হযরত ইউসুফ (আঃ) এর জীবনী দ্বিতীয় পর্ব

হযরত ইউসুফ (আঃ) এর জীবনী দ্বিতীয় পর্ব

হযরত ইউসুফ (আঃ) এর জীবনী
🌿🌿🌿 দ্বিতীয় পর্ব 🌿🌿🌿

ইউসুফ আ. কে হত্যার পরিকল্পনা

পরামর্শের এক পর্যায়ে তাদের একজন এ মত পেশ করলো যে, ইউসুফকে হত্যা করা হোক। অন্য একজন বললো, তাকে হত্যা না করে কোনো দূরদেশে ফেলে আসা হোক। এতে করে মাঝখান থেকে এ কাঁটা দূর হয়ে যাবে এবং পিতার সব মনোযোগ আমাদের প্রতিই নিবদ্ধ হয়ে যাবে। এক্ষেত্রে তাকে হত্যা কিংবা দেশান্তরের কারণে যে গুনাহ হবে, তার প্রতিকার এই যে, পরবর্তীকালে তাওবা করে আমরা ভালো হয়ে যাবো। শিরোনামে উল্লিখিত “এবং তারপর ভালো হয়ে যাবো” বাক্যের এক অর্থ তা-ই বর্ণনা করা হয়েছে। এছাড়া এরূপ অর্থও হতে পারে যে, ইউসুফকে হত্যা করার পর আমাদের অবস্থা ঠিক হয়ে যাবে। কেননা, তখন পিতার মনোযোগের কেন্দ্র শেষ হয়ে যাবে। সুতরাং মনোযোগ আমাদের দিকেই নিবদ্ধ হবে এবং আমরা ভালো পরিগণিত হবো।

সেই মুহূর্তে তাদের মধ্যেরই একজন সমস্ত কথাবার্তা শুনে বললো, ইউসুফকে হত্যা করা উচিৎ হবে না। বরং যদি কিছু করতেই হয়, তবে তাকে কূপের গভীরে এমন জায়গায় নিক্ষেপ করা হোক, যেখানে সে জীবিত থাকবে এবং পথিক যখন কূপে আসবে, তখন তাকে উঠিয়ে নিয়ে যাবে। এভাবে একদিকে তোমাদের উদ্দেশ্য পূর্ণ হয়ে যাবে এবং চিন্তা করতে হবে না। বরং এমতাবস্থায় কোন পথিকই তাকে দূরদেশে নিয়ে চলে যাবে।

এ অভিমত প্রকাশকারী ছিলো তাদের বড় ভাই ইয়াহুদা। কোন কোন রিওয়ায়েতে আছে যে, সবার মধ্যে রুবীল ছিল বড়। সে-ই এ অভিমত ব্যক্ত করছিল। এ ব্যক্তি সম্পর্কে সামনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, মিসরে যখন ইউসুফ আ. এর ছোট ভাই বিনয়ামীনকে আটক করা হয়, তখন সে বলেছিলো, আমি ফিরে গিয়ে কীভাবে মুখ দেখাবো? তাই আমি আর কেনানে ফিরে যাবো না।

পরিকল্পনার বাস্তবায়ন

হযরত ইউসুফ আ. এর ভায়েরা তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে পিতার কাছে এভাবে আবেদন পেশ করলো যে, আব্বাজান! ব্যাপার কী! আপনি দেখি ইউসুফ সম্পর্কে আমাদের প্রতি আস্থা রাখেন না! অথচ আমরা তার পুরোপুরি হিতাকাঙ্ক্ষী। আগামীকাল আপনি তাকে আমাদের সাথে ভ্রমণে পাঠিয়ে দিন, যাতে সেও স্বাধীনভাবে পানাহার ও খেলাধুলা করতে পারে। আমরা সবাই তার পুরোপুরি দেখাশোনা করবো।

তাদের এ আবেদন থেকেই বোঝা যায় যে, এর আগেও তারা কোনো সময় এ ধরনের আবেদন করেছিল, যা পিতা অগ্রাহ্য করেছিলেন। যদ্দরূণ এবার কিঞ্চিত জোর ও পীড়াপীড়ি সহকারে পিতাকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করা হয়েছে। পবিত্র কুরআনে তাদের এ আবেদন সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে,

قَالُوْا یٰۤاَبَانَا مَا لَکَ لَا تَاْمَنَّا عَلٰی یُوْسُفَ وَ اِنَّا لَهٗ لَنٰصِحُوْنَ○ اَرْسِلْهُ مَعَنَا غَدًا یَّرْتَعْ وَیَلْعَبْ وَ اِنَّا لَهٗ لَحٰفِظُوْنَ○

অর্থঃ তারা বললো, হে আমাদের আব্বা! আপনার কী হয়েছে যে, আপনি ইউসুফের ব্যাপারে আমাদেরকে বিশ্বাস করেন না? অথচ আমরা তো তার শুভাকাঙ্ক্ষী। আগামীকাল তাকে আমাদের সাথে প্রেরণ করুন। তাহলে সে তৃপ্তিসহ খাবে এবং খেলাধুলা করবে, আর আমরা অবশ্যই তার হিফাযত করবো। (সূরা ইউসুফ, আয়াত: ১১-১২)

ইউসুফ আ. এর ভাইয়েরা যখন আগামীকাল ইউসুফকে তাদের সাথে ভ্রমণে পাঠানোর আবেদন করলো, তখন হযরত ইয়াকূব আ. বললেন, তাকে পাঠানো আমি দু’কারণে পছন্দ করি না। প্রথমতঃ সে নয়নের মণি, আমার সামনে না থাকলে, আমি শান্তি পাই না। দ্বিতীয়তঃ আমার আশঙ্কা হচ্ছে যে, জঙ্গলে তোমাদের অসাবধানতার মুহূর্তে তাকে বাঘে খেয়ে ফেলতে পারে।

ইয়াকূব আ. এর এ বক্তব্য কালামে পাকের এ আয়াতে বিবৃত হয়েছে,

قَالَ اِنِّیْ لَیَحْزُنُنِیْۤ اَنْ تَذْهَبُوْا بِهٖ وَ اَخَافُ اَنْ یَّاْكُلَهُ الذِّئْبُ وَاَنْتُمْ عَنْهُ غٰفِلُوْنَ○

অর্থঃ ইয়াকূব আ. বললেন, আমার দুশ্চিন্তা হয় যে, তোমরা তাকে নিয়ে যাবে এবং আমি আশঙ্কা করি যে, বাঘ তাকে খেয়ে ফেলবে, অথচ তোমরা তার থেকে অমনোযোগী থাকবে। (সূরা ইউসুফ, আয়াত: ১৩)

বাঘের আশঙ্কা হওয়ার কারণ এই যে, তখন কেনানে বাঘের খুব উপদ্রব ছিল। ওদিকে হযরত ইয়াকূব আ. স্বপ্নে দেখেছিলেন যে, তিনি পাহাড়ের উপর আছেন। নীচে পাহাড়ের পাদদেশে ইউসুফ আ.। হঠাৎ দশটি বাঘ এসে তাঁকে ঘেরাও করে ফেলে এবং আক্রমণ করতে উদ্যত হয়। কিন্তু সেগুলোর মধ্য থেকে একটি বাঘ এসে তাঁকে মুক্ত করে দেয়, অতঃপর ইউসুফ আ. মাটির অভ্যন্তরে গা ঢাকা দেন।

এর ব্যাখ্যা এভাবে প্রকাশ পায় যে, দশটি বাঘ ছিল দশজন ভাই এবং যে বাঘটি তাঁকে আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা করে, সে ছিল বড় ভাই ইয়াহুদা অথবা রুবীল। আর মাটির অভ্যন্তরে গা ঢাকা দেয়ার অর্থ, কূপের মধ্যে নিক্ষিপ্ত হওয়া। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, এ স্বপ্নের ভিত্তিতে হযরত ইয়াকূব আ. স্বয়ং এ ভাইদের পক্ষ থেকেই আশঙ্কা করেছিলেন এবং তাদরকেই বাঘ বলেছিলেন। কিন্তু নানা কারণে ওদের কাছে কথা প্রকাশ করেননি। (আল-জামি‘লিআহকামিল কুরআন লিল কুরতুবী)

ভাইয়েরা হযরত ইয়াকূব আ. এর এ কথা শুনে বললো, আপনার এ ভয়-ভীতি অমূলক। আমরা দশজনের শক্তিশালী দল তার হেফাজাতের জন্য বিদ্যমান রয়েছি। আমাদের সবার উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও যদি বাঘেই তাকে খেয়ে ফেলে, তাহলে আমাদের অস্তিত্বই নিষ্ফল হয়ে যাবে। এমতাবস্থায় আমাদের দিয়ে কোন্ কাজের আশা করা যেতে পারে?

নিম্নোলিখিত আয়াতে ইউসুফ আ. এর ভোইদের সেই কথা বর্ণনা করা হয়েছে,

قَالُوْا لَئِنْ اَکَلَهُ الذِّئْبُ وَنَحْنُ عُصْبَۃٌ اِنَّاۤ اِذًا لَّخٰسِرُوْنَ○

অর্থঃ তারা বললো, আমরা একটি ভারী দল থাকা সত্ত্বেও যদি বাঘ তাকে খেয়ে ফেলে, তবে তো আমরা সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়বো। (সূরা ইউসুফ, আয়াত: ১৪)

হযরত ইয়াকূব আ. পয়গাম্বরসুলভ গাম্ভীর্যের কারণে ছেলেদের সামনে এ কথা প্রকাশ করলেন না যে, আমি স্বয়ং তোমাদের পক্ষ থেকেই আশঙ্কা করি। কারণ এতে প্রথমতঃ তাদের মনোকষ্ট হতো, দ্বিতীয়তঃ পিতার এরূপ বলার দিয়ে ভাইদের শত্রুতা আরো বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল। ফলে এখন ছেড়ে দিলেও অন্য কোনো সময় কোনো ছলছুতায় তাঁকে হত্যা করার ফিকিরে থাকতো। তাই তিনি তাঁকে নিয়ে যাবার অনুমতি দিয়ে দিলেন। তবে ভাইদের কাছ থেকে অঙ্গীকারও নিয়ে নিলেন, যাতে ইউসুফের কোনো রকম কষ্ট না হয়। এ পর্যায়ে বিশেষ করে বড় ভাই ইয়াহুদার হাতে তাকে সোপর্দ করে বললেন, তুমি তার ক্ষুধা-তৃষ্ণা ও অন্যান্য প্রয়োজনের ব্যাপারে খেয়াল রাখবে এবং শীঘ্র ফিরিয়ে আনবে।

ভাইরা পিতার সামনে ইউসুফকে কাঁধে তুলে নিলো এবং পালাক্রমে সবাই উঠাতে লাগলো। কিছু দূর পর্যন্ত হযরত ইয়াকূর আ. ও তাদেরকে বিদায় জানানোর জন্যে গেলেন।

ইমাম কুরতুবী রহ. ঐতিহাসিক রিওয়ায়েতের বরাত দিয়ে উল্লেখ করেছেন যে, তারা যখন হযরত ইয়াকূব আ. এর দৃষ্টির আড়ালে চলে গেল, তখন তারা ইউসুফ আ. কে নামিয়ে দিল এবং তিনি পায়ে হেঁটে চলতে লাগলেন। কিন্তু অল্প বয়স্ক হওয়ার কারণে তাদের সাথে সাথে চলতে অক্ষম হচ্ছিলেন আবার তাকে হত্যা করার ব্যাপারে ভাইদের পরামর্শও টের পেয়ে গিয়েছিলেন। তাই তিনি এক ভাইয়ের আশ্রয় নিতে চাইলেন। সে কোনোরূপ সহানুভূতি প্রদর্শন না করায় তৃতীয়, চতুর্থ; এমনিভাবে প্রত্যেক ভাইয়ের কাছে সাহায্য চাইলেন। কিন্তু সবাই উত্তর দিল যে, তুই যে এগারোটি নক্ষত্র এবং চাঁদ ও সূর্য তোকে সিজদা করতে দেখেছিস, তাদেরকে ডাক দে, তারাই তোকে সাহায্য করবে, আমরা তোকে সাহায্য করতে পারবো না।

ইমাম কুরতুবী রহ. এর ভিত্তিতে বলেন যে, এ থেকে বোঝা যায় ভাইয়ের কোনো না কোনো উপায়ে ইউসুফ আ. এর স্বপ্নের বিষয়বস্তু সম্পর্কে অবগত হয়েছিল। সে স্বপ্ন ইউসুফ আ. এর প্রতি তাদের তীব্র ক্রোধ ও কঠোর ব্যবহারের কারণ হয়েছিল। উক্ত স্বপ্নের কারণেই তারা ইউসুফ আ. এর সাথে হিংসাত্মক আচরণ করেছিল।

অবশেষে ইউসুফ আ. ইয়াহুদাকে বললেন, আপনি সবার বড়। আপনিই আমার দুর্বলতা ও অল্পবয়স্কতা এবং পিতার মনোকষ্টের কথা চিন্তা করে দয়ার্দ্র হোন। আপনি ঐ অঙ্গীকারের কথা স্মরণ করুন যা পিতার সাথে করেছিলেন। একথা শুনে ইয়াহুদার মনে দয়ার সঞ্চার হলো এবং তাকে বললো, যতক্ষণ আমি জীবিত আছি, এসব ভাই তোমাকে কোনো কষ্ট দিতে পারবে না।

তখন ইয়াহুদার অন্তরে আল্লাহ তা‘আলা দয়া ও ন্যায়ানুগ কাজ করার প্রেরণা জাগ্রত করে দিলেন। সে অন্যান্য ভাইকে সম্বোধন করে বললো, নিরপরাধকে হত্যা করা মহাপাপ। আল্লাহকে ভয় করো এবং বালকটিকে তার পিতার কাছে নিয়ে চলো। তবে তার কাছ থেকে অঙ্গীকার নিয়ে নাও যে, সে পিতার কাছে তোমাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ করবে না। ভাইয়ের উত্তর দিল, আমরা জানি, তোমার উদ্দেশ্য কী? তুমি পিতার অন্তরে নিজের মর্যাদার আসন সর্বোচ্চ পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত করতে চাও। মনে রাখো, যদি তুমি আমাদের ইচ্ছা পূরণে প্রতিবন্ধক হও, তবে আমরা তোমাকেও হত্যা করবো।

ইয়াহুদা দেখলো যে, নয় ভাইয়ের বিপরীতে সে একা কিছু করতে পারবে না। তাই সে বললো, তোমরা যদি এ বালককে নিপাত করতে মনস্থ করে থাকো, তবে আমার কথা শোনো, নিকটেই একটি প্রাচীন কূপ রয়েছে। এতে অনেক ঝোপ-জঙ্গল গজিয়েছে। সাপ, বিচ্ছু ও হরেক রকমের ইতর প্রাণী এখানে বাস করে। তোমরা তাকে সেই কূপে ফেলে দাও। যদি কোনো সাপ ইত্যাদি তাকে দংশন করে শেষ করে দেয়, তবে তোমাদের উদ্দেশ্যও সিদ্ধ হবে এবং নিজ হাতে হত্যা করার দোষ থেকে তোমরা মুক্ত থাকবে। পক্ষান্তরে যদি সে জীবিত থাকে, তবে হয়তো কোনো কাফেলা এখানে আসবে এবং পানির জন্য কূপে বালতি ফেলবে। ফলে সে বের হয়ে আসবে। আর তারা তাকে সাথে করে অন্য কোনো দেশে পৌঁছে দেবে। এমতাবস্থায়ও তোমাদের উদ্দেশ্য হাসিল হয়ে যাবে।

গল্পের বিষয়:
ইসলামিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত