যাদের মা বেঁচে আছে কমপক্ষে তাদের জন্যই এই লোখাটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ।
–
মেয়ে থেকে নয়, ‘মা’ থেকেই শুরু করি। মায়া এমন এক বাধন যা থেকে ছুটি পাওয়া এতোটা সহজ নয়।
তবুও তিঁনি বাবা-মা’য়ের পরিবারের মায়া ছেড়ে চলে আসে স্বামীর সংসারে। স্বামীর সংসারে এসেই তাকে খুনি
হতে হয় তার প্রতিটি স্বপ্ন খুনের দ্বায়ে। যেদিন প্রথম স্বামীর সংসারে পা দেয় সেদিন থেকে স্বামীর সংসারে তার দায়িত্ব শুরু হয়ে যায়।
যে কখনো গোলাপের কাঁটার অংশে হাত দেয়নি তাকে সারাদিন দা, বটি, ছুড়ি নিয়ে রান্নাঘরে দিনের বেশিরভাগ সময় বন্ধী থাকতে হয়।
তারা স্বামীর সংসার সাবলীল ভাবে বাঁচতে পারে না। তাদের পরাধীন জীবন শুরু হয় ঠিক মৃত্যু অবধি।
তারা কখনো লাঞ্ছনার শিকার হয় শ্বশুর-শ্বাশুড়ির কাছে।
–
সকাল হতেই সবার ঘুম থেকে উঠতে কষ্ট হয়। শুধু হয় না তাঁর, তিনি দিবারাত্রি পরিশ্রম করে শেষ রাতে ঘুম যেয়ে প্রথম সকালে উঠতে পারেন।
তাঁর বিছানা ছাড়তে কষ্ট হয় না। তারপর লেগে পড়েন রাধুনীর কাজে। সকাল বেলা সবার চোখের পাতা যখন খুলবে, সামনে দেখতে পাবে সবার নাস্তা।
অথচ তারপরও মাঝে মাঝে কেউ তাঁকে বলতে ভুলে যায়,‘খেয়েছো?’
–
সবার বলার মতো সময় নেই, শুধু তারই যেন সবাইকে নিয়ে ব্যস্ত থাকার সময়। আর সবার তাঁকে নিয়ে অবহেলার। যখন তিঁনি ‘মা’ হতে যান।
সবার মুখে তখন হাসি ফুটাতে সক্ষম। কিন্তু যার পেটে সন্তান সম্ভাবনা তাকে কতই না কষ্ট পোহাতে হয়, সেই শুধু অনুভব করতে জানে।
তবুও কত ব্যথা সহ্য করে জন্ম দেন সন্তানের। ১০ মাস ১০ দিন গর্ভে সন্তান নিয়ে চলাফেরা অনেক যন্ত্রনার। আর যখন সন্তান ভূমিষ্টের সময় হয়,
তখন তিঁনি এতই ক্লিষ্টতার সাথে প্রবল যন্ত্রণা সহ্য করে শুধু সন্তানের জন্য ঐ মুহূর্তকাল প্রাথর্না করে, যেন তার সন্তান প্রথিবীতে সুস্থ আসে।
সন্তান পৃথিবীতে এলে তাঁর দায়িত্ব আরো বেড়ে যায়। সন্তানের লালনপালন, পরিবারের দায়িত্ব মোচন।
তাঁর সময় কোন পালতোলা নায়ের মতো স্রোতে চলে যায় তিনি বুঝতেই পারেন না। একটু কাজ, একটু সন্তান করে করে তার প্রহর শেষ হয়ে যায়।
সন্তানকে ঘীরে স্বপ্ন, বাকি তার নিজস্ব স্বপ্নগুলো মৃত। সন্তান ধীরে ধীরে বড় হয়। সন্তানকে নিয়ে দায়িত্ব আরো বাড়ে।
স্কুল দিয়ে আসা, নিয়া আসা, হোমওয়ার্ক করানো হতে আরো অনেক নতুন নতুন দায়িত্ব যুক্ত হতে থাকে। অবশেষে, ছেলে বড় হয়।
মা’র দায়িত্ব কমে আর যদি মেয়ে হয়, মেয়েকে ভালো ছেলে দেখে বিয়ে দেয়ার দায়িত্বটা কাধ থেকে নামাতে পারেন না। এই মা জাতিটার স্বপ্ন নেই।
সন্তান বড় হলে সেও ব্যস্ত হয়ে পড়ে। মা কিন্তু কখন বলতে ভুলেন, ‘বাবা বাহিরে ছিলি কিছু খেয়েছিস?’
–
তিনি কখনো ভুলেন না সন্তানের সামনে খাবারের বাটিটা তুলে দিতে। আর সন্তান সে কয়বার তার মা’র খোজ রেখেছে?
সে কি কখনো মা’র সামনে খাবারের বাটি নিয়ে বসেছে? সে কি কখনো অনেক রাত করে খাবার নিয়ে ডাইনিং টেবিলে বসেছিলো মা’র সাথে খাবে বলে?
সন্তানরা স্বার্থপর হয়। কিন্তু সেই সন্তানরা যখন সন্তানের পিতামাতা হয় তখন তারা বুঝতে পারে, তখন তারা আবার নিঃস্বার্থ হয়ে যায়।
–
আমাদের যেই মা সারাজীবন তার রান্নাঘরে বা পরিবারের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থেকেছোন।
তিনি আমাদের শোবার ঘর পর্যন্ত কাজের বুয়ার মতো পরিষ্কার করে গুছিয়ে রেখেছেন। তার কখনো চাহিদা জন্ম হয়নি।
আমরা সন্তানরা ঘুরতে যাই জীবনের অতিষ্ঠতা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য। তার কি কখনো ব্যস্ততা থেকে মুক্তি পাওয়ার প্রয়োজন পড়েনি।
হয়তো কিছু সংখ্যক মায়ের সেই সুযোগ হয় তবুও বছরে এক থেকে দুইবার। কিন্তু যখন তারা আমাদের বলে, বাবা আমার সাথে এখানে চল বা ওখানে চল।
আমরা তখন উত্তরে বলি, আম্মু আমার সময় নেই। যেই মানুষটা আমাদের তারা সারাটা সময় দিয়ে এত বড় করে তুলেছেন এবং দিচ্ছেন।
তাঁর জন্য আমাদের কোন সময় নেই। আমরা তার জন্য কোন উৎসাহ দেখাই না। তিঁনি অসুস্থ হয়ে বিছানায় থাকলে আমরা তাঁর
পাশের থাকারও সময় পাই না, আমাদের বিরক্ত লাগে। অথচ তিঁনি সারা রাত পর্যন্ত আমাদের সেবা করে তোলেন। তিঁনি এমন এক অমায়িক মানুষ,
তাঁর জীবনে বিশ্রাম নেই। এত সব সহ্য করে তিঁনি আজও সবার সামনে ভালো থাকার অভিনয় করতে পারছেন। বাবার কথা নাই বলি, তিনি সারাদিন কর্মব্যস্ত। আমাদের মাকে সময় দেয়ার মতো সময় তার নেই। আর আমাদের থেকেও নেই।
–
আমাদের মা যখন আমাদের কাছে কিছু জানতে চায়, তার ফোনটা হাতে নিয়ে বলে, বাবা এটা কী? কিভাবে তোর নানিকে ফোন করবো?
আমরা তখন বিরক্ত হয়ে বলি, আম্মা ফোনও করতে পারো না, তোমাকে না কাল দেখিয়ে দিলাম। আমাদের মা’কে আমরা প্রতিনিয়ত
কতভাবে কষ্ট দিয়ে থাকি। আমরা যখন সামান্য উচু গলায় কথা বলি, মা’র সাথে চিল্লাচিল্লি করি তখন তার বুকের ভিতর এমন এক
ব্যথা অনুভব হয় যার কারণে তিনি অজান্তেই কেঁদেছেন। তিঁনি কেঁদেছেন আমাদের এজন্য কতদিন।
–
আমরা জানি না, কি করে এই অভাগীর মুখে আনন্দের হাসি ফুটাতে হবে। তিনিতো ছোট থেকেই আমাদের মুখে হাসি ফুটিয়ে তুলছেন।
যখন কান্না করি চোখের পানি মুছে দিয়েছেন। কিন্তু আমরা শুধু তার চোখের পানির কারণ হতে পারলাম, হাসির নয়। তাদের প্রত্যাশাতো বেশি নয়,
সমান্য সৎ ব্যবহার। তাঁর সাথে কিছুক্ষণ সময় অতিবাহিত করা। তাঁকে তাঁর কাজে সামান্য সাহায্য। তিঁনি সামান্যতেই খুশি। আমরা অবশ্যই
চেষ্টা করবো তাকে সামান্যর মাধ্যমে অসামান্য আনন্দ দেয়ার। তাঁকে নিয়ে মাঝে মাঝে ঘুরতে যাবো। তার মনের অব্যক্ত কথাগুলো আমরা শুনবো।
তিনি বাবার সংসারে বাবার কাছ থেকে সময় পেলেন না, সন্তানের কাছ থেকেও না।
–
এমন জীবন নিশ্চই নিঃসঙ্গ জীবন। নিঃসঙ্গতা মানুষকে গ্রাস করলে তার চারপাশেটা অন্ধকার মনে হয়। আমরাই পারবো তার চারপাশটা আলোকিত করে তুলতে।