হযরত ইউসুফ (আঃ) এর জীবনী ষষ্ঠ পর্ব

হযরত ইউসুফ (আঃ) এর জীবনী ষষ্ঠ পর্ব

হযরত ইউসুফ (আঃ) এর জীবনী ষষ্ঠ পর্ব

ইউসুফ আ. এর পক্ষে নবজাতক শিশুর সাক্ষ্য প্রদান

ব্যাপারটি খুবই নাজুক এবং আযীযে মিসর-এর পক্ষে কে সত্যবাদী, তার মীমাংসা করা কঠিন ছিল। কেননা, সেখানে সাক্ষ্য-প্রমাণের কোনো অবকাশ ছিল না। কিন্তু আল্লাহ তা‘আলা যেভাবে স্বীয় মনোনীত বান্দাদেরকে গুনাহ থেকে বাঁচিয়ে নিষ্পাপ ও পবিত্র রাখেন, ঠিক তেমনিভাবে তাঁদেরকে অশুভ চক্রান্ত থেকে বাঁচিয়ে রাখারও ব্যবস্থা করেন।

সাধারণত এরূপ ক্ষেত্রে মহান আল্লাহ কথা বলতে অক্ষম নবজাতক শিশুদেরকে কাজে লাগান। অলৌকিকভাবে তাদেরকে বাকশক্তি দান করে প্রিয় বান্দাদের পবিত্রতা প্রমাণ করেন। যেমন, হযরত মারইয়ামের প্রতি যখন লোকেরা অপবাদ আরোপ করতে থাকে, তখন একদিনের নবজাতক শিশু ঈসা আ. কে আল্লাহ তা‘আলা বাকশক্তি দান করে তাঁর মুখে জননীর পবিত্রতা প্রকাশ করে দেন। তেমনিভাবে বনী ইসরাঈলের জুরাইজ নামক একজন সাধু ব্যক্তির প্রতি গভীর ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে এমনি ধরনের অপবাদ আরোপ করা হলে, নবজাতক শিশু সেই ব্যক্তির পবিত্রতার সাক্ষ্য দান করে। অনুরূপভাবে হযরত মুসা আ. এর প্রতি ফির‘আউনের মনে সন্দেহ দেখা দিলে, ফির‘আউনের স্ত্রীর চুল পরিচর্যাকারিণী মহিলার সদ্যজাত শিশু বাকশক্তি প্রাপ্ত হয় এবং সে মুসা আ. কে শৈশবে ফির‘আউনের কবল থেকে রক্ষা করে।

ঠিক তেমনিভাবে ইউসুফ আ. এর ঘটনায় হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস ও আবু হুরাইরা রা. এর বর্ণনায় রয়েছে, মহান আল্লাহ একটি শিশুকে বিজ্ঞ ও দার্শনিকসূলভ বাক শক্তি দান করলেন। এই কচি শিশু এ ঘরেই দোলনায় লালিত হচ্ছিল। তার সম্পর্কে কারো ধারণা ছিল না যে, সে এসব কর্মকাণ্ড দেখবে এবং বুঝবে, অতঃপর অত্যন্ত বিজ্ঞতার সাথে তা বর্ণনাও করে দেবে। কিন্তু সর্বশক্তিমান মহান আল্লাহ স্বীয় আনুগত্যের পথে সাধনাকারীদের সঠিক মর্যাদা ফুটিয়ে তোলার জন্য দুনিয়াবাসীকে দেখিয়ে দেন যে, বিশ্বের প্রত্যেকটি অণু-পরমাণু তাঁর গুপ্ত বাহিনী। এরা অপরাধীকে ভালোভাবেই চেনে, তার অপরাধের রেকর্ড রাখে এবং প্রয়োজন মুহূর্তে তা প্রকাশও করে দিতে পারে। এ ছোট শিশুটি বাহ্যত জগতের সব কিছু থেকে উদাসীন ও নির্বিকার অবস্থায় দোলনায় পড়ে ছিল। সে ইউসুফ আ. এর মু‘জিযা হিসেবে ঠিক ঐ মুহূর্তে মুখ খুললো, যখন আযীযে মিসর ছিলেন এ ঘটনা সম্পর্কে নানা দ্বিধাদ্বন্দ্বে জড়িত।

এ শিশুটি যদি এতটুকু বলে দিত যে, ইউসুফ আ. নির্দোষ এবং দোষ যুলাইখার, তবে তাও একটি মু‘জিযারূপে ইউসুফ আ. এর পক্ষে তাঁর পবিত্রতার ব্যাপারে বিরাট সাক্ষ্য হয়ে যেত। কিন্তু আল্লাহ তা‘আলা এ শিশুর মুখে একটি দার্শনিকসুলভ উক্তি উচ্চারণ করালেন এভাবে যে, সে বললো, “ইউসুফ আ. এর জামাটি দেখ; যদি তা সামনের দিকে ছেঁড়া থাকে তবে যুলাইখার কথা সত্য এবং ইউসুফ আ. মিথ্যাবাদী পরিগণিত হবেন। আর যদি জামাটি পেছন দিকে ছেঁড়া থাকে, তাহলে এতে এ ছাড়া অন্য কোনো সম্ভাবনাই নেই যে, ইউসুফ আ. পলায়নরত ছিলেন এবং যুলাইখা তাঁকে পিছন থেকে আটকে ধরে পলায়নে বাধা দিতে চাচ্ছিল। সুতরাং এক্ষেত্রে ইউসুফ আ. অবশ্যই সত্যবাদী সাব্যস্ত হবেন এবং যুলাইখা হবে মিথ্যাবাদী।” এটা এজন্য এভাবে উপস্থাপন করা হলো যে, শিশুর অলৌকিক বাকশক্তি ছাড়াও, এ বিষয়টি যেন প্রত্যেকের কাছে যুক্তি সঙ্গত মনে হয় এবং এর কারণে চাক্ষুষ প্রমাণ আযীযে মিসর নিজেই পেয়ে যেতে পারেন।

অতঃপর যখন বর্ণিত আলামত অনুযায়ী জামাটির পেছন দিকে ছেঁড়া দেখা গেল, তখন ইউসুফ আ. এর পবিত্রতা বাস্তবভাবেই প্রতিভাত হয়ে গেল। পবিত্র কুরআনের নিম্নেবর্ণিত আয়াতসমূহে এ বিষয়টি বিবৃত হয়েছে,

وَشَهِدَ شَاهِدٌ مِّنْ اَهْلِهَا ۚ اِنْ کَانَ قَمِیْصُهٗ قُدَّ مِنْ قُبُلٍ فَصَدَقَتْ وَهُوَ مِنَ الْکٰذِبِیْنَ○ وَ اِنْ کَانَ قَمِیْصُهٗ قُدَّ مِنْ دُبُرٍ فَکَذَبَتْ وَهُوَ مِنْ الصّٰدِقِیْنَ○ فَلَمَّا رَاٰ قَمِیْصَهٗ قُدَّ مِنْ دُبُرٍ قَالَ اِنَّهٗ مِنْ کَیْدِكُنَّ ؕ اِنَّ کَیْدَكُنَّ عَظِیْمٌ○

অর্থঃ মহিলার পরিবারের একজন সাক্ষী (শিশু) সাক্ষ্য দিল যে, যদি তার জামা সামনের দিক দিয়ে ছেঁড়া থাকে, তবে মহিলা সত্যবাদিনী এবং সে মিথ্যাবাদী হবে। আর যদি তার জামা পেছন দিক থেকে ছেঁড়া থাকে, তাহলে মহিলা মিথ্যাবাদিনী এবং সে সত্যবাদী হবে। অতঃপর ঘরস্বামী যখন দেখলো যে, ইউসুফের জামা পেছন দিক থেকে ছেঁড়া তখন সে বললো, নিশ্চয় এটা তোমাদের নারীদের ছলনা। নিঃসন্দেহে তোমাদের ছলনা অত্যন্ত ভীষণ। (সূরা ইউসুফ, আয়াত: ২৬-২৮)

আযীযে মিসর শিশুটির এভাবে কথা বলার দিয়েই বুঝে নিয়েছিলেন যে, ইউসুফ আ. এর পবিত্রতা প্রকাশ করার জন্যেই এ অস্বাভাবিক ঘটনার বহিঃপ্রকাশ হয়েছে।

তদুপরি তার বক্তব্য অনুযায়ী যখন দেখলেন যে, ইউসুফ আ. এর জামাটি পেছন থেকে ছেঁড়া, তখন আযীযে মিসর নিশ্চিত হলেন যে, দোষ যুলাইখার এবং ইউসুফ আ. পবিত্র। তাই তিনি যুলাইখাকে সম্বোধন করে বললেন, “এসব তোমার ছলনা। তুমি নিজের দোষ অন্যের ঘাড়ে চাপাতে এ ফন্দি এটেছো।”

নারী জাতির ছলনা খুবই মারাত্মক

উক্ত আয়াতে আযীযে মিসর নারী জাতির ছলনা অত্যন্ত মারাত্মক বলে উল্লেখ করেছেন। বাস্তবিকই নারী জাতির ছলনা খুবই মারাত্মক। একে বোঝা এবং এর জাল ছিন্ন করা সহজ নয়। কেননা, তারা বাহ্যত কোমল, নাজুক ও অবলা হয়ে থাকে। তাই যারা তাদেরকে দেখে, তারা তাদের কথা দ্রুত বিশ্বাস স্থাপন করে ফেলে। অথচ এসব ক্ষেত্রে অনেকাংশেই তারা বিবেক-বুদ্ধি ও আল্লাহ ভীতির অভাব বশত মিথ্যা ছলনা করে থাকে এবং কথা বানোয়াটি করে অপরের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে থাকে। অবশ্য যারা আল্লাহভীরু ও পরহেযগার, তারা কখনও এরূপ ছলনা করে না। (তাফসীরে মাযহারী)

অতঃপর ঘটনার প্রেক্ষিতে আযীযে মিসর ইউসুফ আ. কে যা বললেন, তা পবিত্র কুরআনে এভাবে ব্যক্ত করা হয়েছে,

یُوْسُفُ اَعْرِضْ عَنْ هٰذَا

অর্থঃ ইউসুফ! এ ঘটনা উপেক্ষা কর (এবং ব্যাপারটি বলাবলি করো না। যাতে আমার বেইজ্জতি না হয়)। (সূরা ইউসুফ, আয়াত: ২১৯)

পরিশেষে তিনি যুলাইখাকে আত্মসংশোধনের জন্য যে উপদেশ দিলেন, তা পবিত্র কুরআনে এভাবে উল্লেখ করা হয়েছে,

وَ اسْتَغْفِرِیْ لِذَنْۢبِکِ ۚۖ اِنَّکِ كُنْتِ مِنَ الْخٰطِئِیْنَ○

অর্থঃ তুমি নিজের অন্যায়ের জন্য ইস্তিগফার (ক্ষমা প্রার্থনা) করো। তুমি তো পাপীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গিয়েছ। (সূরা ইউসুফ, আয়াত: ২৯)

এখানে বাহ্যত বুঝা যায় যে, মহান আল্লাহর কাছে ইস্তিগফার করতে বলা হয়েছে। আবার এটাও হতে পারে যে, স্বামীর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে বলা হয়েছে। কিংবা এটাও হতে পারে যে, ইউসুফ আ. এর কাছে ক্ষমা চাইতে বলা হয়েছে।

গল্পের বিষয়:
ইসলামিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত