ইমাম আবু হানিফা (রহঃ) এর বিনয় ও ধৈর্যের বিরল ঘটনা।

ইমাম আবু হানিফা (রহঃ) এর বিনয় ও ধৈর্যের বিরল ঘটনা।

বিশ্বব্যাপি খ্যাতিসম্পন্ন ইমামে আযম ইমাম আবু হানিফা রহঃ এর বিনয় ও ধৈৰ্য্য এত বেশি ছিল যে, তা পরীক্ষাকারীদেরকেও হার মানাত এবং লজ্জিত করত। এরকম দুটি ঘটনা আপনাদের সম্মুখে তুলে ধরলাম। ঘটনাগুলো আশরাফ আলী থানবি (রহঃ) ৩০০ গল্প বই থেকে সংগৃহীত।

ঘটনা : ১.

একদা যােহরের নামায শেষে বাড়ি গিয়ে নিজের কক্ষে গিয়ে বিশ্রামের জন্য বিছানায় শুয়ে পড়লেন। এক ব্যক্তি এসে দরজায় কড়াঘাত করে। আপনি আন্দাজ করুন, যিনি রাতটি বিনিদ্র কাটিয়ে দিনেও ব্যতিব্যস্ত থেকে সবেমাত্র গা এলিয়েছেন এমন সময় কেউ আসলে কত অপছন্দ হবার কথা।

তা সত্ত্বেও ইমাম সাহেব বিছানা ছেড়ে সিড়ি বেয়ে নিচে এসে দরজা খুলে দেখলেন এক লােক দাঁড়ানাে, আবু হানীফা জিজ্ঞেস করলেন কেন এসেছেন? উত্তরে লােকটি বললেন একটি মাসয়ালা জানা দরকার!

দেখুন এতক্ষণে ইমাম সাহেব মাসয়ালা বলে দেয়ার জন্য বসে ছিলেন, সেখানে মাসআলা জিজ্ঞেস না করে অসময়ে পেরেশান করার জন্য এখানে আসলেন। কিন্তু ইমাম সাহেব তাকে কিছুই বললেন না; বরং বললেন, আচ্ছা ভাই কি মাসআলা জানা দরকার?

সে বললাে এখন আর আমি কী বলবাে আসার সময় মনে ছিল, মাসআলাটি এই মুহূর্তে ভুলে গেলাম। স্মরণে আসছেনা কী জিজ্ঞেস করবাে? আবু হানীফা (রহ.) বললেন আচ্ছা যখন মনে পড়ে তখন জেনে নিও।

তিনি তাকে ভাল-মন্দ আর কিছু বললেন না, কোন রাগ ধমক ব্যতিরেকে চুপচাপ উপরের কক্ষে চলে যান। ক্লান্ত শ্রান্ত দেহটা পুনরায় বিছানায় রেখে তন্দ্রাভাব এসেছে মাত্র।

দ্বিতীয় বার দরজা থেকে আওয়াজ কানে আসতেই শয়নগাহ ত্যাগ সরে নিচে নেমে এসে দরজা খুলতেই সেই লােকটিকে দেখলেন দাড়িয়ে আছে। ইমাম আবু হানীফা তাকে জিজ্ঞেস করলেন কি বিষয়? সে বলল, হযরত! ঐ মাসআলা আমার স্মরণ হয়েছিল। তিনি বললেন আচ্ছা বল তাহলে।

সে বলল, এইমাত্র মনে ছিল আপনি অর্ধেক সিঁড়ি পর্যন্ত আসলেই আবার ভুলে গেছি মাসআলাটি। যদি সাধারণ মানুষ হতেন তবে মেজাজের কী দশাই না হত; কিন্তু ইমাম আবু হানীফা নিজেকে মিটিয়ে দিয়েছেন তাই বললেন, আচ্ছা ভাই, যখন মনে আসে জিজ্ঞেস করে নিবে,

একথা বলে উপরে উঠে গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লেন। নিদ্রা যেতেই পুনরায় দরজায় আঘাত। খটাখট শব্দ শুনে ঘুম বাদ দিয়ে নিচে নেমে দরজা খুললেন। দরজার পাশে ঐ ব্যক্তিকে দাঁড়ানাে দেখে কারণ জানতে চাইলেন। লােকটি বললাে হযরত! ঐ মাসআলা মনে পড়েছে। ইমাম আবু হানীফা বললেন, কি মাসআলা? সেই আগন্তক বলল, আমি জানতে চাই মানুষের মল তিক্ত না মিষ্টি?

অর্থাৎ পায়খানার স্বাদ কেমন এটা আমার জানার বিষয়। (আল্লাহর পানাহ এটা কি কোন মাসআলা হল) অন্যকোন মানুষ হলে হয়রানি করার উচিৎ শিক্ষা দিয়ে ছাড়তেন।

কিন্তু ইমাম আবু হানীফা অত্যন্ত শান্তভাবে উত্তর দিলেন, যদি মানুষের মল তাজা হয় তবে কিছুটা মিষ্টিভাব থাকে আর শুকিয়ে গেলে তিতা হয়ে যায়। অত:পর লােকটি বেপরােয়াভাবে বলে ফেললাে আপনি কি চেখে দেখেছেন? (আল্লাহর পানাহ)।

ইমাম আবু হানীফা রহ. স্থির চিত্তে বললেন, সব কিছুর স্বাদ আস্বাদন করে অর্জন করতে হয় না, বরং কিছু জিনিসের ইলম (আকল) কাণ্ডজ্ঞান দ্বারা হাসিল হয়।

যেমন বিবেক খাটিয়ে উপলব্ধি করা যায় এভাবে যে, মল ত্যাগের পরক্ষণে মাছির আনা-গােনা হয়, তাছাড়া শুকনাে পায়খানার উপরে মাছি বসতে দেখা যায় না। এ দ্বারা বুঝা যায় উভয় মলের মধ্যে পার্থক্য নিশ্চয়ই আছে নতুবা মাছি দুই অবস্থায়ই বসতাে।

ইমাম আবু হানীফা (রহ.)-এর নিকট এমন আলােচনা ও তার আচরণে লোকটি করজোড়ে ক্ষমা প্রার্থনা করে বলল, হযরত! আমাকে মাফ করে দিন। আমি আপনাকে যারপর নাই কষ্ট দিয়েছি। কিন্তু আপনি আমাকে আজ পরাস্ত করেছেন।

ইমাম আবু হানীফা (রহ.) জিজ্ঞেস করলেন, কিভাবে আমি তােমাকে পরাস্ত করেছি? লােকটি বলল, আমার এক বন্ধুর সাথে তর্ক হয়েছে। আমার কথা ছিল হযরত সুফিয়ান সওরী রহ. সবচেয়ে বেশী সহনশীল। উলামাই-কিরামের মধ্যে তাঁর একদম ক্রোধ নেই। রাগহীন মহান বুযুর্গ তিনি আর আমার বন্ধুর বক্তব্য হলাে, এ ক্ষেত্রে সবার শীর্ষে রয়েছেন আবু হানীফা নুমান ইবনে ছাবিত (রহ.)। তিনিই সবচে শান্ত ভদ্র বুযুর্গ ব্যক্তি।

আমাদের উভয়ের মাঝে এই বাহাছের পর আমি যাচাই করার জন্য এই পন্থা বেছে নিলাম যে বিশ্রামের সময় আপনার বাড়িতে গিয়ে দু’তিন বার উপর নীচ উঠা নামা করিয়ে সাংঘাতিক বিরক্ত উত্যক্ত করার পর এমন উদ্ভট প্রশ্ন করবাে যাতে ধৈর্য্যের পাহাড়সম লােকটিও রেগে যায় । এত বেশী ব্যাঘাত ঘটিয়ে পরীক্ষা করে দেখার ইচ্ছা যে, আপনি কত সহ্য করতে পারেন।

আমাদের কথা ছিল আপনি রাগান্বিত হলে আমি জয়ী নতুবা (আমার বন্ধু তুমি জয়লাভ করবে, কেননা তােমার কথাই ঠিক। কিন্তু আপনি আজ আমাকে হারিয়ে দিলেন, আপনার ধৈৰ্য্য সহ্যের কাছে হার মেনে আমি পরাজয়বরণ করেছি। বাস্তবিক পক্ষে এই ভূমণ্ডলে আপনার তুলনায় বেশী সহনশীল, যাকে ক্রোধ স্পর্শ করতে পারে না আমার জানা মতে অন্য কেউ বর্তমান নেই।

ঘটনা :২।

ইমাম সাহেব একদিন বাড়ির দিকে রওয়ানা করেছেন। জনৈক ব্যক্তি তার পিছু নিল। সারাপথ অশ্লীল গালিগালাজ করতে লাগল। লােকটির অশ্রাব্যভাষার নিন্দাবাদ একমনে শুনছেন আর পথ চলছেন তিনি।

এক সময় দু’রাস্তায় ঘােড়ে এসে পৌঁছলেন, যেখান থেকে উভয়ের পথ ভিন্ন হবে, তখন ইমাম আবু হানীফা (রহ.) থেমে গিয়ে গালিদাতাকে বললেন, এখান হতে আমাদের দুজনের পথ ভিন্ন। আপনি একদিকে যাবেন আর আমি অন্যদিকে যাবাে।

সুতরাং অপেক্ষা করছি আপনার অবশিষ্ট গালমন্দ যা বলার বলুন, নতুবা আপনার মনােকষ্ট থেকে যাবে। আপনার আক্ষেপ মিটে গেলে আমি নিজ পথে যাত্রা করবাে!

এই ছিল বিশ্বব্যাপি খ্যাতিসম্পন্ন ইমামে আযমের ধৈৰ্য্য। যার অনুসারী আমরা। গােটা দুনিয়াতে আল্লাহ পাক তার ফয়েয বরকত জারী করেছেন। ফেরেশতাগণ যাকে নিয়ে গর্ব করে।

প্রসিদ্ধ এই মহান ব্যক্তি আল্লাহর ওলীর হিংসুকের অভাব ছিল না। যারা তাকে বিভিন্নভাবে যন্ত্রণা দেয় আর তিনি তা অম্লান বদনে সয়ে যান নিজেকে একেবারে মিটিয়ে দিয়ে।

গল্পের বিষয়:
ইসলামিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত