হযরত ইউসুফ (আঃ) এর জীবনী তৃতীয় পর্ব

হযরত ইউসুফ (আঃ) এর জীবনী তৃতীয় পর্ব

হযরত ইউসুফ (আঃ) এর জীবনী তৃতীয় পর্ব

ইউসুফ আ. কে কূপে নিক্ষেপ

এ প্রস্তাবে ভাইয়েরা সবাই একমত হলো। তাদের এ বিষয়টি নিম্নোক্ত আয়াতে এভাবে বর্ণিত হয়েছে,

فَلَمَّا ذَهَبُوْا بِهٖ وَ اَجْمَعُوْۤا اَنْ یَّجْعَلُوْهُ فِیْ غَیٰبَتِ الْجُبِّ ۚ وَ اَوْحَیْنَاۤ اِلَیْهِ لَتُنَبِّئَنَّهُمْ بِاَمْرِهِمْ هٰذَا وَهُمْ لَا یَشْعُرُوْنَ○

অর্থঃ অতঃপর তারা যখন তাকে নিয়ে চললো, এবং অন্ধকার কূপের গভীরে নিক্ষেপ করতে একমত হলো, তখন আমি তাকে ওহী দিয়ে জানিয়ে দিলাম যে, অবশ্যই তুমি তাদেরকে তাদের এ কাজের কথা এক সময় স্মরণ করিয়ে দিবে, আর তারা তখন তোমার উঁচু মর্যাদার কারণে তোমাকে চিনবে না। (সূরা ইউসুফ, আয়াত: ১৫)

ইমাম কুরতুবী রহ. বলেন, এ ওহী সম্পর্কে দু প্রকার ব্যাখ্যা থেকে পারে। (এক) কূপে নিক্ষিপ্ত হওয়ার পর তাঁর সান্ত্বনা ও মুক্তির সুসংবাদ দানের জন্য এ ওহী পাঠানো হয়েছিল। (দুই) কূপে নিক্ষিপ্ত হওয়ার আগে আল্লাহ তা‘আলা ওহীর মাধ্যমে ইউসুফ আ. কে ভবিষ্যৎ ঘটনাবলী জানিয়ে দিয়েছিলেন। এতে আরো বলে দিয়েছিলেন যে, তুমি এভাবে ধ্বংস হওয়ার কবল থেকে মুক্ত থাকবে এবং এমন পরিস্থিতি দেখা দিবে যে, তুমি তাদের তিরস্কার করার সুযোগ পাবে। অথচ তারা ধারণা করবে না যে, তুমিই তাদের ভাই ইউসুফ। কারণ, তখন তুমি অনেক উচ্চ মর্যাদায় অবস্থান করবে। এক পর্যায়ে তারা হযরত ইউসুফ আ. কে কূপে নিক্ষেপ করতে উদ্যত হলো। তখন তিনি কূপের প্রাচীর জড়িয়ে ধরলেন। ভাইয়েরা তাঁর জামা খুলে তা দিয়ে তাঁর হাত বাঁধলো। তখন ইউসুফ আ. পুনরায় তাদের কাছে দয়া ভিক্ষা চাইলেন। কিন্তু তখনও তারা আগের মতো সেই উত্তরই দিল যে, যে এগারোটি নক্ষত্র তোকে সিজদা করেছিল, তাদেরকে ডাক দে। তারাই তোকে সাহায্য করবে। অতঃপর ভাইয়েরা তাকে বালতিতে ভরে কূপে ছাড়তে লাগলো। সেটা মাঝপথে যেতেই উপর থেকে রশি কেটে দিল।

আল্লাহ তা‘আলা স্বয়ং ইউসুফ আ. কে হিফাযত করলেন। যদ্দরূণ পানিতে পড়ার কারণে তিনি কোনোরূপ আঘাত পেলেন না। অতঃপর নিকটেই একখণ্ড ভাসমান প্রস্তর দৃষ্টিগোচর হলো। তিনি সুস্থ ও বহাল তবিয়তে তার উপরে বসে রইলেন। কোনো কোনো বর্ণনায় এসেছে যে, জিবরাঈল আ. আল্লাহ পাকের আদেশ পেয়ে তাঁকে প্রস্তর খণ্ডের উপর বসিয়ে দেন। ইউসুফ আ. তিন দিন কূপে অবস্থান করেন। ইয়াহুদা প্রত্যহ গোপনে তাঁর জন্য কিছু খাদ্য আনতো এবং বালতির সাহায্যে তাঁর কাছে পৌঁছে দিতো। ইউসুফ আ. কে কূপে নিক্ষেপ করার পর তাঁর ভাইয়েরা সন্ধ্যা বেলায় কান্না করতে করতে তাদের পিতার নিকট উপস্থিত হলো। বিষয়টিকে নিম্নোক্ত আয়াতে এভাবে ব্যক্ত করা হয়েছে,

وَجَآءُوْۤا اَبَاهُمْ عِشَآءً یَّبْكُوْنَ○

অর্থঃ আর তারা রাতের অন্ধকারে কাঁদতে কাঁদতে পিতার কাছে এলো। (সূরা ইউসুফ, আয়াত: ১৬)

হযরত ইয়াকূব আ. কান্নার শব্দ শুনে বাইরে এলেন এবং জিজ্ঞেস করলেন, ব্যাপার কী! তোমাদের ছাগল পালের উপর কেউ আক্রমণ করেনি তো? ইউসুফ কোথায়? তখন ভাইয়েরা যা বললো, তা পবিত্র কুরআনে এভাবে ব্যক্ত করা হয়েছে,

قَالُوْا یٰۤاَبَانَاۤ اِنَّا ذَهَبْنَا نَسْتَبِقُ وَتَرَكْنَا یُوْسُفَ عِنْدَ مَتَاعِنَا فَاَکَلَهُ الذِّئْبُ ۚ وَمَاۤ اَنْتَ بِمُؤْمِنٍ لَّنَا وَلَوْ كُنَّا صٰدِقِیْنَ○

অর্থঃ তারা বললো, হে আমাদের আব্বা! আমরা দৌড় প্রতিযোগিতা করতে গিয়েছিলাম এবং ইউসুফকে আমাদের আসবাবপত্রের কাছে রেখে গিয়েছিলাম। তখন তাকে নেকড়ে বাঘে খেয়ে ফেলেছে। কিন্তু আপনি তো আমাদেরকে বিশ্বাস করবেন না; যদিও আমরা সত্যবাদী হই। (সূরা ইউসুফ, আয়াত: ১৭)

ইউসুফ আ. এর ভাইয়েরা তাঁর জামায় কৃত্রিম রক্ত লাগিয়ে এনেছিল, যাতে পিতার মনে বিশ্বাস জন্মাতে পারে যে, বাঘই তাঁকে খেয়ে ফেলেছে। পবিত্র কুরআনে তাদের এ প্রতারণার কথা এভাবে বিবৃত হয়েছে,

وَجَآءُوْ عَلٰی قَمِیْصِهٖ بِدَمٍ کَذِبٍ ؕ

অর্থঃ তারা ইউসুফের জামায় কৃত্রিম রক্ত লাগিয়ে আনলো। (সূরা ইউসুফ, আয়াত: ১৮)

কিন্তু আল্লাহ তা‘আলা তাদের মিথ্যা ফাঁস করে দেয়ার জন্য তাদেরকে একটি জরুরী বিষয় থেকে গাফেল করে দিয়েছিলেন। তারা যদি রক্ত লাগানোর সাথে সাথে জামাটিও ছিন্ন করে দিত, তবে তারা ইউসুফকে বাঘে খাওয়ার কথাটা বিশ্বাসযোগ্য করতে পারতো। কিন্তু তারা অক্ষত জামায় ছাগল ছানার রক্ত মাখিয়ে পিতাকে ধোঁকা দিতে চাইলো। ইয়াকূব আ. অক্ষত জামা দেখে বললেন, বাছারা! এ বাঘ কেমন বিজ্ঞ ও বুদ্ধিমান ছিল যে, ইউসুফকে তো খেয়ে ফেলেছে; কিন্তু জামার কোনো অংশ ছিন্ন হতে দেয়নি!

এভাবে হযরত ইয়াকূব আ. এর কাছে তাদের জালিয়াতি ফাঁস হয়ে গেলে তিনি যা বললেন, তা কুরআন মাজীদের ভাষায় এভাবে ব্যক্ত করা হয়েছে

وَجَآءُوْ عَلٰی قَمِیْصِهٖ بِدَمٍ کَذِبٍ ؕ قَالَ بَلْ سَوَّلَتْ لَكُمْ اَنْفُسُكُمْ اَمْرًا ؕ فَصَبْرٌ جَمِیْلٌ ؕ وَاللهُ الْمُسْتَعَانُ عَلٰی مَا تَصِفُوْنَ○

অর্থঃ ইয়াকূব আ. বললেন, (এটা কারণই নয়;) বরং তোমাদের মন তোমাদেরকে একটা কথা সাজিয়ে দিয়েছে। সুতরাং এখন পূর্ণ ধৈর্য্য ধারণ করাই শ্রেয়। তোমরা যা বর্ণনা করছো, সে সম্বন্ধে একমাত্র আল্লাহই আমার সাহায্যস্থল। (সূরা ইউসুফ, আয়াত: ১৮)

গভীর কূপ থেকে মুক্তি

ওদিকে আল্লাহর মেহেরবানীতে একটি কাফেলা সেই অন্ধকার কূপের কাছে এসে উপস্থিত হয়। তাফসীরে কুরতুবীতে বলা হয়েছে, এ কাফেলা সিরিয়া থেকে মিসর যাচ্ছিল। পথ ভুলে এ জনমানবহীন জঙ্গলে এসে পড়েছে। তারা পানি সংগ্রহকারীদেরকে পানি খোঁজার জন্য কূপে প্রেরণ করলো। মিসরীয় কাফেলার পথ ভুলে এখানে পৌঁছা এবং এই অন্ধকারকূপের সম্মুখীন হওয়া সাধারণ দৃষ্টিতে একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা হতে পারে। কিন্তু যারা সৃষ্টিরহস্য সম্পর্কে ভালো জানেন, তারা জানেন যে, এসব ঘটনা একটি অপরটির সাথে পরস্পর সংযুক্ত ও অটুট ব্যবস্থাপনার মিলিত অংশ। হযরত ইউসুফ আ. এর স্রষ্টা ও রক্ষকই কাফেলাকে তাদের গন্তব্যের পথ থেকে সরিয়ে এখানে নিয়ে এসেছেন এবং ইউসুফকে সাহায্য করার জন্য কাফেলার লোকদেরকে এই অন্ধকার কূপে প্রেরণ করেছেন।
পানি আনার জন্য কাফেলার মালিক ইবনে দোবর নামক জনৈক ব্যক্তি সেই কূপে পৌঁছেন এবং বালতি নিক্ষেপ করলেন। ইউসুফ আ. সর্বশক্তিমান আল্লাহ তা‘আলার সাহায্য প্রত্যক্ষ করে বালতির রশি শক্ত করে ধরলেন। পানির পরিবর্তে বালতির সাথে একটি সমুজ্জ্বল মুখমণ্ডল পানি উত্তোলনকারীর দৃষ্টিতে ভেসে উঠলো। পবিত্র কুরআনের নিম্নোক্ত আয়াতে সে কথা ব্যক্ত করা হয়েছে,

وَجَآءَتْ سَیَّارَۃٌ فَاَرْسَلُوْا وَارِدَهُمْ فَاَدْلٰی دَلْوَهٗ ؕ قَالَ یٰبُشْرٰی هٰذَا غُلٰمٌ ؕ وَاَسَرُّوْهُ بِضَاعَۃً ؕ وَاللهُ عَلِیْمٌۢ بِمَا یَعْمَلُوْنَ○

অর্থঃ একটি কাফেলা এলো। অতঃপর তারা তাদের পানি সংগ্রাহককে প্রেরণ করলো। সে নিজের বালতি ফেললো। বললো, কী আনন্দের কথা! এ তো একটি কিশোর! (সূরা ইউসুফ, আয়াত: ১৯)

অপ্রত্যাশিতভাবে কূপের তলদেশ থেকে ভেসে ওঠা এই অল্প বয়স্ক অপরূপ ও বুদ্ধিদীপ্ত বালককে দেখে মালেক ইবনে দোবর চিৎকার করে উঠলেন। মুসলিম শরীফে মিরাজ রজনীর হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আমি ইউসুফ আ. এর সাথে সাক্ষাতের পর দেখলাম যে, আল্লাহ তা‘আলা সমগ্র বিশ্বের রূপ-সৌন্দর্যের অর্ধেক তাঁকে দান করেছেন এবং অবশিষ্ট অর্ধেক সমগ্র বিশ্বে বণ্টন করা হয়েছে।

কাফেলার লোকেরা তখন তাঁকে একটি মূল্যবান পণ্য মনে করে গোপন করে ফেললো। আয়াতের পরবর্তী অংশে সে কথা বলা হয়েছে,

وَاَسَرُّوْهُ بِضَاعَۃً ؕ
অর্থঃ তারা ব্যাবসায়িক পণ্যরূপে তাকে গোপন করে ফেললো।

শুরুতে তো মালেক ইবনে দোবর এ কিশোরকে দেখে অবাক বিস্ময়ে চিৎকার করে উঠেছিলেন। কিন্তু পরে চিন্তাভাবনা করে স্থির করলেন যে, এটা জানাজানি না হওয়া উচিত এবং গোপন করে ফেলা দরকার, যাতে একে বিক্রি করে প্রচুর অর্থ লাভ করা যায়।

অথবা এরূপ অর্থও হতে পারে যে, ইউসুফ আ. এর ভাইয়েরা ঐ মুহূর্তে সেখানে এসেছিল। তারা বাস্তব ঘটনা গোপন করে তাঁকে পণ্যদ্রব্য করে নিলো। যেমন, কোনো কোনো রিওয়ায়েতে আছে যে, ইয়াহুদা প্রত্যহ ইউসুফ আ. কে কূপের মধ্যে খানা পৌঁছানোর জন্য যেতো। তৃতীয় দিন তাঁকে কূপের মধ্যে না পেয়ে সে ফিরে এসে ভাইদের কাছে ঘটনা বর্ণনা করলো। অতঃপর সকল ভাই একত্রে সেখানে পৌঁছলো এবং অনেক খোঁজাখুঁজির পর কাফেলার লোকদের কাছ থেকে ইউসুফকে বের করলো। তখন তারা বললো, এ বালকটি আমাদের গোলাম, পলায়ন করে এখানে এসেছে। তোমরা একে কবজায় নিয়ে খুব খারাপ কাজ করেছো।

একথা শুনে মালেক ইবনে দোবর ও তার সঙ্গীরা ভীত হয়ে গেল যে, তাদেরকে চোর সাব্যস্ত করা হবে। তাই ভাইদের সাথে তাকে ক্রয় করার ব্যাপারে কথাবার্তা বলতে লাগলো।

এমতাবস্থায় আয়াতের অর্থ এই হবে যে, ইউসুফের ভাইয়েরা, নিজেরাই ইউসুফকে পণ্যদ্রব্য স্থির করে বিক্রি করে দিলো। ইউসুফ আ. এর মতো একজন মহাপুরুষের সঠিক মূল্য সম্পর্কে ভাইয়েরা ছিল অজ্ঞ। আর তাছাড়া ইউসুফ আ. এর ভাইদের আসল উদ্দেশ্য টাকা উপার্জন ছিল না। আসল উদ্দেশ্যতো ছিলো পিতার কাছ থেকে তাঁকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া। তাই তারা তাঁকে গুটি কতেক দিরহামের বিনিময়ে বিক্রি করে দিল।

নিম্নেবর্ণিত আয়াতে এ কথাই ব্যক্ত করা হয়েছে,

وَشَرَوْهُ بِثَمَنٍۭ بَخْسٍ دَرَاهِمَ مَعْدُوْدَۃٍ ۚ وَکَانُوْا فِیْهِ مِنَ الزَّاهِدِیْنَ○

অর্থঃ তারা তাকে বিক্রি করে দিল অতি অল্পমূল্যে-গুণাগুণিত কয়েক দিরহামে। আর তারা ছিল তাঁর ব্যাপারে নিরাসক্ত। (সূরা ইউসুফ, আয়াত: ২০)

কাফেলার লোকেরা তাঁকে মিসর নিয়ে গেলেন। সেখানে নেয়ার পর ইউসুফ আ. কে বিক্রয়ের কথা ঘোষণা করতেই ক্রেতারা প্রতিযোগিতামূলক ভাবে দাম বলতে লাগলো। শেষ পর্যন্ত ইউসুফ আ. এর ওজনের সমান স্বর্ণ, সমপরিমাণ মৃগনাভি ও সমপরিমাণ রেশমি বস্ত্র দাম সাব্যস্ত হলো।

গল্পের বিষয়:
ইসলামিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত