ক্রন্দসী প্রিয়া: ৩. চিঠিটা পড়ার পর পুড়িয়ে ফেললাম

ক্রন্দসী প্রিয়া: ৩. চিঠিটা পড়ার পর পুড়িয়ে ফেললাম

৩. চিঠিটা পড়ার পর পুড়িয়ে ফেললাম

চিঠিটা পড়ার পর পুড়িয়ে ফেললাম। চিন্তা করলাম, তাকে যদি বিয়ে না করি, তাহলে যে রকম জেদী মেয়ে, হয়তো সত্যি সতিই কোনো অঘটন ঘটিয়ে ফেলবে। আর সে জন্য আমিই দায়ী হব। তাই ঠিক করলাম তাকে বিয়ে করার ব্যাপারে কতকগুলো কঠিন শর্ত আরোপ করে আর একটা পত্র দিয়ে শেষ পরীক্ষা করব। যদি সেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়, তবে তাকে বিয়ে করতে রাজি হব। তাতে আমার তকদিরে যা হয় তোক। যদিও মনে হয়েছিল, যত কঠিন পরীক্ষা করি না কেন, পাশ সে করবেই; তবু খেয়ালের বশবর্তী হয়ে লিখলাম

সেলিনা,
দোয়া নিও। আশা করি ভালো আছ। এই পত্রে আমি তোমাকে বিয়ে করার ব্যাপারে কতকগুলো শর্ত আরোপ করছি। আমার এই শর্তগুলো ভালভাবে পড়ে স্থির মস্তিস্কে চিন্তা করে আমাকে জানাবে। তোমার উত্তর পাওয়ার পর মতামত জানাব।
১. সারাজীবন তোমাকে খোর-পোশ দিতে পারব না।
২. তোমাকে চিরকাল ঐ বাড়িতে থাকতে হবে। যদিও তোমার গার্জেনরা অত্যাচার করে তোমাকে তাড়িয়ে দেয়, তবুও বাড়ি থেকে নিয়ে আসার জন্য আমাকে অনুরোধ করবে না।
৩. কোনো বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া অন্য যে কোনো কারণে আমাকে যখন তখন ডাকা চলবে না। ৪. বিয়ের ব্যাপারটা চিরকাল গোপন রাখতে হবে। আমার বা তোমার কোনো আত্মীয়ের কাছে আমাদের সম্পর্কের কথা প্রকাশ করবে না।
৫. গার্জেনদের অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে যদি কোনো রকম খারাপ পরিস্থিতির সম্মুখীন হও, তবে আমাকে না জানিয়ে নিজে কোনো সিদ্ধান্ত নেবে না।
৬, বাইরে যাওার সময় বোরখা ব্যবহার করতে হবে।
৭. আমার দ্বারা তোমার যৌন ক্ষুধা নাও মিটতে পারে।
৮, বিয়ের পর ব্যাংকের যে টাকার তুমি স্বত্ত্বাধিকারী হবে, সে টাকা নেওয়ার জন্য আমাকে পিড়াপিড়ী করবে না।
৯, আমার সঙ্গে সব সময় মেজাজ বুঝে চলবে। আমাকে কাছে পেয়ে নিজের ইচ্ছামত কিছু বলতে বা করতে পারবে না।
১০. আমি খুব বদমেজাজী, যদি আমার মতের বিরুদ্ধে চল, তাহলে চাবুক মেরে আমার মতে চালাব।
১১. জীবন যাত্রা যতই দুর্বিসহ হয়ে উঠুক না কেন, কোনো দিন তালাকের কথা উচ্চারণ করবে না।
১২. উপরের, এগারটি শর্তের সবগুলো অথবা যে কোনো একটা শর্ত আরোপ করে কখনও কোর্টে নালিশ করতে পারবে না।
সেলিনা তুমি যদি এই চিঠি পড়ে আমাকে কাপুরুষ ও স্বার্থপর ভেবে ঘৃণা করে দূরে সরিয়ে দাও, তাহলে এর চেয়ে জীবনে পরম পাওয়া আমার কাছে আর কিছু নেই। উপরের মালিকই জানেন, আমি তোমার ভালো চাই, না মন্দ চাই। আমি তোমাকে এখনও বলছি উপরের শর্তগুলো পড়ে তোমার মত বদলান উচিত। কারণ এর ফলে তোমার ও আমার দুজনেরই ভালো হবে। তোমার জহির ভাইয়ের সঙ্গে যাতে বিয়ে না হয় তার ব্যবস্থা করে অন্য কোনো সুন্দর স্বাস্থবান ও চরিত্রবান ছেলের সঙ্গে বিয়ের ব্যবস্থা করে দিতে ইনশাআল্লাহ পারব। এই পত্র পড়ে তোমার শুভবুদ্ধির উদয় হোক আল্লাহপাকের দরবারে সেই দোয়া করে শেষ করছি। আল্লাহ হাফিজ।
ইতি—-

কিছুদিন আগে সেলিনা আমাকে একটা ফোন নাম্বার দিয়ে বলেছিল, এটা আমাদের তৃতীয় তলার ভাড়াটিয়াদের। উনি একজন দারোগা। আব্বার এক মক্কেলের কেসের ব্যাপারে ইনকোয়ারী করেছিলেন বলে রাজ সাক্ষী হয়েছিলেন। সেই থেকে আব্বার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয়। আমাকে উনি ও ওঁর স্ত্রী খুব ভালোবাসেন। ওঁদের একমাত্র মেয়ে জোবেদা আমার সহপাঠী ও প্রিয় বান্ধবী। এটা তাদেরই নাম্বার। যদি কোনো কারণে আমাকে দরকার হয়, তবে এই নাম্বারে ডায়েল করে বলবেন, জোবেদার বান্ধবীকে চাই। তাহলে যেই ফোন ধরুক না কেন, আমাকে ডেকে দেবেন। কারণ আপনার ও আমার ব্যাপারটা ওঁরা জানেন। আমি ওঁদেরকে এ রকম ভাবে ফোন আসার কথা বলে রেখেছি। দারোগার ফোন নাম্বার বলে ভয়ের কোনো কারণ নেই। সেলিনা নিজেদের ফোন নাম্বার না দিয়ে অন্যের নাম্বার কেন দিল তা বুঝতে পেরেও কি উত্তর দেয় শোনার জন্য জিজ্ঞেস করলাম, তোমাদের নাম্বার দিলে না কেন?

সেলিনা মাথা নিচু করে উত্তর দিল, আমার প্রেমিক তা জানেন।

এই পত্র লেখার পর প্রায় দশ বার দিন তার সঙ্গে যোগযোগ না হওয়ায় একদিন ঐ নাম্বারে ফোন করলাম। দুবার রিং হওয়ার পর একজন বয়স্ক মহিলা বলে মনে হল রিসিভার তুলে বললেন, হ্যাল্লো, এটা দারোগা সাহেবের বাসা, কাকে চান?

প্রথমে ওঁর গলার ভারী আওয়াজ শুনে ভড়কে যাই। পরে আমতা আমতা করে বললাম, দয়া করে জোবেদার বান্ধবীকে একটু ডেকে দিতে পারেন?

আচ্ছা ধরুন বলে উনি রিসিভারটা পাশে রেখে হেঁকে বললেন, জোবেদা, তোর বান্ধবীকে কে যেন ফোনে ডাকছে।

আমি সব কথা শুনতে পেলাম।

প্রায় দুতিন মিনিট পর একটা মেয়ে রিসিভার তুলে হ্যালো, আমি সেলিনা বলছি বলে একটু হেসে উঠল।

আমি বললাম, আপিন সেলিনা নন, জোবেদা।

আমার কথা শুনে যে ফোন ধরেছিল সে আরও একটু জোরে হেসে উঠে বলল, নে ধর, তোর হবু বর নকল ধরে ফেলেছে।

সেলিনা বলল, কি যা তা বকছিস? উনি শুনতে পেলে খুব রেগে যাবেন।

আমি যে তাদের সব কথা শুনতে পাচ্ছি সেদিকে কারুরই খেয়াল নেই। সেলিনা ফোন ধরে আস সালামু আলায়কুম বলে বলল, আজ আমার কি সৌভাগ্য হতভাগীকে এতদিন পর ফোন করেছেন।

আমি ওয়া আলায়কুম আস সালাম বলে বললাম, কাল সকাল ৯টায় দোকানে আসবে। তারপর ফোন ছেড়ে দিলাম। ভাবলাম, ফোন নাম্বার জানা থাকলে লাইন কেটে গেছে মনে করে ফোন করত।

পরের দিন সকালে সাহেবের গাড়ি আমাকে নিউমার্কেটের গেটে পৌঁছে দিয়ে গেল। আমি গেটের বাইরের দোকান থেকে সিগারেট কিনছি, এমন সময় সেলিনা আমাকে সালাম দিল। আমি সালামের জওয়াব দিয়ে তাকে দোকানে আসতে বলে চলে আসি। আকবর নামে একটা ছেলে দোকানের ফাইফরমাস খাটে। সে দোকান ঝাঁট দিয়ে কলসি নিয়ে খাবার পানি আনতে গেল। আমি আগরবাতি জ্বেলে চেয়ারে বসলাম। তখন পর্যন্ত আমার সহকর্মীরা কেউ আসেনি।

সেলিনা একটা মোটা ফর্সা মেয়েকে সঙ্গে করে নিয়ে এসে তাকে দেখিয়ে বলল, আমার প্রিয় বান্ধবী জোবেদা।

জোবেদা হেসে আমাকে সালাম দিল।

আমি সালামের উত্তর দিয়ে বললাম, কেমন আছেন? আপনার কথা ওর কাছে। অনেক শুনেছি।

ভালো আছি বলে জোবেদা চুপ করে আমার দিকে তাকিয়ে রইল।

তারা দুজনেই সেদিন হলুদ রং এর সাটিন কাপড়ের সালওয়ার কামিজ পরেছিল। আজ সেলিনাকে এই পোশাকে অপূর্ব সুন্দরী বলে আমার মনে হল। চোখে চোখ পড়তে সেলিনা দৃষ্টিটা নামিয়ে নিয়ে বলল, কাল অত তাড়াতাড়ি ফোন ছেড়ে দিলেন কেন?

বললাম, এর উত্তর তো তোমার জানা থাকা উচিত।

জোবেদা বলে উঠল, জানেন, আপনি ফোন ছেড়ে দেওয়ার পর ওতো লাইন কেটে গেছে মনে করে আবার আপনার ফোনের আশায় আধ ঘন্টা বসেছিল।

কথাটা শুনে সেলিনার ফর্সা মুখটা রাঙা হয়ে উঠল। বললাম, সে জন্য দুঃখিত। তারপর লজ্জার হাত থেকে বাঁচাবার জন্য জোবেদাকে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞেস করলাম, ইতিহাসে জোবেদা নামে একজন নারীর কথা বর্ণনা আছে, বলুন তো সেই নারী কে ছিলেন?

জোবেদা বলল, জানি না, আপনি বলে দিন।

বাগদাদের খলিফা হারুন আর রশিদের প্রাধান ও প্রিয় বেগম ছিলেন। তিনি নিজের খরচে প্রজাদের পানির কষ্ট দূর করার জন্য একটি খাল খনন করে দিয়ে ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন। তারপর বললাম, আপনারা বসুন, আমার সহকর্মীরা আসা পর্যন্ত আপনাদের অপেক্ষা করতে হবে।

তারা না বসে ঘুরে ঘুরে দোকানের বই দেখতে লাগল। একটু পরে জোবেদা জিজ্ঞেস করল, এত বই এর নাম আপনার মুখস্থ আছে?

মৃদু হেসে বললাম, না!

তাহলে কাষ্টোমার চাইলেই ঝটপট বের করে দেন কী করে?

আয়নার সামনে দাঁড়ালে যেমন নিজের ছবি ভেসে উঠে, কাস্টোমার যখন কোনো বই চায় তখন ঠিক তেমনি মনের আয়নায় বইটির সবকিছু মনে পড়ে যায়। তাই তাড়াতাড়ি বের করতে পারি। মুখস্থ ধরলে হয়তো দুতিনশ নাম বলতে পারব। আর লিখতে বললে আরও দুএকশ বেশি লিখতে পারব। বাকি সব মনের আয়নায় পর্দার আড়ালে ষ্টক আছে। কেউ কোনো বই চাইলেই পর্দা সরে গিয়ে ঐ বইটির কথা ভেসে উঠে।

সেলিনা একটা বই এনে আমাকে মেমো করে দিতে বলল। বইটির মেমো করছি এমন সময় আমার দুজন সহকর্মীকে আসতে দেখে বললাম, আপনারা নভেলে গিয়ে বসুন, আমি আসছি।

বই এর দাম দিয়ে তারা চলে গেল।

মিনিট পাঁচেক পর আমি নভেল ড্রিংকে গিয়ে দেখি, দুজনে মুখোমুখি বসে গল্প করছে। আমি তাদের পাশে একটা চেয়ারে বসে বেয়ারাকে প্রথমে দুটো করে বড় মিষ্টি ও পরে চানাচুর ও চা দিতে বললাম।

জোবেদা বলল, আপনি বুঝি মিষ্টি খেতে খুব ভালবাসেন?

খাওয়ার ব্যাপারে আমার কোনো বাদ বিচার নেই। আল্লাহপাক তাঁর বান্দাদের জন্য যা কিছু হালাল করেছেন, সবই আমি খেতে ভালবাসি। তার মধ্যে মিষ্টি ও ফলের উপর লোভ একটু বেশি। খাওয়া শেষ হতে বললাম, আরও তে বলি?

তারা দুজনেই বলে উঠল, আর খেতে পরব না।

তারপর চা খেতে খেতে চিঠিটা বের করে সেলিনার হাতে দিলাম। চিঠি নেওয়ার সময় তার হাত কাপছিল। কম্পিত হস্তে চিঠিটা ভ্যানিটি ব্যাগে রেখে দিল।

জোবেদাকে বললাম, আপনি যদি কিছু মনে না করেন, তাহলে একটা কথা জিজ্ঞেস করব?

নিশ্চিন্তে করুণ।

আচ্ছা, আপনি তো ওর প্রিয় বান্ধবী? আপনার কি উচিত না ওকে বিপদ থেকে উদ্ধার করা? ও তো গুহার মধ্যে বাঘ আছে জেনেও তাতে প্রবেশ করতে যাচ্ছে।

জোবেদা বলল, সেলিনা যখন আমাকে প্রথম আপনার পরিচয় জানিয়ে সব কথা বলে তখন আমি ওকে অনেক বারণ করেছি। এমন কি ঝগড়া করে কয়েকদিন মেলামেশা পর্যন্ত বন্ধ করে দিয়েছি। শেষে আবার অনেক অনুনয় বিনয় করে বন্ধুত্ব ফিরে পেয়েছি। ভাবলাম, ওর ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে ঝগড়া করে বন্ধুত্ব নষ্ট করব কেন? অনেক দিন থেকে আপনার সঙ্গে পরিচয় করার ইচ্ছা ছিল, সেলিনাই করায় নি। গতকাল যখন ফোন ধরলাম তখন ওকে চাপ দিতে রাজি হয়ে আজ নিয়ে এসেছে। সত্যি কথা বললে আপনার সামনে আপনার প্রশংসা হয়ে যাবে, তবু বলছি, সেলিনা অপাত্রে প্রেম নিবেদন করেনি।

আপনি ওকে খুব ভালবাসেন, তাই এ কথা বলছেন। কারণ আমার মধ্যে এমন কোনো গুণ নেই, যা দেখে আমাকে সুপাত্র বলা যেতে পারে।

গুণীরা কোনো দিন নিজের গুণ নিজেরা জাহির করে না, বরং তা আপনা থেকে সুগন্ধি ফুলের খুশবুর মত চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে।

কথা বেশি বেড়ে যাচ্ছে দেখে বললাম, দেরি হয়ে গেল, আর সময় দিতে পারছি না। তারপর বিল পেমেন্ট করে তাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে দোকানে ফিরে আসার সময় ভাবলাম, সেলিনা চিঠিটা পড়ে কি করবে কি জানি?

এরপর প্রায় বিশ পঁচিশ দিন সেলিনার কোনো খবর পেলাম না। প্রতিদিন দোকানে এলে মনে হত, আজ নিশ্চয় কোনো খবর পাব। চিঠিটা দিয়ে আমিও খুব অশান্তিতে ছিলাম। একদিন রাজশাহী মেডিকেল কলেজে আর্জেন্ট বই সাপ্লাই দেওয়ার জন্য সকাল আটটায় দোকান খুলে কাউন্টারের উপর টাইপ মেশিন রেখে বিল তৈরি করছিলাম। ঠিক সাড়ে আটটার সময় সেলিনাদের ড্রাইভার এসে আমাকে ছোট্ট একটা ভাজকরা কাগজ দিয়ে বলল, খুকী ভাই দিয়েছে। দাদু চলে যাওয়ার পর কাগজটা খুলে পড়লাম

ওগো আমার হৃদয়ের স্পন্দন,
প্রথমে দুখিনীর সালাম নেবেন। পরে আপনার কদম মোবারকে আজি জানাচ্ছি, আগামীকাল বেলা এগারটায় আপনাকে পার্কের সেই জায়গায় পেতে চাই। এটাই হয়তো আমার জীবনের শেষ অনুরোধ। আল্লাহ হাফেজ।
ইতি–
আপনার পথের কাঁটা
অভাগিণী সেলিনা।

চিঠি পড়ে বুঝতে পারলাম কাঁদতে কাঁদতে লিখেছে। কারণ চিঠিতে কাঁদার চিহ্ন ছিল। সেদিন ছিল মঙ্গবার, বুধবার বই নিয়ে রাজশাহী যাওয়ার কথা। সাহেবকে বলে সেখানে বৃহস্পতিবার যাওয়ার ব্যবস্থা করলাম। চিন্তা করে দেখলাম, যদি তার কথামত না যাই, তাহলে হয়তো কিছু করে ফেলতে পারে।

পরের দিন ঠিক এগারটার সময় পার্কের নিদিষ্ট জায়গায় গিয়ে দেখি সেলিনা চুপচাপ লেকের পানির দিকে চেয়ে গভীর চিন্তায় ডুবে আছে। তার মুখ দেখে বুঝতে পারলাম একটু আগেও কেঁদেছে। আমি ধীর পদক্ষেপে কোনো সাড়া শব্দ না করে অল্প একটু দূরে বসলাম।

প্রায় পাঁচ মিনিট সেলিনা একই ভাবে থেকে একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে হাতের ঘড়ি দেখল। তারপর আমাকে দেখতে পেয়ে এক রকম ছুটে এসে পাশে বসে আমার দুটো হাত নিয়ে নিজের গলায় চেপে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল, ফাইন্যাল পরীক্ষা চলছিল বলে তোমার দেওয়া সেই চিঠি এতদিন পড়িনি। গত পরশু পরীক্ষা শেষ হয়েছে। রাত্রে চিঠিটা পড়ে আজ তোমাকে ডেকে পাঠিয়েছি। তুমি আমাকে এভাবে চিঠি লিখতে পারলে? তোমার ঐ চিঠির শর্ত ছাড়া যদি আরও হাজার শর্ত থাকে, সেগুলোও সব আমি মেনে নেব। তবু তোমাকে হারাতে পারব না। আর এতেও যদি তুমি রাজি না হও, তবে আমার গলাটিপে এখানে মেরে রেখে যাও। এইকথা বলে সে হাত দিয়ে আমার হাত দুটো নিজের গলায় বেশ জোরে চেপে ধরল। তার কথায় ও কাজে আমি খুব অভিভূত হয়ে গেলাম। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, তুমি এখন অপ্রকৃতস্থ। আমার কোনো কথা তোমাকে ভালো লাগবে না। তুমি বাসায় চলে যাও। আর কখনও আমার সঙ্গে যোগাযোগ করবে না। তোমার সঙ্গে যদি আরও কিছুদিন আমার যোগাযোগ থাকে, তাহলে আমি পাগল হয়ে যাব। এইকথা বলে তার গলা থেকে আমার হাত ছাড়িয়ে নিয়ে দ্রুত চলে আসতে লাগলাম।

সেলিনা ছুটে আমার সামনে এসে পথরোধ করে কাঁদতে কাঁদতে বলল, তুমি এভাবে আমাকে অন্ধকারে ফেলে রেখে যেও না। তোমার কাছ থেকে আজ আমি স্পষ্ট কিছু শুনতে চাই।

তার কাঁন্নাভেজা মুখের দিকে তাকিয়ে নিজেকে কয়েক সেকেন্ডের জন্য হারিয়ে ফেললাম। তারপর সামলে নিয়ে বললাম, তোমাকে বলার মতো আমার আর কিছু নেই। যা বলার আগেই চিঠিতে সব বলেছি। এখন তুমি আমার পথ থেকে সরে দাঁড়ালে হয়তো আমি বাঁচতে পারি। নচেৎ আমার যে কি পরিণতি হবে, তা উপরের মালিকই জানেন। শেষের দিকের কথাগুলো আমার নিজের কাছে ভেজাভেজা লাগল। শেষে কি তার কাছে কেঁদে ফেলব মনে হতে তাকে পাশ কাটিয়ে চলে এলাম।

গেটের বাইরে ড্রাইভারের সঙ্গে দেখা। জিজ্ঞেস করল, খুকী ভাইকে কোথায় রেখে এলেন? পরশু রাত থেকে কিছু খায়নি, কারও সঙ্গে কথাও বলেনি? কি হয়েছে কেউ কিছু বুঝতে পারছে না।

কথাগুলো শুনে মনটা আরও খারাপ হয়ে গেল। বললাম, আপনার খুকী ভাই লেকের ধারে আছে, আপনি গিয়ে নিয়ে আসুন।

বাসায় এসে স্ত্রীকে খেতে দিতে বললাম।

আমার স্ত্রী বলল, তরকারী হতে একটু বাকি আছে। তুমি জোহরের নামায পড়ে নাও, ততক্ষণে সবকিছু হয়ে যাবে।

অযু করে মসজিদ থেকে নামায পড়ে এসে খেতে বসে মোটেই খেতে পারলাম না।

আমার স্ত্রী বলল, তুমি যে কিছুই খেলে না!

বললাম, কি জানি খিদে রয়েছে অথচ রুচী নেই।

তোমাকে বেশ কিছু দিন যাবৎ লক্ষ্য করছি, মাঝে মাঝে তুমি খুব চিন্তিত থাক, অথচ আগে এরকম ছিলে না।

মানুষের মন কি আর সব সময় এক রকম থাকে? কিছুদিন যাবৎ শরীরটাও ভালো যাচ্ছে না।

তাহলে ডাক্তারের কাছে একবার চেকআপ করাও না কেন?

তুমি অত ভেব না, একদিন না হয় ডাক্তারের কাছে যাব। মন থেকে চিন্তা দূর করার জন্য এবং ওকে খুশি করার জন্য বললাম, চল। আজ চিড়িয়াখানা দেখতে যাব। তারপর হোটেলে বিরানী খেয়ে বাসায় ফিরবো।

কথাটা শুনে আমার স্ত্রী খুব খুশী হল। সেদিন সারা বিকেল চিড়িয়াখানা দেখে হাতীর পিঠে চড়ে কাটালাম। ফেরার পথে ওর জন্য গ্যানিস থেকে একসেট সালওয়ার কামিজ কিনে হোটেলে খেয়ে বাসায় ফিরলাম।

.

সেলিনাকে সেদিন পার্কে ঐ অবস্থায় ফেলে এসে দিন দিন আমি খুব চিন্তিত হয়ে পড়লাম। শত চেষ্টা করেও তা দূর করতে পারলাম না। যখন একমাস পার হয়ে গেল অথচ কোনো খবর পেলাম না তখন মনের মধ্যে ভীষণ অস্থিরতা অনুভব করলাম। দোকানে এলে এই ভাবটা বেশি হত। একদিন নভেল ড্রিংকের মালিককে জিজ্ঞেস করলাম, ব্যারিষ্টার মঈনুল ইসলামের মেয়ে কি কয়েকদিনের মধ্যে এসেছিল?

উনি বললেন, আপনি জানেন না বুঝি? ব্যারিষ্টার সাহেবের মেয়ে তো আজ এক মাসের মত শয্যাশায়ী। ডাক্তাররা কোনো রোগ ধরতে পারছে না।

খবরটা শুনে খুব মুষড়ে পড়লাম। কি করা উচিত ভেবে ঠিক করতে পারলাম। শুধু মনে হতে লাগল, তার এই পরিণতির জন্য আমিই দায়ী। প্রত্যেক নামাযের পর তার রোগ মুক্তির জন্য আল্লাহপাকের দরবারে দোয়া করতে লাগলাম। এই অস্থিরতার মধ্যে আরও চার পাঁচ দিন গত হয়ে গেল।

আমাকে বেশি চিন্তিত দেখে আমার স্ত্রী ভয় পেয়ে একদিন বলল, আজ দোকানে গিয়ে কাজ নেই। চল, আমিও তোমার সঙ্গে ডাক্তারের কাছে যাব। তার ধারণা হয়েছিল আমার কোনো কঠিন অসুখ হয়েছে।

বললাম, তোমাকে যেতে হবে না, আজ মার্কেটে একজন ডাক্তারকে দেখাব। আমার মন এত খারাপ হয়েছিল যে, সেটা সহকর্মীদের চোখ এড়ায়নি।

ঐদিন দোকানে আসার পর এক সময় তারা জিজ্ঞেস করল, আপনার কী কোনো অসুখ করেছে? কিছুদিন থেকে আপনাকে খুব মন মরা দেখাচ্ছে।

বললাম, তেমন কিছু হয়নি, তবে শরীরটা কিছুদিন যাবৎ খুব খারাপ যাচ্ছে। বিকেল চারটের সময় ড্রাইভারকে আসতে দেখে দোকান থেকে বের হয়ে তার কাছে এগিয়ে গেলাম।

আমাকে দেখে ড্রাইভার বলল, আপনাকে এক্ষুনি আমার সঙ্গে বাসায় যেতে হবে।

বললাম, বাসায় গেলে আবার গোলমাল হবে না তো?

যাকে নিয়ে গোলমাল হবে, সে বোধ হয় আর বাঁচবে না বলে ড্রাইভার রুমাল দিয়ে চোখ মুছল। তারপর আবার বলল, খুকী ভাইয়ের মেজ মামা আর দুজন ডাক্তার বসে আছেন। তারাই আপনাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমাকে পাঠিয়েছেন।

ড্রাইভারকে গাড়িতে যেতে বলে দোকানে ফিরে এসে সাহেবকে ফোন করে বললাম, আমার এক আত্মীয়া মৃত্যুশয্যায়। আমাকে নিয়ে যেতে লোক এসেছে। আমি সেখানে যাচ্ছি। কখন ফিরব ঠিক নেই। তারপর সহকর্মীদের বললাম, আমি যাচ্ছি। কারণটাতে তোমরা শুনলে। গাড়িতে উঠে ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলাম, ওর কি হয়েছে?

কি যে হয়েছে ডাক্তাররই রোগ ধরতে পারেনি। পার্কের সেই ঘটনার আগের দিনের রাত থেকে আজ পর্যন্ত কোনো কিছু খায়নি। কারও সঙ্গে কথা ও বলেনি। এমন কি ডাক্তাররা প্রশ্ন করেও উত্তর পাইনি। শুধু প্রশ্নকারীর মুখের দিকে তাকিয়ে চোখের পানি ফেলে। যেন একদম বোবা হয়ে গেছে। আজ মেজ মামা ডাক্তারদের কাছে আপনার ও খুকী ভাইয়ের সম্পর্কের কথা বলায় ওঁরা বললেন, এতদিন কথাটা গোপন রেখে খুব ভুল করেছেন। ছেলেটিকে না হলে চিকিৎসা করে কোনো লাভ হবে না। তাই মেজ মামা আম্মার সঙ্গে রাগারাগী করে আপনাকে নিয়ে যেতে পাঠিয়েছেন।

গাড়ি পৌঁছাতে ড্রাইভার আমার দিকের দরজা খুলে দিয়ে বলল, সোজা উপরে খুকী ভাইয়ের কামরায় চলে যান।

উপরে গিয়ে দরজার পর্দা সরিয়ে ঘরে ঢুকে দেখলাম, দুজন ডাক্তার চেয়ারে আর একজন ভদ্রলোক খাটে বসে আছেন। আমি সালাম দিলাম।

খাটে বসা ভদ্রলোক সালামের জওয়াব দিয়ে বললেন, তুমি এখানে এসে বস বলে খাটে নিজের পাশে ইঙ্গিত করলেন। তারপর ডাক্তারদের বললেন, চলুন আমরা ড্রইং রুমে বসি।

ওঁরা চলে যাওয়ার পর আমি সেলিনার দিকে লক্ষ্য করলাম, একটা পরিস্কার চাদর দিয়ে শরীর ঢাকা রয়েছে। শুধু মুখাটা খোলা। মাথাটা একটা রুমাল দিয়ে বাঁধা। চোখ দুটো বন্ধ। শরীর শুবিয়ে একদম কাঠ হয়ে গেছে। মুখে একবিন্দু রক্ত থাকায় ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে। আমি তার কাছে সরে বসে কপালে হাত রাখলাম।

সেলিনা ধীরে ধীরে চোখ খুলে অশ্রুভরা নয়নে আমার মুখের দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল।

তার অবস্থা দেখে আমার চোখেও পানি এসে গেল। আমার চোখের পানি তার গালে পড়তে সেলিনা কপালে রাখা আমার হাতটা নিয়ে প্রথমে চুমো খেল। তারপর খুব আস্তে আস্তে বলল, এবার আমার মৃত্যু হলেও কোনো দুঃখ নেই। আমার জীবন সার্থক। আমার প্রেম হেরে যায়নি। একদিন আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, প্রেম দিয়ে তোমাকে জয় করবই। সে প্রতিজ্ঞা আজ আমার পূর্ণ হল। সেইজন্য আল্লাহপাকের কাছে জানাই হাজারো শুকরীয়া।

তার হাতের মধ্যে আমার হাত ছিল। বললাম, তোমার হাতে হাত রেখে বলছি, তোমার প্রেমের কাছে আমি সত্যিই হেরে গেছি। তোমার সব ইচ্ছা পূরণ করব। তুমি শুধু কথা দাও, নিজেকে আর মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেবে না। আত্মহত্যা করতে নিষেধ করেছিলাম বলে কি এভাবে মৃত্যুর দিকে এগোতে হয়? আল্লাহ তায়ালার কাছে দোয়া করছি; তিনি যেন শিঘ্রী তোমাকে সুস্থ করে তোলেন।

তুমি যদি সব সময় আমার কাছে থাক, তাহলে ডাক্তারের চিকিৎসা ছাড়াই আমি ভালো হয়ে যাব।

বললাম, তোমাকে এই রকম অবস্থায় রেখে চলে যেতে আমারও খুব কষ্ট হবে। কিন্তু না গিয়েও উপায় নেই। তবে কথা দিচ্ছি, আল্লাহ চাহে তো প্রতিদিন এসে তোমার সঙ্গে কিছুক্ষণ কাটিয়ে যাব।

বেশ, তোমার ইচ্ছাই আমার কামনা। তবে প্রত্যেক দিন অন্ততঃ একবার আসা চাই

তার কথায় রাজি হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, যিনি তোমার কাছে বসেছিলেন ওঁকে যেন চেনা চেনা লাগল।

উনি আমার মেজ মামা। তোমাকে ভালভাবে চেনেন। জর্জকোর্টের উকিল। তোমার কাছ থেকে অনেক আইনের বই কিনেছেন। আমাদের সব ব্যাপার উনি জানেন। আমার আত্মীয় স্বজনের মধ্যে একমাত্র উনি এখনও আমাকে ভালবাসেন। ওঁর সাহায্য না পেলে আম্মা অনেক আগেই জহির ভাইয়ের সঙ্গে জোর করে বিয়ে দিয়ে দিত। এতকথা বলে সেলিনা হাঁপাতে লাগল।

আমি তাকে কথা বলতে নিষেধ করলাম। এমন সময় জরিনা এসে বলল, মামা আপনাকে ড্রইংরুমে ডাকছেন। উঠে দাঁড়াতে সেলিনা বলল, আমার সঙ্গে দেখা না করে চলে যেওনা যেন। একটা জিনিষ লক্ষ্য করলাম, মাসাধিক কাল আগে রমনা পার্কের সেই ঘটনার দিন সেলিনা আমাকে তুমি বলে সম্বোধন করেছিল, আর আজও সেইভাবে কথা বলছে। আচ্ছা বলে ড্রইংরুমে গিয়ে বসলাম।

মামা নিজে এককাপ চা বানিয়ে বিস্কুটের প্লেট এগিয়ে দিয়ে বললেন, চা খাও।

আমি চায়ে চুমুক দিয়ে ডাক্তারের দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ওর কি অসুখ হয়েছে?

ডাক্তারদের একজন বললেন, তার আগে বলুন, সেলিনা কি আপনার সঙ্গে কথা বলেছে?

বললাম, হ্যাঁ, তবে খুব ক্ষীন স্বরে।

অন্য ডাক্তার বললেন, তবে আর ভয়ের কোনো কারণ নেই। আমরা তো মনে করেছিলাম, সে বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছে। এতদিন আমরা কোনো রোগ ধরতে পারিনি। তারপর সেলিনার মামাকে দেখিয়ে বললেন, ওঁর কাছে আজ আপনাদের দুজনের সম্পর্কের কথা শুনে বুঝতে পারলাম, কোনো রোগ তার শরীরে নেই। ভীষণ মানসিক যন্ত্রণায় ভুগছে। অবস্থা যেভাবে খারাপের দিকে যাচ্ছিল, আর এক সপ্তাহ এই ভাবে থাকলে মারা যেত। এখন আপনি যদি কথায় ও ব্যাবহারের দ্বারা তার মানসিক যন্ত্রণা দূর কতে পারেন, তাহলে শিঘ্রী ভালো হয়ে যাবে। সব থেকে মুস্কিল হচ্ছিল, কোনো খাবার বা ওষুধ তাকে খাওয়ান যাচ্ছিল না। যদি জোর করে খাওয়াবার চেষ্টা করা হয়, তবে তা মুখে নিয়ে ফেলে দেয়। ওঁকে সুস্থ করার সবকিছু নির্ভর করছে আপনার উপর। ডাক্তাররা বিদায় নেওয়ার সময় আবার বললেন, ভালো করে খাওয়াবার চেস্টা করুন, আর যে ভিটামীনগুলো আছে সেগুলো ঠিকমত খাওয়ান। আশা করি অল্পদিনে সব ঠিক হয়ে যাবে।

ডাক্তাররা চলে যাওয়ার পর মেজ মামা আমাকে বললেন, শুধু একটা কথা বলব, তোমার উপরেই সেলিনার ভালো মন্দ নির্ভর করছে। এখন আমি আসি। পরে এক সময় তোমার সঙ্গে কথা বলব।

সকলে চলে যাওয়ার পর সেলিনার ঘরে এসে খাটের পাশে একটা চেয়ার টেনে বসে জরিনাকে হরলিক্স তৈরি করতে বললাম।

সেলিনা বলল, ডাক্তাররা বুঝি আমাকে শুধু খাওয়াতে বলেছেন?

ডাক্তাররা যাই বলুক না কেন? আমি তোমাকে যেভাবে যখন পথ্য ও ওষুধ খেতে বলে যাব, ঠিকমত সেগুলো খাবে। জরিনার কাছ থেকে কাগজ কলম চেয়ে নিয়ে কখন কি খাবে তার একটা চার্ট তৈরি করে জরিনাকে বললাম, তুমি তোমার আপাকে চার্টমত খাওয়াবে। যদি কোনো রকম ওজর আপত্তি করে, তাহলে আমি আগামীকাল এলে জানাবে।

জরিনা হরলিক্স তৈরি করে ওকে চামচে করে খাওয়াল। তারপর বলল, জানেন, আজ একমাস আট দিন পর আপা এই প্রথম কিছু খেল ও কথা বলল। এতদিন শুধু পানি খেয়ে ছিল।

জিজ্ঞেস করলাম, তোমার আপাকে দেখাশুনা করে কে?

জরিনা বলল, আমি ও মা। একজন নার্সও রাখা হয়েছে। নিজের প্রয়োজনে। কিছুক্ষণ আগে সে বাইরে গেছে।

আমি আসরের নামায পড়ে সেলিনাকে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি নামায পড়বে না?

কি করে পড়ব? আমি যে খুব দুর্বল। উঠতে পারি না। যতদিন সামর্থ ছিল পড়েছি।

তোমার তো উঠার দরকার নেই। জেনে রেখ, মেয়েদের প্রাকৃতিক অসুবিধে ও পাগল ব্যক্তি ছাড়া কারুর জন্য নামায মাফ নেই। যে কোনো অবস্থা হোক না কেন নামায পড়তেই হবে। তারপর জরিনাকে প্লেটে করে কিছু শুকনো ভালো মাটি আনিয়ে দিতে বললাম।

জরিনা তাদের কাজের মেয়েকে মাটি আনতে বলল। কাজের মেয়েটি যখন মাটি নিয়ে ফিরল তখন নার্সও এল।

আমি জরিনা ও নার্সকে বললাম, প্রত্যেক নামাযের সময় সেলিনাকে এইভাবে তাইমুম (অযু) করিয়ে দেবেন বলে মাটিতে দুহাত ঘসে প্রথমে আমি আমার সমস্ত মুখমন্ডল এবং পরে আবার মাটিতে হাত ঘসে দুহাতের কনুই পর্যন্ত মুছলাম। নার্স তাকে সেইভাবে তাইমুম করিয়ে দিল। তারপর আমি তাদেরকে বললাম, আপনারা দুজনে ওকে ধরে পূর্ব দিকে মাথা ও পশ্চিম দিকে পা করে শুইয়ে দিন।

আমার কথামত তারা সেলিনাকে শুইয়ে দিল।

আমি তাকে বললাম, তুমি এবার চিৎ হয়ে শুয়ে চোখের ঈশারায় নামায পড়।

আমি যতক্ষণ ছিলাম ততক্ষণ কেউ আমার অনুমতি ছাড়া ঘরে আসেনি। এক সময় আমি সেলিনার মাথায় হাত বুলাতে বুলোতে বললাম, তুমি বিশ্বাস করবে কিনা জানি না, তোমাকে সেদিন পার্কে ঐ অবস্থায় ফেলে এসে এতদিন যে কি যন্ত্রণা ভোগ করেছি, তা একমাত্র উপরের মালিকই জানেন। সত্যি ত্যি তোমাকে যে আমি এত, গভীরভাবে ভালবেসে ফেলেছি, তা এই ঘটনার আগে বুঝতে পারিনি। তার সুন্দর সুডৌল আপেলের মত গাল দুটো হাড়ের সঙ্গে মিশে গেছে তা লক্ষ্য করে আমার গলা ধরে এল।

সেলিনা তা বুঝতে পেরে আমার হাতটা দুহাতের মুঠোর মধ্যে নিয়ে কাদ কাদ স্বরে বলল, আমার জন্য তুমি যে কত কষ্ট এতদিন পেয়েছ এবং এখনও পাচ্ছ, তা সবকিছু আমি অনুভব করতে পারছি। আমার এখন মনে হচ্ছে, আমার মত সৌভাগ্যবতী মেয়ে সারা দুনিয়ায় নেই।

রাত দশটায় এশার নামায পড়ে সেলিনাকে বললাম, এবার আমাকে আজকের মত বিদায় দাও।

আমার কথা শুনে তার পাড়ুর মুখটা আরও মলিন হয়ে গেল। কোনো কথা না বলে ছলছল নয়নে আমার মুখের দিকে চেয়ে রইল।

বললাম, প্রতিদিন তো আসব, মন খারাপ করছ কেন? তারপর একবার তার মাথায় ও মুখে হাত বুলিয়ে আল্লাহ হাফেজ বলে চলে আসি।

এরপর কোনো দিন সকালে অথবা রাত্রে যখনই সময় পেতাম তখনই গিয়ে ওর কাছে বেশ কিছুক্ষণ কাটিয়ে আসতাম। যাওয়ার সময় নানারকম ফল ও মিষ্টি নিয়ে যেতাম। দশবার দিনের মধ্যে সেলিনা বেশ সুস্থ হয়ে উঠল।

আরো দুতিন দিন পর সেলিনা আমার হাতে একটা খাম দিয়ে বলল, এতে কিছু টাকা আছে। যদি তুমি মনে কিছু না করে এটা নাও, তাহলে খুব খুশী হব।

তাকে খুশী করার জন্য খামটা নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কি ব্যাপার? হঠাৎ আমাকে টাকা দিলে কেন?

তুমি আমার জন্য এত খরচ করছ, ভাবলাম, তোমার যদি টাকার টান পড়ে।

আল্লাহপাকের রহমতে আমার টাকার টান পড়বে না। চাকরি ছাড়াও আমার একটা সাইড বিজনেস আছে। তা থেকে যা পাই, তার অল্পকিছু ছাড়া প্রায় সবটাই ব্যাংকে জমা হচ্ছে। তোমার দেওয়া টাকা আমি নিলাম, কিন্তু ভবিষ্যতে এ রকম আব্দার আর করবে না। এখন এই টাকাগুলো আমি আমার প্রেমিকার কাছে গচ্ছিত রাখছি, সময় মত চেয়ে নেব। এই বলে টাকার খামটা তার হাতে ফেরৎ দিলাম।

সেলিনা নির্বাক হয়ে কয়েক মুহুর্ত আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে চোখের পানি গোপন করার জন্য মাথা নিচু করে নিল।

আমি তার চিবুক ধরে তুলে বললাম, আমাকে তুমি ভুল বুঝ না। আমার এই ব্যবহারে যদি তুমি মনে কষ্ট পেয়ে থাক, তবে মাফ চাইছি।

টপ টপ করে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে সেলিনা বলল, তোমার কোনো অন্যায় হয়নি, বরং আমি ভুল করে দয়া দেখাতে গিয়ে চরম অন্যায় করে তোমার মনে ব্যাথা দিয়েছি। তুমি আমাকে ক্ষমা কর।

বললাম, ভুল মানুষ মাত্রেই করে। আর সেই জন্য আল্লাহপাকের রাসুল(দঃ) বলেছেন, মানুষ ভুল করবে বলেই আল্লাহপাক ক্ষমা রেখেছেন। যদি তারা তা স্বীকার করে তার কাছে ক্ষমা চায়। তাহলে আল্লাহপাক তাদের ক্ষমা করে দেন। এর কয়েদিন পর তাকে বললাম, প্রতিদিন আসতে আমার অসুবিধে হয়। তুমি তো এখন ভালো হয়ে গেছ। তুমি বরং মাঝে মাঝে আমার সঙ্গে দেখা করো। তাকে আমার দোকানের ও পাশের দুতিনটে দোকানের ফোন নাম্বার দিয়ে বললাম, যে কোনো একটাতে ডায়েল করে আমাকে চাইলেই পাবে।

তারপর থেকে আমি আর তাদের বাসায় যাইনি। মাঝে মাঝে সেলিনা ফোন করে নভেল ড্রিংকে আসতো, আমি সেখানে তার সঙ্গে দেখা করতাম। আবার কোনো ছুটির দিনে পার্কে যেতাম।

এদিকে আমার স্ত্রী আমাকে যাতে কোনো রকম সন্দেহ না করে সেজন্য স্বাভাবিক জীবন শুরু করলাম। মন থেকে সমস্ত চিন্তা দুর করে দিলাম। সিদ্ধান্ত নিলাম, সেলিনাকে বিয়ে করলেও স্ত্রীর সঙ্গে কোনো দিন কোনো কারণে খারাপ ব্যবহার করব না।

কিছুদিন পর সেলিনা ফোন করে বলল, তুমি আগামী কাল ছুটি নিয়ে সকাল সাড়ে আটটায় জি, পি, ওর গেটে থাকবে, আমি আসব, বিশেষ দরকার আছে।

দরকারটা এখন বললে হত না?

এখন বলব না, কাল বলব। তোমার কিন্তু আসা চাই। তারপর অনুমতি নিয়ে ফোন ছেড়ে দিল।

সাহেবের কাছ থেকে ছুটি নিলাম, কিন্তু স্ত্রীকে বললাম না। পরের দিন ঠিক সময় মত জি, পি, ওর গেটে দাঁড়ালাম। দুমিনিট পর সেলিনাদের গাড়ি এসে আমার সামনে ব্রেক করল।

সেলিনা সালাম দিয়ে দরজা খুলে বলল, এস!

আমি সালামের জওয়াব দিয়ে গাড়িতে বসতে তার গায়ে গা ঠেকে গেল।

মৃদু হেসে বলল, ব্যবধান রেখে বসব? না যেভাবে আছি সেভাবে থাকব?

তোমার বিবেককে জিজ্ঞেস করে দেখ।

সেলিনা অল্প একটু সরে বসে ড্রাইভারকে গাড়ি ছেড়ে দিতে বলল। তারপর আমাকে জিজ্ঞেস করল, কোথায় নিয়ে যাব বলোত?

কি করে বলব? ধনীর দুলালীদের মতলব বোঝা মুশকিল।

তুমি এভাবে আমার সঙ্গে কথা বলবে না। আমার প্রেমের পর্দায় আঘাত লাগে বলে রুমাল দিয়ে চোখ মুছল।

এত সামান্য কথায় আঘাত পাবে ধারণা করিনি। বললাম, কথাটা আমি এমনি বলেছি। সিরিয়াসলি বা তোমার মনে আঘাত দেওয়ার জন্য বলিনি। কথার মোড় ঘোরাবার জন্য বললাম, মনে হচ্ছে কোনো অভিসন্ধি এঁটেছ।

সেলিনা বলল, একদিন তো আমাকে সাইকোলজী ও এ্যাসট্রোলজীর ছাত্রী বানিয়েছিলে, আজ যদি আমি তোমাকে সেই কথা বলি?

বল, আমিও বলব, ঐ সব বই পড়িনি। আমার প্রেম আমাকে বলে দিয়েছে। এই কথায় দুজনেই হেসে উঠলাম।

ড্রাইভার দাদু আমাদের কথার মধ্যে এই প্রথম কথা বললেন, প্রেমিক প্রেমিকারা মনের কথা আপনা থেকে জানতে পারে, যদি তাদের প্রেম খাটি হয়। সে জন্য কোনো বই পড়ার দরকার হয় না।

আমি বললাম, দাদু, আপনার কথা হাণ্ডেড পারসেন্ট কারেক্ট।

কোর্ট হাউস স্ট্রীটের একটি দোতলা বাড়ির সামনে গাড়ি থামল। সেলিনা আগে নেমে আমাকে নামতে বলল। তারপর আমাকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ির ভিতর যাওয়ার সময় ড্রাইভারকে বলল, আপনি এখন চলে যান। দরকার মত ফোন করে ডেকে নেব।

আমাকে যে বাড়িতে নিয়ে গেল, সেটা নিচে চার কামরা ও উপরে চার কামরা। উপরে নিয়ে গিয়ে যে কামরায় বসাল, সেটা উকিলের চেম্বার। ঘরের চারিদিকের আলমারীতে সব আইনের বই। তার মধ্যে অনেক বই আমার চেনা। ঘরের মাঝখানে একটা বড় টেবিল। তার চারপাশে অনেকগুলো চেয়ার। দরজার সোজা একটা মুভিং চেয়ার রয়েছে। আমাকে বসিয়ে এক্ষুনি আসছি বলে সেলিনা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

প্রায় সঙ্গে সঙ্গে তার মেজ মামার সঙ্গে ফিরে এল।

আমি দাঁড়িয়ে সালাম দিলাম।

মেজ মামা সালামের জওয়াব দিয়ে বসতে বলে নিজেও বসলেন। তারপর বললেন, আমি তোমাকে অনেকদিন থেকে চিনি। তুমিও নিশ্চয় আমাকে চিনতে পেরেছে?

জ্বি হ্যাঁ, সেদিন সেলিনাদের বাসায় চেনা চেনা মনে হতে জিজ্ঞেস করে জেনেছি।

উনি আবার বললেন, তুমি আমার ছেলের মত, তাই তোমাকে প্রথম থেকে তুমি বলে সম্বোধন করেছি, কিছু মনে করোনিতো বাবা?

আপনি আমাকে এত আপন করে নিয়েছেন জেনে আমি কৃতজ্ঞ।

উনি ড্রয়ার খুলে দুটো স্ট্যাম্প বের করে আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, সবগুলো স্টার চিহ্নের পাশে সিগনেচার করে দাও।

আমি একটা স্ট্যাম্প নিয়ে পড়ে দেখি সেটা কোর্ট ম্যারেজের এ্যাপ্লিকেশন। সেলিনা আগেই সই করেছে।

মামীর সঙ্গে দেখা করে আসি বলে সেলিনা চলে গেল।

আমি সিগনেচার না করে বললাম, আপনার সঙ্গে আমার কিছু কথা ছিল।

মামা বললেন, তুমি যা বলবে খুকী সেসব বলেছে। আরও যদি কিছু বলতে চাও শুনব, কিন্তু কোনো কাজ হবে না। কারণ এতকিছুর পর ওকে আর ফেরান যাবে না। ও খুব একরোখা। যা করবে বলবে, তা করেই ছাড়বে। নিজের মতের বাইরে কখনো কিছু করে না। আমার কাছে প্রথম যখন সমস্ত ঘটনা প্রকাশ করে নিজের মতামত জানায় তখন আমি খুব রাগারাগী করেছি। সংসারের জটিল সমস্যার কথা বলে অনেক ভয় দেখিয়েছি এবং বুঝিয়েছিও। ওর মামীমাও অনেক করে ঐসব খেয়াল ছাড়তে বলেছে। কিন্তু ওর ঐ এক কথা, হয় তোমাকে বিয়ে করবে নচেৎ আত্মহত্যা করবে। এই একরোখা স্বভাবের জন্য আমার বোন ওকে একদম দেখতে পারে না। ওকে ওর ছেলেবেলা থেকে জানি বলে নিজের মত বিসর্জন দিয়ে বাঁচাবার জন্য সাহায্য করছি।

সবকথা শোনার পর সিগনেচার করলাম। তারপর অন্য ষ্ট্যাম্পটা পড়লাম। একই জিনিসের দুই কপি অঙ্গিকার পত্র। তাতে আমার দেওয়া বিয়ের শর্তগুলো টাইপ করা। সেগুলোতেও সেলিনার সিগনেচার রয়েছে।

বললাম, ওর মতিগতি বদলাবার জন্য এই শর্তগুলো লিখে চিঠি দিয়েছিলাম। বিয়েই যখন করতে যাচ্ছি, তখন এটার আর কী দরকার?

মামা বললেন, তোমার সেই চিঠি পড়ে আমিও তা বুছেঝি; কিন্তু ওর হুকুম এটাও রেজেষ্ট্রী করতে হবে। তুমি দুটোতেই সিগনেচার করে দাও। নচেৎ ও আমাকে আস্ত রাখবে না।

আমি সিগনেচার করছি এমন সময় পনের ষোল বছরের একটি মেয়ে এসে বলল, আব্বা, আপনাদের নাস্তা খাওয়ার জন্য আম্মা ডাকছেন।

মেয়েটিকে দেখিয়ে মামা বললেন, আমার বড় মেয়ে জোহরা, এবারে ম্যট্রিক দেবে।

জোহরা আমাকে হাত তুলে তাসলিম বলল।

আমি তার প্রতিউত্তর দিলাম।

আমরা ডাইনিং রুমে গিয়ে বসলাম। একটু পরে সেলিনা এসে মামার পাশে বসল। একজন মহিলা আমাদের খাওয়াবার জন্য এলে সেলিনা বলল, মামীমা।

আমি সালাম দিয়ে বললাম, নাস্তা খেয়ে এসেছি, আমাকে সামান্য কিছু দিন।

মামীমা সালামের জওয়াব দিয়ে দুটো মিষ্টির সঙ্গে কলা ও আপেলের কয়েকটা ফালি দিলেন।

নাস্তার পর সেলিনা মামাকে জিজ্ঞেস করল, আমাদেরকে আর দরকার হবে?

মামা বললেন, এত তাড়া কিসের? তোমরা এখন গল্প কর। বেলা বারটার দিকে একজন পিয়ন এসে তোমাদের ডেকে নিয়ে যাবে। এগুলো এফিডেভিট করার সময় তোমাদেরকে দরকার হবে। আর দুপুরে তোমরা এখানে খাবে।

আমরা ড্রইং রুমে এসে বসলাম। জোহরাও সঙ্গে এসেছিল। তাকে জিজ্ঞেস করলাম, তোমরা কয় ভাই বোন?

দুই বোন এক ভাই। আমিই বড়। ওরা স্কুলে গেছে। আপনারা আসবেন, তাই আম্মা আমাকে আজ স্কুলে যেতে দেননি।

হঠাৎ সেলিনা বলল, তুমি সিগারেট খাচ্ছ না কেন?

আসবার সময় কিনতে ভুলে গেছি।একটা দশ টাকার নোট বের করে জোহরার দিকে বাড়িয়ে ধরে বললাম, কাউকে দিয়ে এক প্যাকেট সিজার্স সিগারেট ও একটা ম্যাচ আনিয়ে দিতে পার?

অফ কোর্স বলে জোহরা যেই টাকাটা আমার হাত থেকে নিতে গেল, সেলিনা তখন তার হাতটা টেনে নিয়ে আট আনা পয়সা দিয়ে বলল, শুধু একটা ম্যাচ, সিগারেট লাগবে না। তারপর টাকাটা আমাকে ফেরৎ দিল।

জোহরা বেরিয়ে যেতে বললাম, সিগারেট লাগবে না এ কথার অর্থ?

সেলিনা ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে এক প্যাকেট মূর সিগারেট বের করে আমার হাতে দিয়ে বলল, আসার সময় মৌচাক মার্কেট থেকে তোমার জন্যে কিনেছি।

মূর সিগারেট বেশ দামী। খাওয়ার সময় একটা সুগন্ধ ছড়ায়। আমি খেতে খুব ভালবাসি। অতদামী সিগারেট খেয়ে টাকা অপচয় করা পছন্দ করি না। তাই সব সময় না খেয়ে মাঝে মধ্যে খাই। জোহরা ম্যাচ দিয়ে চলে গেল।

সেলিনা একটা চেয়ার টেনে এনে আমার সামনে বসল।

সিগারেট ধরিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আমি যে এই সিগারেট খেতে ভালবাসি, তা জানলে কেমন করে? এই সিগারেট তো তোমার সামনে কোনো দিন খাইনি।

একদিন নিউমার্কেটে তোমাকে এই সিগারেট খেতে দেখেছিলাম। সে সময় এর গন্ধটা আমার খুব ভালো গেলেছিল। তাতেই বুঝেছি তুমি এই সিগারেট ভালবাস।

আজকের দিনে তুমি যদি অনেক দামী কোনো জিনিস প্রেজেন্ট করতে, তা হলেও বোধ হয় এতটা আনন্দিত হতাম না। সিগারেট ধরিয়ে জোরে টান দিয়ে সমস্ত ধোঁয়া ওর মুখের উপর ছাড়লাম বিরক্ত করার জন্য। কিন্তু ওর মুখে বিরক্তের কোনো চিহ্ন দেখলাম না। জিজ্ঞেস করলাম, সিগারেটের ধোঁয়াতে তোমার অসুবিধে হয় না?

হাসিমুখে সেলিনা জবাব দিল, সিগারেটের ধোঁয়ার গন্ধটা আমাকে মোহিত করে দেয়।

তাহলে একটা টেষ্ট করে দেখবে কি?

বাবা না, আমার দ্বারা তা সম্ভব নয়।

একটা কথা বলি শোন, তোমাকে আমার বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলার জন্য বিয়ের ব্যাপারে যেসব শর্ত লিখে চিঠি দিয়েছিলাম, তাতে যখন কোন কাজ হল না তখন সেটা রেজেষ্ট্রি করার আর দরকার নেই। যতক্ষণ ওটা থাকবে ততক্ষণ আমি আমার বিবেকের কাছে অপমান বোধ করব। মামার কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে নষ্ট করে ফেল।

চিরকাল ওটা আমি সঙ্গে রাখব। আমার জীবদ্দশায় অথবা মৃত্যুর পর আমার কোনো আত্মীয় যেন তোমার বিরুদ্ধে কোনো বিষয় নিয়ে কোর্টে নালিশ করতে না পারে।

তার যুক্তি শুনে আশ্চর্য না হয়ে পারলাম না। বললাম, ঐ দলিলটা থাকলে তোমার ক্ষতির কারণ হতে পারে। আমি যদি কোনো দিন তোমাকে বিট্রে করি, তাহলে তুমি কোনো রকম ব্যবস্থা নিতে পারবে না।

আমি নিশ্চিত, যতদিন আমরা বেঁচে থাকবো, ততদিন কেউ কাউকে বিটে করতে পারব না।

এত নিশ্চয়তা পেলে কোথা থেকে?

আমার প্রেমের কাছ থেকে। জ্ঞান হওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত আমি যা চিন্তা করেছি তা মিথ্যা হয়নি।

ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে একমাত্র আল্লাহপাক ওয়াকেফহাল। মানুষ নিজের ভবিষ্যৎ নিজে গড়তে যেয়ে অনেক সময় বিফল হয়।

আমি তকদির বিশ্বাস করি। সাধ্যমত তদবীর করে যাব। ফলাফল উপর ওয়ালার হাতে।

এবার জিজ্ঞেস করলাম, ডিগ্রীতে এ্যাডমিশন নেবে নাকি?

তুমি যা বলবে তাই করব।

যা বলব তা যদি তোমার মতের বিপরীত হয়, তাহলে তো এখন থেকে মনোমালিন্য শুরু হবে।

কখনও না। যেদিন থেকে তোমাকে ভালবেসেছি, সেদিন থেকে নিজের কামনা বাসনা নিজের কাছে খারাপ লেগেছে। নিজস্ব সবকিছু ত্যাগ করে তোমার মতে চললে ইহকাল ও পরকালে যে সুখ শান্তি পাব, সে কথা আমার প্রেম অনেক আগেই আমাকে শিক্ষা দিয়েছে। কেউ যদি আমাকে জিজ্ঞেস করে, তোমার এখন কি করতে বা কি খেতে ইচ্ছা করছে? তার উত্তরে বলব, আমার প্রেমিকের যা যা ইচ্ছা করবে আমারও তাই।

না, তার কথা শুনে চিন্তা করলাম, এত গভীর প্রেম ও কেমন করে পেল? কে তাকে এত শিক্ষা দিল? মনে করলাম জিজ্ঞেস করব নাকি, বিকেলে কোনো প্রোগ্রাম। আছে কিনা?

ঠিক এমন সময় সেলিনা বলে উঠল, বিকেলেও তোমাকে ছাড়ছি না। প্রথমে পার্কে যাব, তারপর কিছু কেনাকাটা করব।

কি করে যে ও আমার মনের খবর জানতে পারে, তা ভেবে খুব আশ্চর্য হলাম।

আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে সেলিনা আবার বলল, তোমাকে একটা অনুরোধ করছি, আজ থেকে কোনোদিন যে কোনো বিষয়ে অর্থাৎ-খাওয়া, পরা ও কোনো কাজের ব্যাপারে আমার কি পছন্দ হয়, কি ভালো লাগে বা কি ইচ্ছা জাগে, কোনো কিছুই জিজ্ঞেস করবে না। কারণ তোমার সবকিছু আমার নিজের চেয়ে অধিক পছন্দ।

বেলা বারটার কিছু আগে একজন পিয়ন এসে আমাদেরকে কোর্টে নিয়ে গেল। কোর্টের কাজ সারতে দেড়টা বেজে গেল।

মামা বললেন, তোমরা বাসায় গিয়ে খেয়ে নাও। আমার ফিরতে দেরি হবে।

খাওয়া দাওয়া শেষ হবার পর সেলিনা বলল, চল, এবার রওনা হওয়া যাক।

দাদুকে গাড়ি নিয়ে আসতে বলবে না?

খেয়ে উঠেই ফোন করেছিলাম। উনি দশ মিনিট ধরে অপেক্ষা করছেন।

মামা মামীর সঙ্গে দেখা না করে কি যাওয়া ঠিক হবে?

তোমরা দুজনে আবার আসবে কিন্তু বলে মামীমা ঘরে ঢুকলেন।

আমরা দুজনে তার পায়ে হাত দিয়ে সালাম করলাম।

তিনি দোয়া করলেন, আল্লাহ তোমাদেরকে সুখী করুন। তারপর বললেন, তোমার মামার খাবার একজন এসে নিয়ে গেছে। উনি কখন ফিরবেন তার কোনো ঠিক নেই

মামীমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমরা রমনা পার্কের লেকের ধারে সেই জায়গায় গেলাম। সেখানে পৌঁছে সেলিনা আমাকে কদমবুসি করল।

আমি তাকে দুহাত দিয়ে ধরে দাঁড় করিয়ে মাথায় ও কপালে চুমো খেয়ে দোয়া করলাম, হে পরওয়ারদিগারে আলম, তুমি আমার প্রেমিকার সমস্ত নেক মকসুদ পুরণ কর। আমি যেন তাকে সুখ শান্তি দিতে পারি সে তওফিক তুমি আমাকে এনায়েৎ কর। তারপর তার ডান হাতটা নিয়ে চুমো খাওয়ার সময় শাহাদাৎ আঙ্গুলে আস্তে করে কামড়ে দিলাম।

সেলিনা একবার কেঁপে উঠে কামড়ে দেওয়া আঙ্গুলটা নিয়ে চুষতে লাগল।

বললাম, এত জায়গা থাকতে এখানে এলে কেন?

এই জায়গাটাকে চিরকালের জন্য স্মরণীয় করে রাখলাম। কিছু মার্কেটিং করব, কোথায় যাবে? নিউ মার্কেট, না বায়তুল মোকাররমে?

গ্যানিসে, তার আগে বায়তুল মোকাররমে একবার যাব।

দাদুকে সেই মতো বলে গাড়িতে উঠলাম। বায়তুল মোকাররমে পৌঁছে দোতলার একটি জুয়েলারী-দোকানে ঢুকলাম।

দোকানের ম্যানেজার আমার খুব বন্ধু লোক। কয়েকদিন আগে তাকে দুটো আংটি তৈরি করার অর্ডার দিতে এসে সেলিনার ব্যাপারটা বলেছিলাম।

আমাদেরকে দোকানে ঢুকতে দেখে সালাম দিয়ে বললেন, কি খবর খান সাহেব? সাথে নিশ্চয় নতুন ভাবি?

সালামের উত্তর দিয়ে বললাম, ঠিক ধরেছেন।

তাহলে তো মিষ্টি খাওয়ান উচিত।

সে সব আর একদিন হবে। আজ সময় কম, আপনি আংটি দুটো তাড়াতাড়ি দিন।

ম্যানেজার দুটো ছোট বাক্স এনে কাউন্টারের উপর রাখলেন।

আমি সেলিনাকে বললাম, দুটি বাক্সে দুজনের নাম লেখা দুটি আংটি আছে, বাক্স না খুলে তোমারটা তোমাকে বেছে নিতে হবে। কি, পারবে না?

সেলিনা কয়েক মুহুর্ত আমার মুখের দিকে চেয়ে কি যেন চিন্তা করল। তারপর একটা বাক্স খুলে ফেলল।

আমরা আশ্চর্য হয়ে দেখলাম, যে বাক্সটা খুলল, তাতে তারই নাম লেখা আংটিটা রয়েছে।

আমি আংটিটা নিয়ে তার ডান হাতের অনামিকায় পরিয়ে দিলাম।

সেলিনা অন্য বাক্সটা খুলে নূরজাহান নাম লেখা দেখে বলল, এটা নিশ্চয় আপামণির নাম?

হ্যাঁ বলে ম্যানেজারকে দাম মিটিয়ে দিয়ে গাড়িতে উঠে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কী করে জানলে কোনটাতে তোমার নাম লেখা আছে?

তা বলতে পারব না। শুধু এইটুকু বলতে পারি, আল্লাহপাকের মেহেরবাণীতে আমার প্রেম জয়ী হয়েছে।

তোমার প্রেমের দাম আমি দিতে পারব কিনা জানি না। আল্লাহতায়ালার কাছে দোয়া করছি, তিনি যেন তোমাকে সুখি করেন।

গ্যানিসে গিয়ে সেলিনা বলল, তোমার পছন্দমতো আমার জন্য কাপড় চয়েস করে দাও।

আমি দোকানের একজন কর্মচারীকে ওর মাপের সালওয়ার কামিজ দেখাতে বললাম, অনেকগুলোর মধ্যে সবুজ ও হলুদ রং এর দুসেট পছন্দ করে বললাম, এই গুলোর মেমো দিন, ছোট বড় হলে চেঞ্জ করে নেব। তারপর সেলিনাকে জিজ্ঞেস করলাম, জরিনার জন্য কিছু কিনবে না?

জরিনা গতকাল আম্মার সঙ্গে নিউমার্কেটে গিয়ে কিনেছে।

ক্যাশ কাউন্টারে গিয়ে মেমো নিয়ে টাকা দেওয়ার জন্য যেই মানিব্যাগ বের করেছি, অমনি সেলিনা ঝটকরে আমার হাত থেকে মানিব্যাগ কেড়ে নিয়ে কর্মচারিটিকে ঐ কালারের আরও দু সেট দিতে বলল।

আমি ব্যাপারটা বুঝতে পেরে দোকানের কর্মচারীকে শুধু হলুদ সেটটা দিতে বলে সেলিনাকে বললাম, মানিব্যাগটা দাও।

দেব, তবে এখন নয়। তোমার জন্যেও কাপড় চয়েস কর।

বললাম, আজ নয়, অন্যদিন।

আমি যে একটু রেগে গেছি, তা বুঝতে পেরে সেলিনা তিন সেট কাপড়ের দাম মিটিয়ে দিয়ে বলল, চল, আজ আর কিছু কিনব না। গাড়ির কাছে এসে আমাকে মানিব্যাগটা ফেরৎ দিয়ে বলল, তুমি রাগ করো না। আজ তোমাকে আমি শুধু কাপড় চয়েস করে দিতে এনেছি। অন্য দিন তুমি যা খুশী কিনে দিও, আপত্তি করব না। আর এই সেটটা আজকের আনন্দের দিনে আপামনিকে উপহার স্বরূপ দিলাম বলে একটা কাপড়ের বাক্স আমার হাতে দিল।

তোমার কথা কিন্তু বলতে পারব না।

তোমার যা ইচ্ছা তাই বলো।

সেলিনাকে বিদায় দিয়ে আমি আবার গ্যানিসে গিয়ে দুটো বাচ্চার দুসেট কাপড় কিনলাম। তারপর মসজিদে আসরের নামায পড়ে ঠাঠারী বাজারে এক বন্ধুর দোকানে গেলাম। সেখানকার কাজ সেরে মাগরিবের নামায পড়ে বাসায় ফিরলাম।

আমার স্ত্রী হাত থেকে কাপড়ের প্যাকেটটা নিয়ে খুলে খুব খুশি হল।

বাথরুমে হাতমুখ ধুতে যাওয়ার সময় নতুন সেটটা পরতে বললাম। ফিরে এসে দেখি, নতুন কাপড় পরে নিজেকে ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় দেখছে।

আমি আংটিটা পকেট থেকে বের করে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে তার আঙ্গুলে পরিয়ে দিয়ে বললাম, আজ তোমাকে খুব সুন্দরী দেখাচ্ছে।

আমাকে কদমবুসি করে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, কি ব্যাপার, আজ এতগুলো টাকা খরচ করলে যে?

আমি তার মাথায় চুমো খেয়ে বললাম, আমার মন চাইল, তাই করলাম। কেন? কোনো অন্যায় করেছি নাকি? তুমি কৈফিয়ৎ চাইছ যে?

আমি কি তাই বললাম, বলে আমাকে জড়িয়ে ধরে চুমো খেল।

আমিও তার প্রতিদান দিলাম।

গল্পের বিষয়:
ইসলামিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত