হযরত ইউসুফ (আঃ) এর জীবনী পঞ্চম পর্ব
ইউসুফ আ. এর প্রতি আযীযে মিসর-এর স্ত্রীর আসক্তি
ইউসুফ আ. আযীযে মিসর-এর ঘরে সুখে-স্বাচ্ছন্দ্যে বসবাস করছিলেন। কিন্তু ইতোমধ্যে এক পরীক্ষামূলক বিপদ এই দেখা দিল যে, আযীযে মিসর-এর স্ত্রী হযরত ইউসুফ আ. এর প্রতি আসক্ত হয়ে পড়লো। এ প্রেক্ষিতে উক্ত মহিলা তার সাথে কুবাসনা চরিতার্থ করার জন্য তাকে ফুসলাতে লাগলো। নিম্নোক্ত আয়াতে এ কথাই ব্যক্ত করা হয়েছে,
وَرَاوَدَتْهُ الَّتِیْ هُوَ فِیْ بَیْتِهَا عَنْ نَّفْسِهٖ وَغَلَّقَتِ الْاَبْوَابَ وَقَالَتْ هَیْتَ لَکَ ؕ قَالَ مَعَاذَ اللهِ اِنَّهٗ رَبِّیْۤ اَحْسَنَ مَثْوَایَ ؕ اِنَّهٗ لَا یُفْلِحُ الظّٰلِمُوْنَ○
অর্থঃ যে মহিলার ঘরে ইউসুফ আ. ছিলেন, সে তাকে ফুসলাতে লাগলো এবং দরজাসমূহ বন্ধ করে দিল। সেই মহিলা বললো, শোনো! তোমাকে বলছি, এদিকে আসো! তিনি বললেন, আল্লাহ রক্ষা করুন। নিশ্চয়ই আমার মালিক আমাকে সযত্নে থাকতে দিয়েছেন। আর অবশ্যই সীমা লঙ্ঘনকারীরা কখনো সফলকাম হয় না। (সূরা ইউসুফ, আয়াত: ২৩)
উক্ত মহিলা ছিল আযীযে মিসর-এর স্ত্রী। কিন্তু এ স্থলে পবিত্র কুরআনে “আযীযের পত্নী” শব্দ ব্যবহার না করে “যার ঘরে ছিল” এ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এতে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, ইউসুফ আ. এর উক্ত গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা এ কারণে আরো অধিক কঠিন ছিল যে, তিনি তারই ঘরে তারই আশ্রয়ে থাকতেন। সুতরাং তার আদেশ উপেক্ষা করা তার পক্ষে সহজসাধ্য ছিল না।
হযরত ইউসুফ আ. যখন নিজেকে চতুর্দিক থেকে বেষ্টিত দেখলেন, তখন পয়গাম্বরসূলভ ভঙ্গিতে সর্বপ্রথম আল্লাহ তা‘আলার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করে বললেন, مَعَاذَ اللهِ (আমি আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করছি)
এক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, তিনি শুধু নিজ ইচ্ছা ও সংকল্পের ওপর ভরসা করেননি, বরং মহান আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করেছেন। আর এটা স্বতঃসিদ্ধ কথা যে, যে ব্যক্তি আল্লাহর আশ্রয় লাভ করে, তাকে কেউ সিরাতে মুস্তাকীম থেকে বিচ্যুত করতে পারে না। এ ছাড়াও তিনি পয়গাম্বরসূলভ বিজ্ঞতা ও নসীহত পেশ করে স্বয়ং সেই মহিলাকে উপদেশ দিতে লাগলেন যে, তারও উচিত আল্লাহ তা‘আলাকে ভয় করা এবং মন্দ বাসনা থেকে বিরত থাকা।
ইউসুফ আ. আরো বললেন যে, আপনার স্বামী আযীযে মিসর আমাকে লালন-পালন করছেন, আমাকে উত্তম আবাসন দিয়েছেন। অতএব তিনি আমার প্রতি অনুগ্রহকারী; অথচ আমি তার ইযযতে হস্তক্ষেপ করবো! এটা জঘন্য অনাচার। আর অনাচারীরা কখনও কল্যাণপ্রাপ্ত হয় না।
সুদ্দী ইবনে ইসহাক রহ. প্রমুখ তাফসীরবিদগণ বর্ণনা করেন যে, এ নির্জনতায় সেই মহিলা ইউসুফ আ. কে নিজের প্রতি আকৃষ্ট করার জন্য ইউসুফ আ. এর রূপ ও সৌন্দর্যের উচ্ছাসিত প্রশংসা করতে লাগলো। সে বললো, তোমার চুল কত সুন্দর! ইউসুফ আ. বললেন, মৃত্যুর পর এই চুল সর্বপ্রথম আমার দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। এরপর সে বললো, তোমার দুই চোখ কতই না আকর্ষণীয়। ইউসুফ আ. বললেন, মৃত্যুর পর এগুলো পানি হয়ে আমার মুখমণ্ডলে প্রবাহিত হবে। সে আরো বললো, তোমার মুখমণ্ডল কতই না কমনীয়! ইউসুফ আ. বললেন, এগুলো সব মাটির খোরাক।
আল্লাহ তা‘আলা হযরত ইউসুফ আ. এর মনে পরকালের চিন্তা এত বেশী প্রবল করে দেন যে, ভরা যৌবনেও জগতের যাবতীয় ভোগ-বিলাস তাঁর দৃষ্টিতে তুচ্ছ হয়ে যায়। এভাবে আখিরাতের চিন্তা-ই মানুষকে সব রকম অন্যায় থেকে ফিরিয়ে রাখতে পারে।
আগে আলোচিত হয়েছে যে, আযীযে মিসর-এর স্ত্রী যুলাইখা ঘরের দরজা বন্ধ করে ইউসুফ আ. কে পাপ কাজের দিকে আহ্বান করে। তখন ইউসুফ আ. আল্লাহর নিদর্শন দেখার করার সাথে সাথে যুলাইখার কুমতলবের নাগপাশ ছিন্ন করে বন্ধ দরজাসমূহের দিকে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে লাগলেন এবং কোনোরূপ দ্বিধা বা চিন্তার মধ্যে সময় ব্যায় করলেন না। এ সময় হযরত ইউসুফ আ. স্বীয় প্রতিপালকের কী নিদর্শন দেখেছিলেন, পবিত্র কুরআনে সেটা বলা হয়নি। তবে বিভিন্ন রিওয়ায়েতের ভিত্তিতে তাফসীরবিদগণ এ সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য উপস্থাপন করেছেন। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস, মুজাহিদ, সাঈদ ইবনে যুবাইর, মুহাম্মাদ ইবনে সিরীন, হাসান বসরী রহ. প্রমুখ বলেছেন, আল্লাহ তা‘আলার মু‘জিযা হিসেবে এ নির্জন কক্ষে হযরত ইয়াকূব আ. এর চিত্র এভাবে ইউসুফ আ. এর সামনে উপস্থিত করে দেন যে, তিনি হাতের অঙ্গুলি দাঁতে চেপে হুঁশিয়ার করেছেন।
কোনো কোনো তাফসীরবিদ বলেন, আযীযে মিসর-এর মুখচ্ছবি তাঁর সামনে ফুটিয়ে তোলা হয়। কেউ বলেন, ইউসুফ আ. এর দৃষ্টি ছাদের দিকে উঠতেই সেখানে কুরআন মাজীদের এ আয়াত লিখিত দেখেন,
وَ لَا تَقْرَبُوا الزِّنٰۤی اِنَّهٗ کَانَ فَاحِشَۃً ؕ وَسَآءَ سَبِیْلًا○
অর্থঃ তোমরা ব্যভিচারের নিকটবর্তী হয়ো না। নিশ্চয়ই এটা খুবই জঘন্য নির্লজ্জতা (যা খোদায়ী শাস্তির কারণ) এবং অত্যন্ত গর্হিত পথ। (সূরা বনী ইসরাঈল, আয়াত: ৩২)
কেউ কেউ উল্লেখ করেছেন, যুলাইখার ঘরে একটি মূর্তি ছিল। সেই মুহূর্তে যুলাইখা মূর্তিটিকে কাপড় দিয়ে আবৃত করলো। ইউসুফ আ. এর কারণ জিজ্ঞেস করলেন। উত্তরে সে বললো, এটা আমার উপাস্য, এর সামনে পাপ কাজ করার মতো সাহস আমার নেই। তখন ইউসুফ আ. বললেন, আমার উপাস্য তো আরো বেশী লজ্জা করার উপযুক্ত। কেননা, তাঁর দৃষ্টিকে কোনো পর্দা ঠেকাতে পারে না।
কারো কারো মতে, ইউসুফ আ. এর নবুয়্যাত ও দীনী জ্ঞানই ছিল স্বয়ং পালনকর্তা সম্পর্কে তাঁর এই দিব্যদৃষ্টির কারণ, যাকে আয়াতে “তাঁর প্রতিপালকের নিদর্শন” বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
তাফসীরবিদগণ আল্লামা ইসমাঈল ইবনে কাসীর রহ. এসব উক্তি উদ্ধৃত করার পর যে মন্তব্য করেছেন, তা সব সুধীজনের কাছেই সর্বাপেক্ষা সাবলীল ও গ্রহণযোগ্য। তিনি বলেছেন, কুরআন মাজীদ যতটুকু বিষয় বর্ণনা করেছে, ততটুকু নিয়ে ক্ষান্ত থাকা দরকার। অর্থাৎ হযরত ইউসুফ আ. এমন কিছু দেখেছেন, যদ্দরূণ তাঁর মন সৎ ও ন্যায়ের পথে আরো দৃঢ়পদ হয়েছে। আর এ বিষয়টি কী ছিল, তাফসীরবিদগণ এ ব্যাপারে যা কিছু উল্লেখ করেছেন, সেগুলোর যে কোন একটি হতে পারে। তাই নিশ্চিতরূপে কোনো একটি নির্দিষ্ট করা যায় না।
হযরত ইউসুফ আ. এ নির্জন কক্ষে মহান আল্লাহর নিদর্শন দেখার সাথে সাথেই সেখান থেকে বেরিয়ে আসার জন্য উদ্যত হলেন এবং বন্ধ দরজার দিকেই দৌড় দিলেন। তখন আযীয পত্নী তাঁকে ধরার জন্য তাঁর জামা টেনে ধরে তাঁকে বাইরে যেতে বাঁধা দিতে চাইলো। কিন্তু ইউসুফ আ. পবিত্রতা রক্ষার ব্যাপারে ছিলেন দৃঢ় সংকল্প। তাই থামলেন না, বরং খুব দ্রুত বেগে সামনে ধাবমান হলেন। ফলে জামা পেছন দিক থেকে ছিঁড়ে গেল। ইতিমধ্যে ইউসুফ আ. দরজার বাইরে চলে গেলেন এবং তাঁর পিছে পিছে যুলাইখাও সেখানে উপস্থিত হলো।
ঐতিহাসিক সূত্রে বর্ণিত আছে যে, দরজাগুলো তালাবদ্ধ ছিল। কিন্তু ইউসুফ আ. দৌড়ে দরজায় পৌঁছতেই মহান আল্লাহর কুদরতে আপনা-আপনি তালাগুলো খুলে নীচে পড়ে গেল এবং তৎক্ষণাৎ ইউসুফ আ. বের হয়ে গেলেন।
তারা উভয়ে দরজার বাইরে আসতেই আযীযে মিসরকে সামনে দণ্ডায়মান দেখতে পেলেন। আযীযে মিসরকে দেখেই তার স্ত্রী চমকে উঠলো। অতঃপর নিজেকে সামলে নিয়ে কথা বানিয়ে ইউসুফ আ. এর উপর দোষ চাপিয়ে বলল, “আপনার পরিরবারের সাথে যে কুকর্মের ইচ্ছা করে, তার শাস্তি কী হতে পারে এ ছাড়া যে, তাকে কারাগারে নিক্ষেপ করা হবে অথবা অন্য কোনো কঠোর শাস্তি দেয়া হবে?
পবিত্র কুরআনে বিষয়টি এভাবে বিবৃত হয়েছে,
وَاسْتَبَقَا الْبَابَ وَقَدَّتْ قَمِیْصَهٗ مِنْ دُبُرٍ وَّاَلْفَیَا سَیِّدَهَا لَدَا الْبَابِ ؕ قَالَتْ مَا جَزَآءُ مَنْ اَرَادَ بِاَهْلِکَ سُوْٓءًا اِلَّاۤ اَنْ یُّسْجَنَ اَوْ عَذَابٌ اَلِیْمٌ○
অর্থঃ তারা উভয়ে ছুটে দরজার দিকে গেল এবং মহিলা ইউসুফের জামা পেছন দিক থেকে ছিঁড়ে ফেললো। আর উভয়ে মহিলার স্বামীকে দরজার কাছে পেল। মহিলা বললো, যে ব্যক্তি আপনার স্ত্রীর সাথে কুকর্মের ইচ্ছা করে, তাকে এ ছাড়া আর কী শাস্তি দেয়া যেতে পারে যে, তাকে কারাগারে পাঠানো হবে অথবা অন্য কোনো যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি প্রদান করা হবে? (সূরা ইউসুফ, আয়াত: ২৫)
ইউসুফ আ. পয়গাম্বরসূলভ ভদ্রতার খাতিরে হয়তো সেই মহিলার গোপন ইচ্ছার কথা প্রকাশ করতেন না। কিন্তু যখন সে নিজেই এগিয়ে এসে ইউসুফ আ. এর প্রতি মিথ্যা অপবাদ দিল, তখন বাধ্য হয়ে তিনি সত্য প্রকাশ করে বললেন,
قَالَ هِیَ رَاوَدَتْنِیْ عَنْ نَّفْسِیْ
অর্থঃ বরং তিনিই স্বীয় কুমতলব চরিতার্থ করার জন্য আমাকে ফুঁসলিয়েছেন। (সূরা ইউসুফ, আয়াত: ৬২)