ক্রন্দসী প্রিয়া: ১. মীরপুরে এক আত্মীয়ের বাড়ি

ক্রন্দসী প্রিয়া: ১. মীরপুরে এক আত্মীয়ের বাড়ি

১. মীরপুরে এক আত্মীয়ের বাড়ি

০১.

মীরপুরে এক আত্মীয়ের বাড়ি থেকে ফেরার পথে বাসে হঠাৎ অন্তরঙ্গ বন্ধু জামানের সাথে দেখা। সালাম ও কুশলাদি বিনিময়ের পর বলল, তোর সঙ্গে অনেক দিন পর দেখা হল। এখন তুই কিছু করছিস, না শুধু লেখা নিয়ে আছিস?

বললাম, আমার কথা বাদ দে। তুই লাইব্রেরীর চাকরি ছেড়ে কি যেন কেমিকেলের ব্যবসা করছিস শুনেছিলাম, সেটা এখন কেমন চলছে?

আল্লাহপাকের রহমতে ভালই চলছে। তা ছাড়াও একটা বইয়ের দোকান করেছি। একদিন ভাবি ও ছেলেমেয়েদের নিয়ে আমাদের বাড়িতে আয় না। বাড়ি করেছি শুনিস নি বোধ হয়?

না শুনিনি। বাড়ি যখন করেছিস তখন ব্যবসা ভালই চলছে নিশ্চয়?

হ্যাঁ বলে একটা কার্ড আমার হাতে দিয়ে বলল, কবে আসবি বল? তোর সঙ্গে তো প্রায় দশ বছর পরে দেখা হল, এর মধ্যে আমার জীবনে একটা রোমান্টিক ও মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে গেছে। তুই আগামী শুক্রবার ভাবিকে নিয়ে সকালের দিকে আসবি। তোর ভাবিকে বলে লাখবো। ও শুনলে খুব খুশি হবে। তোদের কথা প্রায় মাঝে মাঝে জিজ্ঞেস করে। ঐদিন ঘটনাটাও শোনাব।

বললাম, ঠিক আছে, ইনশাআল্লাহ যাব।

গুলিস্তানে আসার পর বাস থেকে নেমে জামান আমাকে নিয়ে একটা রেষ্টুরেণ্টে ঢুকে চা-নাস্তার অর্ডার দিল।

জিজ্ঞেস করলাম, তোদের ছেলেমেয়ে কয়টা?

দুই ছেলে ও এক মেয়ে। তোদের?

মৃদু হেসে বললাম, তিন বছর হল বিয়ে করেছি। এখনও হয়নি।

এমন সময় মেসিয়ার নাস্তা নিয়ে এলে জামান বলল, নাস্তা খেয়ে নিই আয়। আমার একটু তাড়া আছে। শুক্রবার আসিস, চুটিয়ে গল্প করা যাবে।

রেষ্টুরেণ্ট থেকে বেরিয়ে জামান একটা রিকশায় উঠে বলল, চলি দোস্ত। তুই কিন্তু ভাবিকে নিয়ে সকালের দিকে আসবি, একসঙ্গে নাস্তা খাব। তারপর সালাম বিনিময় করে রিকশা ওয়ালাকে বলল, সদরঘাট চল।

বাসায় এসে গিন্নীকে বললাম, আজ বহুদিন পরে বাসে বন্ধু জামানের সঙ্গে দেখা হল। তার কথা তোমার মনে আছে?

আমার স্ত্রী বলল, সেই বন্ধু তো? যে নিউমার্কেটে লাইব্রেরিতে চাকুরি করত? আমাদের বাসায় কয়েকবার এসেছে?

হ্যাঁ, সে এখন চাকরি ছেড়ে দিয়ে কেমিকেলের ব্যবসা করে বেশ টাকার মালিক হয়েছে, একটা বাড়িও করেছে। তারপর কার্ডটা তার হাতে দিয়ে বললাম, এটা তার ঠিকানা। আগামী শুক্রবার আমাদেরকে যেতে বলেছে। না গেলে বেচার মনে খুব কষ্ট পাবে।

কার্ডের উপর চোখ বুলিয়ে ফেরৎ দেওয়ার সময় আমার স্ত্রী বলল, বেশ তো যাওয়া যাবে।

শুক্রবার সকাল নটার সময় স্বস্ত্রীক জামানদের বাড়িতে গিয়ে পৌঁছালাম। সালাম বিনিময়ের পর জামান ও তার স্ত্রী অভ্যর্থনা করে আমাদেরকে ড্রইংরুমে বসাল।

জামানের স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলাম, ভাবি কেমন আছেন?

আল্লাহপাকের রহমতে ভাল আছি। তারপর লেখক সাহেবের পরবর্তী কি বই কবে নাগাদ বেরোচ্ছে? আপনার আগের দুটো বই কিন্তু দারুন হয়েছে।

জামানও সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল, সত্যি দোস্ত, তোর জওয়াব নেই।

বললাম, কতটা দারুণ হয়েছে জানি না, তবে তোরা দুজনেই যখন সার্টিফিকেট দিচ্ছিস তখন মনে হচ্ছে, দারুণ না হলেও কিছু একটা হয়েছে। বর্তমানে প্রেমের পরশ নামে একটি বই লিখছি।

বন্ধুপত্নী বলল, নামটা শুনে মনে হচ্ছে এটাও দারুণ হবে।

দোয়া করুন, আল্লাহপাক যেন আপনাদের মনের বাসনা পুরণ করার তওফিক আমাকে দান করেন।

তাতো করবই, তারপর আমার স্ত্রীর হাত ধরে বলল, আপা, আপনি চুপ করে আছেন কেন? আমরা পাঠক-পাঠিকারা যখন ওঁর লেখা পড়ে এত আনন্দ পাই তখন আপনার তো সব থেকে বেশি আনন্দ পাওয়ার কথা।

আমার স্ত্রী কিছু বলার আগে জামান বলে উঠল, তুমি বেচারীকে কিছু বলার চান্স দিচ্ছ কই!

তুমি থামতো বলে বন্ধুপত্নী বলল, তোমরা বসে গল্প কর, আমরা ভিতরে যাচ্ছি। তারপরে চলুন আপা বলে আমার স্ত্রীকে নিয়ে চলে যেতে উদ্দত হল।

জামান বলল, দয়া করে একটু জলদি আমার বন্ধুর জন্য কিছু পাঠাও। কত বেলা হয়ে গেছে দেখছ না?

শুধু বন্ধুর জন্য পাঠাব, আর তোমার জন্য? জানেন আপা, আমার উনি না ভীষণ পেটুক। সকাল থেকে কিছু খাওয়ার জন্য কয়েকবার তাগিদ দিয়ে বলেছে, মেহমানরা কখন আসবে তার ঠিক নেই, যখন আসবে তখন না হয় আর একবার তাদের সঙ্গে খাওয়া যাবে। এখন কিছু দাও না, খিদেয় পেট চোঁ চোঁ করছে।

আমি বললাম, নটার আগে কিছু পাচ্ছ না। এর মধ্যে যদি না আসে তখন দেখা যাবে।

আমার স্ত্রী হেসে ফেলে বলল, এটা আপনার অন্যায় হয়েছে। ভাই সাহেব খিদে পেয়েছে বলা সত্বেও আপনি তাকে কিছু খেতে না দিয়ে ঠিক করেন নি।

আমি বললাম, ওর কাছে আপনার ক্ষমা চাওয়া উচিত।

ভাবি বলল, আমি আপনাদের জন্য এত করলাম, আর আপনারা দুজনেই আমার দোষ দিচ্ছেন। এ যে দেখছি-যার জন্য চুরি করি সেই বলে চোর।

জামান বলল, হয়েছে হয়েছে, আমার কাছে আর ক্ষমা চাইতে হবে না। তাড়াতাড়ি কর, নচেৎ দেরি করলে ক্ষমা চাইলেও কিন্তু করব না।

স্বামীর প্রতি একবার কটাক্ষ হেনে ভাবি বলল, ক্ষমা চাওয়ার মতো অন্যায় করলে তো ক্ষমা চাইব। তারপর সে আমার স্ত্রীকে নিয়ে ভিতরে চলে গেল।

খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা বেশ ভালই হয়েছিল। তখন বর্ষাকাল। দুপুরের পর মুষলধারে বৃষ্টি নামল। জোহরের নামায পড়ে খাওয়ার পর্ব শেষ করে আমাকে নিয়ে ড্রইংরুমে যাওয়ার সময় জামান স্ত্রীকে বলল, তোমরা দুজনে গল্প কর, আমাদের কাছে এসে ডিষ্টার্ব করো না। আমাদের দুজনের মধ্যে বিশেষ কিছু কথা। আছে। তবে এমন বর্ষামুখর দিনে মাঝে মাঝে ছোলা-কড়াই ভাজা আর চা পাঠালে খুব খুশী হব। তারপর ড্রইংরুমে এসে দুজনে মুখোমুখি সোফায় বসে সিগারেট ধরালাম।

প্রথমে আমিই বললাম, তুই কি যেন তোর জীবনের ঘটনা বলবি বলেছিলি?

জামান বলল, বলব, তবে তার আগে তোকে কথা দিতে হবে, এটাকে নিয়ে তুই একটা উপন্যাস লিখবি। তোর ফুটন্ত গোলাপ ও বিদেশী মেম বই দুটো তো খুব হীট করেছে। আশা করি, আমারটাও করবে।

বললাম, তোর ইচ্ছা পুরণ করার চেষ্টা করব।

তাহলে আরম্ভ করছি শোন–

.

বেলা তখন দুটো। ১৯৭২ সালের ডিসেম্বরের আধাআধি। জোহরের নামাযের পর খাওয়ার পর্ব শেষ করে দোকানের সামনের আঙ্গিনায় রোদ পোহাচ্ছি। সে বছর শীত বেশ জোরে সোরে পড়েছিল। যখনকার কথা বলছি, তুই তো জানিস তখন আমি ঢাকা গভঃ নিউমার্কেটের একটা বড় লাইব্রেরীতে সেলস ম্যানেজার ছিলাম। অন্যান্য দোকানের কয়েকজন কর্মচারীর সঙ্গে সিগারেট খেতে খেতে গল্প করছি। এমন সময় আমার একজন সহকর্মীর ডাকে আমি দোকানে গেলাম। তিনজন ছাত্রীকে দেখিয়ে সে বলল, ইনারা দুটো বই ফেরত দিয়ে অন্য বই নিতে এসেছেন।

ওদের মধ্যে একজন আমার কাছে এগিয়ে এসে বলল, দয়া করে এই দুটো বই চেঞ্জ করে দিন। তারপর একটা বই কাউন্টারের উপর রেখে বলল, এটার ভিতরের দুটো পাতা ছেঁড়া। আর ওরা গতকাল এখান থেকে যে বইটা কিনেছিল, সেটা না দিয়ে আপনারা ভুল করে অন্য বই প্যাকেট করে দিয়েছেন। তারপর দ্বিতীয় বইটাও কাউন্টারের উপর রেখে বলল, বইয়ের ভেতরে মেমো আছে।

শীতের রোদ থেকে আসতে এমনি বিরক্ত লাগছিল, তার উপর বই চেঞ্জের কথা শুনে আরো বেশি বিরক্ত বোধ করে সহকর্মীকে তাদের মেমো মোতাবেক বইটি দিতে বললাম। যে ছাত্রীটি আমার সঙ্গে কথা বলছিল, তার বইটা ছিল ইন্টারমিডিয়েটের ইংলিশের নোট। আমি ঐ বইটার অন্য এক কপি তাকে দিলাম। তারপর ফেরৎ বইটার ছেঁড়া পাতা খুঁজতে গিয়ে সেখানে এক টুকরো কাগজ ভাঁজ করা দেখলাম।

কাগজটা ছাত্রীটিকে ফেরৎ দিতে গেলে সে আস্তে করে বলল, ওটা আপনাকে দিয়েছি, পড়ে দেখবেন।

প্রথমে কথাটা আমি বুঝতে পারিনি। পরক্ষণে কথাটার ইঙ্গিত বুঝতে পেরে মেয়েটির দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালাম, হলুদ রঙ এর জাপানি সিফনে আবৃত দেহ থেকে জ্যোতি বেরুচ্ছে। দীর্ঘায়ত চোখে অপূর্ব কোমলতা।

চার চোখ এক হতে মেয়েটি স্নিগ্ধ কণ্ঠে শুধাল, আমাকে চিনতে পারছেন না?

আমি একটু চিন্তা করে বললাম, এখানে আমার চেনা জানা কোনো মেয়ে নেই। তবে আপনাকে যেন কোথায় দেখেছি বলে মনে হচ্ছে।

মেয়েটি তখন মিনতি সুরে বলল, আপনার সঙ্গে আমার খুব জরুরী কথা আছে। এই চিঠিটা পড়ে সেইমতো আমার সঙ্গে দেখা করলে খুব উপকৃত হব।

কিন্তু আপনার সঙ্গে আমার কোনো প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না

মৃদু হেসে মেয়েটি জওয়াব দিল, দয়া করে তর্ক করবেন না। প্লীজ, মনে করুন এটা একটা আপনার খুব আপনজনের ঐকান্তিক মিনতি।

আমি কিছু বলার আগে তার সঙ্গিনীরা তাকে ডেকে নিয়ে চলে গেল। মেয়েটির স্পর্ধা দেখে যদিও রাগে আমার আপাদমস্তক রি রি করে উঠল, তবু কাগজটায় কি লেখা আছে তা জানার ইচ্ছা দমন করতে না পেরে দোকানের ভিতরে গেলাম। সেখানে অফিসিয়াল কাজের জন্য টেবিল, চেয়ার, লাইট, ফ্যান সব কিছুর ব্যবস্থা আছে। বইয়ের আলমারী দিয়ে জায়গাটা ঘেরা। কাগজটা খুলে পড়লাম

মাননীয় ম্যানেজার সাহেব, আপনি যদি আগামী সাপ্তাহিক ছুটির দিন সকাল আটটায় মার্কেটের এক নাম্বার গেটে আসেন, তাহলে আমি খুব বাধিত হব।
ইতি-সেলিনা।

প্রথম থেকেই মেয়েটির কথা বার্তায় আমি সন্তুষ্ট হতে পারিনি। সবকিছু যেন গায়ে-পড়া ভাব। তারপর এই চিঠি পড়ে বেশ অসন্তুষ্ট হলাম। কারণ আমি ধর্মের আইন যথাসম্ভব মেনে চলি। অন্য যে কোনো লোক হলে হয়তো রোমান্টিক কিছু অনুভব করত। এই রকম চিন্তা করা যে পাপ, তা আমি জানতাম। সিগারেট ধরিয়ে কাগজটা পুড়িয়ে ফেললাম। মনে হলো সব অসন্তোষ দুর হয়ে গেল। তারপর বেমালুম সব কিছু ভুলে গেলাম।

আমি যে দোকানে চাকরি করতাম সে দোকানের মাঝখানের দেয়াল ভেঙ্গে দুটোকে একটা করা হয়েছে। আমি ছাড়াও তিনজন সেলসম্যান ছিল। কর্মদক্ষতায় সকলের চেয়ে সিনিয়ার ছিলাম। আর ঠিকমতো নামায রোযা করতাম। সেই জন্য আমার সহকর্মীরা আমাকে খুব সমীহ করে চলতো। আমি তাদেরকে তুমি বলে সম্বোধন করতাম। এই দোকানে কলেজ, ইউনিভার্সিটি, মেডিকেল কলেজ ও আইনের দেশী-বিদেশী এবং নানারকম ধর্মীয় পুস্তক ছিল।

দোকানের অর্ডার লিষ্ট তৈরির কাজে কয়েকদিন খুব ব্যস্ত ছিলাম। ঐ চিঠির কথা হয়তো কোনো দিন আর মনেই পড়ত না। কিন্তু বিধির বিধান অন্য রকম। উক্ত ঘটনার দিন পনের পর একদিন মার্কেটের ভিতরের একটি ঘড়ির দোকানে আমার রিষ্ট ওয়াচটা ওয়েলিং করতে দিয়ে ফিরছি, হঠাৎ ঐ মেয়েটির সঙ্গে মুখোমুখি দেখা। বলল, আমার সঙ্গে একটু আসুন।

মেয়েটিকে দেখে তার নাম ও চিঠির কথা মনে পড়ে গেল। আর তার স্পর্ধার বহর দেখে রাগে চোয়ালটা আপনা হতেই শক্ত হয়ে উঠল। তথাপি নিজেকে সংযত করে সৌজন্য রক্ষা করার জন্য বললাম, আমার এখন সময় নেই।

মিনতি ভরা কণ্ঠে সেলিনা বলল, আপনার বেশি সময় নষ্ট করব না। দয়া করে যদি আসেন, তাহলে দুএকটা কথা বলেই ছেড়ে দেব।

আমাকে একটা মেয়ের সঙ্গে কথা বলতে দেখে অন্যান্য দোকানের পরিচিত কয়েকজন সেলসম্যান আমাদেরকে বিশেষ ভাবে যে লক্ষ্য করছে, তা আমি এদিক ওদিক তাকাতেই বুঝতে পারলাম। বললাম, ঠিক আছে চলুন।

সেলিনা আমাকে নভেল ড্রিংক রেষ্টুরেণ্টের দোতলার একটি কেবিনে বসিয়ে বলল, কি খাবেন? ঠান্ডা না গরম?

কোনো কিছুই এখন আমি খাব না, যে জন্য ডেকেছেন বলুন।

আপনি যদি কিছু না খান, তবে ভাববো আমার উপর খুব রেগে আছেন।

বিরক্ত হয়ে বললাম, ঠান্ডা।

তাহলে আপনিই অর্ডার দিন।

যদিও তখন শীতকাল তবু বেয়ারাকে ডেকে রাগের চোটে চারটে ঈগলু দিতে বললাম। বেয়ারা চলে যেতে ওকে বললাম, আপনার যা বলার তাড়াতাড়ি বলে ফেলুন।

আপনি যেভাবে রেগে আছেন, তাতে কিছু বলতে সাহস হচ্ছে না।

তাহলে বলার দরকার নেই, চললাম। দয়া করে আমার সঙ্গে আর যোগাযোগ করবেন না। এই কথা বলে আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম।

তখন সেলিনাও দাঁড়িয়ে আমার একটা হাত খপ করে ধরে বলল, প্লীজ, যাবেন না। একটু বসুন।

আহ, কি করছেন, হাত ছাড়ুন। সেলিনা লজ্জা পেয়ে হাত ছেড়ে দিতে আমি বসলাম। এমন সময় বেয়ারা দুটো ঈগলু টেবিলের উপর রাখল। তাকে বললাম, তুমি কেমন মেসিয়ার? অর্ডার দিলাম চারটে, আর দিলে দুটো। অথচ অন্যেরা খদ্দেরকে বেশি খাওয়াবার চেষ্টা করে।

বেয়ারা কিছু বলার আগেই সেলিনা বলল, আমরা যখন এখানে আসি তখন দোকানের মালিক দেখেছেন। উনি জানেন আমি ঈগলু খাইনা। তবু যখন আমার কাছ থেকে অর্ডার গেছে তখন কম করে দিয়েছেন।

বুঝতে পারলাম দোকানের মালিকের সাথে সেলিনার ঘনিষ্ঠতা আছে। বললাম, আপনি ঈগলু না খেয়ে অন্য কিছু খান।

আগে কখনো না খেলেও এবার থেকে খাব বলে সেলিনা খেতে আরম্ভ করল। তারপর বলল, আজ তো আপনার সময় নেই। তাই আপনাকে আগামী ছুটির দিন কিংবা যেদিন আপনার সময় হবে সেদিন আমার সংগে এক জায়গায় যেতে হবে। বিশেষ জরুরী কিছু কথা আমি আপনাকে বলতে চাই। গত ঐ ছুটির দিন আমি সকাল আটটা থেকে বেলা বারটা পর্যন্ত আপনার জন্য মার্কেটের গেটে অপেক্ষা করেছিলাম।

কথাটা শুনে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আমি যে আসবো সেটা আপনি ভাবলেন কি করে? একজন অপরিচতি লোককে একটা চিঠি লিখে আসতে বললেই সে যে আসবে, সেটাই বা বিশ্বাস করলেন কেমন করে?

জানি না, তবে আমার বিশ্বাস ছিল আপনি আসবেন। আর আমি আপনার কাছে অপরিচিতা হলেও আপনাকে আমি অনেক দিন থেকে চিনি।

সেলিনার উত্তর শুনে আরও অবাক হয়ে বললাম, কি কথা। এখানে বলা যাবে না?

সে অনেক কথা, এখানে অত কথা বলা সম্ভব নয়।

একটু চিন্তা করে বললাম, একটা শর্তে যেতে রাজি আছি।

একটা কেন, যদি শত শর্ত দেন, সবগুলো মানতে রাজি।

আপনি এরপর ভবিষ্যতে আমার সঙ্গে আর কোনো রকম যোগাযোগ করবেন না।

ভবিষ্যতের কথা আল্লাহপাক জানেন, তবে আপনার শর্ত মেনে চলার আপ্রাণ চেষ্টা করব।

আগামী ছুটির দিন বেলা নটায় মার্কেটের এক নাম্বার গেটে আসব বলে দোকানের মালিকের নিকট বিল দেওয়ার জন্য গেলাম। উনি বললেন, বিল আগাম দেওয়া আছে। চলে আসার জন্য ঘুরে দেখি, সেলিনা ঠিক আমার পিছনে দাঁড়িয়ে আছে। আমি তার সঙ্গে কোনো কথা না বলে দোকানে চলে আসি।

.

ছুটির দিন বেলা নটায় নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়ে দেখি, সেলিনা একটা প্রাইভেট কারের ডাইভিং সিটে বসে রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে। গাড়িটার নাম কার্ডিলাক। সবুজ রং এর সুন্দর গাড়িটা খুব দামী বলে মনে হল।

আমাকে দেখতে পেয়ে সেলিনা গাড়ি থেকে নেমে সালাম দিয়ে বলল, আপনি রাইট টাইমে এসেছেন। এ দিন সে প্রথম আমাকে সালাম দেয়।

আমি সালামের জওয়াব দিয়ে বললাম, মানি, টাইম এন্ড ক্যারেক্টার এই তিনটি জিনিষ খুব মূল্যবান। মনিষিরা বলেন, মানি ইজ লষ্ট, নাথিং ইজ লষ্ট; টাইম ইজ লষ্ট, সামথিং ইজ লষ্ট; বাট ক্যারেক্টার ইজ লষ্ট, এভরীথিং ইজ লষ্ট। আর ইসলামের আইন অনুযায়ী এই গুলি অমূল্য রতনচরিত্রের উৎকর্ষ সাধনই ইসলামী জিন্দেগীর সারকথা। প্রত্যেক মানুষের উচিত, এই তিনটি জিনিসের মর্যাদা দেওয়া। যদি পৃথিবীর মানুষ এইগুলির অপব্যবহার না করত, তাহলে তাদেরকে কোনো অশান্তির আগুন স্পর্শ করতে পারত না।

সেলিনা মন দিয়ে আমার কথাগুলো শুনল, তারপর আসুন বলে নিজে ড্রাইভিং সীটে বসে পাশের গেট খুলে দিয়ে আমাকে বসতে বলল।

বললাম, আমি পিছনের সীটে বসব।

কক্ষনো না, আপনাকে সামনের সীটে বসতেই হবে।

তার কথার জোর দেখে কয়েক সেকেন্ড চিন্তা করলাম, তারপর আর কিছু না বলে মাঝখানে বেশ ব্যবধান রেখে বসে পড়লাম।

গাড়ি ছেড়ে দিয়ে বলল, আপনি স্বচ্ছন্দে সিগারেট খেতে পারেন। তাতে আমার কোনো অসুবিধে হবে না।

বেশ অবাক হয়ে একটা সিগারেট ধরালাম। ভাবলাম, মেয়েটা অন্তর্যামী না কি? কারণ সত্যিই ঐ সময় আমার সিগারেট খাওয়ার খুব ইচ্ছা হচ্ছিল। হঠাৎ চিন্তা হল, আমাকে কোথায় নিয়ে যাবে আর কি কথাই বা বলবে? গাড়ি, পোশাক পরিচ্ছদ ও চাল-চলন দেখে মনে হচ্ছে খুব বড় লোকের মেয়ে। বন্ধুদের কাছে বড়লোকের মেয়েদের অনেক খামখেয়ালীর গল্প শুনেছি। তখন আর একটি ঘটনার কথা আমার মনে পড়ল।

প্রায় বছর দুই আগে একদিন ইউনির্ভাসিটির দুটি ছাত্রী বই কিনতে আসে। কথায় কথায় একজন হঠাৎ আমার বাড়ি কোথায় জিজ্ঞেস করল। আমি আমার ঠিকানা বললাম। যাওয়ার সময় তাদের একজন কাগজে কিছু লিখে আমার হাতে দিয়ে বলল, ঠিকানা দিলাম, সময় করে একদিন বেড়াতে আসবেন।

কাগজটা হাতে নিয়ে পড়ে দেখি, উনি জনৈক জর্জের মেয়ে, ঠিকানা ধানমন্ডি। ওরা চলে যাওয়ার পর কাগজটা হাতের মধ্যে গুলি পাকিয়ে ড্রেনে ফেলে দিই। চিন্তায় এমনই ডুবে ছিলাম যে, গাড়ি পৌঁছে কখন থেমে গেছে বুঝতে পারিনি। সেলিনা যখন গাড়ির দরজা খুলে দিয়ে বলল, কই, নামুন তখন খেয়াল হল। দেখলাম, একটা চারতলা বিল্ডিং এর করিডোরে গাড়ি দাঁড়িয়ে। গাড়ি থেকে নামতে আমাকে উপরের তলায় নিয়ে গেল। সিঁড়ির মাথা থেকে গোটা বারান্দায় কার্পেট বিছান। পরপর চারটে দরজায় ভেলভেটের ভারি পর্দা। বারন্দার শেষ মাথায় দুটি দরজায় পর্দা নেই। উপরে উঠে দ্বিধাজড়িত পদক্ষেপে এগোচ্ছি। প্রথম দরজা পার হয়ে দ্বিতীয় দরজার কাছে এসে সেলিনা পর্দা সরিয়ে বলল, ভিতরে আসুন। ভিতরে ঢুকবো কিনা চিন্তা করে ইতস্ততঃ করছি দেখে সেলিনা আমার একটা হাত ধরে একেবারে খাটের কাছে নিয়ে গিয়ে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আমার দুহাত ধরে একরকম জোর করে বসিয়ে দিয়ে বলল, একটু বসুন, আমি এক্ষুনি আসছি। তারপর প্রায় ছুটে বেরিয়ে গেল।

আমাকে যে খাটে বসাল সেটা ডবল বেডের স্প্রীংএর তাতে খুব নরম গদী থাকায় আমার শরীরের কিছু অংশ দেবে গেল। মনে হল জীবনে এত নরম বিছানায় কোনোদিন বসিনি। ঘরের চারদিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলাম সত্যিই এরা খুব বড়লোক। ঘরের মেঝেতেও কার্পেট বিছান। জানালা গুলোতে ভারী পর্দা ঝুলছে। একটা বুককেসও মেহগিনি কাঠের একটা বড় আলমারী রয়েছে। আলমারীর একটা পুরো পাল্লায় বেলজিয়াম গ্লাস। আমি যেখানে বসেছিলাম তার সোজাসুজি আলমারী থাকায় আয়নায় নিজের ছবি দেখতে পেলাম। আমার পোশাক দেখে এই পরিবেশের সঙ্গে বেমানান মনে হল। ড্রেসিংটেবিলের পাশে একটি সেক্রেটারিয়েট টেবিল। তার দুপাশে দুটো চেয়ার রয়েছে। ভাবলাম, চেয়ারে না বসিয়ে খাটে বসাল কেন? চেয়ারে বসাই ভাল। এই মনে করে উঠে দাঁড়িয়ে দরজার দিকে লক্ষ্য করতেই দেখতে পেলাম, একজন মধ্যবয়স্কা সুন্দরী স্বাস্থবতী মহিলা পর্দা সরিয়ে আমার দিকে রাগের সঙ্গে তাকিয়ে আছেন। চোখে চোখ পড়তেই বললেন, কে তুমি? এখানে কেন এসেছ? বেরিয়ে যাও। আবার যদি কোনো দিন আসতে দেখি, তাহলে পুলিশের হাতে তুলে দেব। স্কাউড্রেল, বদমাশ, জোচ্চোর, লোফার, শিঘ্রী বেরিয়ে যাও।

আমি লজ্জায়, ঘৃণায় ও অপমানে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে নীচের দিকে তাকিয়ে রইলাম, আর সেলিনার বোকামীর জন্য ওর উপর খুব রেগে গেলাম।

আমাকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মহিলাটি আবার বললেন, যাবে? না পুলিশে ফোন করব?

আমি তখন ধৈর্যের শেষ সীমায় পৌঁছে গেছি। নিজেকে কঠোরভাবে সংযত করে বললাম, দেখুন, কাউকে সাজা দেওয়ার আগে সত্যি সে অপরাধী কিনা সেটা অনুসন্ধান করা এবং তাকে তার অপরাধ জানিয়ে দেওয়া উচিত।

স্টুপিড, আই সে গেট আডট, বলে ভদ্রমহিলা টেবিলের উপর রাখা টেলিফোনের কাছে এগিয়ে গেলেন।

থামুন, পুলিশ ডাকতে হবে না, আমি চলে যাচ্ছি! এই কথা বলে যখন আমি দরজার কাছে এসেছি, সেই সময় সেলিনা ঝড়ের বেগে ছুটে এসে বলল, আপনি যাবেন না। তারপর ভদ্রমহিলাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল, আম্মা, তুমি কাকে কি বলছ? আমি যে ওঁকে অনেক সাধ্য সাধনা করে এখানে এনেছি; আর তুমি অপমান করে তাড়িয়ে দিচ্ছ?

আমি একটও অপেক্ষা না করে ঘর থেকে বেরিয়ে সিড়ির দিকে এগোলাম, তখনও সেলিনা বলছে, আম্মা, তুমি ওঁকে যেতে মানা কর, তোমার পায়ে পড়ি আম্মা। তুমি না ডাকলে উনি ফিরে আসবেন না। আমি ততক্ষণে সিঁড়ি দিয়ে নেমে নিচে এসে একজন রোগামতো বুড়োকে গাড়ি মুছতে দেখলাম।

গাড়ির কাছে পৌঁছেছি, তখন সেলিনা ছুটে এল। আমি বাধা দেওয়ার আগেই আমার একটা হাত ধরে গাড়ির পিছনের দরজা খুলে জোর করে আমাকে ভিতরে ঠেলে দিয়ে নিজেও উঠে আমার পাশে খুব ঘনিষ্ট হয়ে বসল। তারপর সেই বুড়োকে উদ্দেশ্য করে বলল, দাদু, নিউমার্কেট চলুন।

আমি সরে বসে বললাম, আমাকে গুলিস্তানে নামিয়ে দেবেন।

সেলিনা তখনও কাঁদছিল। বলল, না দাদু, বরং রমনা রেস্টুরেন্টে চলুন। কথাটা শুনে খুব রেগে গিয়ে তার দিকে তাকালাম, তার করুণ অবস্থা দেখে রাগটা আপনা থেকেই কেন যেন পড়ে গেল। বললাম, আমাকে আপনার বেডরুমে নিয়ে যাওয়া উচিত হয়নি, ড্রইংরুমে বসাতে পারতেন।

আপনাকে কখনও আমি ড্রইংরুমে বসাতে পারব না! বিশ্বাস করুণ, আম্মা যে আপনার সঙ্গে এমন দুর্ব্যবহার করবে তা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি।

গাড়ি রমনা রেস্টুরেন্টের গেটে থামার পর আমাকে সঙ্গে নিয়ে ভিতরে যাওয়ার সময় সেলিনা ড্রাইভারকে বলল, দাদু, আপনার কোনো কাজ থাকলে সেরে আসুন। আমার ফিরতে ঘন্টা দুই দেরি হবে। কেবিনে ঢুকে সেলিনা বেল টিপে বেয়ারাকে দুগ্লাস লস্যির অর্ডার দিল। দুতিন মিনিটের মধ্যে বেয়ারা লস্যি নিয়ে এলে তাকে বলল, আমারা এখানে ঘন্টা দুই পরে ডিনার খাব। এর মধ্যে তোমাকে আসতে হবে না। দরকার হলে বেল বাজাব, আর যাওয়ার সময় বখশিস পাবে।

ঠিক আছে মেমসাব বলে বেয়ারা চলে গেল!

আমি তখন চিন্তা করছি ওর কথা শোনার পর ফাইনাল বোঝাপড়া করে নিতে হবে, ভবিষ্যতে যেন আমার সঙ্গে কোনোরকম সম্বন্ধ না রাখে।

সেলিনা হঠাৎ উঠে এসে মেঝের উপর বসে পড়ে আমার দুপা জড়িয়ে ধরে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলল, আমার বোকামীর জন্য আপনি খুব অপমানিত হয়েছেন, সেজন্য আমি মাফ চাইছি। বলুন আমাকে মাফ করেছেন।

ঘটনার আকস্মিকতায় ভীষণ আশ্চর্য হলাম। তারপর রাগতস্বরে বললাম, পা ছাড়ুন, উঠুন। চরম গুরুজন ছাড়া কারও পায়ে হাত দেওয়া উচিত না।

আপনি আগে বলুন, মাফ করে দিয়েছেন?

বললাম, পাগলামি করবেন না; পাগলামিরও একটা সীমা আছে। তবু যখন পা ছাড়ল না তখন আমি দাঁড়িয়ে ওর দুটো হাত ধরে জোর করে তুলে চেয়ারে বসিয়ে বললাম, বেশি বাড়াবাড়ি করলে এক্ষনি চলে যাব, যে কথা বলার জন্য এনেছেন বলুন।

সেলিনা তখনও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল। আমি কি করব বুঝতে না পেরে চিন্তিত হলাম। কিছুক্ষণ পর সিগারেট ধরিয়ে বললাম, যা গত হয়ে গেছে তাকে নিয়ে আপনি অত মন খারাপ করছেন কেন? সেটা ভেবে বরং আমারই বেশি রাগ ও মন খারাপ হওয়ার কথা। আপনাকে আমি অনেক আগেই মাফ করে দিয়েছি। নচেৎ আপনার সঙ্গে এখানে আসতাম না। মায়েরা সন্তানদের ওরকমভাবে অনেক বকাঝকা করে। আমি সে জন্য মনে কোনো কষ্ট নিইনি। তবে আপনার নির্বুদ্ধিতার জন্য সে সময় আপনার উপর খুব রাগ হয়েছিল। কিন্তু এখন আর তা নেই। কারণ আপনি যে কাজ করেছেন, সেটা যে মস্তবড় অন্যায়, এই জ্ঞানটাও আপনার নেই।

সেলিনা উঠে গিয়ে বেসিন থেকে হাত-মুখ ধুয়ে এসে আমার দিকে একটা গ্লাস এগিয়ে দিয়ে নিজেও একটা নিয়ে চুমুক দিল। তারপর বলল, ব্যারিষ্টার মইনুল ইসলাম চৌধুরীকে চেনেন?

নামটা শুনেই মনে হোঁচট খেলাম। তখন প্রায় তিন বছর আগের ঘটনা আমার মনের পাতায় ভেসে উঠল।

১৯৭০ সালে ব্যারিষ্টার সাহেব প্রথম যেদিন আমাদের দোকানে আইনের বই কেনার জন্য আসেন তখন সালওয়ার কামিজ পরে এই মেয়েটিও সঙ্গে ছিল। উনি সেদিন অনেক বই কিনেছিলেন। দেরি হচ্ছে দেখে আমি মেয়েটিকে একটি চেয়ার দিয়ে বলেছিলাম, খুকি, তুমি এখানে বসো। তারপর থেকে মেয়েটি ব্যারিষ্টার সাহেবের সাথে প্রায় আসত।

আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে সেলিনা আবার বলল, উনি আমার আব্বা।

বললাম, ওঁকে আমি খুব ভালভাবে চিনি। প্রায় এক বছরের বেশী হয়ে গেল দেখিনি।

৭১ সালে পাক হানাদাররা আব্বাকে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে গিয়ে হত্যা করেছে। এই বলে সেলিনা আবার ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল।

ওঁর মৃত্যু সংবাদ শুনে আমিও খুব দুঃখ পেলাম। বললাম, মাফ করবেন, না জেনে আপনার মনে ব্যাথা দিলাম। সেলিনা কাঁদছিল। আমার তখন অনেক কথা মনের পর্দায় ভেসে উঠল। ব্যারিষ্টার সাহেব সেদিন দোকানে এসেই জিজ্ঞাসা করলেন, আপনাদের ম্যানেজার সাহেব কে?

একজন সহকর্মী আমাকে দেখিয়ে দেয়। আমি তখন একজন কাষ্টমারের বই মেমো করছিলাম। উনি আমার নিকটে এসে একটি লিষ্ট দিয়ে বললেন, দেখুন তো এই বইগুলো আপনার দোকানে আছে কিনা? কথাগুলো এমনভাবে বললেন, যেন আমি লিষ্ট দেখার উপযুক্ত না।

আমি লিষ্টটা নিয়ে একবার চোখ বুলিয়ে বললাম, অর্ধেক বই আছে, আর বাকিগুলো অন্য লেখকের আছে। উনি সব বইগুলী দুইভাগে নামাতে বললেন। ওঁর কথামত বইগুলো কাউন্টারের উপর নামালাম। কাজটা করতে আমার দুতিন মিনিট লেগেছিল।

অবাক হয়ে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কতদুর লেখাপড়া করেছেন?

বললাম, অল্পকিছু করেছি।

পকেট থেকে একটা কার্ড বের করে আমাকে দিয়ে বললেন, বিদেশ থেকে নতুন বই এলেই আমাকে অনুগ্রহ করে জানাবেন। সেই থেকে ওঁর সঙ্গে আমার পরিচয়। এইসব ভাবছিলাম, সেলিনার কথায় সম্বিত ফিরল।

ও তখন বলছে, আমি যখন প্রথম দিন আব্বার সঙ্গে আপনাদের দোকানে যাই তখন আপনাকে দেখেই প্রেমে পড়ি। কথাটা অবিশ্বাস্য হলেও সত্য। তবে প্রেম কি জিনিস তখন আমি জানতাম না। শুধু আপনাকে দেখতে, আপনার কথা শুনতে খুব ভালো লাগত। সেই জন্য আব্বা যখনই মার্কেটে যেতেন, আমিও যেতাম! অনেক সময় আব্বা মার্কেট থেকে কাপড়-চোপড় কিনে যখন বাসায় ফিরতেন, সেই সময় আপনাকে দেখার জন্য মন খুব ছটফট করত। ঐ দিন যখন আপনি আমাকে চেয়ার দিয়ে বললেন, খুকী এখানে বস, তখন আমি চমকে উঠি। ভাবলাম, আপনি আমার নাম জানলেন কি করে? কারণ, আমার ডাক নাম খুকী। সেদিন আমারও কয়েকটা বই কেনার দরকার ছিল। একটা লিষ্টও আপনার হাতে দিয়েছিলাম। লিস্ট দেখে আপনি বললেন, আমাদের দোকানে স্কুলের বই নেই। আমি তখন নবম শ্রেণীতে পড়ি। আব্বা তখন বললেন, খুকীকে একটা ভালো গল্পের বই দিন। আপনি মোসলেম পঞ্চসতী বইটি আব্বার হাতে দিয়ে বললেন, বইটি খুব ভালো। এতে। রিলিজিয়াস জ্ঞান অনেক আছে। আব্বা খুশি হয়ে বলেছিলেন, ছাত্র ছাত্রীদের এই রকম বই পড়া খুব দরকার। বইটা তখন আমার মোটেই পছন্দ হয়নি। কিন্তু বাসায়। এসে অনিচ্ছা সত্ত্বেও যতই পড়তে লাগলাম ততই ভালো লাগল। মুসলমান নারীদের মধ্যে যে ঐ রকম আদর্শ চরিত্রবতী নারী ছিলেন, তা আমি এর পূর্বে কখনও শুনিনি। বইটি পড়ে ধর্মের অনেক কিছু জানতে ইচ্ছা হয় এবং বুঝতে পারলাম আপনি ধার্মিক। ম্যাট্রিক পাশ করার পর আম্মার সঙ্গে আমি ও আমার ছোট বোন জরিনা আপনার কাছে গল্পের বই কেনার জন্য গিয়েছিলাম। তখন মনে হয়েছে আপনি আমাকে চিনতে পেরেও না চেনার ভান করেছেন। পরে সে ভুল। ধারণা আমার ভেঙে যায়। সব সময় আমি আপনার প্রতি লক্ষ্য রেখেছিলাম। আপনি একবারও ভালো করে আমার দিকে তাকালেন না। তারপর ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হয়ে বই কেনার জন্য গিয়ে লিষ্টটা আপনার হাতে দিলাম! আপনি অন্য একজনকে লিষ্টটা দিয়ে বইগুলি দিতে বললেন। মেমো করে যখন টাকাটা আমার কাছ থেকে নিচ্ছিলেন তখন আমি ইচ্ছা করে আপনার হাতের সঙ্গে আমার হাত ঠেকিয়ে দিলাম। এই প্রথম আমার প্রেমিকের ছোঁয়া পেয়ে আমি শিহরিত হই। আপনার দিকে ভীরু চোখে তাকালাম। কোনো পরিবর্তন দেখতে পেলাম না। এতক্ষণ কথা বলে সেলিনা চুপ করল।

আমি বললাম, আপনার আসল কথাটা কি স্পষ্ট করে বলুন।

সেলিনা আমার মুখের দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে বলল, আমি আপনাকে অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে আজ তিন বছর আগে থেকে ভালবেসে আসছি।

তার কথা শুনে প্রথমে চমকে উঠি। তারপর অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, প্রেম-ভালবাসা এই শব্দগুলোর ডেফিনেশান জানেন?

ডেফিনেশান টেফিনেশান আমি বুঝি না। যা বললাম তা ধ্রুব সত্য। এর মধ্যে কোনো বাচালতা নেই। বাচালতাকে আমি ঘৃণা করি। সোজা পথে চলি। বাঁকা পথ চিনি না। আমার বিবেক যখন প্রেমকে এই বলে বোঝাতে চেয়েছে, একজন অজানা অচেনা লোককে ভালো লাগলেও তার সঙ্গে প্রেমের বন্ধনে কিছুতেই আবদ্ধ হওয়া যায় না। তখন আমার প্রেম বিদ্রোহ করে বলেছে, প্রেম কোনোদিন পাত্র বিচার করে না। যে পাত্রের বিচার করে, সে আসল প্রেম থেকে বঞ্চিত। আসল প্রেমিক অনল জেনেও তাতে ঝাঁপ দেয়, যদিও সে জানে অনলে ঝাপ দিলে পুড়ে যাবে তবুও। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আমার প্রেম সত্য। একদিন না একদিন তার জয় হবেই হবে। কথা শেষ করে চুপ করে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।

তার কথা শুনতে শুনতে হতভম্ব হয়ে তার মুখের দিকেই চেয়ে ছিলাম। চোখে, চোখ পড়তে দৃষ্টিটা ফিরিয়ে নিয়ে একটা সিগারেট ধরিয়ে চিন্তায় ডুবে গেলাম। ভাবলাম, এই সমস্ত কথা ও শিখল কোথায়? নিশ্চয় আউট বই অনেক পড়েছে। গত কয়েকদিনের ব্যবহারে এবং আজকের ঘটনা দেখে মনে হল, তার মধ্যে কোনো মিথ্যা বা অভিনয় নেই। হয়তো, সত্যিই অনেকদিন থেকে আমাকে ভালবেসে আসছে। কখাটা চিন্তা করে আমার খুব দুঃখ হল। কারণ সে অপাত্রে প্রেম নিবেদন করেছে। আমার দিক থেকে সবচেয়ে প্রথম এবং বড় বাঁধা, আমি বিবাহিত ও দুই সন্তানের জনক। দ্বিতীয়তঃ আমি একটা লাইব্রেরীর সেলস ম্যানেজার। মাত্র পাঁচশো টাকা বেতন পাই। যদিও আমার একটা সাইড বীজনেস থেকে মাসে এক হাজার টাকা আসে। তবুও এদের সঙ্গে আমার কোনো তুলনা হয় না। আমার স্ত্রী স্বচ্ছল পরিবারের একমাত্র মেয়ে। সে সুন্দরী ও স্বাস্থ্যবতী। আমাদের দাম্পত্য জীবনে এতটুকু অশান্তি নেই। আমরা উভয় উভয়েকে খুব ভালবাসি। তাকে ছাড়া জীবনে অন্য কোনো মেয়ের দিকে দৃষ্টিপাত করিনি। আমার স্ত্রীর মধ্যে এমন কোনো খুঁৎ নেই, যেটা নিয়ে আমি অন্য মেয়ের দিকে চেয়ে তুলনা করব। আমার দেহের গড়ন একহারা হলেও খারাপ না। ছেলেবেলা থেকে আমি খুব কর্মঠ, মাঠে ফসল ফলিয়েছি। স্কুল লাইফ, কলেজ লাইফ এবং বিয়ের চার বছর পর পর্যন্ত ব্যায়ামবীর মনোতোষ রায়ের ছাত্র ছিলাম। এই সর্ব প্রথম সেলিনাকে ভালো করে দেখার ইচ্ছা হওয়ায় তার পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখলাম। দেখতে সুন্দরী, কিন্তু গুণবাচক নয়। রংটা বেশ ফর্সা। মনে হল আঠার বিশ বছরের মেয়েরা যে সমস্ত কারণে পুরুষদের কাছে আকর্ষণীয় হয়, তার সব কয়টা গুণ তার শরীরে আছে। আমার কাছে সব থেকে বেশি আকর্ষণীয় মনে হয়েছিল তার চোখ। যেন কত গভীর প্রেম ঐ চোখের চাহনীর মধ্যে রয়েছে। আমি সেই চোখের দিকে চেয়ে প্রেমের সাগরে বেশ কিছুক্ষণের জন্য নিজেকে হারিয়ে ফেললাম।

সেলিনা আমার দিকে চেয়ে চোখের ভাষা পড়ে নিচ্ছিল। সে নীরবতা ভঙ্গ করে বলে উঠল, আপনি এতক্ষণ ধরে কি ভাবছেন? কিছু বলুন। আমার কথা আমি বলেছি, আপনার কথা শোনার পর আরও কিছু বলব।

আমি কি বলব চিন্তা করতে করতে ঘড়ি দেখলাম, বেলা এগারটা।

আমাকে ঘড়ি দেখতে দেখে সেলিনা বলল, আমার মস্তবড় ভুল হয়ে গেছে, আপনাকে নাস্তা খাওয়ান হয়নি।

তার আর দরকার নেই। নাস্তা আমি বাসা থেকে খেয়ে এসেছি। এখন কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর দিন। আমার মধ্যে কি এমন জিনিস দেখলেন, যার ফলে প্রেমে পড়ে গেলেন? আমি দেখতে তেমন সুন্দর নই, স্বাস্থ্যও খুব ভাল নয়, যা মেয়েদেরকে সর্ব প্রথম আকর্ষণ করে। তাছাড়া আমি দোকানের একজন সামান্য : কর্মচারী, তাতেই নিশ্চয় বোঝেন আমার আর্থিক অবস্থা।

আপনার সমস্ত প্রশ্নের উত্তর কিছুক্ষণ আগে বলেছি। আবার যদি শুনতে চান তাহলে ঐ একই কথা বলব।

আর কোনো প্রশ্ন না করে প্রায় আদেশের স্বরে বললাম, আমার পরিচয় বলছি, মন দিয়ে শুনুন। তারপর চিন্তা করে দেখবেন, কি করবেন।

আমি আপনার পরিচয় শুনতে চাই না।

ধমক দিয়ে বললাম, আপনি শোনতে না চাইলেও আমি শুনাব। কারণ আমার। পরিচয় জানা আপনার একান্ত কর্তব্য। আমি আপনার এত কথা শুনলাম, আর আপনি আমার সামান্য পরিচয়টুকুও শুনতে চান না? সেলিনা আর কোনো আপত্তি না করায় বলতে আরম্ভ করলাম।

১৯৬৫ সালে আমি একজন রিফিউজী হিসাবে পশ্চিম বাংলা থেকে স্বস্ত্রীক ঢাকায় আসি। আমি ম্যাট্রিক পাশ করার পর প্রাইমারী স্কুলে মাষ্টারী শুরু করি। আর নাইট কলেজে ইন্টারমিডিয়েট পড়তে থাকি। সে বছর অর্থাৎ ১৯৬৫ সালে ভারত পাকিস্তানের মধ্যে সতের দিনের যুদ্ধ হয়। যুদ্ধ থেমে যাওয়ার কয়েক মাস পর আমার ছোট বোনের স্টুল পরীক্ষা করার জন্য তার স্বামীর সঙ্গে গ্রামের ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী কলিকাতার এক বড় ডাক্তারের কাছে যাই। আমাদের গ্রাম থেকে কলিকাতার দূরত্ব পঁয়ত্রিশ মাইল। কলেজ স্ট্রীটের মোড়ের এক দোকান, থেকে সিগারেট কেনার সময় এক ভদ্র লোককে ডাক্তারের ঠিকানা দেখিয়ে লোকেশানটা জিজ্ঞেস করলাম। এমন সময় সেখানে কয়েকজন গুণ্ডা ধরনের লোক এল। তাদের মধ্যে একজন আমাকে লক্ষ্য করে বলল, শালা নেড়ে এখনও পাকিস্তান যায় নি? এই কথা বলে আমাকে পাজাকোলা করে তুলে নিয়ে একটা বড় বাড়ির আঙ্গিনায় একধারে দাঁড় করিয়ে বলল, শালা নেড়েকে কেটে ফেলব। ঐ দেশের হিন্দুরা মুসলমানদেরকে সাধারণতঃ নেড়ে বলে বিদ্রুপ করে থাকে। আমার তখনও দাড়ী ছিল। জীবনের প্রথম থেকেই দাড়ী রেখেছি। তার উপর পাজামা। পাঞ্জাবী পরেছিলাম। তাই তারা আমাকে সহজে মুসলমান বলে চিনেছিল। আমার ছোটবোনের স্বামী ধুতি ও শাট পরেছিল বলে তাকে সন্দেহ করে নি। যাই হোক, রাখে আল্লাহ মারে কে? হঠাৎ কোথা থেকে চার পাঁচজন ছাত্র ধরনের ছেলে এসে তাদের সঙ্গে ঝগড়া আরম্ভ করে দিল। তাদের মধ্যে থেকে একজন আমার হাত ধরে গেটের বাইরে এনে বলল, তাড়াতাড়ি এখান থেকে চলে যান। দেখলাম, তখনও ছোট বোনের স্বামী করুণ দৃষ্টিতে বাড়ির গেটের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমি তাকে সঙ্গে নিয়ে দ্রুত সেখান থেকে চলে আসি। আসার সময় ভিতরের ঘটনা তাকে বললাম। সেদিন স্টুল পরীক্ষা না করেই আমরা বাড়ি ফিরে আসি। তারপর সবাইকে জানালাম; আমি আর এখানে থাকব না, পাকিস্তান চলে যাব। কারণ জিজ্ঞেস করলে সবাইকে উক্ত ঘটনা বলতাম। আমরা দুই ভাই, তিন বোন। আমি বাপের বড় ছেলে। ছোট ভাইটি তখন ক্লাস টেনে পড়ে। বোনেদের সকলের বিয়ে হয়ে গেছে। আমাদের সংসার মোটামুটি স্বচ্ছল। চাষের ধান ও তরি-তরকারী, পুকুরে মাছ এবং ঘরের গরুর দুধ কোনোটারই অভাব ছিল না। কিছুদিন আগে থেকে আম্মা আব্বাকে বলে আসছিল, খোকার বিয়ে দিয়ে বৌ আন। আমি আর কত দিন তোমাদের সংসারের ঘানি টানব? শুধু আব্বা আম্মা -আমাকে খোকা বলে ডাকেন। আব্বা তখন বললেন, পঁচিশ বছরের নিচে ছেলেদের বিয়ে দেওয়া উচিত না। আমার বয়স তখন বিশ বছর। আমি যখন (পুর্ব পাকিস্তানে) বর্তমানে বাংলাদেশে চলে আসব বললাম। তখন হঠাৎ করে আব্বা তার ফুপাতো ভাইয়ে সঙ্গে শলা পরামর্শ করে একরাতে তার মেয়ের সঙ্গে আমার জবরদস্তি বিয়ে দিয়ে দেন। বিয়ের দুঘন্টা আগেও তাদের পরামর্শের কথা জানতাম না। আমি খুব ছেলেবেলা থেকে ধর্মের আইন যথাসম্ভব মেনে চলি। আমার দাদাজী বলতেন, ভাই, জীবনে কোনোদিন কোনো কারণেই নামায রোযা ত্যাগ করো না। আর আব্বা বলতেন, অনেষ্টী ইজ দা বেষ্ট পলিসি। আমি তাদের উপদেশ সামনে রেখে সব সময় চলে আসছি। তাই মনে হয় আল্লাহপাকের রহমতে আজ পর্যন্ত পথভ্রষ্ট হইনি। আমার বিয়ে দিয়েও তারা আমাকে ধরে রাখতে পারলেন না। সুযোগমতো স্ত্রীকে নিয়ে চলে আসি। সব কথা বলতে গেলে অনেক লম্বা হয়ে যাবে, তাই সংক্ষেপে বললাম। এখানে আসার পর থেকে এই লাইব্রেরীতে চাকরি করছি।

আমার পরিচয়তো শুনলেন! এখন চিন্তা করে দেখুন, আমি কি আপনার উপযুক্ত? আপনার এত ভালবাসার মুল্য কি করে আমি দেব? আপনি বিরাট বড়লোকের মেয়ে। আমার মত দীন-হীনকে ভালবেসে সারা জীবন দুঃখের সাগরে ভাসবেন। আমি বিবাহিত ছেলেমেয়ের বাবা। সেটা সবচেয়ে বিরাট বাধা বলে আপনার মনে হওয়া উচিত। আপনি আমার প্রেমে পড়েছেন শুনে আমার অন্তর গর্বে ফুলে উঠতো, যদি আমি আপনার উপযুক্ত হতাম। তবে আপনার ভালবাসার কথা আমার চিরকাল মনে থাকবে। কুল ব্রেনে আপনাকে জানাচ্ছে, আমি আপনার কোনো উপকারে আসব না। একটা কথা আপনাকে বলি শুনন, আমার জানাশোনা আপনাদের সমপর্যায়ভুক্ত অনেক ভাল ছেলে আছে। আপনার ভালবাসার মুল্য বাবদ তাদের একজনের সঙ্গে বিয়ের ব্যাপারে যোগাযোগ করে দিতে পারি। এই কয়েকদিনের মধ্যে আপনাকে যতটুকু জেনেছি, তাতে করে আপনার মনের মত ছেলে চয়েস করে দিতে আশা করি পারব। মনে হয় তাতে ঠকবেন না। বাকিটা আপনার তকৃদির। মানুষ সুখ-শান্তির জন্য যত চেষ্টাই করুক না কেন, সব কিছুর চাবিকাঠি সেই উপরওয়ালার হতে।

ঠিক আগের মত আদেশের স্বরে সেলিনা বলে উঠল, থামুন, আমি আর ঐ সমস্ত কথা শুনতে পারছি না। আশা করি, আপনার বক্তব্য শেষ হয়েছে?

আপনি যদি কথা না বাড়ান, তাহলে আমার আর বলার কিছু নেই।

ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সেলিনা বলল, বারটা বেজে গেছে, ডিনার খাওয়া যাক বলে কলিং বেলে হাত রেখে জিজ্ঞেস করল, কি খাবেন?

বললাম, এখানে কিছু খাব না; বাসায় গিয়ে খাব।

এমন সময় বেয়ারা এলে তাকে সেলিনা দুপ্লেট মুরগীর বিরানী অর্ডার দিল। বেয়ারা চলে যেতে বলল, প্রতিদিন তো বাসায় খান, আজ আমি আপনাকে আমন্ত্রণ করে এনেছি, এখানে খেতেই হবে, কোনো কথা শুনবো না।

আবার কি করতে কি করে বসবে ভেবে কিছু না বলে চুপ করে বসে রইলাম।

বেয়ারা খাবার নিয়ে এলে তাকে সেলিনা গাড়ির নাম্বার ও কালারের বর্ণনা দিয়ে বলল, এই গাড়ি যদি গেটে থাকে, তাহলে ড্রাইভারকে খেয়ে নিতে বলুন। তারপর তাকে আরও কি সব অর্ডার দিয়ে নিজের প্লেট থেকে এক টুকরো মাংস আমার প্লেটে তুলে দিয়ে বলল, নিন শুরু করুন।

অনিচ্ছা সত্ত্বেও অল্প কিছু খেলাম। মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে আছে। আবার কি বলবে না কোথাও যাবে এইসব মনে মনে চিন্তা করতে লাগলাম।

আমাকে অল্প সময়ের মধ্যে খাওয়া শেষ করতে দেখে সেলিনা বলল, আপনি এত তাড়াতাড়ি খান কি করে? আপনার ঠিকমত হজম হয়?

কেন? আমাকে দেখে কি পেটের অসুখের রুগী বলে মনে হয়?

না তা হয় না, তবে খাবার সময় ধীরে সুস্থে খেতে হয়।

তা ঠিক, তবে আমার জীবনের অভিধানে স্লো বলে কোনো কথা লেখা নেই। শুধু নামাযের বেলায় এর ব্যতিক্রম হয়।

কেন নামাযের সময় ব্যতিক্রম হয় কেন?

নামায হল মোমেনদের (বিশ্বাসীদের) মেরাজ স্বরূপ। অর্থাৎ স্কুল মোখলুকাতের সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে দিদার। তাঁর স্ততি গেয়ে নিজের অপরাধ ও অপারগতা স্বীকার করে ক্ষমা প্রার্থনা চেয়ে করুণা ভিক্ষা করা। এই কাজ কি আর তাড়াতাড়ি করা যায়? হাদিসে আছে, রাসুলুল্লাহ (দঃ) বলিয়াছেন, যারা অনেক ধন দৌলত চুরি করে, তারা বড় চোর নয়। বরং তারাই বড় চোর, যারা নামাযের সবকিছু আদায় না করে তাড়াতাড়ি নামায পড়ে।

সেলিনা খাওয়া বন্ধ করে আমার কথা শুনল। তারপর লজ্জায় হোক বা অন্য যে কোনো কারণে হোক আর খেল না।

খাওয়া শেষে হওয়ার পর সিগারেট ধরিয়ে বললাম, চলুন উঠা যাক। আশা করি, আপনি আমার কথা চিন্তা করে আমাকে ভুলে যেতে চেষ্টা করবেন।

সেলিনা বলল, আপনার বলার পর আমি কিছু বলব বলেছিলাম; কিন্তু আপনি যে রকম তাড়াহুড়া করছেন, বলতে সাহস পাচ্ছি না। আপনাকে কথা দিতে হবে আগামী ছুটির দিনে এখানে আসবেন।

এখানে আসবার আর কোনো দরকার আছে বলে আমি মনে করি না। তাছাড়া প্রত্যেক ছুটির দিন আসা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। সপ্তাহে মাত্র একদিন ছুটি পাই, সংসারে নানা রকম কাজ কর্ম থাকে।

মিনতি স্বরে সেলিনা বলল, শুধু আর একটা দিন। পরে আর কোনো দিন অনুরোধ করব না।

একটু ভেবে বললাম, এই কথা যেন মনে থাকে। আর আগামী ছুটির দিন। নয়, তার পরের সপ্তাহের ছুটির দিন পার্কের দক্ষিণ দিকের গেটে বিকেল তিনটেয় আসব।

আমরা কথা শুনে তার মুখটা আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল, আর চোখ দুটো পানিতে ভরে গেল। ফেরার সময় সেলিনা বিলের সঙ্গে বেয়রাকে দশ টাকা বখশিস দিল। তারপর আমার কথামতো আমাকে গুলিস্তানে নামিয়ে দিয়ে বিদায় নিয়ে চলে গেল।

বাসায় ফেরার জন্য রিকশায় উঠলাম। মনের মধ্যে তখন নানা রকম চিন্তা হতে লাগল। বাসায় এসে স্ত্রীকে বললাম, হোটেলে খেয়ে এসেছি, শরীরটা ভাল লাগছে না, আমি এখন ঘুমোব। ঘুমোতে গিয়ে চোখ বন্ধ করা সার হল। শুধ সেলিনা ও তার মায়ের কথা মনে পড়তে লাগল। মাথার মধ্যে যন্ত্রণা হতে বাথরুম থেকে হাত মুখ ধুয়ে এলাম। তারপর লুংগীর উপর পাঞ্জাবী চড়িয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে পড়লাম। তখন আমি বাংলা বাজারে থাকতাম। সবকিছু অস্বস্তি লাগছিল। কেবলই মনে হতে লাগল স্ত্রীর কাছে যেন কত বড় অন্যায় করে ফেলেছি। হাঁটতে হাঁটতে সদর ঘাটে নদীর ধারে গিয়ে একটা নৌকা ভাড়া করে মাঝিকে মিটফোর্ড হাসপাতালের দিকে যেতে বললাম। নদীতে কত রকমের নৌকা, ষ্টিমার, লঞ্চ দেখতে দেখতে মন থেকে চিন্তা দুর করার চেষ্টা করলাম। তাতে বিশেষ ফল হল না। আসরের আজান শুনে পাটুয়াটুলির বড় মসজিদে নামায পড়ে আল্লাহপাকের দরবারে ক্ষমা চেয়ে শান্তি প্রার্থনা করলাম। মনটা বেশ হালকা হল; কিন্তু বাসায় ফিরে স্ত্রীর সঙ্গে স্বাভাবিক ব্যবহার করতে পারলাম না। তাকে দেখে মনটা আবার খারাপ হয়ে গেল। আমার স্ত্রী শরীরের কথা জিজ্ঞেস করতে বললাম, শরীরটা ভালো না। সেইজন্য মনটাও খারাপ। কিছু যেন ভালো লাগছে না। এই কথা বলার পর অস্বস্তি ভাবটা আরও বেড়ে গেল। স্ত্রীর কাছে কখনও মিথ্যা বলিনি। আজ মিথ্যা বলে নিজের কাছে নিজে খুব ছোট হয়ে গেলাম। এই অস্বস্তি ভাবটা দুতিন দিন ছিল। শেষে চিন্তা করলাম, যে ভাবেই হোক সেলিনাকে আমার বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে দুরে সরিয়ে দিতে হবে, তাহলে আমি আবার শান্তি ফিরে পাব।

গল্পের বিষয়:
ইসলামিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত