পাঠক অবগত আছেন যে, আল্লাহর রfসূল (সা:) আমাদেরকে যা দিয়েছেন সেটা হক। তাঁর এন্তেকালের পর পর্যায়ক্রমে ছাহাবী, তাবেয়ী এবং তাবে তাবেয়ীগণ রাসূলের (সা:) শিক্ষার যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন তা রাসূলের (সা:) জীবদ্দশাতেই স্বীকৃত হয়েছিল। এই চারটি যুগের নীতিমালার ভিত্তিতেই আমরা মুসলমান। এর পরবর্তী যুগে যদি কোন মুসলমান নিজেদের জ্ঞান-প্রসূত মতবাদ গড়ে তোলে তবে তা বাতেল হিসেবে নিক্ষিপ্ত হবে। এই মতবাদ সকল মুসলমানই মেনে নিয়েছেন। একবার হযরত মাওলানা কাসেম নানোতূবী (রঃ) কে শিয়াগণ চ্যালেঞ্জ করেন। সুতরাং এক বিরাট ‘বাহাছ’ বা বিতর্ক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। বিরাট এক মঞ্চের ওপর শামিয়ানা টানানো হল। শিয়া আলোমগণ এসে মঞ্চ ভরে গেল। শিয়া জনগণ মঞ্চের চার পাশে ভীড় করল। সুন্নী জনতাও অসংখ্য। কিন্তু অনেক ক্ষন হয়ে গেল সুন্নী আলেমের কোন খোঁজ নাই। মাওলানা কাসেম কোথায়? মাওলানা কাসেম কোথায়? চারিদিকে খোঁজ খোঁজ রব শুরু হল। কিন্তু তাকে কোথাও পাওয়া গেল না। সুন্নী জনগণ লজ্জায় মাথা নত করে রইল। শিয়ারা ভাবল আমাদের আলেমদের সঙ্গে পেরে ওঠা সহজ হবে না। আমাদের আলেমে মঞ্চ ভরে গেছে। আর ওদের মাত্র একজন আলেম। কেতাব-পত্রও ওদের নাই। আমাদের কেতাবে স্তুপাকার হয়ে গেছে মঞ্চ। শিয়া আলেমগণ অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে ভাবলেন আমাদের বিরাট আয়োজন দেখে মাওলানা কাসেম সরে পড়েছেন, তিনি আর আসবেন না। সুতরাং শিয়া আলেমগণ উৎফুল্ল হয়ে নিজেদের এক তরফা বিজয় ঘোষণা করতে যাবেন এমন সময় দেখা গেল একজন লোক জনতার পিছন থেকে মঞ্চের দিকে এগিয়ে আসছেন। পরণে নীল লুঙ্গি, গায়ে মার্কিনের কোর্তা, মাথায় সফেদ টুপি, দ্বিধাহীন অন্তর, চেহারায় সত্যের দীপ্তি। ভীতিহীন চাহনি নিয়ে তিনি মঞ্চে উঠলেন। পায়ের জুতা খুলে বগলে চেপে রাখলেন। ইনিই মাওলানা কাসেম। সবার দৃষ্টিই মাওলানা কাসেমের দিকে। কিন্তু মাওলানা কাসেম বগলের জুতা কোথাও রাখছেন না কেন? সবাই বলল, “হুজুর, জুতাজোড়া এক পাশে রেখে দিন।” মাওলানা কাসেম না, এখানে শিয়া আছে। এখানে জুতা রাখা যাবে না।
সবাই জিজ্ঞেস করল: কারণ?
মাওলানা কাসেম: শিয়ারা জুতা চুরি করে থাকে।
শিয়া আলেমগণ অবাক হলেন এবং উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন “কোথায় দেখেছেন শিয়াদেরকে জুতা চুরি করতে? কী প্রমাণ আছে আপনার কাছে? মাওলানা কাসেম কেন, রাসূলুল্লাহ (সা) এর মজলিস থেকে একজন শিয়া জুতা চুরি করেছিল আপনারা জানেন না? শিয়া আলেমগণ বলেন কি? রসূলুল্লাহ (সা) এর জীবদ্দশায় মুসলমানদের মধ্যে শিয়া মতবাদ চালুই ছিল না, শিয়া ব্যক্তি আসবে কোথায় থেকে? আপনি কি ইতিহাস কিছুই জানেন না? মাওলানা কাসেম মাফ করবেন। আমি ভুল বলেছি। রসূলুল্লাহ (সা) এর যামানায় নয়। ব্যাপারটি ঘটেছিল ছাহাবাদের যামানায়। ছাহাবাগণ তালিমে মশগুল ছিলেন এমন সময় একজন শিয়া এসে তাঁদের মহফিল থেকে জুতা চুরি করে নিয়ে যায়।
শিয়ারা মিথ্যা কথা। এরূপ কোন ঘটনাই ঘটতে পারে না। কারণ ছাহাবাদের যামানায় কোন শিয়া ছিল না। মাওলানা কাসেম তাহলে তাবেয়ীনের যামানায় ঘটনাটি ঘটেছিল। শিয়া অসম্ভব! তাবেয়ীনের যামানায়ও কোন শিয়া ছিল না । মাওলানা কাসেম তাহলে নিশ্চয় তাবে-তাবেয়ীনের যামানায় শিয়া ব্যক্তিটি জুতা চুরি করেছিল। শিয়ারা বলল, ইতিহাস সাক্ষী আছে এই চারটি যামানায় কোন শিয়া ছিল না । কারণ শিয়া মতবাদ সৃষ্টি হয়েছে এই চারটি যামানার অনেক পরে। সুতরাং শিয়াগন জুতা চুরি করতেই পারে না।
মাওলানা কাসেম এই যে চারটি যামানার কথা বললেন, এর সঙ্গে আমাদের কিরূপ সম্পর্ক রয়েছে বলতে পারেন? শিয়া নিশ্চয় বলতে পারি। এই চার যামানায় দেওয়া ইসলামের ব্যাখ্যার ভিত্তিতে আমরা মুসলমান। পরবর্তী যুগের দেওয়া সব ব্যাখ্যাই বাতেল এবং আবর্জনায় নিক্ষিপ্ত। মাওলানা কাসেম একটু আগেই আপনারা স্বীকার করেছেন রসূলুল্লাহ (সা) এর যামানায় কোন শিয়া ছিল না। ছাহাবা, তাবেয়ী এবং তাবে-তাবেয়ীগণের যামানায়ও কোন শিয়া ছিল না। তাহলে কি আপনারা সেই মতবাদ গ্রহণ করেননি যা এই চার যামানার পরে সৃষ্টি হয়েছে এবং যা নিঃসন্দেহে বাতেল ও আবর্জনায় নিক্ষিপ্ত?
শিয়া আলেমগণ নির্বাক। কোন জওয়াব নাই। মাথা নিচু করে বসে রইলেন। জনতা স্তব্ধ। মাওলানা কাসেম এবার বগল থেকে জুতা বের করলেন। স্তব্ধ জনতার মধ্য দিয়ে জুতা পায়ে ধীর, স্বাভাবিক পদক্ষেপে অনুষ্ঠান থেকে বের হয়ে গেলেন। কোন অহংকার নাই, কোন বাহাদুরী নাই, জলসা পিছনে রেখে অনেক দূর চলে গেলেন। শিয়া আলেমগণ তখনও নির্বাক। জনতা তখনও স্তব্ধ।
(মাওলানা আব্দুল হামিদ, আল্লামা বিনুরী টাউন, করাচী, ১৯৬২ ইং)