ক্রন্দসী প্রিয়া: ৬. বিয়ের প্রায় পাঁচ ছয় মাস পর

ক্রন্দসী প্রিয়া: ৬. বিয়ের প্রায় পাঁচ ছয় মাস পর

৬. বিয়ের প্রায় পাঁচ ছয় মাস পর

বিয়ের প্রায় পাঁচ ছয় মাস পর থেকে সেলিনা মাঝে মাঝে শহরের বড় বড় হোটেলে রুম ভাড়া করে ফোনে আমাকে হোটেলের নাম ও রুম নাম্বার দিয়ে যেতে বলত। আমি যদি বলতাম, কি দরকার ছিল এত টাকা খরচ করার, বাসায় তো কোনো অসুবিধে হচ্ছে না। সেলিনা উত্তর দিত আমার প্রিয়তম খামখেয়ালি, তাই আমিও খামখেয়ালিনি হয়েছি। প্রত্যেকটা প্রশ্নের উত্তর এমন দিত যে, আমাকে হার মানতে হত। কিন্তু হেরে গিয়েও খুব আনন্দ পেতাম।

হঠাৎ একদিন আমাকে জিজ্ঞেস করল, আপামনি কি আমাদের ব্যাপারটা কিছুই জানেন না?

আমি বললাম, না, তবে বিয়ের আগে তাকে একটা গল্প বলে তার মতামত জানতে চেয়েছিলাম। গল্পটা বলিছি শোন।

একটা পত্রিকায় একজন লেখক একটা গল্প লিখেছিলেন। গল্পের শেষ না করে পাঠকদের মাঝে প্রশ্ন করে বলেছিলেন, যে কেউ সঠিক উত্তর দিতে পারলে তাকে লেখক পাঁচশত টাকা পুরস্কার দেবেন। তোমার আপামনি বলল, আগে গল্পটা শোনা যাক, তারপর উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করা যাবে। আমি বলতে শুরু করলাম

এক ধনীর দুলালী দোকানের একজন গরীব কর্মাচারীর প্রেমে পড়ে যায়। একথা যখন মেয়েটা ছেলেটাকে জানায়, তখন ছেলেটা তাকে কোনো পাত্তাই দিল না। মেয়েটা কিন্তু নাছোড় বান্দা। পরে ছেলেটাও মেয়েটার রূপে ও গুণে মুগ্ধ হয়ে ধীরে ধীরে তার প্রেমে পড়ে যায়। কিন্তু ছেলেটার দিক থেকে দুটো বড় বাধা ছিল! প্রথমতঃ সে বিবাহিত ও দুই সন্তানের জনক। সে গরিব না হলেও বড়লোক নয় এবং সে তার স্ত্রীকে খুব ভালবাসে। অনেক চিন্তা ভাবনা করে একদিন ছেলেটা মেয়েটাকে নিজের পরিচয় দিয়ে তার প্রেমের পরীক্ষা নিল। আর মনে করল, মেয়েটা নিশ্চয় তার সত্য পরিচয় পেয়ে আপনা থেকে দূরে সরে যাবে। কিন্ত মেয়েটা তার পরিচয় শুনে বলল, তুমি যেই হও না কেন, আমি তোমাকে প্রাণ দিয়ে ভালবেসেছি। তোমাকে ছাড়া আমি অন্য কাউকে বিয়ে করতে পারব না। তুমি যদি আমাকে বিয়ে না কর, তবে আমি বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করব।

লেখক এবার গল্প শেষ করে প্রশ্ন করেছেন, আপনারই বলুন, ছেলেটার কি করা উচিত?

গল্পটা শুনে তোমার আপামনি বলল, দূর, ঐ সব আবার সত্য হয়। লেখকরা সব মাতাল। মদ খেয়ে মাতলামি করেছে।

আমি বললাম, তা না হয় লেখক মাতলামি করেছে, কিন্তু সত্যি সত্যিই কেউ যদি এই রকম পজিশনে পড়ে? তাহলে তার কি করা উচিত তুমি বল।

তোমার আপামনি বলল, ঐ ধরণের মেয়েরা কোনোদিন ভালো হয় না। তাছাড়া কোথাকার কে মেয়ে, সে আত্মহত্যা করুক বা আর যাই করুক, ছেলেটার তাকে বিয়ে করা উচিত নয়।

আমি বললাম, তোমার উত্তরটা আমি পত্রিকা অফিসে পাঠিয়ে দেব। এখন বুঝতে পারছ, একজন মেয়ে হয়েও স্বামীর ভাগ দিতে হবে বলে তোমার আপামনি ঐ মেয়েটিকে দূরে সরিয়ে মেরে ফেলতে চাইল। তারপর সেলিনাকে জিজ্ঞেস করলাম, তোমার আপামনি তো যাহোক একটা উত্তর দিল, এখন তুমি বলতো, এটার সঠিক উত্তর কি হবে?

সেলিনা কান্নাজড়িত স্বরে বলল, আমার ঘটনাটাই এর সঠিক উত্তর। এর বেশি কিছু আমি বলতে পারব না। আমাকে কোনোদিন আর এধরনের প্রশ্ন কর না? তুমি আমাকে এত বেশি প্রশ্ন কর কেন? ভয় হয় যদি প্রশ্নের উত্তর তোমার মনের মত না হয়, তাহলে হয়তো তুমি আমার উপর অসন্তুষ্ট হবে।

ঠিক আছে সখি ঠিক আছে, তোমাকে আর কোনোদিন প্রশ্ন করব না। কিন্তু বলতে পার এত পানি তোমার চোখে……. বলে চুপ করে গেলাম।

থামলে কেন? বল না।

বাক্যটা পুরো বললে তোমাকে প্রশ্ন করা হয়ে যাবে যে?

সেলিনা হেসে ফেলে বলল, সত্যি, আমি ভেবে আশ্চর্য হয়ে যাই, এত প্রশ্ন তোমার মনে আসে কোথা থেকে?

আমাকে প্রশ্ন করতে নিষেধ করে এখন থেকে তাহলে তুমি প্রশ্ন করতে শুরু করলে?

এই কথায় দুজনেই হেসে উঠলাম।

বিয়ের তিন বছর পর একদিন সেলিনা বলল, আমাকে কোনো লেডিজ গাইনীর কাছে চেকআপ করাবে?

রসিকতা করে ইংরেজীতে বললাম, বাট হোয়াই? এনিথিং রং?

বলতে যে লজ্জা করছে।

স্বামীর কাছে স্ত্রীর লজ্জা করতে নেই। তাছাড়া তোমার সব লজ্জাস্থানগুলো যখন আমার দখলে তখন লজ্জার কোনো কারণ নেই। যা বলার তাড়াতাড়ি বলে ফেল।

তুমি দিন দিন ভীষণ অসভ্য হয়ে যাচ্ছ।

সে জন্য তুমিই দায়ী। তোমার লজ্জাস্থানগুলো দিন দিন আমাকে অসভ্য করে তুলছে।

এ রকম অসভ্যতা করলে আমি বলব না, যাও দুষ্ট কোথাকার?

ঠিক আছে, আর অসভ্যতা করব না। এবার আসল কথাটা বল, নচেৎ শান্তি পাচ্ছি না।

এতদিন হয়ে গেল মা হচ্ছি না কেন?

ও তাই বল, তোমার কথা শুনে তো ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। সন্তানের জন্য এত তাড়াহুড়ো করছ কেন? মা হতে খুব সখ হচ্ছে বুঝি?

সন্তানের মা ডাক না শুনলে নারী জনম সার্থক হয় না।

মহারানীর আদেশ শীরধাৰ্য্য।

কয়েকদিন পর সেলিনাকে একজন লেডীজ গাইনী স্পেশালিষ্টের কাছে নিয়ে গেলাম।

উনি পরীক্ষা করে বললেন, আপনার স্ত্রী কোনোদিন সন্তানের মা হতে পারবেন। কারণ ওঁর সন্তান জন্মাবার ঘর নেই।

কথাটা শুনে সেলিনার দিকে চেয়ে দেখি, একদৃষ্টে আমার দিকে তাকিয়ে আছে, আর তার মুখটা সাদা হয়ে গেছে।

ব্যাপারটা বুঝতে পেরে ডাক্তার বললেন, মিসেস খান, আপনি এত নার্ভাস ফিল করছেন কেন? আল্লাহ আপনাকে সন্তান ধারণে অক্ষম করে পয়দা করেছেন। এখানে মানুষের কোনো হাত নেই।

ডাক্তারের কথায় সেলিনা সম্বিত ফিরে পেয়ে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, চল বাসায় চল।

বাসায় এসে তাকে বললাম, ডাক্তার খুব দামী কথা বলেছেন। আল্লাহপাক যা কিছু করেন বান্দাদের মঙ্গলের জন্যই করেন। যদিও সেগুলো আপাতঃদৃষ্টিতে খারাপ বলে মনে হয়। তার ইচ্ছার উপর বেজার হতে নেই। সব কিছুর উপর সন্তুষ্ট থাকা উচিত। আমি যখন এইসব বলছিলাম সেলিনা তখন আমার বুকে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল। আমি তার কান্না থামাবার জন্য মাথায় ও পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে বললাম, কেঁদো না, আল্লাহপাক নারাজ হবেন। আর একদিন না হয় মেডিকেলে এক্স-রে করে দেখব।

কান্না থামিয়ে সেলিনা বলল, বেশ তাই হবে।

মেডিকেলে এক্স-রে রিপোর্টেও তাই পাওয়া গেল। এবার সেলিনা কাঁদল না। কিন্তু এরপর থেকে খুব ধীর ও গম্ভীর হয়ে গেল। আগের মত চাঞ্চল্যভাব আর দেখা যেত না। তার পরিবর্তন দেখে আমি বেশ চিন্তিত হলাম। কেন কি জানি কেবলই মনে হত, সে কোনো কঠিন অসূখে পড়বে। তার চিন্তা দূর করার জন্য একদিন আদর করতে করতে বললাম, তোমার প্রেমিক তোমার কাছ থেকে আগের মত আর প্রেম পাচ্ছে না বলে অভিযোগ করছে।

কক্ষন তা হতে পারে না। এ তার ছলনাময় অভিযোগ! মৃত্যুর আগে পর্যন্ত আমি তাকে প্রেম দিয়ে যাব।তবে মাঝে মাঝে আমি খুব অন্যমনস্ক হয়ে পড়ি।এর কি কোনো প্রতিকার নেই?

আছে, তুমি মা হবার চিন্তা দূর করে দিয়ে সব সময় আল্লাহ ও রাসূলের (দঃ) কথা চিন্তা করবে। যখন তা ভালো লাগবে না তখন ধর্মীয় বই পড়বে। তাও যখন ভালো লাগবে না তখন আমার কথা ভাববে।

তোমার কথা ভাবলে যে সব সময় তোমাকে কাছে পেতে ইচ্ছা করে। সেই জন্য তো আল্লাহপাকের কাছে অন্ততঃ একটা সন্তান চেয়েছিলাম কিন্তু আমি এমনই হতভাগী যে, তাও আমার ভাগ্যে নেই।

বললাম, তোমার ধারণা ভুল। দুনিয়ার দিকে ভালো করে তাকালে দেখতে পাবে, তোমার চেয়ে অনেক বেশি ভাগ্যহীনা রয়েছে। তাকে চিন্তার থেকে বাঁচাবার জন্য মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে চরম অস্ত্র ব্যবহার করলাম। যদিও মনে হয়েছিল এর ফলে তার মনে প্রচন্ড আঘাত লাগবে। বললাম, তুমি যে সন্তান সন্তান করে এত মূষড়ে পড়ছ, আমি কিন্তু তোমার গর্ভে সন্তান আসুক এটা চাইনি। সেই জন্য বোধ হয় আল্লাহ তোমাকে বন্ধ্যা করে সৃষ্টি করেছেন। কথাগুলো বলে ফলাফলের জন্য তার মুখের দিকে চেয়ে রইলাম। মনে হল এক্ষুনি ভীষণ ঝড় উঠবে।

সেলিনা কয়েক সেকেণ্ড আমার দিকে তাকিয়ে থেকে জড়িয়ে ধরে পিঠে কয়েক ঘা কিল দিয়ে বলল, এই কথা এতদিন বলনি কেন? আগে বললে আমার আজ এই অবস্থা হত না। না জেনে তোমার মনে কত ব্যাথা দিয়েছি। মাফ করে দাও বলে বসে পড়ে আমার পা জড়িয়ে কাঁদতে লাগল।

প্রথমে আমি মনে করেছিলাম, যা বলে কাঁদছে সেটা ঠিক। কিন্তু পরক্ষণে বুঝতে পারলাম, আমি তার গর্ভে সন্তান চাই না জেনে মনে ভীষণ আঘাত পেয়েছে। তাকে তুলে নিয়ে সেদিন এত বেশি আদর করেছিলাম, যা ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না।

বিয়ের পর যখনই তার কাছে যেতাম তখনই প্রথমে আমার প্রথম স্ত্রী ও ছেলে মেয়ে কেমন আছে জিজ্ঞেস করত।

একদিন তাকে বললাম, আচ্ছা, আমি তোমার কাছে এলেই ওদের কথা জিজ্ঞেস কর কেন?

বলল, তারা যে তোমারই অংশ, তাইতো তাদের খবর জানতে ইচ্ছে করে।

বিয়ের চার বছর পর একদিন যখন সেলিনা বাসার খবর জানতে চাইল তখন ভুল করে বলে ফেললাম, গত পরশু একটা খোকা হয়েছে। সাতদিনে আকিকা করব।

খবরটা শুনে সেলিনা আমার হাত দুটো ধরে আঁশু ভরা চোখে বলল, আমাকে নিয়ে যাবে? ওদের সাবাইকে দেখার জন্য মন বড় ছটফট করে।

ভুল করে কথাটা বলে আমি যে অন্যায় করেছি, তা টের পেয়ে বললাম, যা পারব না তা জেনেও আমাকে করতে বল কেন? তোমার ইচ্ছা পুরণ করতে না পারলে মনে যে কি হয়, তাতো তোমার অজানা নয়।

আমার কথা শোনার পর সেলিনা রুমাল দিয়ে চোখ মুছে বলল, খোকার কি নাম রাখবে?

মুহাম্মাদ সায়ফুল্লাহ খান।

এই নামের অর্থ কি?

প্রশংসিত আল্লাহর তরবারী।

আমাকে যখন তুমি নিয়ে যেতে পারবে না তখন ঐদিন আমি একটা উপহার দেব নিয়ে যেও।

বেশ তো তাই দিও।

আকিকার আগের দিন সেলিনা নিউ মার্কেটে এসে আমার হাতে একটা বাক্স দিয়ে। বলল, খোকার জন্য। আর এই হতভাগীর দোয়া দিও বলে রুমালে চোখ মুছল।

রাত্রে বাসায় ফিরে স্ত্রীর হাতে বাক্সটা দিলাম।

সে বাক্সটা খুলল। দেখলাম, তাতে রয়েছে একজোড়া জামা প্যান্ট, একজোড়া জুতো আর একটা সোনার আংটি। আংটিতে মিনে করা সায়ফুল্লাহ নাম লেখা।

আরও এক বছর পর একদিন সেলিনা বলল, হয় আমাকে তোমার একটা ছেলে এনে দাও, নচেৎ আমাকে আপামণির কাছে এক সঙ্গে রাখার ব্যবস্থা কর। আমি আর নিঃসঙ্গ জীবন কাটাতে পারছি না।

এরকম কথা যে সে একদিন বলবে, সেটা আমি অনেক আগেই বুঝতে পেরেছিলাম। তাই এই পরিস্থিতির জন্য তৈরিও ছিলাম। রাগ না করে খুব নরম সুরে বললাম, মাথায় বুঝি পোকা ঢুকেছে? ঐ সব খেয়াল বাদ দাও। সেখানে গেলে আরও বেশি অশান্তি পাবে।

যতই অশান্তি পাই, আর যে পরিস্থিতির উদ্ভব হোক, আমি আপামনির পায়ে ধরে কাঁদব। বাদির মত তার ছেলেমেয়েদের সেবা যত্ন করব। প্রথম দিকে তিনি যতই লাঞ্ছনা গঞ্জনা দিক না কেন, আমার বিশ্বাস, ইনশা আল্লাহ একদিন না একদিন আমি তার মন জয় করতে পারবই।

আমি তার আগের মত একরোখা ভাব উদয় হতে দেখে বেশ চিন্তিত হলাম। সেদিন তাকে একটা সুখবর শোনাব মনে করে গিয়েছিলাম। সেই সুখবরটা এখানে কাজে লাগিয়ে তার মানষিক চিন্তা অন্যদিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য বললাম, আজ তোমাকে একটা সুখবর দেব। খবরটা শুনে আমাকে কি দেবে আগে বল।

তুমি যা পেলে সব থেকে বেশি খুশি হও তাই দেব।

আমি একটা ব্যাবসা করব। চাকরি গতকাল ছেড়ে দিয়েছি। বাসাও তাড়াতাড়ি চেঞ্জ করব। ব্যাবসা উপলক্ষে সারা বাংলাদেশ ঘুরতে হবে। আমার ইচ্ছা তোমাকে সঙ্গে নিয়ে সব জায়গায় যাব। ব্যাবসাও হবে আর তোমাকে নিয়ে বেড়ানও হবে। কি, খবরটা শুনে তুমি খুশী হওনি?

নিশ্চয় বলে সেলিনা প্রথমে আমাকে কিছুক্ষণ জড়িয়ে ধরে রইল। তারপর দুহাতে আমার মুখ ধরে চুমোয় চুমোয় ভরিয়ে দিয়ে বলল, আমার যে কি আনন্দ হচ্ছে, তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারছি না।

.

১৯৭৬ সালে আমি চাকরি ছেড়ে দিয়ে ব্যাবসা আরম্ভ করি। ব্যাবসার কাজে বাংলাদেশের সব জেলাতে আমাকে ঘুরতে হয়েছে। ঢাকাতে মাসের মধ্যে বড় জোর আট দশ দিন থাকতাম। সেলিনাও প্রায় সব সময় আমার সঙ্গে ট্রেনে, বাসে অথবা, প্লেনে করে গিয়েছে। যাবতীয় খরচ সেলিনাই বহন করত। আমার টাকা মোটেই খরচ করতে দিত না। যেখানে যা পছন্দ হয়েছে নিজের জন্য, আমার জন্য, তার আপামনি ও ছেলেমেয়েদের জন্য কিনেছে। আমি অনেকবার এতবেশি খরচ করতে নিষেধ করেছি। কিন্তু সে কোনো কথা শুনত না। বলত,খরচ করে একটু আনন্দ পাই, তাতে তুমি বাধা দিও না। তার মনে ব্যথা লাগবে ভেবে পরে আমি আর কিছু বলতাম না। একবার তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তুমি যে আমার সঙ্গে ঢাকার বাইরে বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছ, আম্মা কিছু বলেন না?

সেলিনা বলল, আসবার সময় শুধু আম্মাকে বলে আসি তোমার সঙ্গে যাচ্ছি। বিয়ের পর থেকে আম্মা আমার কোনো খবর বড় একটা রাখে না। জরিনাকেও আমার সঙ্গে কোথাও যেতে দেয় না।

সে জন্য তুমি মন খারাপ কর না। তোমার তো খোঁজ খবর নেওয়ার একজন লোক হয়েছে, তাই প্রয়োজন বোধ করেন না।

ব্যাবসা আরম্ভ করার পর, বছর খানেক বেশ কাটল। একদিন চট্টগ্রামে সফিনা হোটেলে তাকে রেখে ব্যাবসার কাজে বাইরে গিয়েছিলাম। ফিরে এসে দরজায় নক করতে খুলে দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে সেলিনা ফুঁপিয়ে উঠল।

আমি তাড়াতাড়ি দরজা লাগিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কি হয়েছে? কাঁদছো কেন?

সেলিনা বলল, পাশের রুমে স্বস্ত্রীক একজন ভদ্রলোক এসেছেন। তাদের সঙ্গে কি সুন্দর একটা তিনচার বছরের ছেলে রয়েছে। ছেলেটা যখন তার মাকে আম্মা বলে ডাকছিল তখন থেকে ঐ ডাক শোনার জন্য আমার মন ভীষণ উতলা হয়েছে। কিছু ভালো লাগছে না। চল অন্য কোনো হোটেলে যাই।

বললাম, বেশ তো এক্ষুনি সে ব্যবস্থা করছি। তারপর আমরা অন্য হোটেলে গিয়ে উঠলাম।

চট্টগ্রাম থেকে ফেরার কয়েকদিন পর সেলিনা বলল, তুমি বুদ্ধি করে কিছু একটা উপায় বের কর। যেভাবে হোক আমি আপামনি ও ছেলেমেয়েদের একবার দেখব।

কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললাম, তাদের সবাইকে নিয়ে এক দিন আমি পার্কে বেড়াতে যাব। তুমি লেকের ধারে সেই জায়গায় থাকবে। কিন্তু একটা কথা খুব খেয়াল রাখবে, এমন কথা বা এমন ব্যবহার আমার সঙ্গে করবে না, যাতে করে তোমার আপামনি বুঝতে পারে তোমার সঙ্গে আমার পরিচয় আছে। কারণ তোমার আপামনি ভীষণ চালাক।

সেলিনা আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে কয়েকটা কিস দিয়ে বলল, তোমার বুদ্ধির তারিফ করার ভাষা আমার নেই। তোমাকে আর বেশি কিছু বলতে হবে না। তুমি তোমার কর্তব্য ঠিক করবে আর আমার দিকটা আমি দেখব। তবে তুমি যদি তাদেরকে পৌঁছে দিয়ে কিছুক্ষণের জন্য সেখান থেকে চলে যাও, তাহলে খুব ভালো হয়।

আমিও তাকে আদর করে বললাম, সে দেখা যাবে।

সপ্তাহ খানেক পরে সেলিনার সঙ্গে কথাবার্তা ঠিক করে আমি স্ত্রী-ছেলেমেয়ে নিয়ে রমনা পার্কে একদিন বেড়াতে গেলাম। আমার বড় ছেলের বয়স তখন আট, মেয়ের পাঁচ, আর ছোট ছেলের দেড় বছর। বেড়াতে বেড়াতে নির্দিষ্ট জায়গার কাছাকাছি একটা ঢালাই করা বেঞ্চে সবাইকে নিয়ে কিছুক্ষণ বসলাম। তারপর বাদাম ভাজা কিনে এনে আমার স্ত্রীর হাতে দিয়ে বললাম, তুমি ছেলে মেয়েদের নিয়ে বাদাম খাও, আমি গেট থেকে একটু আসছি। এক বন্ধু ঠিক এই সময়ে আমার সঙ্গে দেখা করার জন্য গেটে আসবে বলে কথা দিয়েছে। বেশি দেরি করব না।

আমার স্ত্রী বলল, শিঘ্রী ফিরো কিন্তু। তুমি তো আবার বন্ধু পেলে দুনিয়ার সব কিছু ভুলে যাও।

ছেলেমেয়েদের দিকে খেয়াল রাখতে বলে আমি গেটের দিকে গিয়ে ঘুরে এসে কিছুটা দূরে আড়াল থেকে ওদের লক্ষ্য রাখলাম।

সেলিনা লেকের ধারে নির্দিষ্ট জায়গায় আগের থেকে ড্রাইভার দাদুর সঙ্গে বসে গল্প করছিল। আমি চলে আসার দুতিন মিনিট পর উঠে গিয়ে আমার স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে লাগল। তারপর ভ্যানিটি ব্যাগ খুলে ছেলেমেয়েদের হাতে কি যেন দিল, আর ওদের খুব আদর করল। কিছুক্ষণ গল্প করার পর ড্রাইভার দাদুকে ডেকে বেঞ্চে বসিয়ে তাকে কিছু বলে সবাইকে নিয়ে গেটের দিকে গেল। ওরা চলে যাওয়ার পর আমি দাদুর কাছে এসে জিজ্ঞেস করলাম, কি ব্যাপার? সব গেল কোথায়?

দাদু বললেন, দুজনে বোন সম্পর্ক পাতিয়েছে। সম্পর্কটা পাকা করার জন্য কোথায় যেন গেল। আপনাকে এখানে অপেক্ষা করতে বলেছে। আচ্ছা দুলাভাই, ইনিই বুঝি বড় আপা?

বললাম, ঠিক বলেছেন।

দাদু আবার বলেন, প্রথম দিকে আপনার উপর আমার খুব রাগ ছিল। কিন্তু যতই আপনাকে দেখছি ততই আমিও ভালবেসে ফেলছি। বড় আপা কি এ সব বিষয় কিছুই জানেন না?

না দাদু, জানলে আমরা তিনজনে অশান্তির আগুনে পুড়ে ছারখার হয়ে যাব। তাই প্রতিজ্ঞা করেছি, সারা জীবন তার কাছে গোপন রাখব। শুধু আপনার খুকি ভাইকে বড় ভয় হয়। কি জানি আনন্দের মধ্যে যদি কিছু বলে বা করে বসে, তাহলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। প্রায় একঘন্টা পর তারা ফিরে এল। দেখলাম, সেলিনার হাতে কাপড়ের ও মিষ্টির বাক্স। এসেই সেলিনা আমাকে আস-সালামু আলায়কুম দিয়ে বলল, কি দুলা ভাই, কেমন আছেন?

আমি কোনো রকমে ওয়া আলায়কুম আসসালাম বলে অবাক হয়ে তার দিকে চেয়ে রইলাম।

আমার অবস্থা দেখে সেলিনা ড্রাইভার দাদুকে বলল, আপনি ওঁকে সব কিছু খুলে বলেন নি?

হাসি চেপে রেখে দাদু গাম্ভির্যের সঙ্গে বললেন, বলেছি তো?

প্রথমটা আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হলেও দাদুর উত্তর শুনে বললাম, হ্যাঁ, হ্যাঁ, উনি আপনাদের সম্পর্কের কথা বলেছেন। এখন সন্ধ্যে হয়ে আসছে, আজ তা হলে আসি?

সেলিনা বলল, দাদু, চলুন আপামনিদের বাসায় গিয়ে মেহমানি করে আসি।

তার কথা শুনে চিন্তায় পড়ে গেলাম। ভেবেছিলাম, ওদেরকে পেয়ে একট বাড়াবাড়ি করবে। কিন্তু বাসায় যেতে চাইবে এতটা ধারণা করিনি। খুব ভয় হতে লাগল। যদি বেতালে কিছু করে বসে, তাহলে সামাল দেওয়া মুস্কিল হয়ে পড়বে।

আমাকে চিন্তিত দেখে সেলিনা বলে উঠল, কি দুলাভাই, আমি আপনাদের বাসায় যেতে চাইলাম, আর আপনি চুপ করে আছেন। ভয় পেলেন নাকি?

আমি মুখে হাসি ফুটিয়ে বললাম, এটা তো খুব আনন্দের কথা। ছোট বোন বড় বোনের বাসায় যাবে তাতে দুলাভাই ভয় পাবে কেন? বরং খুশীই হবে! তারপর সবাই গাড়িতে করে বাসায় ফিরলাম।

বাসায় এসে মাগরিবের নামায পড়ে আমাদের পোষা মোরগটা জবাই করে স্ত্রীকে বললাম, বিরানী রান্না কর।

সেলিনা কথাটা শুনতে পেয়ে বলল, না আপা, বিরানী খেতে ভালো লাগে না। তুমি বরং জর্দা পোলাও আর গোস্ত আলাদা রান্না কর। এখন থেকে বলে রাখছি, এবার থেকে মাঝে মাঝে আমি আসব। কিন্তু আমার জন্য আলাদা কিছু রান্না। করতে পারবে না, যা হবে তাই খাব। যদি কিছু কর, তবে না খেয়েই চলে যাব।

আমার স্ত্রী বলল, ঠিক আছে ভাই, তাই হবে। খাওয়া দাওয়া শেষ করে রাত দশটায় বিদায় নেওয়ার সময় সেলিনা বলল, আজ আমি আমার ঠিকানা দিয়ে গেলাম না। একদিন এসে সবাইকে নিয়ে যাব।

আমার স্ত্রী বলল, এবার আসার সময় দুলামিয়াকে সঙ্গে করে নিয়ে আসবে।

আচ্ছা বলে সালাম দিয়ে আল্লাহ হাফেজ বলে সেলিনা গাড়িতে উঠল।

ওরা চলে যাওয়ার পর আমি স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলাম, কি ব্যাপার বলত? অমন বড়লোক বোন জোগাড় করলে কি করে?

সে এক আশ্চর্য ঘটনা।

কি আশ্চর্য ঘটনা খুলেই বল না; মেয়েটার ব্যবহার দেখে মনে হল সত্যিই তোমরা যেন মায়ের পেটের বোন।

ঘটনাটা পুরো বলছি শোন

আমাদেরকে পার্কে রেখে তুমি চলে যাওয়ার পর আমি ছেলেমেয়েদের নিয়ে বাদাম খাচ্ছিলাম। এই মেয়েটাকে ঐ ড্রাইভারের সঙ্গে কিছু দূরে লেকের ধারে বসে গল্প করতে দেখলাম। একটু পরে মেয়েটা ধীরে ধীরে আমাদের কাছে এসে আমাকে সালাম দিয়ে আমার মুখের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রইল?

আমি সালামের জওয়াব দিয়ে বললাম, আপনাকে তো চিনতে পারছি না বোন?

আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে সায়ফুল্লাকে কোলে নিয়ে খুব আদর করল। তারপর সব ছেলেমেয়েদের হাতে টফি দিয়ে একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বলল, এই হতভাগীকে চিনে আর কি করবেন? তবে আপনি যখন আমাকে বোন বলে ডেকেছেন, যদি বিরক্ত না হন তাহলে পরিচয় দিয়ে কিছুক্ষণ আপনার সঙ্গে আলাপ করতে চাই।

ওকে দেখে খুব বড় লোকের বৌ বলে মনে হয়েছিল। বললাম বিরক্ত হব কেন? বসুন।

মেয়েটা আমার পাশে বসে বলল, আমার নাম সেলিনা খানম। ঠিক আপনার মতো আমারও একটা আপা আছে। কিন্তু আমার এমনই দুর্ভাগ্য যে, আমি তার সঙ্গে দেখা করতে পারিনি। কারণ আমি ভালবাসা করে বিয়ে করেছি বলে আমার সব আত্মীয় স্বজন আমাকে দেখতে পারে না। এমন কি আম্মা পর্যন্ত কোনো খোঁজ খবর নেয় না।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, আপনার আব্বাও কি কোনো খবর নেন না?

উনি আমার বিয়ের আগে মারা গেছেন।

আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, আপনার স্বামী কি করেন? কোথায় থাকেন? আর ঐ বুড়ো লোকটাই বা কে?

আমার স্বামী ব্যবসা করেন। উনি ঢাকাতেই থাকেন! বুড়ো লোকটা আব্বার দূর সম্পর্কের চাচা হন। আমরা দাদু বলে ডাকি। উনি আমাদের গাড়ি চালান আর গার্জেনের মতো দেখাশোনা করেন।

আপনি স্বামীর বাড়িতে থাকেন না?

আমার স্বামী দ্বিতীয়বার আমাকে বিয়ে করছেন। উনি প্রথম স্ত্রীকে খুব ভালবাসেন। তার মনে কষ্ট হবে বলে আমাকে নিয়ে যান না। আমি আমার মায়ের। কাছেই থাকি।

সেলিনাকে আমার সঙ্গে কথা বলার সময় ছেলেমেয়েদেরকে খুব আদর করতে দেখে বললাম, কতদিন আপনাদের বিয়ে হয়েছে? ছেলে মেয়ে হয় নি?

সেলিনা কিছুক্ষণ নিচের দিকে চেয়ে চোখের পানি মুছে বলল, আমি সে ভাগ্য নিয়ে জন্মায়নি আপা। আজ প্রায় পাঁচ বছর আমাদের বিয়ে হয়েছে। এতদিনে যখন আমার ছেলেমেয়ে হল না। তখন আমার স্বামী মেডিকেলে চেক-আপ করিয়েছেন। ডাক্তাররা বলেছেন, আমার সন্তান ধারণের ক্ষমতা নেই। তারপর সায়ফুল্লাহকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল, আল্লাহপাক যদি শুধু এই রকম একটা ছেলে আমাকে দিত, তাহলে মেয়ে জনম সার্থক হত। আমি জীবনে কোনোদিন মা ডাক শুনতে পাব না মনে হলে বুক ফেটে যায় বলে ঝর ঝুর করে কেঁদে ফেলল।

তার কথা শুনে আমার খুব দুঃখ হল। ভাবলাম, ওরা কত বড় লোক, আর মেয়েটা দেখতেও সুন্দরী। কিন্তু সন্তান না হওয়ায় কত অশান্তিতে আছে। তাকে সান্তনা দেওয়ার জন্য বললাম, কি করবেন বোন? সবই আল্লাহর ইচ্ছা। তাঁর মর্জি ছাড়া কোনো কিছু হয় না।

সেলিনা লেকের পানিতে চোখ মুখ ধুয়ে এসে বলল, আপনি যদি ছোট বোন বলে স্বীকৃতি দেন, তাহলে আমি আপনাকে এখন থেকে আপামণি বলে ডাকব। আর আপনার সঙ্গে নিজের বড় বোনের মত কুটুম্বীত করব।

ওর সব কিছু শুনে আমার খুব মায়া হল। বললাম, আমারও কোনো বোন নেই। আপনি আমার ছোট বোন হলে আমিও খুব খুশী হব।

সেলিনা আমার দুটো হাত ধরে চুমো খেয়ে বলল, সত্যি বলছেন?

আমি বললাম সত্যি বলছি।

তখন সেলিনা আবার বলল, তাহলে আমরা আর আপনি করে সম্বোধন করব। ওটাতে দূরের সম্পর্ক বোঝায়। এখন থেকে তুমি আমার নাম ধরে ডাকাবে। আর আমি তোমাকে আপামনি বলে ডাকব।

সেলিনার কথায় যেন যাদু আছে। তার সরল ব্যবহারে আমি খুশী হয়ে বললাম, তাই হবে।

তাহলে চল সম্পর্কটা পাকা করে ফেলি।

কোথায় আবার যাব? আমার স্বামী এক্ষুনি এসে আমাদের খোঁজ করবেন।

সে ব্যবস্থা আমি করছি বলে ড্রাইভারকে ডেকে তার কাছ থেকে গাড়ির চাবি নিয়ে বলল, আজ থেকে আপনার আর একটা বোন বাড়ল। সম্পর্কটা পাকাপোক্ত করার জন্য আমি সবাইকে নিয়ে যাচ্ছি। আপনি এখানে বসুন। লক্ষ্য রাখবেন, একজন ভদ্রলোক এসে এদের খোঁজ করলে সব কথা বলে এখানে বসিয়ে গল্প করবেন। কিছুক্ষণের মধ্যে আমরা ফিরে আসব। তারপর সায়ফুল্লাহকে বুকে তুলে আমাদের সবাইকে নিয়ে নিজে গাড়ি চালিয়ে নিউমার্কেটে এসে প্রথমে মিষ্টি খাওয়াল। তারপর সকলের জন্য কাপড় ও মিষ্টি কিনে পার্কে নিয়ে এল। তার পরের ঘটনা তুমি তো জান।

আমি বললাম, যাই হোক, কাপড় নেওয়া তোমার উচিত হয় নি।

আমার স্ত্রী বলল, আমি অনেক আপত্তি করেছি। কিন্তু সেলিনা শুনেনি। বলল, আমি তোমর ছোট বোন। আপামণিদের ছোট বোনদের অনেক অন্যায় আবদার সহ্য করতে হয়। এই সব করে যদি আমি একটু শান্তি পাই, তাতে তুমি বাধা দিও না আপা। এই কথা বলে চোখ মুছল। এত সামান্য কথাতে তার চোখে পানি দেখে মেয়েটাকে সত্যিই খুব দুঃখী মনে হওয়ায় আর আপত্তি করতে পরিনি।

.

এই ঘটনার পর সেলিনা প্রায় বলত, আবার কবে তোমার বাসায় যাব অথবা তাদেরকে আমাদের বাসায় করে নিয়ে আসবে? এখন নয় পরে বলে আমি কাটিয়ে দিতাম।

চাকরি ছেড়ে ব্যাবসা আরম্ভ করার পর কমলাপুরে বাসা ভাড়া নিই। সেলিনাকে বাসার কাছে একজন ডাক্তারের ফোন নাম্বার দিয়ে বলেছিলাম, দরকার হলে এই নাম্বারে ফোন করবে। ডাক্তার সাহেব আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। একদিন দাদুও সেলিনাকে নিয়ে এসে ডাক্তারের সঙ্গে পরিচয় করিয়েও দিয়েছিলাম। আর বলেছিলাম, কোনো ইমারজেন্সী খবর থাকলে ফোনে অথবা দাদু এসে ডাক্তারকে জানাবেন। ডাক্তার আমারও সেলিনার ব্যাপাটা আগের থেকে জানতেন।

ব্যাবসার কাজে চিঠি পেয়ে হঠাৎ করে আমাকে সিলেট যেতে হয়। ফিরতে কয়েকদিন দেরি হয়েছিল। সেলিনার সঙ্গে দেখা করে যেতে পারিনি। তবে ফোনে সে কথা জানিয়ে ছিলাম। যেদিন ফিরে আসি, সেদিন রাত্রি আটটায় ডাক্তারের সঙ্গে দেখা হতে বললেন, ড্রাইভার গত পরশু এসেছিল। সেলিনা ভাবি এ্যাকসিডেন্ট করে মেডিকেলে আছে। অবস্থা খুব খারাপ। আমি গতকাল গিয়ে দেখে এসেছি। এই নিন ওয়ার্ড ও বেড নাম্বার।

সংবাদটা আমাকে বিদ্যুৎ পৃষ্টের মত সর্ট করল। বেশ কিছুক্ষণ কথা বলতে পারলাম না।

ডাক্তার আমার অবস্থা বুঝতে পেরে বললেন, এত ঘাবড়ে যাচ্ছেন কেন? আল্লাহপাকের রহমতে ভাবি ভালো হয়ে যাবেন। নিন ধরুন বলে ঠিকানা লেখা কাগজটা আমার হাতে গুঁজে দিলেন।

আমি কাগজটা নিয়ে লুংগি ও পাঞ্জাবীপরা অবস্থায় একটা রিক্সায় উঠে মেডিকেলে গিয়ে পৌঁলাম। স্পেশাল পাশ বের করে সেলিনার ওয়ার্ডে গিয়ে দেখলাম, শুধু নাক, মুখ ও হাত ছাড়া তার সমস্ত শরীর ও মাথা প্লাষ্টার করা। তখনও জ্ঞান ফিরেনি। এই দৃশ্য দেখে নিজেকে সামলাতে পারলাম না। চোখ দুটো অশ্রুতে ভরে উঠল।

বেডের পাশে জরিনা ও আম্মা ছিল। জরিনা আমাকে দেখতে পেয়ে কেঁদে ফেলে বলল, আপা গত পরশু এ্যাকসিডেন্ট করেছে। আজ পর্যন্ত জ্ঞান ফিরেনি। প্রচুর রক্ত গেছে। আপাকে বাচাতে হলে আরো অনেক রক্তের দরকার। ব্লাড ব্যাংকে রক্ত নেই। মাত্র দুবোতল পাওয়া গেছে। ডাক্তার বলেছে কালকের মধ্যে রক্ত জোগাড় না হলে আপাকে বাঁচান যাবে না।

আমি রুমালে চোখ মুছে জিজ্ঞেস করলাম, এ্যাকসিডেন্ট হল কি করে?

জরিনা বলল, আমি ও আম্মা গাড়ি নিয়ে গুলশান গিয়েছিলাম। আপা বাড়িতেই ছিল। হঠাৎ ফোন পেলাম আমাদের আয়া বলছে, মেডিকেল থেকে ফোন এসেছে আপা এ্যাকসিডেন্ড করে সেখানে আছে। আমরা তাড়াতাড়ি করে ইমারজেন্সিতে খোঁজ নিয়ে আপার কাছে আসি? ডাক্তারের কাছে জানতে পারলাম, মালিবাগের মোড়ে একটা ট্রাক, আপা যে রিক্সায় ছিল সেটাকে পিছন থেকে ধাক্কা দেয়। আপা রিক্সা থেকে ছিটকে রাস্তায় পড়ে যাওয়ার পর একটা প্রাইভেট কার আপার উপর দিয়ে চলে যায়। এইসব কথা ডাক্তার রিক্সাওয়ালার কাছ থেকে শুনেছেন। তাকেও মেডিকেলে আনা হয়েছিল। সে অল্প আঘাত পাওয়ায় প্রাথমিক চিকিৎসার পর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। আজ কেবিনের ব্যবস্থা করা গেছে। আপাকে এক্ষুনি কেবিনে নিয়ে যাওয়া হবে। ডাক্তার সেই ব্যবস্থা করতে গেছেন।

এমন সময় একজন ডাক্তার দুজন নার্সসহ এসে ট্রলিতে করে সেলিনাকে কেবিনে নিয়ে গেল।

আমি ডাক্তারকে পরিচয় দিয়ে বললাম, আমরা রক্ত পাব কোথায়? তার চেয়ে আমার রক্ত টেষ্ট করে দেখুন, চলবে কি না?

ডাক্তার যখন আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন তখন জরিনা ও আম্মা আমাদের সাথে এল। যেতে যেতে আমি ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করলাম সেলিনা বাচবে তো?

ডাক্তার বললেন, কিছুই বলা যাচ্ছে না। মাথায় ও পেটে ভীষণ আঘাত পেয়েছেন। আমাদের কর্তব্য আমরা করছি। এরপর উপরের মালিকের উপর নির্ভর করুণ। সি ইজ সিরিয়াসলি উনডেড।

আমার দেখাদেখি জরিনা ও আম্মা টেষ্ট করার রক্ত দিল। ঘন্টা খানেক পরে রিপোর্ট এল আমাদের কারুর রক্ত সেলিনার রক্তের গ্রুপের সঙ্গে মিলছে না। রাত্রি বারটা পর্যন্ত থেকে বাসায় ফিরে সেলিনার এ্যাকসিডেন্টের ও রক্তের কথা আমার স্ত্রীকে বললাম।

সব শুনে আমার স্ত্রী বলল, মেয়েটি খুব ভালো। একদিনের পরিচয়ে আমাকে ঠিক আপন বোনের মত করে নিয়েছে। তুমি আমাকে কাল সকালে নিয়ে যাবে। আমার রক্ত যদি তার গ্রুপের সঙ্গে মিলে যায়, তবে তাকে আমি রক্ত দিয়ে বাঁচাব।

বললাম, বড় বোনের মত কথা বলেছ!

পরের দিন সকালে তাকে নিয়ে মেডিকেলে গেলাম। কেবিনে ঢুকে দেখলাম, আমার শাশুড়ী রয়েছেন। আমি আমার স্ত্রীকে বললাম, সেলিনার আম্মা। আমার স্ত্রী সালাম দিয়ে বেডের কাছে এগিয়ে গেল। সেলিনাকে দেখে কেঁদে ফেলল। জিজ্ঞেস করল বাঁচবে তো?

আমার চোখেও পানি এসে গিয়েছিল। সামলে নিয় বললাম, আল্লাহপাকের দরবারে দোয়া কর। তিনি যেন ওকে সুস্থ করে দেন। আল্লাহ তায়ালার কি শান। আমার স্ত্রীর রক্ত টেষ্ট করে ডাক্তার বললেন, সেম গ্রুপ, চলবে। রক্ত দেওয়ার পর তাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে এলাম।

আমার প্রথম স্ত্রীকে দেখে আমার শাশুড়ীর চেহারায় বিরক্ত ও রাগের চিহ্ন ফুটে উঠতে দেখলাম। তার পরের ঘটনা দেখে তিনি খুব আশ্চর্য হয়ে ভয়ার্ত স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, সেলিনা বাচবে তো বাবা?

এই পাঁচ বছরের মধ্যে আজ প্রথম উনি আমার সঙ্গে কথা বললেন। বললাম, আপনি দোয়া করুন, আল্লাহপাক সন্তানদের প্রতি মায়ের দোয়া কবুল করে থাকেন।

সারাদিন সেলিনার কাছে থাকতাম। রাত্রি বারটার দিকে বাসায় ফিরতাম। স্ত্রী জিজ্ঞেস করলে বলতাম, ব্যাবসার কাজে ব্যস্ত থাকি, আসবার সময় সেলিনাকে দেখে এলাম আজও জ্ঞান ফিরেনি।

সাতদিন পর সেলিনার জ্ঞান ফিরল। কিন্তু ভালো করে কথা বলতে পারল না। জ্ঞান ফিরে পাওয়ার দুদিন পর আমাকে কাছ বসতে বলল। আমি তার কাছে বসে মাথায় হাত রাখলাম।

কিছুক্ষণ আমার দিকে চেয়ে থেকে বলল, জান, আমার প্রেম আমাকে বলছে, আমি আর বাঁচব না, যা কিছু বলার তোমার প্রেমিককে শিঘ্রী বলে ফেল। কথা বলার সময় তার চোখ থেকে পানি গড়িয়ে বালিশ ভিজে যাচ্ছিল।

আমিও কান্না রোধ করতে পারলাম না। প্রথমে নিজের তারপর তার চোখ মুছে দিয়ে তার ঠোঁটে একটা আংগুল রেখে বললাম, তুমি এ রকম কথা বলো না, আমি সহ্য করতে পারছি না। প্রেমিকাকে হারিয়ে প্রেমিক কি করে বাঁচবে?

সেলিনা আমার আংগুল সরিয়ে দিয়ে বলল, আমি তোমার কাছে যা কিছু অন্যায় করেছি মাফ করে দাও। আমি মরে গেলে আমার জন্য দোয়া করো। আর যত শীঘ্র পার আপামনি ও ছেলেমেয়েদের নিয়ে এস, শেষ দেখা একবার দেখব।

আমার চোখ দিয়ে তখনও পানি পড়ছিল। বললাম, তোমার আপামণি তোমাকে দু-তিন দিন এসে দেখে গেছে। রক্ত পাওয়া যায়নি বলে সে তোমাকে নিজের রক্ত দিয়েছে। অবশ্য তখন তোমার জ্ঞান ছিল না। আমি কালকেই তাদেরকে নিয়ে আসব।

এমন সময় নার্স এসে আমাকে দূরে ডেকে নিয়ে গিয়ে বললেন, ওঁকে বেশি কথা বলাবেন না। ওঁর শরীর খুব দুর্বল, কোনো কারণে উত্তেজিত হলে হার্টফেল করবেন। সেজন্য ডাক্তার মাঝে মাঝে ইনজেকসান দিয়ে অজ্ঞান করে রাখতে বলছেন।

আমি সেলিনার কাছে ফিরে এসে কথা বলতে নিষেধ করলাম। আর উত্তেজিত না হওয়ার জন্য অনেক বোঝালাম।

আমার কথা শুনল না। বলল, আমাকে কিছু কথা বলতেই হবে, পরে আর সময় পাব না। তুমি মেজ মামাকে দিয়ে কালকের মধ্যে একটা উইল করে নিয়ে আসবে, আমি সিগনেচার করে দেব। উল্লেখ থাকবে আমার ব্যাংকের সমস্ত টাকা আমি স্বেচ্ছায় আমার স্বামীকে সত্ত্বাধিকারী করলাম।

বললাম, তুমি থাকবে না আর আমি তোমার টাকা ভোগ করব, তা কখনও আমার দ্বারা হবে না। তার চেয়ে তোমার পরকালের ভালোর জন্য আমি ঐ টাকা খরচ করতে চাই।

না, তোমাকে আমার সবকিছু নিতে হবে। নচেৎ আমি মরে গিয়েও শান্তি পাব না। তুমি নিজে টাকাটা ভোগ করলে আমি বেশি শান্তি পাব।

তাকে শান্ত করার জন্য বললাম, প্রেমিক তার প্রেমিকার জন্য যদি ঐ টাকা দিয়ে কিছু করে, তাহলে তো আর তোমার তাতে কোনো আপত্তি নেই?

দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে সেলিনা বলল, প্রেমিক যা ভাল বুঝবে করবে তাতে আমার কোনো আপত্তি নেই।

নার্সের গলার শব্দ পেয়ে পিছন ফিরে দেখি জরিনা ও আম্মা আমার পিছনে দাঁড়য়ে আছে। মনে হল, আমাদের সব কথা ওঁরা শুনেছেন।

নার্স সেলিনাকে ইনজেকসান দিয়ে চলে গেল। কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যে ও ঘুমিয়ে পড়ল। জরিনাকে ওর কাছে থাকতে বলে আমি হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে কোর্টে মেজ মামার কাছে গিয়ে আমারও সেলিনার মতামত বললাম।

মামা বললেন, এত তাড়াহুড়ো কিসের? সেলিনা তো বেঁচে যেতেও পারে?

আমি বললাম, আল্লাহপাক যেন তাই করেন। কিন্তু সেলিনা এটা আগামী কাল করে নিয়ে যাওয়ার জন্য খুব পিড়াপিড়ী করেছে। প্রথম উইলটা সেলিনার মতে করবেন। দ্বিতীয়টা যে করবেন তাতে উল্লেখ থাকবে, আমি আমার স্ত্রীর সবকিছুর সত্ত্বাধিকারী হওয়ার পর তারই সম্মুখে তার পরকালের মুক্তির জন্য মেডিকেলের পুওরফান্ডে সব কিছু দান করে দিলাম।

পরদিন সকাল আটটায় সেলিনার কেবিনে গিয়ে দেখি, মামা এবং আরও দুতিনজন উকিল বসে আছেন। আমি আসবার তিন চার মিনিট পর জরিনা ও আম্মা এলেন। সেলিনা নীরবে সকলকে লক্ষ্য করছিল। আমি সেলিনার কাছে গিয়ে বললাম, মামা তোমার কথামতো উইল করে এনেছেন, তুমি সিগনেচার করার পর ওঁরা সাক্ষী হিসাবে সিগনেচার করবেন।

সেলিনা আমার দিকে তাকিয়ে উইলটা পড়তে বলল। মামা পড়তে লাগলেন

আমি (সেলিনা খানম), পিতা মরহুম মঈনুল ইসলাম চৌধুরী, ঠিকানা……….. আমার মৃত্যুর পূর্বে আমার স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি এবং ব্যাংকের সমস্ত টাকা স্বজ্ঞানে খুশীর সঙ্গে আমার স্বামী (…) কে স্বত্বাধিকারী করে গেলাম। ভবিষ্যতে আমার কোনো অংশীদার ঐসব সম্পত্তিতে কোনো রকম দাবি করলে আইনতঃ তাহা আগ্রাহ্য হবে।

এরপর মামা দ্বিতীয় ইউলটাও পড়লেন।

সব শুনে সেলিনা মৃদু হেসে বলল, পরের উইলটা যে তুমি এভাবে করবে, তা আমি জানতাম। তবে টাকাটা তুমি নিজে ভোগ করলে, আমি বেশি শান্তি পেতাম।

আমি বললাম, তুমি নিজের দিকটা শুধু দেখলে, আমার দিকটা দেখবে না?

কয়েক সেকেণ্ড সেলিনা কি যেন চিন্তা করল। তারপর বলল, তোমার মতই আমার মত। তারপর মামাকে উদ্দেশ্য করে বলল, আমি সিগনেসার করতে পারব না। আপনি আমার হয়ে করে দিন।

তার সম্মতি পাওয়ার পর আমরা সকলে সিগনেচার করলাম।

কিছুক্ষণ পর সেলিনা মামাদের চলে যেতে বলল। ওরা চলে যাওয়ার পর আম্মাকে ডেকে বলল, আমি তোমার অবাধ্য মেয়ে। তোমার কথা না শুনে অনেক কষ্ট দিয়েছি। জীবিত কালে মাফ না করলেও আমার মরণের পর তুমি আমাকে মাফ করে দিও। পারলে তোমার জামাইকেও মাফ করে দিও। ওর কোন দোষ নেই, সব দোষ আমার। তারপর জরিনার দিকে চেয়ে বলল, তুই যেন আমার মতো আম্মার মতের বিরুদ্ধে কিছু করে তার মনে কষ্ট দিসনি।

তখন সকলের চোখ দিয়ে পানি পড়ছিল।

আমার শাশুড়ী ডুকরে কেঁদে উঠলেন। একটু সামলে নিয়ে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বললেন, আমি তোদেরকে মাফ করে দিয়েছি মা। তোদের দুজনকে বুঝতে অনেক দেরি করে ফেলেছি, তোরা আমাকে মাফ করে দে।

সেলিনার মুখে বিজয়িনীর মতো হাসি ফুটে উঠল। আমাকে বলল, তুমি আমার হয়ে মাকে কদমবুসি কর।

আমি ওঁর পায়ে হাত দিয়ে সালাম করতে উনি মাথায় ও চিবুকে হাত বুলিয়ে ভিজে গলায় বললেন, থাক বাবা থাক, আমাকে আর বেশি অপরাধী কর না, এমনিতেই এতদিন তোমাদের প্রতি যা অন্যায় করেছি, তা যেন আল্লাহ মাফ করেন।

সেলিনা আমাকে ডেকে বলল, আজ তুমি আমাকে ছেড়ে কোথাও যেও না। শুধু আপামণি ও ছেলেমেয়েদেরকে এক্ষুনি গিয়ে নিয়ে এস। শেষ বারের মতো আপামণির সঙ্গে দুএকটা কথা বলতে চাই।

আমার মনে হল ও বুঝি আর বাচবে না। আম্মা ও জরিনাকে তার কাছে থাকতে বলে বাসায় গিয়ে তাড়াতাড়ি করে সবাইকে নিয়ে এসে দেখলাম, আম্মা ও জরিনা তার দুপাশে বসে আছে, সেলিনার চোখ বন্ধ।

আমি বললাম, তোমার আপামণি এসেছে।

জরিনা সরে বসলে আমার স্ত্রী সেলিনার কাছে বসল।

সেলিনা চোখ খুলে প্রথমে সকলকে দেখল, তারপর আমার স্ত্রীর একটা হাত ধরে বলল, আপামণি, তুমি তোমার রক্ত দিয়ে বাঁচিয়ে আমাকে চিরঋণী করে রাখলে। এই ঋণ শোধ করার সুযোগ আমাকে আল্লাহপাক দিলেন না। যদি ইসলামে জায়েজ থাকত, তাহলে মরণের পর আমার গায়ের চামড়া দিয়ে তোমার জুতো তৈরি করে দিতে ওসিয়ত করতাম। আমি তোমার কাছে অনেক বড় অন্যায় করেছি। যা কোনো মেয়ে অন্য মেয়েকে ক্ষমা করতে পারে না। তোমার স্বামীকে এ ব্যাপারে কোনোদিন কোনো কিছু বলো না। উনি মানুষ হয়েও ফেরেস্তার মত চরিত্রবান। আমি ওঁকে প্রেমের যাদু দ্বারা পাঁচ বছর আগে বিয়ে করেছি। অনেকবার বহু অনুনয় বিনয় করেছি তোমার সঙ্গে মিলেমিশে থাকার জন্য। শুধু তোমার মনে কষ্ট হবে বলে উনি রাজি হননি। তুমি ওঁর সমস্ত অন্তর জুড়ে রয়েছে। অনেক কষ্টে দুবছর ধরে চেষ্টা করে আমি সেখানে একটু জায়গা করতে পেরেছি। তাতেই আমি বুঝেছি, কত গভীরভাবে উনি তোমাকে ভালবাসেন। এত কথা বলে সেলিনা হাঁপাতে লাগল।

আমি বললাম, তুমি এখন চুপ কর, বেশি কথা বললে তোমার বিপদ হবে।

সেলিনা হাঁপাতে হাঁপাতেই বলল, কথাগুলো আমাকে শেষ করতেই হবে। সারাজীবন তোমার কোনো হুকুম অমান্য করিনি। যাওয়ার সময় তুমি কোনো হুকুম করো না। তারপর তার আপামণির দিকে তাকিয়ে আবার বলতে লাগল, শেষকালে অনেক জীদ করে শুধু একটিবার তোমাদেরকে দেখতে চেয়েছিলাম। তাই সেদিন। পার্কে তোমাদেরকে রেখে উনি বাইরে গিয়েছিলেন। তারপর যা কিছু ঘটেছে তা আমি নিজে করেছি। উনি এসবের কিছুই জানতেন না। আপামণি, এসব কথা শুনে তুমি খুব দুঃখ পাচ্ছ, কোনোদিন কথাগুলো হয়তো তুমি জানতেও পারতে না, তোমার কাছে মাফ না চেয়ে মরতে পারছি না, তাই বললাম।

এমন সময় নার্স হন্তদন্ত হয়ে এসে বললেন, আপনারা কি পেসেন্টকে মেরে ফেলতে চান? যান, সবাই চলে যান। ওঁর এখন কথা বলা একদম নিষেধ।

সেলিনা নার্সকে ধমকের সুরে বলল, সিস্টার, আপনি থামুন, আমাকে বলতে দিন। তা না হলে বলার আর সময় পাব না। তারপর তার আপামণিকে বলল, তুমি তো আমাকে ছোট বোন বলে গ্রহণ করেছ? ছোট বোনের এই অন্যায়টা কি মাফ করে দেবে না? আমি তোমার দুটি পায়ে ধরে বলছি, আমাকে তুমি মাফ করে দাও। চুপ করে আছ কেন? সহসা মাথাটা একটু তুলেই লা-ইলাহা ইল্লালাহু মোহাম্মাদুর রসুলুল্লাহ বলে কাৎ হয়ে গেল।

প্রথমে আমরা কেউ বুঝতে পারিনি, সেলিনা মারা গেছে।

নার্স কয়েক সেকেণ্ড নাড়ী ধরে বলল, সি ইজ ডেড। তারপর একটা চাদর দিয়ে তাকে ঢেকে দিল।

ওরা সবাই কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। তখন আমার মুখ থেকে অজান্তে বেরিয়ে গেল ইন্না লিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজেউন।

এর পরের ঘটনা আর কিছু নেই। জামানের শেষের দিকের কথাগুলো কান্নার মত শোনাল। গল্পটা শুনতে শুনতে আমার চোখেও পানি এসে গিয়েছিল।

আমাকে রুমাল দিয়ে চোখ মুছতে দেখে বলল, কি রে, তুইও কাঁদছিস? সত্যি কথা বলতে কি জানিস, তার কথা মনে পড়লে আমি নিজেকে সামলে রাখতে পারি না বলে চোখ মুছল।

জিজ্ঞেস করলাম, সেলিনার মৃত্যুর পর তোর শাশুড়ী কী তোর সঙ্গে আর সম্পর্ক রাখেন নি?

বললাম, না রাখলেই ভালো হত।

বুঝলাম না!

না বোঝার কি আছে? তিনি এখন আমার স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদের সঙ্গে এমন ব্যবহার করেন, যা আমি কিছুতেই সহ্য করতে পারছি না।

সেটাতো আরও বুঝতে পারছি না।

তোর মাথায় গোবর আছে। তুই যে কি করে লেখক হলি, তা ভেবে পাচ্ছি। আরে তিনি আমাদের বাসায় প্রায়ই আসেন এবং আমাদের সঙ্গে এত মধুর ব্যবহার করেন, যেন আপন মেয়ে জামাই ও নাতি-নাতনি।

তাই বল, এটা তো খুব ভালো কথা। আফটার অল তুই তো তার আপন। মেয়েকেই বিয়ে করেছিলি। তা ছাড়া তিনি তার ভুলও বুঝতে পেরেছেন।

হ্যাঁ, তা তো তোরা বলবি। কিন্তু সেলিনা বেঁচে থাকতে যদি এ রকম করত, তা হলে সে যে কত খুশি হত বলে রুমাল দিয়ে আবার চোখ মুছল।

আমি তাকে সান্তনা দেওয়ার জন্য বললাম, কি আর করবি বন্ধু? সবকিছু আল্লাহ্ পাকের ইচ্ছা। তার কোনো কাজে হস্তক্ষেপ করার এতটুকু কারুর ক্ষমতা নেই। সবর কর। দোয়া করি, আল্লাহপাক তোকে সবকিছু সহ্য করার তওফিক দিক। জেনে রাখ, কোনো এক কবি বলেছেন

প্রেমের পবিত্র শিখা চিরকাল জ্বলে
স্বর্গ হতে আসে প্রেম স্বর্গে যায় চলে।

তারপর ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললাম, আমি যেন আড়াই ঘন্টা স্বপ্ন দেখলাম। সত্যি এরকম ঘটনা দুনিয়াতে বিরল। এখন আসরের নামাযের সময় হয়ে গেছে। চল দুজনের মসজিদ থেকে নামায পড়ে আসি।

বৃষ্টি অনেক আগে ছেড়ে গিয়ে সোনালি রোদ উঠেছে। নামায পড়ে এসে চা নাস্তা খেয়ে স্ত্রীকে নিয়ে বাসায় ফিরলাম।

ফেরার পথে স্ত্রী জিজ্ঞেস করল, দুবন্ধুতে এতক্ষণ ধরে কি এত গল্প করলে?

বললাম, ও নিজের জীবনের একটা রোমান্টিক ও মর্মান্তিক ঘটনা আমাকে শুনিয়েছে। শোনাবার আগে প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিয়েছে, কাহিনীটা নিয়ে যেন একটা উপন্যাস লিখি।

কাহিনীটা আমাক শোনাবে না?

আগে লিখি, তারপর সেই পাণ্ডুলিপিটা তুমি পড়ো।

গল্পের বিষয়:
ইসলামিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত