হযরত আয়েশা রা. : নারীদের জন্য অনুসরণীয়

হযরত আয়েশা রা. : নারীদের জন্য অনুসরণীয়

আবদুস সাত্তার আইনী :
হযরত আয়েশা রা. আবু বকর রা.-এর কন্যা। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুওত-প্রাপ্তির চতুর্থ বছরে তাঁর জন্ম হয়। ছোটোবেলা থেকেই তিনি ছিলেন অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার অধিকারী। অতি শৈশবে তিনি যখন পুতুল নিয়ে খেলা করতেন তখনই তাঁর যুক্তিপূর্ণ কথা-বার্তা, বিচক্ষণ দৃষ্টিভঙ্গি এবং খেলনাগুলো সাজানোয় পরিপাট্য ও কর্মকুশলতা দেখে বোঝা যেতো তিনি ভবিষ্যতে প্রজ্ঞাবান ও জ্ঞানী এবং বহুদর্শী হয়ে উঠবেন। সত্যিই হয়েওছিলো তাই। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নারী-পুরুষ নির্বিশেষ সবার জন্যই নবী ছিলেন। সবার কাছে আল্লাহর বাণী পৌঁছে দেওয়া ছিলো তাঁর কর্তব্য। নারী-বিষয়ক অনেক বিধি-বিধান আছে, যা কেবল স্ত্রীর নিকই খোলামেলাভাবে বলা যায়, অন্য কারো কাছে বলা যায়। এজন্য আয়েশা রা.-এর মত ধীমান, মেধাবী ও বিচক্ষণ নারীরই প্রয়োজন ছিলো।

এ-ব্যাপারে আল্লাহপাকের পক্ষ থেকে নির্দেশ এলো। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্বপ্ন দেখলেন, একজন ফেরেশতা হযরত আয়েশা রা.-কে কাপড় দিয়ে আবৃত করে তাঁর সামনে উপস্থিত করেছেন। এই স্বপ্ন তিনি একবার নয়, তিনবার দেখলেন। নবীগণের স্বপ্ন কেবল স্বপ্ন নয়; তাঁদের স্বপ্ন আল্লাহপাকের পক্ষ থেকে প্রত্যাদেশ। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বুঝতে পারলেন, আল্লাহপাকের পক্ষ থেকে আয়েশা রা.-কে বিবাহ করার জন্য নির্দেশ এসেছে। আল্লাহর পক্ষ থেকে যে-নির্দেশ আসে নবীগণ তা দ্বিধাহীনভাবে পালন করেন। তাই পৌঢ়ত্বে উপনীত হওয়ার পরও আয়েশা রা. কে বিবাহ করতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আপত্তি করার কোনো কারণ থাকলো না।১

নবুওতের দশম বছর চলছে। আয়েশা রা.-এর বয়স তখন মাত্র ছয় বছর। এই বছরেই খাদীজা রা. পরলোকগমন করেন। হযরত খাদীজা রা.-এর ইন্তেকালের পর হযরত খাওলা বিনতে হাকিম রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সম্মতিতে আয়েশা রা.-এর মা উম্মু রোমানের কাছে তাঁর বিবাহের প্রস্তাব দেন। উম্মু রোমান তখন কেনো মতামত দেন নি। তিনি বিষয়টি তাঁর স্বামী আবু বকর রা.-কে জানালেন। ইতোপূর্বে আবু বকর রা. হযরত আয়েশাকে যুবায়ের ইবনে মুতআমের পুত্রের কাছে বিবাহ দেওয়া প্রতিশ্র“তি দিয়েছিলেন। স্ত্রীর কাছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রস্তাব শুনে বললেন, আমি যুবায়েরকে প্রতিশ্র“তি দিয়েছিলাম’ ওর ছেলের কাছে আয়েশাকে বিয়ে দেবো। এখন কী করা যায়? আমি তো জীবনে কখনো প্রতিশ্র“তি ভঙ্গ করিনি। কিন্তু আল্লাহর নির্দেশও তো অমান্য হওয়ার নয়। একদিন যুবায়ের ইবেন মুতআম বলে ফেললো, আমার পুত্রের জন্য আয়েশাকে বিয়ে করিয়ে আনলে আমার ঘরে ইসলাম প্রবেশ করবে। আমি এই বিয়ের কোনো প্রয়োজন দেখছি না। তার এই কথা শুনে আবু বকর রা. স্বস্তি পেলেন। তিনি হযরত খাওলা রা.-এর মধ্যস্থতায় আয়েশা রা.-কে
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে বিয়ে দিলেন।২

বিবাহের পর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনবছর মক্কায় অবস্থান করেন। নবুওতের ত্রয়োদশ বছরে আল্লাহর পক্ষ থেকে হিজরতের নির্দেশ আসে। তিনি তাঁর পরিবারবর্গ মক্কায় রেখে আবু বকর রা.-কে সঙ্গে নিয়ে মদীনায় হিজরত করেন। মদীনায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বসবাসের জন্য মসজিদের পাশে হুজরা (ছোটো কুটির) নির্মাণ করা হলো। হুজরা নির্মাণের পর তাঁদের পরিবারের সদস্যদের মদীনায় নিয়ে আসার জন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যায়েদ ইবনে হারিসা ও আবু রাফেকে এবং আবু বকর রা. আবদুল্লাহ ইবনে উরাইকিতকে মক্কায় পাঠালেন। কয়েক দিনের মধ্যেই দুই পরিবারের সদস্যদের নিয়ে মদীনায় ফিরে এলেন। মদীনায় পৌঁছে আয়েশা রা. জ্বরে আক্রান্ত হয়ে পড়েন। জ্বরের প্রকোপে তাঁর মাথা চুল পর্যন্ত উঠে গেলো। বেশ কিছুদিন তিনি পীড়া ভোগ করার পর আরোগ্য লাভ করেন। পরিপূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠলে আবার বালিকাসুলভ খেলাধুলায় মন দেন।
তখন হযরত আয়েশা রা.-এর বয়স নয় বছর। তাঁর মা উম্মু রোমান এই সময়ে তাঁর বিয়ের অনুষ্ঠান উদ্যাপন করার ইচ্ছা পোষণ করলেন। প্রতিবেশী আনসারী নারীদের অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হলো। তাঁরা প্রায় সবাই আবু বকর রা.-এর কুটিরে সমবেত হলেন। কিন্তু হযরত আয়েশা রা. এ-সম্পর্কে কিছুই জানতেন না। তিনি আগের মতই সখীদের সঙ্গে খেলছিলেন। ঘরের বাইরে তাদের সঙ্গে দোলনায় দোল খাচ্ছিলেন। এই সময় তিনি মায়ের ডাক শুনে ঘরে গেলেন। মা তাঁর মুখ-হাত ধুয়ে দিয়ে মাথার চুল পরিপাটি করে দিলেন।

আনসারী নারীরা মুবারকবাদ-মারাহাবা বলে আয়েশা রা.-কে শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করলেন। এই সময় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেখানে তাশরিফ আনলেন। অনুষ্ঠান সম্পন্ন হলো। হযরত আয়েশা রা.-কে স্বামীর গৃহে পাঠানো হলো। তিনবছর আগে শাওয়াল মাসে হযরত আয়েশার বিয়ে হয়েছিলো। তিনবছর পর আজ তিনি শাওয়াল মাসেই স্বামীর গৃহে প্রেরিত হলেন। আরবগণ শাওয়াল মাসকে অশুভ মনে করতো। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরবে প্রচলিত এই ভুল ধারণা বাতিল করার উদ্দেশ্যেই শাওয়াল মাসকে বিয়ের জন্য বেছে নিয়েছিলেন।৩

হযরত আয়েশা রা. নিজে বলেছেন, শাওয়াল মাসেই আমার বিয়ে হয়েছিলো এবং শাওয়াল মাসেই আমি স্বামীর গৃহে প্রেরিত হয়েছিলাম। কিন্তু দাম্পত্য জীবনে আমি ছিলাম সবার চেয়ে সুখী।৪
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং হযরত আয়েশার মাঝে যে-ভালোবাসা ছিলো তা অবর্ণনীয়। জীবনের শেষকালে তিনি বলেছেন, বিশ্বজগতে হযরত আয়েশা রা. আমার কাছে সবেচেয়ে প্রিয়। রাসূলের সহধর্মিণীদের মধ্যে একমাত্র আয়েশা রা.-ই ছিলেন কুমারী, বাকি সবাই রাসূলের সঙ্গে বিবাহের পূর্বে অন্য স্বামী গ্রহণ করেছিলেন।

আয়েশা রা. বলেন, শুধু আমার ঘরে আমার চাদরের নিচে থাকাকালে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি ওহি নাযিল হয়েছে; অন্যকোনো স্ত্রীর ঘরে এমন হয়নি। একটি পাত্র থেকে পানি নিয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমার সঙ্গে গোসল করেছেন; অন্য স্ত্রীর সঙ্গে এভাবে গোসল করেন নি। আমার ঘরে আমার বুকের ওপর মাথা রেখে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পরলোকগমন করেছেন।৫

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন ইন্তেকাল করেন তখন হযরত আয়েশা রা.-এর বয়স আঠারো বছর। তাঁর দাম্পত্য জীবন ছিলো মাত্র নয় বছরের। এই নয় বছরে তিনি উচ্চ শিক্ষা ও অগাধ জ্ঞান অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। কুরআন, হাদিস, তাফসির ফিকাহ ও ফতোয়া তথা ইসলামি শিক্ষার সব বিভাগেই তাঁর অগাধ জ্ঞান ছিলো। হযরত আবু বকর রা., হযরত উমর রা. এবং হযরত উসমান রা.-এর খেলাফতকালে তিনি ফতোয়া প্রদান করতেন। নামকরা সাহাবিগণ যাঁরা দীর্ঘদিন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সান্নিধ্যে থেকে জ্ঞান অর্জন করেছিলেন তাঁরাও ভুল-ভ্রান্তির শিকার হলে হযরত আয়েশা রা.-এর কাছে এসে সংশোধন করে নিতেন। হযরত আয়েশা রা. কর্তৃক সংশোধিত বিষয়গুলো একত্র করে আল্লামা জালালুদ্দিন সুয়ুতি একটি গ্রন্থ প্রণয়ন করেছেন।৬

শরিয়ত-সংক্রান্ত কোনো সূক্ষ্ম ও জটিল সমস্যার সমাধান সম্ভব না হলে তৎকালীন বড় বড় আলেমগণ হযরত আয়েশা রা.-এর শরণাপন্ন হতেন। হযরত আবু মুসা আশআরি রা. বলেন, কোনো জটিল সমস্যা নিয়ে আলেমগণ হযরত আয়েশা রা.-এর কাছে উপস্থিত হলে সমাধানের যথার্থ জ্ঞান তাঁর কাছে পেতেন।৭

হাদিসের গ্রন্থগুলোতে হযরত আয়েশা রা. থেকে ২২১০ টি হাদিস বর্ণিত হয়েছে। কোনো কোনো আলেমের মতে শরিয়তের বিধানাবলির এক-চতুর্থাংশ হযরত আয়েশা রা. কর্তৃক বর্ণিত হয়েছে। যাঁরা শরিয়তের বিধি-বিধান বর্ণনা করেছেন তাঁদের সংখ্যা হাজার হাজার। যদি একা হযরত আয়েশা রা. থেকেই দীনের এক-চতুর্থাংশ বিধান বর্ণিত হয়ে থাকে তাহলে তাঁর জ্ঞানের গভীরতা ও প্রাচুর্য সহজেই উপলব্ধি করা যায়।

তিনি যে কেবল ধর্মজ্ঞানে অতুলনীয় ছিলেন, তা নয়। সাহিত্য, কবিতা, ইতিহাস, বংশ-তালিকার সূত্রপরম্পরা সম্পর্কেও তাঁর অগাধ জ্ঞান ছিলো। অন্ধকার-যুগের কবিদের সুদীর্ঘ কবিতাবলি তিনি মুখস্থ করে রেখেছিলেন। তৎকালীন বিশ্বে নারীদের মধ্যে তিনিই ছিলেন সবচেয়ে বিদুষী।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইন্তেকালের পর তিনি আটচল্লিশ বছর জীবিত ছিলেন। এই দীর্ঘসময় তিনি দীন প্রচার ও জ্ঞানচর্চায় অতিবাহিত করেছেন। তাঁর মত নারী জ্ঞানের আলোকবর্তিকা প্রজ্জ্বলিত না রাখলে মুসলিম জগতের একাংশ অন্ধকারে ডুবে থাকতো।

ছেষট্টি বছর বয়সে ৫৭ হিজরিতে হযরত আয়েশা রা. ইন্তেকাল করেন। এই সময়ে মারওয়ানের পক্ষ থেকে আবু হুরায়রা রা. মদীনার শাসনকর্তা ছিলেন। তিনিই হযরত আয়েশার জানাযা পড়ান। এরপর তাঁর অসিয়ত অনুযায়ী মদীনার জান্নাতুল বাকি কবরস্তানে রাতের বেলা তাঁকে দাফন করা হয়। কাসিম ইবনে মুহাম্মদ, আবদুল্লাহ ইবনে আবদুর রহমান, আবদুল্লাহ ইবনে আবু আতিক, উরওয়া ইবনে যুবায়ের এবং আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়ের তাঁকে কবরে নামান। প্রথমোক্ত দুইজন ছিলেন হয়রত আয়েশা রা.-এর ভাতিজা আর শেষোক্ত দুইজন ছিলেন তাঁর ভাগ্নে। আর আবদুল্লাহ ইবনে আতীক ছিলেন তাঁর ভাইয়ের নাতি।

কুরআন ও হাদিসের জ্ঞানচর্চা, দীনপ্রচার, চারিত্রিক গুণাবলি, বিচক্ষণতা ও দূরদর্শিতায় হযরত আয়েশা রা. ছিলেন অনন্য; তাঁর মত আর কেউ ছিলেন না। তিনি তাঁর জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে জ্ঞানচর্চা ও দীনের কল্যাণে কাজে লাগিয়ে আজো মুসলমানদেন হৃদয়ে ভাস্বর হয়ে আছেন। মুসলিম নারীদের জন্য তিনি চিরঅনুসরণীয়।

তত্বসূত্র :
১ সহিহুল মুসলিম, ২য় খণ্ড, পৃ. ২৮৫।
২ মাওলানা শিবলী নুমানী, সীরাতুন্নবী, মাতাবায়ে মাআরিফ, আযমগড়, ১৯৫২, পৃ. ৪০৬।
৩ মুহাম্মদ ইবনে সাআদ, আত্তাবাকাতুল কুব্রা, মাকতাবায়ে বেরেল, লিডেন, ১৩২২ হিজরি, ১ম খণ্ড, পৃ. ৪১।
৪ মাওলানা শিবলী নুমানী, সীরাতুন্নবী, মাতাবায়ে মাআরিফ, আযমগড়, ১৯৫২, পৃ. ৪০৬-৪০৭। বাংলাদেশের মানুষ মুর্হারমের চাঁদ, কার্তিক মাস, পৌষ মাস ইত্যাদি কিছু সময়কে অশুভ মনে করে থাকে। কিন্তু এসব ভিত্তিহীন ও অমূলক ধারণা।
৫ আল্লামা জালালুদ্দিন মুহাম্মদ ইবনে আহমদ আস্সুয়ুতি, আলখাসাইসুল কুবরা, মাকতাবা তিজারিয্যাতুল কুব্রা, মিসর, ১৩২২ হিজরি, ১ম খণ্ড, পৃ. ৮৮; ইবনুল কায়্যিম আলজাওযিয়্যা, যাদুল মাআদ, ১ম সংস্করণ, মিসর, ১৯২৮, ১ম খণ্ড, পৃ. ২৮।
৬ মাওলানা শিবলী নুমানী, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪০৭।
৭ মাওলানা আবদুর রউফ দানাপুরী, আসাহ্হুর সিয়ার, পৃ. ৫৭১।

গল্পের বিষয়:
ইসলামিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত