অ্যাই হেইট মাইসেলফ, হোয়েন অ্যাই অ্যাম আপসেট।
অফিস থেকে প্রায় ছুটে বের হয়ে এলাম। ক্রোধে, ক্ষোভে, বিরক্তিতে মাথা দপদপ করছে। নিজেকে মানুষ বলে মনে হচ্ছে না। রাস্তার পাশে শব্দ করে থুথু ফেললাম। শান্তি লাগলো না। বসকে গালি দিয়ে আবারো দুবার শব্দ করে থুথু ফেললাম। যে চাকরি করি, সেটা করার চাইতে ঘরে বেকার বসে থাকাও প্রায়ই ভালো মনে হয়। হুট করে চাকরি ছেড়ে দিলে আব্বার অল্প উপার্জনে বাসার অবস্থা আরও বেশি শোচনীয় হয়ে যাবে, আম্মার কষ্ট বাড়ছে, প্রেমিকার সাথে ডেটিং অফ হবে, নিজের হাত খরচের জন্যে কোন কিছুই থাকবে না। এইসব যুক্তি ভেবে দিনের পর দিন নেড়ি কুকুরের মত এই বায়িং হাউজে কাজ করে যাচ্ছি আমি। সকাল সাতটায় অফিসের জন্যে রওনা হও, পৌনে নয়টায় অফিস পৌছাও। ঠিক নয়টা পনের বাজার আগে এক কাপ রঙ চা খেয়ে কাজে লেগে যাও। কাজ করো রাত নয়টা, দশটা কিংবা কোন কোন রাত এগারটা- বারোটা পর্যন্ত। দিনরাত বসের অকথ্য ভাষার গালি খাও আর মাসশেষে কয়েকটা হাজার টাকা নোট হাতে পাও। ব্যস! জীবন শেষ?
শালার বস। বাপ-দাদার টাকায় ব্যবসা করে, কয়েকটা দেশ ঘুরে এসে, গোটা কয়েক ইংরেজি, ইটালিয়ান ভাষা শিখে বাঙালির গুষ্ঠি উদ্ধার করতে আসছে। প্যান্টের বাম পকেটে হাত দিয়ে সিগারেট খুঁজতে থাকি আমি। মাথা যন্ত্রনায় দপ দপ করছে। মনে হচ্ছে অদৃশ্য কোন হিংস্র পশু এসে আমার চামড়া, মাংস ভেদ করে সরাসরি হাড়ে গিয়ে কামড়ে দিচ্ছে। মুখ খারাপ করে মনে মনে কিছু অকথ্য ভাষায় গালাগালি করলাম আমি। রাত সাড়ে দশটার মত বাজে। অফিস থেকে প্রায় ছুটে বেড়িয়ে এসেছি আজ। আর কোনদিন এই জঘন্য অফিসে ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে না। আবার কেন যেন মনে হচ্ছে অফিসে ফিরে গিয়ে বসের সামনে গিয়ে প্রচণ্ড ক্ষোভ নিয়ে চিৎকার করে বলে আসি, আমাকে যে কতটা গালি দিসিস তুই, তার কয়েকশ গুণ গালি তোকে ফেরত দিতে পারবো আমি। তুই শুনবি? মানুষকে মানুষ মনে করিস না ছোটলোক। আবার মনে হচ্ছে ব্যাটাকে গিয়ে শার্টের কলার চেপে ধরে চাপার হাড়টা ভেঙ্গে দিয়ে আসি।
সিগারেট খুঁজে পেলেও ম্যাচ খুঁজে পেলাম না। বিরক্তিতে মন ছেয়ে যাচ্ছে আরও। আশে পাশে কোন পান সিগারেট বা টংয়ের দোকান নেই। সিগারেটের নেশা বেড়ে যাচ্ছে একটু একটু করে। জঘন্য জীবন।
চাকরির চাকর হয়ে গিয়েছি আমি। দিন রাত কামলা দেওয়া ছাড়া আর কিছুই করছি না। মানুষের বাচ্চা হলে কেউ এই অফিসে কাজ করে? আমি গাধার তিন নম্বর বাচ্চা এই জন্যে আমি এই অফিসে কাজ করি। আর পত্রিকায় যখন আসুন জেনে নেই, বসকে পদোন্নতির কথা কীভাবে বলবেন শিরোনামে লেখা ছাপা হয় তখন মন দিয়ে পড়ি। আমি আসলে একটা একটা ছাগল। শুধু ছাগল না বড় ধরণের রাম ছাগল।
রাস্তাঘাট আগের চেয়ে ফাঁকা। রাত সাড়ে দশটার পর এই দিকের এলাকাগুলো একটু একটু করে নীরব হয়ে যায়। টুনটুন করে রাস্তার পাশ দিয়ে দু একটা রিকশা যাচ্ছে। আমি দ্বিধাগ্রস্তের মত হাঁটছি। ম্যাচ খুঁজে না পেয়ে মন তেতো হয়ে গেছে। বাড়ি ফিরতেও ইচ্ছে করছে না। মনে হচ্ছে কোথাও চলে যাই। মনে হচ্ছে, দুনিয়ার সবকিছু ভেঙ্গে ফেলি।
-মামা, কই যাইবেন? আমার ডান পাশে একটা রিকশা এসে থামল। আমি শুনেও না শোনার ভান করে নিজের মত করে হাঁটতে লাগলাম। – মামা যাইবেন না? কই যাইবেন, বলেন। বিরক্ত হয়ে তাকালাম। রিকশাওয়ালা একটি ছেলে। হাড়গিলে চেহারা। বড় বড় নির্বোধ চোখ। আমি ভ্রু কুঁচকে বললাম, ম্যাচ আছে?
-না, মামা। ম্যাচ নাই। সিগারেট খাই না। কথা শুনে মেজাজ আরও খারাপ হয়ে গেলো। ইচ্ছে হল বলি, রিকশাওয়ালার বাচ্চা, সিগারেট খাস না তো কি রোজ রোজ পোলাও খাস? এত ভালোমানুষ হলে রিকশা চালাস কেন? কোন এক অদ্ভুত কারণে আমার রিকশাওয়ালা ছেলেটার উপর এক ধরনের বিজাতীয় ক্রোধ কাজ করতে থাকে। শব্দ করে রাস্তায় আবার এক দলা থুথু ফেলি আমি। তারপর ছোট্ট একটা লাফ দিয়ে রিকশায় উঠে বলি।
– চল।
– কোনদিকে যাইবেন?
কোনদিকে যাইবেন? কথাটা শুনে আমার মেজাজ আরও খারাপ হয়ে যায়। চিবিয়ে চিবিয়ে বলি, লাস ভেগাস যাবো। নিয়া যা।
রিকশাওয়ালা ছোকড়া কিছুটা অনিশ্চিতভাবে মাথা নেড়ে সোজাসুজি রিকশা টানতে থাকে। গাধাটা লাস ভেগাস চিনে না। হা হা হা। খুব সম্ভবত লাস ভেগাসের ঠিকানা সে আমার কাছ থেকে জিজ্ঞেশ করতেও ভয় পাচ্ছে। গাধাটা হয়ত এতক্ষণে বুঝেছে তার যাত্রীটি বেশি সুবিধার নয়। হাসি পাচ্ছে আমার। রাস্তা ফাঁকা। রিকশা হু হু করে ছুটে যাচ্ছে। রাতের আকাশে অন্ধকার বেড়েছে। কয়েক মুহূর্তের জন্যে আমার মনে হয় রিকশা বুঝি আমাকে সত্যি সত্যি লাস ভেগাস নিয়ে যাচ্ছে। যাহ, নিয়ে যা… আরও জোরে রিকশার প্যাডেলে চাপ দে। নির্বোধ রিকশাওয়ালাকে বোকা বানাতে পেরে আমার বেশ আমোদ লাগছে। নিজেকে কেমন যেন বস বস মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে যে কোন সময় কোন এক রাস্তার মোড়ে রিকশা থামিয়ে এই চ্যাংড়া ছোকরা যদি জানতে চায়, এবার কোনদিকে সে যাবে, তাহলেই একে অকথ্য ভাষায় গালি দেওয়ার সুযোগ পেয়ে যাবো আমি। আহ! ভাবতেই মনে আরাম লাগছে। ঢাকার রিকশাওয়ালারা এতো বেকুব হয় নাকি? লাস ভেগাস যে বাংলাদেশেই নেই সেইটা এই চ্যাংড়া জানবে না কেন? হোয়াট দ্য হেল?
রিকশার গতি বাড়ছে। আমার মনে কেন জানি সিগারেট না খেতে পারার কোন আফসোস এখন আর কাজ করছে না। আমি তীব্রভাবে অপেক্ষা করছি এই রিকশাওয়ালা ছোকরাকে গালি দিয়ে ছ্যাড়াভ্যাড়া করে দেওয়ার জন্যে। গালি দিতে দিতে উত্তেজিত হয়ে গেলে দু একটা চড়- থাপ্পড় দিয়ে দিতে পারি। গাধার বাচ্চাটা কি আর করবে? কিচ্ছু করতে পারবে না। ছোকড়া একবার খালি কিছু জিজ্ঞেশ তো করুক। জাস্ট একবার।
-মামা, আমি কোনদিন লাস ভেগাস যাই নাই। আজকে আপনার সাথে আমিও যামু। ঢাকায় আমি এহোনো নতুন। অনেক কিছুই চিনি না।
কেন জানি আমি কোনদিন লাস ভেগাস যাই নাই কথাটা খট করে কানে লাগে আমার। আমিও তো কোনদিন লাগ ভেগাস যাই নি। এই পোড়া দেশের বাইরে
কোথাও যাওয়ার ভাগ্য হয় নি আমার। আমার সাথে কি রিকশাওয়ালা ছোকড়ার কোন পার্থক্য আছে আদৌ?
-তোর বাড়ি কই? ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে জানতে চাই আমি।
-বাড়ি কিশোরগঞ্জ। ঢাকায় আইসি ছয় মাস সতের দিন হইবো। দিনে একটা গ্যারেজে কাম করি। আর রাইতে রিকশা চালাই। আমার রিকশা ছিলো নিজের। চুরি হইয়া গেসে। এইটা ভাড়ার রিকশা।
ছেলেটার কাজের কথা শুনে থমকে যাই। গলায় প্রশ্ন রেখে বলি, তোর রিকশা ছিলো মানে?
-হ মামা, আমার রিকশা। গ্রাম থেইকা ঢাকার চাকরি করতে আর পড়তে আইসিলাম। আম্মার দেওয়া জমানো টেকা দিয়া রিকশা কিনসিলাম। চাকরি পাই না, পাই না। এদিকে টেকা পয়সা শেষ। পড়ালেখা খরচ কেমনে দিমু? আপনি কন? হের পরে এক পোলারে ভাড়ায় রিকশা চালাইতে দিসিলাম। সেই পোলায় এক সপ্তাহের মাথায় আমার রিকশা নিয়া ভাগসে। এক নিঃশ্বাসে বলে যায় সে।
এইবার আমি যেন কিছুটা নড়েচড়ে বসি। ভালো করে তাকিয়ে দেখি কালো-সবুজ চেক শার্ট। সস্তা কালো গ্যাভাডিনের প্যান্ট পরা রিকশাচালক ছেলেটার মাথার চুল পরিপাটি করে আঁচড়ানো। পোষাক দেখে গোছানো আর ভদ্র মনে হয় আমার ছেলেটাকে। কৌতূহলী হয়ে জানতে চাই, এরপর তুই কী করলি?
-এরপর পাগলের মত আমি যে কত খুঁজসি আমার রিকশাটা। আমার রিকশাটা নতুন ছিলো। নাম দিসিলাম সোলায়মান আলী। আমার বাপের নামে নাম। সেই রিকশাটা একটা বাটপার পোলা নিয়া গেলো। এরপর রাস্তায় রাস্তায় ঘুরসি কয়েকদিন। এরপর এক ভালা লোক তার গ্যারেজে আমার কাজ দিলো। সেইখানেই কাজ করি। উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেসি। সন্ধ্যার পরে গ্যারেজের কাম শেষ কইরা এই ভাড়া রিকশা চালাই মামা। টেকা জমাইতেসি, আমি আবার নিজের রিকশা কিনমু।
আমি সব শুনে বিহ্বল হয়ে যাই। আমার এই রিকশাওয়ালা ছেলেটাকে রীতিমত ঈর্ষা হতে থাকে। ছেলেটার কথা শুনে মনে হয়। ওর জীবন হল সাদাসিধে জীবন, পরিশ্রমী, সৎ। একই সাথে এমন এক ছেলে ও যে কিনা যে কোন দুঃখ কষ্ট প্রতারণার কথা সহজভাবে বলতে পারে। নিজের জীবনকে ওর জীবনের সাথে তুলনা করে কুঁকড়ে যাই আমি। অনার্স শেষ করেছি বছর তিনেক হল। মার্ষ্টার্সে ভর্তি হবো হব করেও অফিসের কাজ, প্রেমিকা, আলসেমির জন্যে এখনো ভর্তি হওয়া হই নি। চাকরি করতে হয় বলে চাকরি করছি। মাস শেষে কোন টাকাই হাতে থাকে না, টাকা জমানো তো দূরে থাকুক। নিজের আব্বার বা মায়ের নামে কিছু করবো এমন কিছু কস্মিনকালেও মাথায় আসে নি। উল্টা আমরা ভাই বোনেরা আব্বার স্বল্প উপার্জনের ক্ষমতা নিয়ে বিরক্ত থাকি। স্কুল জীবন থেকে চলমান আর্থিক সমস্যা কারণে বিনা বেতন বা অর্ধ বেতনে পড়িতে চাই, কিংবা মাসে বেতন দিতে বিলম্ব হবে এই ধরনের আবেদন পত্র লিখে লিখে বছর কাটিয়েছি। মন দিয়ে জীবনে কিছুই শিখি নি। পড়ালেখা, কাজ, জীবন কিছুই ভালোলাগে নি কখনো। প্রথম কিছুদিন প্রেম বা প্রেমিকাকে যাও ভালো লেগেছিলো। বর্তমানে প্রেমও আমার কাছে অভ্যাস এবং খরচের খাতায় নতুন হিসাব বাদে আর কিছুই না।
একজন মফিজ, কাদের, জয়নুলের সাথে হয়তো আমার কোন অমিল নেই। নিজেকে অযথাই বাড়িয়ে বাড়িয়ে মহা ক্ষমতাধর কিছু ভেবে বসেছি। যেই রিকশাওয়ালা ছেলেটাকে কিছুক্ষণ আগেও আমি নির্বোধ ভেবে অকথ্য গালি দিয়ে, চড় মারার সুযোগ খুঁজছিলাম এখন তার কাছেই নিজেকে দুর্বল মনে হচ্ছে আমার। বুঝতে পারছি না, আসলে কী করা উচিত। মনে হচ্ছে আমি এখন আমি ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হয়ে উঠছি, মনে হচ্ছে আমি তুচ্ছ থেকে তুচ্ছতর হয়ে মাটির সাথে মিশে যাই।
-মামা, আর কিছুই তো দেখি বলতেসেন না। লাস ভেগাসটা কোনদিকে?
রিকশাওয়ালা ছেলেটার কথায় সম্বিত ফিরে আসে আমার। অপ্রভিত কন্ঠে বলি-
রিকশা থামাও। এক্ষুনি রিকশা থামাও ছেলেটাকে তুই সম্বোধনে ডাকতে কেন যেন গলায় বাঁধে আমার।
বড় হাইওয়ে রাস্তার পাশে রিকশা থেমে যায়। আমি রিকশা থেকে নেমে বলি, ভাড়া কত হয়েছে বলো?
-যাইবেন না মামা? আচ্ছা, ভাড়া দেন। যত খুশি। ন্যায্য ভাড়া যত মনে করবেন তত দিবেন। কোন জোর জবরদস্তি নাই।
-নাহ! যাবো না। এই নাও একশ টাকা রাখো। পঞ্চাশ তোমার ন্যায্য ভাড়া। আর পঞ্চাশ তোমাকে এমনি দিলাম।
-মামা, শুধু পঞ্চাশ টাকা দিবেন। আমি কারও কাছ থেইকা টাকা ধার নেই না। এমনেও টাকা নেই না। ধার করলে তো ধারের টাকায় এতদিনে নতুন রিকশা কিনতে পারতাম, নিজে রিকশা চালাইয়া কষ্ট করতাম না। আপনি এমনেই পঞ্চাশ টাকা দেন।
পঞ্চাশ টাকা দিয়ে আমি পকেটে হাত রেখে ঘুরপথে হাঁটা ধরি। কী মনে করে পেছনে ঘুরে জোরে ডেকে উঠি, এই ছেলে, তোমার নাম জানা হলো না। কী নাম তোমার?
-আমার নাম বসন্ত ।
এবার যেন শেষবারের মত চমকে উঠি আমি। বাতাসে রিকশার বেলের টুং টাং শব্দ মিলিয়ে যায়। আমি আপনমনে বিড়বিড় করি… বসন্ত, ছেলেটার নাম বসন্ত। কি চমৎকার নাম। কী সুন্দর ওর জীবন দর্শন। বসন্ত… বসন্ত… বসন্ত, কারো কাছ থেকে টাকা ধার নেয় না। বসন্ত এমনি এমনি কারও থেকে টাকা নেয় না।
মনে মনে ভাবি কাল সকাল থেকে নতুন করে জীবনটাকে দেখার চেষ্টা করব। হয়তো পারবো না তবুও চেষ্টা করবো। অফিসের বসকে মনে মনে ক্ষমা করে দেই। আমি উদার বলে নয় বরং একজন ভালো মানুষের সন্ধান পেয়ে একজন খারাপ মানুষকে ক্ষমা করে দেই আমি।
অনেক দিন পর নির্জন রাতে আপনমনেই শীষ বাজাই আমি। রাতের অন্ধকারে ক্লান্ত পায়ে নিজেকে নিয়ে হেঁটে যাই। কেবলই হেঁটে যাই…