মানুষের প্রতি রয়েছে মানুষের ভালোবাসা। এটাই প্রকৃতির নিয়ম, মনুষ্যত্বের দাবি। কিন্তু প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি তাঁর সাহাবীগণের যে ভালোবাসা ছিলো, সত্যিই তা পবিত্র ও অতুলনীয়। পৃথিবীর ইতিহাসে তার কোন নজীর খোঁজে পাওয়া যায় না। অতুলনীয় সেই ভালোবাসার হৃদয়ছোঁয়া কয়েকটি দৃষ্টান্ত নিয়েই আমার আজকের আলোচনা।
এক. ইসলামের সূচনালগ্নের কথা। তখন মাত্র ঊনচল্লিশজন লোক ইসলাম গ্রহণ করেছেন। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুমতিক্রমে হযরত আবু বকর রা. প্রকাশ্যে ইসলাম প্রচার শুরু করলেন। প্রথম যেদিন বক্তৃতা করলেন সেদিনই মুশরিকদের গায়ে আগুন জ্বলে উঠলো, হিংস্র হায়েনার মতো ঝাপিয়ে পড়ল ওরা হযরত আবু বকর রা. এর উপর। ক্ষত-বিক্ষত করে দিলো সারা শরীর। দীর্ঘ সময় বেহুঁশ হয়ে পড়ে থাকলেন তিনি। তারপর সম্বিত ফিরে পাওয়া মাত্রই প্রথমে জিজ্ঞেস করলেন প্রিয় নবীজি কেমন আছেন? তার মমতাময়ী মা পুত্রকে কিছু খাওয়ার জন্য অনেক অনুরোধ করলেন। কিন্তু হযরত আবু বকর রা. শপথ করে বললেন, নবীজির সাক্ষাত লাভের পূর্বে কোন আহার গ্রহণ করবেন না। এরপর রাতে লোক চলাচল বন্ধ হলে পরম মমতাময়ী মাতা পুত্রকে নিয়ে প্রিয় নবীজির খেদমতে উপস্থিত হলেন। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবু বকর রা. কে দেখে তাকে জড়িয়ে ধরলেন। হযরত আবু বকরও রা. তাঁকে জড়িয়ে ধরলেন। এভাবে জড়াজড়ি করে তারা উভয়ে খুব কাঁদলেন, কাঁদলো উপস্থিত সকল মুসলমান। এটাই হলো সত্যিকারের ভালোবাসা। যে ভালোবাসার কাছে খাদ্য, চিকিৎসা এমনকি পরম মমতাময়ী মায়ের স্নেহ-ভালোবাসাও হার মানে!
দুই. অহুদ যুদ্ধে মুসলিমগণ যখন বিপর্যয়ের সম্মুখীন, তখন এক আনসারী মহিলা যুদ্ধে জড়িত লোকজনের কাছে ব্যাকুল হৃদয়ে জানতে চাইলেন, প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কেমন আছেন? এক ব্যক্তি বলল, তোমার পিতা শহীদ হয়ে গেছেন। মহিলা শুধু ‘ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন’ পড়ে অসহ্য অস্থিরতায় আবারো জানতে চাইলেন, প্রিয় নবীজি কেমন আছেন? প্রিয় নবীর ভালোবাসার কাছে যেন আপন পিতার শাহাদাতের সংবাদও ম্লান হয়ে যাচ্ছে! এরপর এক এক করে তাঁর স্বামী, ভ্রাতা ও পুত্রের শাহাদাতের সংবাদ জানানো হল তাঁকে। কিন্তু তিনি ইন্নালিল্লাহি… উচ্চারণ করে বারবার মানুষের কাছে শুধু প্রিয়নবীর কথাই জিজ্ঞেস করছিলেন। এক সময় তিনি শুনতে পেলেন যে, প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ভালো আছেন। কিন্তু ব্যাকুল হৃদয় তাতেও শান্ত হলো না। এরপর নবীজিকে স্বচক্ষে দেখেই তবে শান্ত হলেন সেই আনসারী মহিলা। এটাই হলো প্রকৃত নবীপ্রেম। প্রিয়নবীর প্রতি পবিত্র ভালোবাসা। যার উপমা মেলে না এ পৃথিবীতে।
তিন. সাহাবী হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে যায়েদ ইবনে আবদি রাব্বিহি। তিনি তার বাগানে ফল-ফলাদি ও গাছ-গাছালি দেখাশোনা করছেন। এমন সময় নবীজির ইন্তিকালের সংবাদ জানতে পেলেন। হৃদয়ের কোমল বৃত্তে তিনি আচমকা প্রচণ্ড আঘাত পেলেন। দুঃখে শোকে আর মহব্বতের আতিশয্যে আল্লাহর কাছ প্রার্থনা করে বসলেন, হে আল্লাহ! আমার দৃষ্টিশক্তি রহিত করে দাও। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পরে আমি এই চোখ দিয়ে আর কিছুই দেখতে চাই না। অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে উৎসারিত এই প্রার্থনা বৃথা গেল না। সত্যিই দৃষ্টিশক্তি রহিত করে দেয়া হলো তার। মানুষের প্রতি কি মানুষের এমন ভালোবাসাও হতে পারে, যে ভালোবাসার কাছে নিজের দৃষ্টিশক্তির মহব্বতও হার মানে!
চার. হযরত ওমর রা. এর বীরত্বের কথা কে না জানে? তিনি ছিলেন মানবেতিহাসের এক লৌহমানব। অথচ সে ওমর রা. যখন নবীজির ইন্তিকালের সংবাদ পেলেন তখন তিনি একদম অস্থির হয়ে ওঠলেন। প্রিয়নবীর বিরহের শোক কিছুতেই তিনি সইতে পারছিলেন না, নাঙ্গা তলোয়ার হাতে নিয়ে দাড়িয়ে গেলেন। আহত ক্রদ্ধ কণ্ঠে বলতে লাগলেন- যে বলবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মৃত্যুবরণ করেছেন আমি তার গর্দান উড়িয়ে দেব। প্রিয়নবী তো তাঁর বন্ধুর নিকট গমন করেছেন মাত্র। হযরত ওসমান রা.ও অপ্রকৃতিস্থ হয়ে পড়লেন। দু’দিন পর্যন্ত কোন আওয়াজ বেরুল না তার কণ্ঠ থেকে। হযরত আলী রা. এমনভাবে চুপসে গেলেন মনে হচ্ছিল যেন তিনি অনুভূতি শক্তি হারিয়ে ফেলেছেন।
পরিস্থিতি যখন জটিলরূপ নিচ্ছিল হযরত আবু বকর রা. তখন নবীপ্রেমের দাবিতেই হৃদয়মন দৃঢ় করে ওঠে দাঁড়ালেন। সকলকে শান্তনা দিয়ে দ্বীপ্ত কণ্ঠে শোনালেন পবিত্র কুরআনের সেই অমোঘ বাণী-
‘আর মুহাম্মদ একজন রসূল বৈ তো নয়! তাঁর পূর্বেও বহু রসূল অতিবাহিত হয়ে গেছেন। তাহলে কি তিনি যদি মৃত্যুবরণ করেন অথবা নিহত হন, তবে তোমরা পশ্চাদপসরণ করবে? বস্তুতঃ কেউ যদি পশ্চাদপসরণ করে, তবে তাতে আল্লাহর কিছুই ক্ষতি-বৃদ্ধি হবে না। আর যারা কৃতজ্ঞ, আল্লাহ তাদের সওয়াব দান করবেন।’ [সূরা আলে ইমরান : ১৪৪]
কুরআনের এই বাণী শুনে সবাই প্রকৃতিস্থ হয়ে গেলেন।
পাঁচ. কিশোর সাহাবী হযরত যায়েদ বিন হারেসা রা. মুসলমানদের হাতে বন্দী হয়ে গোলামরূপে আসার পর তার পিতা কেঁদে কেঁদে তাকে খুঁজে ফিরছিল। এক সময় সন্ধান পেয়ে তার পিতা ও চাচা মদিনায় গিয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দরবারে হাজির হলো। তারা বিনীত সুরে আরজ করল, হে হাশেম বংশধর! আপনি হারামের অধিবাসী এবং আল্লাহর ঘরের প্রতিবেশী। আপনি বন্দী মুক্ত করেন, ক্ষুধার্তদের আহার দান করেন, আমাদের প্রতি অনুগ্রহ করুন। মুক্তিপণ নিয়ে আমাদের পুত্রকে মুক্ত করে দিন।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যায়েদের পিতাকে বললেন, আপনি ওকে জিজ্ঞেস করুন, ও যদি যেতে চায় তাহলে আপনারা ওকে নিয়ে যান; মুক্তিপণের কোন প্রয়োজন নেই। আর যদি না যেতে চায় তাহলে আমরা ওর ওপর কোন চাপ প্রয়োগ করতে পারব না। এরপর যায়েদ রা. উপস্থিত হলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আগন্তুক দু’জনের দিকে ইশারা করে তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি এদের চেন? যায়েদ রা. বললেন হ্যাঁ, ইনি আমার পিতা আর ইনি আমার চাচা। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আমার পরিচয়ও তোমার জানা আছে, সুতরাং এখন তোমার ইচ্ছে মনে চাইলে আমার কাছে থাকতে পার, আর ইচ্ছে হলে তাদের সাথেও যেতে পার। বালক যায়েদ জবাব দিলেন আমি আপনার পরিবর্তে আর কাকেই বা পছন্দ করতে পারি আপনিই তো আমার বাবা-চাচার মতো। বালক যায়েদের এ জবাব শুনে পিতা ও চাচা আবেগ বিহ্বল কণ্ঠে বলে ওঠলেন, যায়েদ! তুমি আজাদির উপর গোলামীকে প্রাধান্য দিচ্ছো?
হযরত যায়েদ রা. বললেন, আমি নবীজির মাঝে এমন সৌন্দর্য দেখেছি, যার বিপরীতে কোন কিছুই পছন্দ করতে পারি না। একথা শুনে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে কোলে টেনে নিলেন আর বললেন, একে আমি আমার পুত্র বানিয়ে নিলাম। এক কিশোর সাহাবীরও কি গভীর ভালোবাসা ছিল নবীর প্রতি। পিতা-মাতা, ভাই-বোন ও আত্মীয়-স্বজনের ভালোবাসাও সেখানে ম্লান হয়ে যায়।
ছয়. অহুদ যুদ্ধের সময় যখন নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শির মোবারকে শিরস্ত্রানের দু’টি কড়া ঢুকে পড়লো। হযরত আবু বকর রা. ও হযরত উবায়দা রা. অধীর চিত্তে দৌড়ে এলেন। দাঁত দিয়ে শিরস্ত্রাণের কড়া টেনে বের করে আনলেন। হযরত উবায়দা রা. এর একটি দাঁতও ভেঙ্গে গেল। কিন্তু তিনি দমলেন না অপর কড়াটিও দাঁত দিয়ে টেনে বের করে আনলেন। এতে তার আরেকটি দাঁত ভেঙ্গে গেল। কড়াটি বেরিয়ে এলে নবীজির মাথা মোবারক থেকে রক্তের ফিনকি ছুটছিল। এ দৃশ্য দেখে সাহাবী মালেক ইবনে সিনান দৌড়ে এলেন এবং তার দুই অধরে নবীজির রক্ত চুষে পান করে ফেললেন। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন ইরশাদ করলেন, ‘যার রক্তের সাথে আমার রক্ত মিশে গেছে তাকে জাহান্নামের আগুন স্পর্শ করতে পারবে না।’ কি গভীর ভালোবাসা থাকলে মানুষ মানুষের রক্ত পান করতে পারে! সত্যিই কি তা কল্পনীয়?!
সাত. হযরত যায়েদ ইবনে দাসানা রা. কাফিরদের হাতে বন্দী হবার পর পাপিষ্ঠরা তাকে শূলে চড়ানোর আয়োজন করে। তামাশা দেখার জন্য সমবেত হয় অনেক লোক। আবু সুফিয়ান তখনো ইসলাম গ্রহণ করেননি। তিনি নরম সুরে জিজ্ঞাসা করলেন, যায়েদ! সত্যি করে বলতো; আল্লাহর শপথ দিয়ে তোমাকে জিজ্ঞেস করছি, তুমি কি এটা পছন্দ কর যে, তোমার পরিবর্তে মুহাম্মদের গর্দান উড়িয়ে দেয়া হোক আর তোমাকে হাসিমুখে তোমার পরিবারের নিকট ফিরিয়ে দেয়া হোক। হযরত যায়েদ রা. দৃঢ় কণ্ঠে জবাব দিলেন, আল্লাহর শপথ! নবীজির যাত্রাপথে একটি কাঁটা লুকিয়ে রাখা হবে আর আমি ঘরে বসে আরাম করবো, এতটুকুও আমার সহ্য হবে না।
হযরত যায়েদের জবাব শুনে সেদিন মক্কার কাফেররা হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলো। আরব নেতা আবু সুফিয়ান মন্তব্য করেছিলেন, মুহাম্মদের প্রতি তার সাথীদের যে ভালোবাসা আমি দেখেছি, অন্য কারো প্রতি এমন ভালোবাসা আমি আর কখনো দেখিনি।
এই হলো সাহাবায়ে কিরামের রাসূল-প্রেমের হৃদয়ছোঁয়া কয়েকটি দৃষ্টান্ত। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তারা পিতা-মাতা, সন্তান-সন্ততি ও ধন-সম্পদের থেকেও অধিক ভালোবাসতেন। একবার হযরত আলী রা. এর কাছে এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি আপনাদের কেমন ভালোবাসা ছিলো? হযরত আলী রা. বললেন, আল্লাহর শপথ! হযরত রাসূলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আমরা আমাদের পিতা-মাতা, সন্তান-সন্ততি, ধন-সম্পদ ও তৃষ্ণার্ত সময়ে প্রাপ্ত পানির চেয়েও অধিক ভালোবাসতাম।
তাই হে পাঠক! প্রিয়নবীর প্রতি উম্মত হিসেবে আমাদের হৃদয়েও জাগাতে হবে রসূল-প্রেম। বাস্তবতার আলোকে ফুটিয়ে তোলতে হবে প্রিয়নবীর সুন্নাতসমূহকে। তবেই আমরা শামিল হতে পারবো তাদের কাতারে যারা প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ভালোবেসেছিলেন সত্যিকারের ভালবাসা।