ইন্টারভিউ এর জন্য রেডি হয়েই বসে আছি আমি। প্রতি ইন্টারভিউতেই দেরি হয় কারন রাত জেগে পড়তে হত । কিন্তু আজ দেরি হয়নি কারন, খুশিতে রাতে ঘুমাই নি । আমি আজ জানি যে, এই চাকরীটা হয়ে যাবে । এক বড়-ভাই সব ব্যবস্থা করে রেখেছে । শুধু এটেন্ড করতে হবে আর “কমিশনার” সাহেবের চিঠিটা কোম্পানি ডিজিএম কে দিতে হবে । দুপুর বেলা রোদের মধ্যে গিয়ে টিউশনি করাতে হবে না । ছাত্রীর মা পাশে ঘড়ি নিয়ে ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করবে না যে, আরো তো পাঁচ মিনিট বাকি আছে এখনই চলে যাবেন ? ছাত্রীর বাবা ছাত্রীকে পড়ানোর সময় বারবার সন্দেহ নিয়ে উঁকি দেবে না ।
একটা ছাত্রীর বাবার উপর অনেক রাগ লুকিয়ে আছে । কোনো একদিন গলির অন্ধকারের মধ্যে পেলে কয়েকটা গালি দিয়ে ঠাস করে এক চর মারব শালাকে ।
তবে ছাত্রীর মিষ্টি হাসিটা আর দেখতে পাব না । কেউ আর পড়ার বই ছেড়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসবে না । প্রাইভেট মাস্টার মানে সময়ের কেনা একটা গোলাম ।
আমি এইসব ভাবতে ভাবতে ইন্টারভিউ উদ্দেশ্যে বেড়িয়েছি । তবে বাসে যাব না, আজ যাবো রিক্সায় ।
এখনও অনেক সময় বাকি দেখে পাশের চায়ের দোকানে বসলাম । সাইডেই একটা চশমা পড়া ছেলে অনেকগুলো কাগজপত্র নিয়ে বসে আছে ।
ভাবছি চাকরি টা হলে হয়ত সোমাকে বিয়ে করবো । প্রাইভেট পড়ানো কোন কাজ না । সোমার একটা কথা- শৈলেন, তুমি বেকার । আর বেকার ছেলের কাছে আমার পরিবার বিয়ে দিবে না। ভাবতেই খারাপ লাগে।
পাঁশে বসা ছেলের দিকে তাকিয়ে বলি-
— ইন্টারভিউ দিতে এসেছেন ?
—-বিরক্তির সাথে জবাব দিল, হ্যা । এখানে আজ কাগজপত্র নিয়ে সবাই ইন্টারভিউ দিতেই আসবে ।
— তাকে বিরক্ত হতে দেখে আমার মজা লাগল । ইচ্ছে করছিল ঘাড়ে হাত দিয়ে বলি, আরে শালার-ব্যাটা তোরা লোক-দেখানো ইন্টারভিউ দিচ্ছিস চাকরীটা তো আমিই পাবো । তবে কিছু না বলেই চা খেতে লাগলাম, সাথে একটা সিগারেট নিয়ে জোরে জোরে টান দিতে শুরু করলাম ।
কিছুক্ষন পর মৌখিক পরীক্ষা হবে । সবাই রুমের বাইরে লাইন ধরে বসে আছে । পিয়ন এসে এক এক করে নাম ধরে ডাক দিচ্ছে । আমার একটু হাসিও পাচ্ছে কারন, সবই লোক দেখানো । আমি গিয়ে সেই লোকটার পাশেই বসলাম । তাকে বিরক্ত করে দারুন আনন্দ পাচ্ছি । কিন্তু এখন মনে হয় সে বিরক্ত হচ্ছে না । খেয়াল করলাম তার হাত-পা কাঁপছে, কপালে ঘাম জমে আছে।
জিজ্ঞেস করলাম,
—- ভাই কোনো সমস্যা ?
—–সে চমকে উঠে বলল, ভাই আমার হাতটা একটু ধরেন ।
—- তার হাতটা চেপে ধরলাম । লোকটার প্রতি তাঁর মায়া লাগল ।
— লোক টা একটু ভরসা পেল । বলল থ্যাংকস
— বললাম, এই ইন্টারভিউ দেয়ার দরকার নেই ভাই চলে যান ।
— সে কাঁপতে কাঁপতে বলল, নারে ভাই এই চাকরীটা আমার পেতেই হবে । নাহলে আমার সুইসাইড ছাড়া গতি নেই ।
—-আমি পুরাই আশ্চর্য ! সুইসাইড করবেন কেন ?
—-ভাই আমার মা নেই । বাবা প্যারালাইজড হয়ে বিছানায় পড়ে আছে । সে নিজের কোনো কাজ করতে পারে না । অথচ আমি তার চিকিৎসা করাতে পারি না । সামান্য টিউশনির টাকা দিয়ে বাজারই হয়না । চিকৎসা কিভাবে করাব ? বোনটা বাবার কাছে থাকে । প্রতি ইইন্টারভিউ দেয়ার পর আমার দিকে আশা নিয়ে তাকিয়ে থাকে । কিছু জিজ্ঞেস করার সাহস পায়না ।এদিকে ও স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে । বেতন দিতে পারি না । বলেই লোকটা কেঁদে দিল ।
আমি তার সার্টিফিকেট গুলো হাতে নিয়ে অবাক হলাম । লোকটা এম.বি.এ করে সাধারন জুনিয়র হিসাবরক্ষকের পোস্টে ইন্টারভিউ দেবে । আর আমি ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে কেবল অনার্স পড়েই চাকরী পাচ্ছি । বুকের ভেতরটায় প্রচন্ড ব্যাথা হতে লাগল । তখন নিজেকে নরপিশাচ মনে হচ্ছিল । যেন কারো রক্ত চুষে খাচ্ছি । তাকে সার্টিফিকেট গুলো ফেরত দিয়ে পকেটের কমিশনার চিঠিটা দিয়ে বললাম, ভাই ভেতরে গিয়ে বলবেন আপনাকে কবির সাহেব পাঠিয়েছেন আর এই চিঠিটা দেখাবেন । আজ আপনার চাকরী হয়ে যাবে । বলেই সেখান থেকে বিদায় নিলাম। ভাবতে লাগলাম আমার নিজেরও একটা পরিবার আছে । আমার এখনও অনেক কিছু করার সময় আছে, নিজের জন্য নিজের পরিবারের জন্য । আমি সৎ ভাবে আমার চেষ্টা চালিয়ে যাব । আর এবার ফাইনাল পরীক্ষা টা দিয়ে দেব ।
বিকেলে সোমা এলো আমার কাছে । এসেই বলল-
— কি তুমি চাকুরি পাও নাই ।
— না
— আসলে তোমার চাকুরি করার ইচ্ছা নাই । আমি তোমাকে তিন মাস সময় দিলাম এর মধ্য চাকুরি ও বিয়ে তোমাকে করতে হবে ।
— দেখ তিন মাস পড়ে আমার অনার্স পরীক্ষা । এ সময় আমি কি করে বিয়ে করি । আচ্ছা সোমা চল আজ বিয়েটা করি ।
— না আমি কোন বেকার ছেলে কে বিয়ে করব না । তাছাড়া তুমি ভাল করে জানো আমার বড় জামাই বাবু সরকারী চাকুরি করে । আমি তোমার মায়ের উপর বুঝা হতে পারবো না ।
— আমার মা তো তোমাকে বউ করতে চায় ।
— রাখ তোমার মায়ের কথা । আসলে তোমার মা বাসায় একটা কাজের মেয়ে চায় । না হয় কোন
মা বেকার ছেলে কে বিয়ে করায় ।
— দেখ আমি বেকার না প্রাইভেট পড়াই ।
— পড়াও তো কি জানি । আসলে বড় লোকের মেয়ে খুঁজো গোপনে ।
— সোমা, এভাবে কথা বল না।
— কি ভাবে বলব । আমার ছোট বোন কে তো তুমিই পড়াতে তাই না।
— হ্যাঁ তাই বলে কি আমি তোমার ছোট বোনকে কি লাভ করি নাকি !
— যাই হোক । সব শিয়াল একেই ডাকে । আমার বোন সিমা কিন্তু এখনো তোমাকে মিস করে!!!
— থাক থাক । আমার কাজ আছে আমি যাই ।
— যেতে মানা করি নাই । আজ থেকে তিন মাস মনে থাকে যেন ।
সোমা চলে গেল । আমি কোন সিদান্ত নিতে পারলাম না। এমন করে তিন মাস শেষ । সত্যি সোমার বিয়ে । আমার কাছে খবর চলে আসলো । হাত থেকে সিগারেট ফেলে সোমার বাসায় গেলাম । কিন্তু সোমার বাসার লোক জন বলল সোমা দেখা করবে না। আমাকে চলে যেতে বলল ।
আজ সত্যি আমার মন অনেক খারাপ । কি করবে ভেবে পাচ্ছি না । চাকুরি টা থাকলে হয়ত আজ সোমাকে বিয়ে করতাম।
পরের দিন রাত নয়টা । মাকে নিয়ে গেলাম ডাক্তারের কাছে একটু চেকাপ করাতে এমন সময় দেখলাম ঐ চাকুরি দেয়া ছেলেটা তাঁর বাবা কে নিয়ে এসেছে ডাক্তার দেখাতে । আমাকে দেখে ঐ সে জড়িয়ে ধরল । তাঁর বাবা কে বলল যে চাকুরীটা আমি তাকে দিয়েছি । ভদ্র লোক আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল বাবা তুমি আমাদের পরিবার কে বাঁচিয়েছ । আমি নামাজ পড়ে সারা জীবন তোমার জন্য দোয়া করব । আমার মাকে বলল – আপা আপনি দেখবেন একদিন আপনার ছেলে আপনার মুখ উজ্জল করবে । মা আমাকে জড়িয়ে বলল- বাবা দুঃখ না পেলে জীবন কেমন টা বুঝা যায় না। সামনে তোমার সুন্দর জীবন । চিন্তা করি যাক আমি একা দুঃখ পেলাম কিন্তু একটা গোটা পরিবার তো সুখি হল ।।