আবদুল্লাহ্ নাম, সিদ্দীক ও আতীক উপাধি, ডাকনাম বা কুনিয়াত আবুবকর । পিতার নাম ‘উসমান’ কুনিয়াত আবু কুহাফা । মাতার নাম সালমা এবং কুনিয়াত উম্মুল খায়ের । কুরাইশ বংশের উপর দিকে ষষ্ঠ পুরুষ ‘মুররা’তে গিয়ে রাসুল (সাঃ) নসবের সাথে তাঁর নসব মিলিত হয়েছে । রাসুল (সাঃ) এর জন্মের দু’বছরের কিছু সময় পর তিনি জন্মগ্রহণ করেন এবং অনুরূপ সময়ের ব্যবধানে তাঁরা উভয়ে ইন্তেকাল করেন । তাই মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল রাসুল (সাঃ) বয়সের সমান ।
তিনি ছিলেন উজ্জল গৌরবর্ণ, পাতলা ছিপছিপে ও প্রশস্ত ললাট বিশিষ্ট । শেষ বয়সে চুল সাদা হয়ে গিয়েছিল । মেহেদীর খিজাব লাগাতেন । অত্যন্ত দয়ালু ও সহনশীল ছিলেন ।
তিনি ছিলেন সম্মানিত কুরাইশ ব্যক্তিবর্গের অন্যতম । জ্ঞান, মেধা, অভিজ্ঞতা, বুদ্ধি, বিচক্ষনতা ও সচ্চরিত্রতার জন্য আপামর মক্কাবাসীর শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন । জাহিলী যুগে মক্কাবাসীদের দিয়াত বা রক্তের ক্ষতিপূরণের সমুদয় অর্থ তাঁর কাছে জমা হতো । আরব বাসীর নসব বা বংশ সংক্রান্ত জ্ঞানে তিনি ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ বিশেষজ্ঞ । কাব্য প্রতিভাও ছিল । অত্যন্ত বিশুদ্ধ ও প্রাঞ্জল-ভাষী ছিলেন । বক্তৃতা ও বাগ্মিতায় খোদাপ্রদত্ত যোগ্যতার অধিকারী ছিলেন ।
তিনি ছিলেন তার গোত্রের অত্যন্ত জনপ্রিয়, বন্ধুবৎসর ও অমায়িক ব্যক্তি । তিনি ছিলেন ব্যবসায়ী, দানশীল ও চরিত্রবান । জাহিলী যুগেও কখনো শরাব পান করেননি ।তাঁর অমায়িক মেলামেশা, পান্ডিত্য ও ব্যবসায়িক দক্ষার কারণে অনেকেই তার সাথে বন্ধুত্ব ও সখ্যতা স্থাপন করতো । তাঁর বাড়ীতে প্রতিদিন মক্কার বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়মিত বৈঠক বসতো ।
হযরত আবুবকরের পিতা আবু কুহাফা কুরাইশদের মধ্যে যথেষ্ট মর্যদাবান ব্যক্তি ছিলেন । তিনি ছিলেন বয়োঃবৃদ্ধ ও সচ্ছল । তাঁর গৃহ কেবল ব্যবসা বাণিজ্যের জন্য প্রসিদ্ধ ছিল না, সামাজিক কর্মকান্ডেও তাঁর মতামত অত্যন্ত শ্রদ্ধার সাথে গ্রহণ করা হতো । মক্কা বিজয় পর্যন্ত ইসলামের প্রতি তিনি আকৃষ্ট না হলেও পুত্র আবু বকরকে ইসলাম থেকে ফিরিয়ে রাখার চেষ্টা করেছেন- এমন কোনো প্রমাণ ইতিহাসে পাওয়া যায় না । অবশ্য হযরত আলীকে (রাঃ) তিনি দেখলে মাঝে মাঝে বলতেন “এই ছোকরারাই আমার ছেলেটিকে বিগড়ে দিয়েছে” । মক্কা বিজয়ের দিন রাসুল (সাঃ)এর খিদমতে হাজির হয়ে ইসলামের ঘোষণা দেন । হিজরী ১৪ সনে প্রায় এক‘শ বছর বয়সে ইন্তিকাল করেন । শেষ বয়সে দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেছিলেন ।
হযরত আবুবকরের মা উম্মুল খায়ের বহু পূর্বে মক্কার ইসলামের প্রথম পর্যায়ে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। মক্কার ‘দারুল আরকামে’ ইসলাম গ্রহণকারীদের মধ্যে তিনি অন্যতম । স্বামীর মত তিনিও দীর্ঘজীবন লাভ করেন । প্রায় ৯০ বছর বয়সে ছেলেকে খিলাফেতের পদে অধিষ্ঠিত রেখে ইহলোক ত্যাগ করেন । আবু বকর ছিলেন পিতার একমাত্র পুত্র সন্তান । অত্যন্ত আদর যত্ন ও বিলাসিতার মধ্যে পালিত হোন । শৈশব থেকে যৌবনের সূচনা পর্যন্ত পিতার উপর নির্ভরশীল ছিলেন । বিশ বছর বয়সে পিতার ব্যবসা বাণিজ্যের দায়িত্ব নিজ কাধেঁ তুলে নেন ।
শৈশব থেকে রাসুল (সাঃ)এর সঙ্গে আবু বকরের বন্ধুত্ব ছিল । তিনি রাসুল (সাঃ) অধিকাংশ বাণিজ্য সফরের সঙ্গী ছিলেন । একবার রাসুল (সাঃ) এর সঙ্গে ব্যবসায় উপলক্ষে সিরিয়া যান । তখন তাঁর বয়ষ প্রায় আঠারো এবং রাসুল (সাঃ) এর বিশ । তাঁরা যখন সিরিয়া সীমান্তে; বিশ্রামের জন্য রাসুল (সাঃ) একটি গাছের নীচে বসেন । আবু বকর একটু সামনে এগিয়ে এদিক ওদিক দেখতে লাগলেন । এক থৃষ্টান পাদ্রীর সাথে তাঁর দেখা হয় এবং ধর্ম বিষয়ে কিছু কথা বলে । আলাপের এক পর্যায়ে পাদ্রী জিজ্ঞেস করে, ওখানে গাছের নিচে কে? আবু বকর বললেন, এক কুরাইশ যুবক, নাম মুহাম্মাদ বিন আবদুল্লাহ্ । পাদ্রী বলে উঠলো, এ ব্যাক্তি আরবদের নবী হবেন । কথাটি আবু বকরের অন্তরে গেঁথে যায় । তখন থেকেই তাঁর অন্তরে রাসুল (সাঃ) প্রকৃত নবী হওয়া সম্পর্কে প্রত্যয় দৃঢ় হতে থাকে । ইতিহাসে এ পাদ্রীর নাম ‘বুহাইরা’ বা ‘নাসতুরা’ বলে উল্লেখিত হয়েছে ।
রাসুল (সাঃ) এর নবুওয়াত লাভের ঘোষনায় মক্কায় হৈ চৈ পড়ে গেল । মক্কার প্রভাবশালী ধনী নেতৃবৃন্দ তাঁর বিরোধিতায় কোমর বেঁধে লেগে যায় । কেউবা তাঁকে মাথা খারাপ, কেউবা জীনে ধরা বলতে থাকে। নেতৃবৃন্দের ইংগিতে ও তাদের দেখাদেখি সাধারণ লোকেরাও ইসলাম থেকে দূরে সরে যায় । কুরাইশদের ধনবান ও সম্মানী ব্যক্তিদের মধ্যে একমাত্র আবু বকর রাসুল (সাঃ) এর সঙ্গ দেন, তাঁকে সাহস দেন এবং বিনা দ্বিধায় তাঁর নবুওয়াতের প্রতি ঈমান আনেন । এই প্রসংগে রাসুল (সাঃ) বলেছেনঃ ‘আমি যাকেই ইসলামের দাওয়াত দিয়েছি, একমাত্র আবু বকর ছাড়া প্রত্যেকের মধ্যে কিছু না কিছু দ্বিধার ভাব লক্ষ্য করেছি ।’ এভাবে আবু বকর হলেন বয়স্ক আযাদ লোকদের মধ্যে প্রথম মুসলমান ।
মুসলমান হওয়ার পর ইসলামের ভিত্তি সুদৃঢ় করার লক্ষ্যে তিনি রাসুল (সাঃ) সাথে দাওয়াতী কাজে আত্মনিয়োগ করেন । মক্কার আশেপাশের গোত্রসমূহে ইসলামের দাওয়াত দিতেন । হজ্জের মওসুমে বিভিন্ন তাঁবুতে গিয়ে লোকদের দাওয়াত দিতেন । বহিরাগত লোকদের কাছে ইসলামের ও রাসুলের (সাঃ) পরিচয় তুলে ধরেন । এভাবে আরববাসী রাসুল (সাঃ) প্রচারিত দ্বীন সম্পর্কে অবহিত হয়ে তাঁর ওপর ঈমান আনে । তাঁর ব্যক্তিগত প্রভাব ও চেষ্টায় তৎকালীন কুরাইশ বংশের বিশিষ্ট যুবক উসমান, যুবাইর, আবদুর রহমান, সা‘দ ও তালহার মত ব্যক্তিরা সহ আরো অনেকে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন।
রাসুল (সাঃ) যখন নবুওয়াতের প্রকাশ্য ঘোষনা দিলেন, আবু বকরের নিকট তখন চল্লিশ হাজার দিরহাম । ইসলামের জন্য তিনি তাঁর সকল সম্পদ ওয়াক্ফ করে দেন । কুরাইশদের যেসব দাস-দাসী ইসলামে গ্রহণের কারণে নিগৃহীত ও নির্যাতিত হচ্ছিল, এ অর্থ দ্বারা তিনি সেই সব দাস-দাসী খরীদ করে আযাদ করেন । তেরো বছর পর যখন রাসুল (সাঃ) সাথে তিনি মদীনায় হিজরাত করেন তখন তাঁর কাছে এ অর্থের মাত্র আড়াই হাজার অবশিষ্ট ছিল । অল্পদিনের মধ্যে অবশিষ্ট দিরহাম গুলির ইসলামের জন্য ব্যয়িত হয় । বিলাল, খাব্বার, আম্মার, আম্মারের মা সুমাইয়্যা, সুহাইব. আবু ফুকাইহ প্রমুখ দাস-দাসী তাঁরই অর্থের বিনিময়ে দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্তি লাভ করেন । তাই পরবর্তীকালে রাসুল (সাঃ) বলেছেনঃ আমি প্রতিটি মানুষের ইহসান পরিশোধ করেছি । কিন্তু আবু বকরের ইহসানসমূহ এমন যে, তা পরিশোধ করতে আমি অক্ষম । তার প্রতিদান আল্লাহ দিবেন । তার অর্থ আমার উপকারে যেমন এসেছে, অন্য কারো অর্থ তেমন আসেনি ।
রাসুল (সাঃ) এর মুখে মি‘রাজের কথা শুনে অনেকেই যখন বিশ্বাস-অবিশ্বাসের মাঝখানে দোল খাচ্ছিল, তখন তিনি দ্বিধাহীন চিত্তে বিশ্বাস স্থাপন করেছিলেন । হযরত হাসান (রাঃ) বলেনঃ ‘মি’রাজের কথা শুনে বহু সংখ্যক মুসলমান ইসলাম ত্যাগ করে । লোকেরা আবু বকরের কাছে গিয়ে বলে, আবু বকর, তোমার বন্ধুকে তুমি বিশ্বাস করো? সে বলেছে, সে নাকি গতরাতে বাইতুল মাকদাসে গিয়েছে, সেখানে সে নামায পড়েছে, অতঃপর মক্কায় ফিরে এসেছে ।’
আবু বকর বললেনঃ তোমরা কি তাকে অবিশ্বাস করো? তারা বললঃ হ্যাঁ, ঐতো মসজিদে বসে লোকজনকে একথাই বলছে । আবু বকর বললেনঃ আল্লাহর কসম, তিনি যদি এ কথা বলে থাকেন তাহলে সত্য কথাই বলেছেন । এতে অবাক হওয়ার কি দেখলে? তিনি তো আমাকে বলে থাকেন, তাঁর কাছে আল্লাহর কাছ থেকে ওহী আসে । আকাশ থেকে ওহী আসে মাত্র এক মুহূর্তের মধ্যে । তাঁর সে কথাও আমি বিশ্বাস করি । তোমরা যে ঘটনায় বিস্ময় প্রকাশ করছো এটা তার চেয়েও বিস্ময়কর । তারপর তিনি রাসুল (সাঃ) এর কাছে গিয়ে হাজির হলেন । তিনি জিজ্ঞেস করলেনঃ হে আল্লাহর নবী, আপনি কি জনগনকে বলেছেন যে, আপনি গতরাতে বাইতুল মাকদাস ভ্রমন করেছেন? তিনি বললেন, হ্যাঁ । আবু বকর বললেনঃ আপনি ঠিকই বলেছেন । আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আপনি নিঃসন্দেহে আল্লাহর রাসুল । রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বললেনঃ হে আবু বকর, তুমি সিদ্দীক । এভাবে আবু বকর ‘সিদ্দীক’ উপাধিতে ভুষিত হন ।
মক্কায় রাসুল (সাঃ) অভ্যাস ছিল প্রতিদিন সকাল সন্ধ্যায় আবু বকরের বাড়ীতে গমন করা । কোন বিষয়ে পরামর্শে প্রয়োজন হলে তাঁর সাথে পরামর্শ করা । রাসুল (সাঃ) দাওয়াত ও তাবলীগের উদ্দেশ্যে কোথাও গেলে তিনিও সাধারণত সঙ্গে থাকতেন ।
মুসলমানদের ওপর মুশরিকের অত্যাচার চরম আকার ধারণ করলে একবার তিনি হাবশায় হিজরাত করার ইচ্ছা করেছিলেন কিন্তু ‘ইবনুল দাগনাহ’ নামক এক গোত্রপতি তাঁকে এ সিদ্ধান্ত থেকে বিরত রাখে । সে কুরাইশদের হাত থেকে এ শর্তে নিরাপত্তা দেয় যে, আবু বকর প্রকাশ্যে সালাত আদায় করবেন না, কিন্তু দীর্ঘদিন এ শর্ত পালন করা তাঁর পক্ষে অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায় । তিনি ইবনুদ দাগনাহর নিরাপত্তা ফিরিয়ে দেন এবং অন্যান্য মুসলমান ভাইয়ের যে অবস্থা হয় সন্তুষ্টচিত্তে তা গ্রহণের জন্য প্রস্তুত হয়ে যান ।
রাসুল (সাঃ) হিরাতের সেই কঠিন মুহূর্তে আবু বকরের কুরবানী, বুদ্ধিমত্তা, ধৈর্য ও বন্ধুত্বের কথা ইতিহাসে চিরদিন অম্লান হয়ে থাকবে । তাঁর সাহচর্যে কথা তো পবিত্র কুরআনে স্পষ্টভাবে ঘোষিত হয়েছে । ইবন ইসহাক বলেন, “আবু বকর রাসুল (সাঃ) কাছে হিজরাতের অনুমতি চাইলে রাসুল (সাঃ) তাঁকে বলতেন, তুমি তাড়াহুড়া করো না । আল্লাহ হয়তো তোমাকে একজন সহযাত্রী জুটিয়ে দেবেন । আবু বকর একথা শুনে ভাবতেন যে, রাসুল (সাঃ) হয়তো নিজের কথাই বলছেন । তাই তিনি তখন থেকেই দুটো উট কিনে অত্যন্ত যত্ন সহকারে পুষতে থাকেন । এই আশায় যে, হিজরাতের সময় হয়তো কাজে লাগতে পারে ।”
উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়িশা (রাঃ) বর্ণনা করেন, রাসুল (সাঃ) দিনে অন্তত একবার আবু বকরের বাড়ীতে আসতেন । যে দিন হিজরাতের অনুমতি পেলেন সেদিন দুপুরে আমাদের বাড়ীতে আসলেন, এমন সময় কখনো তিনি আসতেন না । তাঁকে দেখা মাত্র আবু বকর বলে উঠলেন, নিশ্চয় কিছু একটা ঘটেছে । তা নাহলে এমন সময় রাসুল (সাঃ) আসতেন না । তিনি বাড়ীতে প্রবেশ করলে আবু বকর তাঁর খাটের একধারে বসলেন । আবু বকরের বাড়ীতে তখন আমি আর আমার বোন আসমা ছাড়া আর কেউ ছিল না । রাসুল (সাঃ) বললেন, তোমার এখানে অন্য যারা আছে তাদেরকে আমার কাছ থেকে সরিয়ে দাও । আবু বকর বললেন, হে আল্লাহর রাসূলঃ আমার দুই মেয়ে ছাড়া আর কেউ নাই । আপনার কি হয়েছে? রাসুল (সাঃ) বললেনঃ আল্লাহ আমাকে হিজরাত করার অনুমতি দিয়েছেন । আবু বকর জিজ্ঞেস করলেন, আমিও কি সঙ্গে যেতে পারবো? রাসুল (সাঃ) বললেনঃ হ্যাঁ, যেতে পারবে । আয়িশা (রাঃ)বলেনঃ সে দিনের আগে আমি জানতাম না যে, মানুষ আনন্দের আতিশয্যেও এত কাঁদতে পারে । আমি আবু বকরকে (রাঃ) সেদিন কাঁদতে দেখেছি । অতঃপর আবু বকর (রাঃ) বললেনঃ ‘হে আল্লাহর রাসূল! এই দেখুন, আমি এই উট দুটো এই কাজের জন্যই প্রস্তুত করে রেখেছি।’
তারা আবদুল্লাহ ইবন উরায়কাতকে পথ দেখিয়ে নেয়ার জন্য ভাড়া করে সাথে নিলেন । সে ছিল মুশরিক, তবে বিশ্বাস ভাজন । রাতের আধাঁরে তাঁরা আবু বকরের বাড়ীর পেছনে দরজা দিয়ে বের হলেন এবং মক্কার নিম্নভূমিতে ‘সাওর’ পর্বতের একটি গুহায় আশ্রয় নিলেন । হাসান বসরী (রাঃ) থেকে ইবন হিশাম বর্ণনা করেনঃ তাঁরা রাতে সাওর পর্বতের গুহায় পৌছেন । রাসুল (সাঃ) প্রবেশের আগে আবু বকর (রাঃ) গুহায় প্রবেশ করলেন । সেখানে কোন হিংস্র প্রাণী বা সাপ-বিচ্ছু আছে কিনা তা দেখে নিলেন । রাসুল (সাঃ) বিপদমুক্ত রাখার উদ্দেশ্যেই তিনি এরূপ ঝুকি নিয়েছিলেন ।
মক্কায় উম্মুল মু’মিনীন হযরত খাদীজার ওফাতের পর রাসূলকে (সাঃ) যখন আবু বকর (রাঃ) বিমর্ষ দেখলেন, অত্যন্ত নিষ্ঠা ও আদব সহকারে নিজের অল্পবয়স্কা কন্যা আয়িশাকে (রাঃ) রাসুল (সাঃ) সাথে বিয়ে দেন । মোহরের অর্থও নিজেই পরিশোধ করেন ।
হিজরতের পর সকল অভিযানেই তিনি রাসুল (সাঃ) সাথে অংশগ্রহণ করেন । কোন একটি অভিযানেও অংশগ্রহণ থেকে বঞ্চিত হননি ।
তাবুক অভিযানেও তিনি ছিলেন মুসলিম বাহিনীর পতাকাবাহী । এ অভিযানের সময় রাসুল (সাঃ) আবেদনে সাড়া দিয়ে বাড়ীতে যা কিছু অর্থ-সম্পদ ছিল সবই তিনি রাসুল (সাঃ) হাতে তুলে দেন । আল্লাহর রাসূল (সাঃ) জিজ্ঞেস করেন. ‘ছেলে-মেয়েদের জন্য বাড়ীতে কিছু রেখেছো কি?’ জবাব দিলেন, ‘তাদের জন্য আল্লাহ ও আল্লাহর রাসুলই যথেষ্ট ।’
মক্কা বিজয়ের পর নবম হিজরীতে প্রথম ইসলামী হজ্জ আদায় উপলক্ষে রাসূল (সাঃ) আবু বকরকে (রাঃ) ‘আমীরুল হজ্জ’ নিয়োগ করেন । রাসুল (সাঃ) অন্তিম রোগ শয্যায় তাঁরই নির্দেশে মসজিদে নববীর নামাযের ইমামতির দায়িত্ব পালন করেন । মোটকথা, রাসুল (সাঃ) জীবদ্দশায় আবু বকর (রাঃ) তাঁর উযীর ও উপদেষ্টা ভুমিকা পালন করেন ।
রাসুল (সাঃ) ওফাতের পর আবু বকর (রাঃ) তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন । ‘‘খলীফাতু রাসুলিল্লাহ’-এ লকবটি কেবল তাঁকেই দেওয়া হয় । পরবর্তী খলীফাদের ‘আমীরুল মু’মিনীন’ উপাধি দেওয়া হয় ।
হযরত উমারও ছিলেন উসামার এ বাহিনীর অন্তর্ভূক্ত একজন সৈনিক । অথচ নতুন খলিফার জন্য তখন তাঁর মদীনায় থাকা অত্যন্ত প্রয়োজন । খলীফা ইচ্ছা করলে তাঁকে নিজেই মদীনায় থেকে যাওয়ার নির্দেশ দিতে পারতেন । কিন্তু তিনি উসামার ক্ষমতায় হস্তক্ষেপ না করে তাঁর কাছে আবেদন জানালেন উমারকে মদীনায় রেখে যাওয়ার জন্য । উসামা খলীফার আবেদন মন্জুর করলেন । কারণ, আবু বকর বুঝেছিলেন উসামার নিয়োগকর্তা খোদ রাসুল (সাঃ) । সুতরাং এ ক্ষেত্রে উসামার ক্ষমতা তাঁর ক্ষমতার ওপরে । এভাবে আবু বকর (রাঃ) রাসুল (সাঃ) আদেশ যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করেন । এবং তাঁর সামান্যতম বিরুদ্ধাচারণ থেকেও বিরত থাকেন ।
রাসুল (সাঃ) ইন্তিকালের পর আবাস ও জুবইয়ান গোত্রদ্বয় যাকাত দিতে অস্বীকৃতি জানায় । বিষয়টি নিয়ে খলীফার দরবারে পরামর্শ হয় । সাহাবীদের অনেকেই তাদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান না চালানোর পরামর্শ দেন । কিন্তু আবু বকর (রাঃ) অটল । তিনি বললেন, ‘আল্লাহর কসম, রাসুল (সাঃ) যুগে উটের যে বাচ্চাটি যাকাত পাঠানো হতো এখন কেউ তা দিতে অস্বীকার করে আমি তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করবো ।
কিছু লোক নবুওয়াতের মিথ্যা দাবীদার ছিল । আবু বকর (রাঃ) অসীম সাহস ও দৃঢ়তা সহকারে এসব ভন্ড নবীর বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করে ইসলামের বিরুদ্ধে সকল ষড়যন্ত্র নস্যাত করে দেন । তাই ইতিহাসবিদরা মন্তব্য করেছেন, আল্লাহর সাহায্য ও সহায়তার পর যদি আবু বকরের এ দৃঢ়তা না হতো, মুসলিম জাতির ইতিহাস হয়তো অন্যভাবে লেখা হতো ।
এমনটি সম্ভব হয়েছে এজন্য যে, হযরত আবু বকরের (রাঃ) স্বভাবে দু’টি পরস্পরবিরোধী গুনের সমাবেশ ঘটেছিল, সীমাহীন দৃঢ়তা ও কোমলতা । এ কারণে তাঁর চরিত্রে সর্বদা একটা ভারসাম্য বিরাজমান ছিল । কোন ব্যক্তির স্বভাবে যদি এ দু’টি গুনের কেবল একটি বর্তমান থাকে এবং অন্যটি থাকে অনুপস্থিত, তখন তার চরিত্রের ভারসাম্য বিনষ্ট হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকে । কিন্তু আল্লাহর অনুগ্রহে এ দুটি গুন তাঁর চরিত্রে সমানভাবে বিদ্যমান ছিল । হযরত আবু বকর (রাঃ) যদিও মুসলমানদের নেতা ও খলীফা ছিলেন, তবুও তাঁর জীবন ছিল খুব অনাড়ম্বর । খলীফা হওয়া সত্বেও মদীনার অলিগলিতে ঘুরে ঘুরে জনগনের অবস্থা জানতেন এবং তাদের ব্যক্তিগত কাজও সময় সময় নিজ হাতে করে দিতেন । হযরত উমার (রাঃ) বলেনঃ ‘আমি প্রতিদিন সকালে এক বৃদ্ধার বাড়ীতে তার ঘরের কাজ করে দিতাম । প্রতিদিনের মত একদিন তার বাড়ীতে উপস্থিত হলে বৃদ্ধা বললেন, আজ কোন কাজ নেই । এক নেককার ব্যক্তি তোমার আগেই কাজগুলি শেষ করে গেছে । হযরত উমার পরে জানতে পারেন, সেই নেককার লোকটি হযরত আবু বকর (রাঃ) । খলীফা হওয়া সত্বেও এভাবে এক অনাথ বৃদ্ধার কাজ করে দিয়ে যেতেন । হযরত আবু বকর (রাঃ) সাত্র আড়াই বছরের মত খিলাফত পরিচালনা করেন । তবে তাঁর এ সময়টুকু ইসলামের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয় । রাসুল (সাঃ) ইন্তিকালের পর তাঁর সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য অবদান হলো, মুসলিম উম্মাহর ঐক্য ও সংহতি বজায় রাখা । আরবের বিদ্রোহসমূহ নির্মূল করা । রাষ্ট্রও সরকারের তিনি এত মজবুত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করেন যে, মুসলমানরা ইরান ও রোমের মত দুই পরাশক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে সাহসী হয় এবং অল্প সময়ের মধ্যে তাদের বহু অঞ্চল দখল করে নেয় ।
হযরত আবু বকরের (রাঃ) আরেকটি অবদান পবিত্র কুরআনের সংকলন ও সংরক্ষন । তাঁর খিলাফতের প্রথম অধ্যায়ে আরবের বিভিন্ন স্থানে বিদ্রোহ দেখা দেয় । সেইসব বিদ্রোহ দমন করতে গিয়ে কয়েকশত হাফেজে কুরআন শাহাদাত বরণ করেন । শুধুমাত্র মুসায়লামা কাজ্জাবের সাথে যে যুদ্ধ হয় তাতেই সাত শ’ হাফেজ শহীদ হন । অতঃপর হযরত উমারের পরামর্শে হযরত আবু বকর (রাঃ) সম্পূর্ন কুরআন একস্থানে গ্রন্থাকারে সংকলন করেন এবং কপিটি নিজের কাছে সংরক্ষন করেন। ইতিহাসে কুরআনের এই আদি কপিটি ‘মাসহাফে সিদ্দীকী’ নামে পরিচিতি । পারবর্তীকালে হযরত ‘উসমানের (রাঃ) যুগে কুরআনের যে কপিগুলি করা হয় তা মূলত ‘মাসহাফে সিদ্দীকীর’ অনুলিপি মাত্র । পবিত্র কুরআন ও রাসূলের বাণীতে আবু বকরের সীমাহীন মর্যাদা ও সম্মানের কথা বহুবার বহু স্থানে ঘোষিত হয়েছে ।
হযরত আবু বকর (রাঃ) রাসুল (সাঃ) থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন । আল্লামা জাহাবী ‘তাজকিরাতুল হুফফাজ’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন অত্যন্ত সতর্ক । অত্যাধিক সতর্কতার কারণে তাঁর বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা অন্যদের তুলনায় খুব কত । উমার, উসমান, আবদুর রহমান ইবন আউফ, ইবন মাসউদ, ইবন উমার, ইবন আমর, ইবন আব্বাস, হুজাইফা, আবু মুসা, তাঁর দু’কন্যা আয়িশা ও আসমা প্রমুখ সাহাবী তাঁর থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন । বিশিষ্ট তাবেয়ীরাও তাঁর থেকে বর্ণনা করেছেন ।
১৩ হিজরীর ৭ জমাদিউল উখরা হযরত আবু বকর (রাঃ) জ্বরে আক্রন্ত হন । ১৫ দিন রোগাক্রান্ত থাকার পর হিজরী ১৩ সনের ২১ জামাদিউল উখরা মুতাবিক ৬৩৪ খৃষ্টাব্দের আগস্ট মাসে ইন্তিকাল করেন । হযরত আয়িশার (রাঃ) হুজরায় রাসুল (সাঃ) পাশের একটু পূর্ব দিকে তাঁকে দাফন করা হয়। তিনি দু’বছর তিন মাস দশ দিন খিলাফতের দায়িত্ব পালন করেন ।