছিল। তালাক হয়ে যাওয়াটাই সে কামনা করছিল। সুতরাং কথা না বলে কোনো প্রকারে ফজরের আযান পর্যন্ত কাটিয়ে দিতে পারলেই স্বামীর এই কথা তালাক হিসেবে গণ্য হয়ে যাবে। স্বামীর বন্ধন থেকে মুক্তি পাওয়ার এই একটা সুযোগ হল। সুতরাং সে মুখ আরো শক্তভাবে বন্ধ করল।
এদিকে স্বামী বেচারা আরো বিপদে পড়ে গেল। এতদিন কথা বলেনি সেই ভাল ছিল। কিন্তু এখন দেখি এই কথা দ্বারা একেবারে তালাক হয়ে যাবে। হায়! ফজর হতে তো আর বেশি দেরি নাই, এমন কথা কেন বললাম! লোকটি খুব বিব্রত হয়ে মাসআলার খোঁজে বের হয়ে পড়ল। কেমন করে তালাক থেকে বউকে বাঁচান যায়? অনেক আলেম-উলামার কাছে ছোটাছুটি করল। কিন্তু তার পক্ষে কোনো ফতোয়া পাওয়া গেল না। সবাই বলল, এই বউকে তালাক থেকে আর বাঁচানো যাবে না। যদি এভাবে কথা বন্ধ রাখে তবে ফজরের আযান হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বউ তালাক হয়ে যাবে।”
অবশেষে লোকটি হযরত ইমাম আবু হানিফা (রঃ) এর খেদমতে হাজির হয়ে তার দুঃখের কথা ব্যক্ত করল, “হুযুর এই বউ তালাক হয়ে গেলে আমি বাঁচবো না । আমাকে এই বিপদ হতে রক্ষা করুন।” ইমাম আবু হানিফা (রঃ) বললেন, “তোমার বউ তালাক হবে না। তুমি বাড়ী যাও। বউ তোমারই থাকবে”। এই ফতোয়া শুনে আলেম-উলামা অবাক হয়ে বলাবলি করতে লাগলেন, “যে ইমামকে আমরা এত শ্রদ্ধা করি তিনি একজন সামান্য ব্যক্তির দুঃখ দেখে স্থির থাকতে পারলেন না? শরীয়তের মাসআলাকে হেরফের করে ফতোয়া দিয়ে দিলেন”? কিন্তু ব্যাপারটি ঘটলো অন্যভাবে। বিজ্ঞ ইমামের পক্ষেই শুধু এরূপ জটিলকে সহজ করা সম্ভব ছিল। লোকটির বাড়ির কাছে একটি মসজিদ ছিল।
ইমাম আবু হানিফা (রঃ) ফরজ হওয়ার আগেই সেই মসজিদে গিয়ে উচ্চস্বরে আযান দিতে লাগলেন। বউটি আযান শোনা মাত্র আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে স্বামীকে ডেকে বলতে লাগল, “আমার তালাক হয়ে গেছে। আমার বিদায়ের ব্যবস্থা করুন”। লোকটি বলল, “কেমন করে হল তোমার তালাক?” বউ বলল, ঐ দেখুন মসজিদে ফজরের আযান হচ্ছে। আমি ফজরের আযানের পূর্ব পর্যন্ত কথা বলা বন্ধ রেখেছিলাম তাই সেই কথা
অনুযায়ী তালাক হয়ে যায়”। লোকটি আবার চিন্তায় পড়ে গেল। ইমাম সাহেবের কন্ঠে আযানের আওয়াজ শুনে মসজিদের দিকে ছুটে গেল। বলল, “হুযুর আপনি বললেন, বউ তালাক হবে না কিন্তু বউ তো তালাক হয়ে গেল। এখন আমি কি করি?”
ইমাম সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, “কেমন করে তালাক হল?” লোকটি বলল, “এই যে ফজরের আযান হয়ে গেল এর আগ পর্যন্ত সে কথা বন্ধ রেখেছিল।” ইমাম সাহেব বললেন, “এই আযানের পরে তোমার স্ত্রীকি কথা বলেছে কিছু?” লোকটি বলল “জী হাঁ, আযানের পরে কথা বলেছে।” ইমাম সাহেব বললেন- তবে ঠিক আছে। তোমার বউ তালাক হয়নি। ফজরের আযানের এখনও অনেক দেরী আছে। তার আগেই তোমার বউ কথা বলে ফেলেছে। যে আযান শুনে কথা বলেছে সেটা ছিল
তাহাজ্জুদের আযান। লোকটি আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে উঠল। বাড়ী গিয়ে বউকে জড়িয়ে ধরে বলল, সে তাহাজ্জুদের আযান শুনে কথা বলে ফেলেছে। সব কিছু শুনে বউটি হতভম্ব আর আলেমগণ হতবাক! (আল-এফাযাতুল ইয়্যাওমিয়্যাহ- খণ্ড ৪, পৃষ্ঠা- ২৩৪)
কসম খাওয়ার বিভ্রাট (দুই)
এক ব্যক্তি রাগান্বিত হয়ে তার স্ত্রীর কাছে কসম খেয়ে বলল, যদি আমি তোমার সাথে আগে কথা বলি, তবে তুই তালাক। স্ত্রীও অভিমান করে কসম করে বলল, যদি আমি আগে কথা বলি, তবে আমার অমুক গোলাম আজাদ।
দীর্ঘদিন অতিবাহিত হয়ে যায়, কেউ কারো সাথে কথা বলে না। ফলে সংসার অচল। স্বামী আগে কথা বললে স্ত্রী তালাক হয়ে যাবে। আর স্ত্রী আগে কথা বললে তার গোলাম আজাদ করে দিতে হবে। এখন উপায় কি এ নিয়ে স্বামী বেচারা খুবই চিন্তায় পড়ে গেলেন। কেবল আফসোস করতে লাগলেন।
সংসার রক্ষা করার স্বার্থে স্বামী ছুটলেন আলেমদের কাছে। আলেমগণ সবাই একবাক্যে বলে দিলেন স্ত্রীর সাথে আগে কথা বললে তালাক হয়ে যাবে আর স্ত্রী আগে কথা বললে গোলাম আজাদ করা ছাড়া আর কোনো রাস্তা খোলা নেই। সুতরাং হয় স্ত্রী তালাক, না হয় গোলাম আজাদ এই দুই পথ ছাড়া আর বিকল্প কোনো রাস্তা নেই। আলেমদের দৃঢ় বক্তব্য শোনে লোকটির পেরেশানী আরো বেড়ে গেল।
অবশেষে সে ইমাম আবু হানিফা (র:) এর কাছে গিয়ে বিস্তারিত বিষয়টি জানিয়ে সমাধান বের করার অনুরোধ করল। সব শোনে ইমাম আবু হানিফা (র:) বললেন, যাও, তুমি তোমার স্ত্রীর সাথে কথা বল। কোনো ভয় নেই, তালাক হবে না।
এই কথা শোনে সকল আলেম বিষ্মেয়ে ফেটে পড়লেন। সবাই বলতে লাগলেন, আমরা ইমাম আবু হানিফা (র:) কে সব চেয়ে জ্ঞানী ভাবতাম, অথচ তিনি এই ফতোয়া কিভাবে দিলেন। শেষে সকল আলেম একত্রিত হয়ে ইমাম আবু হানিফা (র:) এর কাছে এসে এর ব্যাখ্যা চাইলেন।
ইমাম আবু হানিফা (র:) জবাব দিলেন, স্বামীর কসম খাওয়ার পর পরই স্ত্রী স্বামীকে সম্মোধন করে কসম খাওয়াতে স্ত্রীর কথা বলা হয়ে গেছে। সুতরাং এখন স্বামী কথা বললে স্ত্রীর পরে কথা বলা হবে। কাজেই তালাক হবে না। আর স্বামী কথা বলার পর স্ত্রী কথা বললে তাতে স্ত্রীরও গোলাম আজাদ করা লাগবে না।
এই বক্তব্য শোনার পর আগুন্তুক অলেমদের আর কিছু বলার রইল না।
তথ্যসূত্র: আল এফাদ্বাতুল ইয়াউমিয়্যাহ, খন্ড ৪, পৃষ্ঠা ২৩৫।