এককালে মানুষ প্রকৃতির চির সবুজ আর নিরবধি বয়ে চলা নদী ভালবাসতো, গ্রাম ভালবাসতো, কাঁদা মাখা মেঠো পথ ভালবাসতো।
সেই মেঠো পথ দিয়ে হেঁটে চলবার সময় স্বপ্ন দেখতো, একদিন গ্রামের মেঠো পথ আবর্তনের ফলে শহরের রাজপথে পরিণত হবে।
হয়তো সে স্বপ্ন স্বল্প সময়ে বাস্তবায়ন হয়েছে।সাথে পরিবর্তন এসেছে মানুষের ভালবাসার প্রকৃতিতে।
এখন কেন জানি নদী,সবুজ প্রকৃতি,কাঁদা ভরা মেঠো পথ মানুষকে আর টানে না।
মানুষ কেমন যান্ত্রিক হয়ে যাচ্ছে, লোপ পাচ্ছে মমত্ববোধ, ভালবাসা আর নৈতিকতা র।
.
সেই আদিকাল হতে মানুষ প্রভুত্ব আর দাসত্বে বিশ্বাসী।
পৃথিবীতে ক্ষমতা লাভ আর বিত্তশালী হবার জন্য প্রভুত্ব আর দাসত্বে লিপ্ত হয় মানুষ।
এখন তার ব্যাতীক্রম নয়। বর্তমানে শুধু সেটার পদ্ধতিগত পরিবর্তন এসেছে।
.
এসব ভাবতে ভাবতে রহমত সাহেব কল্পনার জগৎ এ ঢুপ দেয়। কল্পনার ডানায় ভর দিয়ে বেরিয়ে আসে দু-একটি কবিতা।
খচাখচা অস্পষ্ট অক্ষরে সেগুলো ঢেলে দেয় পুরাতন ডায়েরির পাতাতে ।
.
তিনি মানুষের তাচ্ছিল্য করবার ভঙ্গিমা দেখে অবাক হয়। কতিপয় উচ্ছৃঙ্খল কবির গালাগাল এসে পড়ে তার গায়ে ।
অশ্লীল, অনাচার, অশালীন কিছু কবিতা যা এ সমাজের নবীনেরা সাদরে গ্রহণ করে শ্রেষ্টত্ব প্রদান করেছে, তিনি তার বিরোধীতা করেন ।
তবু কেও কেও রহমত সাহেবকে কবি সম্বোধন করে ওই সব কবিদের কাতারে দাড় করিয়ে দেয়।
সে সময় ব্যাথায় বুকটা চিনচিন করে ওঠে, তবুও মুখ বুঝে সহ্য করে যান।
.
রহমত সাহেব খোলা আকাশের দিকে তাকায়। বিশাল আকাশের কোণায় কোণায় সামান্য মেঘ খেলা করে ।
সে মেঘ ভেদ করে পার হতে চাই সাতটা আসমান। যেখান থেকে প্রতিটা মানুষের ভাল-মন্দের ফায়সালা করেন আল্লাহ তায়ালা রব্বুল আলামিন।
আল্লাহর ফায়সালার উপর বিশ্বাস স্থাপনের কবিতা লেখেন। এই চির সবুজ প্রকৃতি, নিরবধি বয়ে চলা নদীর দিকে তাকায় ।
তারপর শুকরিয়া আদায় করে আরও কয়েকটি কবিতা লেখেন।
.
হঠাৎ মাগরিবের আযান শুনে খেয়াল হয়, তাকে বাসা থেকে বাজারের জন্য পাঠিয়েছিল। তড়ি-ঘড়ি করে ডায়েরিটা বন্ধ করে উঠে দাড়ান।
মসজিদে গিয়ে মাগরিবের নামায আদায় করে নেন।তারপর ছুটে চলেন বাজারের উদ্দ্যশে।
.
মিনিট দুই বাজার থেকে ফিরেছেন ঘরে । এরই মধ্যে রহমত সাহেবের স্ত্রী বাজারের ব্যাগটা ছুড়ে দিয়েছেন রহমত সাহেবের পায়ের কাছে ।
রহমত সাহেব আমতা-আমতা করে বললেন
“”কি হলো ব্যাগটা ছুড়ে মারলে যে?””
“”মারবো না, ভাগ্য ভালো তোমার মাথায় পটল ফাটায়নি””দাঁতে দাঁত চেপে জবাব দিলেন রহমত সাহেবের স্ত্রী ।
তারপর বললেন “”তোমাকে যে লিস্ট করে দিয়েছিলাম সেটা কই?
তার তো একটাও আনোনি, নিয়ে এসেছো সব সস্তা তরকারি। আর মাছই বা কই?””
.
বাজারের তরকারি লিস্টটা পকেটেই রয়েছে। কিন্তু ইচ্ছা করেই খুলে দেখেননি রহমত সাহেব।
বুক পকেট খাঁ খাঁ করলে, ওসব লিস্টে যে কাজ হয় না সে তিনি ভাল করেই জানেন।
তারপরও স্ত্রী কে সান্তনা দেওয়ার জন্য বললেন “” একদম ভুলে গেছি লিস্ট দেখতে। আর জানোই তো কবিরা ভুলো মনা হয়।
তবে তোমার জন্য কিন্তু কবিতা লিখতে ভুলিনি । “”
হাতের ডায়েরিটা এগিয়ে দিয়ে বললেন”” নাও নাও পড়ে দেখো, তারপর বলো কেমন হয়েছে ?””
রহমত সাহেবের স্ত্রী আরো রেগে গেলেন। চোঁখ বড় বড় করে বললেন “”খালি পেটে তোমার ওই কবিতা পিরিত আমার দ্বারা হবে না গো।
পারলে তোমার ওই কবিতা দিয়ে কিছু টাকা ইনকাম করে দেখাও তো ? তা তো পারবা না ।খালি কবিতা লিখেই খালাস। কি হবে তোমর ওই কবিতা””
রহমত সাহেব কপাল কুচকালেন তারপর নাক ফুলালেন। ইষৎ কন্ঠস্বর কঠিন করে বললেন ” ছি! তুমি কি করে এমনটা ভাবলে?
তুমি অশ্লীল, অশালীন আর অনাচারে ভরা কবিতার সাথে আমার কবিতা বাজারে তুলতে চাও।
আমি চাইলেই অশ্লীল, অশালীন কয়েকটা কবিতা লিখে এ সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যেতে পারি।
সেখানে সাময়িক অর্থ আর লোক দেখানো সম্মান আছে কিন্তু তাতে যে আত্ব তৃপ্তি নেই। নেই পরকালে শান্তি।
আল্লাহ রব্বুল আলামিনের সৃষ্টির গুনগান যাদের নিকট মুল্যহীন, তাদের কাছে তুলে ধরা যে বড় অপরাধ।
এর মুল্য প্রদানে এ পৃথিবীর মানুষ যে ব্যর্থ । আল্লাহ যেনো তোমার ভাবনার মৃত্যু ঘটান। “”
.
রহমত সাহেবের স্ত্রী চুপ হয়ে গেলেন, তারপর বাজারের ব্যাগটা তুলে নিয়ে চলে গেলেন রান্না ঘরের দিকে।
তরকারি কাটতে কাটতে কয়েক বার চোঁখের পানি মুছলেন আচল দিয়ে। তিনি কেনো জানি দারিদ্রতাকে মেনে নিতে পারছেন না কিছুতেই ।
দেওয়াল টপকে পাশের বাসার থরে থরে সাজানো দামী আসবাবপত্রের দিকে মন চলে গেলো।
নিজের শুন্য বাসাটির কথা মনে উঠতেই আরও কয়েক ফোঁটা চোঁখের পানি গড়িয়ে পড়লো চোয়াল বেয়ে।
সবাই কত না সুখী, শুধু তারই দুঃখ মাখানো দিন যাপন ।
মনে মনে সৃষ্টি কর্তার উপর প্রচান্ড ক্ষোভ প্রকাশ করলেন। তার বেলাতেই কেনো এমনটা করলেন তিনি।
.
রহমত সাহেব এশার নামায পড়তে মসজিদে গেছেন। এরই মধ্যে রান্না শেষ করে ঘরে ঢুকেছেন রহমত সাহেবের স্ত্রী ।
ঘরে ঢুকে কিছুতেই মন বসাতে পারলেন না তিনি। হঠাৎ খেয়াল হলো কবিতার ডায়েরিটা পড়ার। চুপ-চুপ টেবিল চেয়ারে গিয়ে বসলেন তিনি।
এক একটা পাতা উল্টিয়ে পড়তে লাগলেন কবিতা।
আল্লাহর সৃষ্টি আর গুনাবলী নিয়ে লেখা কবিতা গুলো মনে ধরতে লাগলো তার। কবিতার একেকটা লাইন জীবন্ত হয়ে উঠলো তার কাছে।
বুঝতে চেষ্টা করলেন কবিতার লাইন গুলো।
< এ ভূ-মন্ডলে যাহা আছে ধন-দৌলত, এ যে নহে মনুষ্য সৃষ্টি, সবই আল্লাহর দান।
যেবা পাইয়াছে যতটুকু, তাহা লয়ে করে যদি শুকরিয়া জ্ঞাপন, সেই সুখী হন।
মনে লয়ে লোভ ব্যাথা,সাথে ধন-দৌলতের স্বপ্ন গাথা, চির দুঃখী সেই, জ্ঞানী জনে কন।
একটি চাহিদা পুর্ন হলে আরেকটি আসে,এভাবেই চাহিদা রয়ে যাই, শেষে লোভে ভাঁসে।
দেখোনা হে চোঁখও মেলি , কত জনে ভুগিছে আহা,হইয়া মরণ ব্যাধি।
তুমি তো আছো বেশ, শুকরিয়া করো পেশ, আল্লাহর দরবারে। >
.
রহমত সাহেবের স্ত্রী আরও কয়েকটি কবিতা পড়লেন। একেকটা কবিতা পড়তে লাগলেন আর চোঁখের পানি ফেলতে লাগলেন।
এ তৃপ্তির যেনো সমাপ্তি হয় না । তার কঠিন, কলুষিত হ্রদয়ে পবিত্র নুরের ছটা লাগতে শুরু হলো।
ভুলে গেলেন লোভ, ক্রোধ আর হিংসা। তিনি যেনে এই মাত্র জন্ম গ্রহণ করলেন।
রহমত সাহেবের স্ত্রী ভাবতে লাগলেন কিভাবে সংস্কৃতি মানুষকে পাল্টে দিতে পারে।
অপসংস্কৃতিই যে সুন্দর পৃথিবী সৃষ্টির প্রধান অন্তরায়। যা এ সমাজ সানন্দে গ্রহণ করছে।
.
এশার নামায শেষ করে বাড়িতে প্রবেশ করলেন রহমত সাহেব। তিনি ঘরে প্রবেশ করে, অন্য এক চিত্র দেখতে পেলেন।
এশার নামায শেষ করে তার স্রী আল্লাহর দরবারে ক্ষমা প্রার্থনা করছেন। তিনি প্রফুল্ল মন নিয়ে আলহামদুলিল্লহ বললেন।
তার পর মুচকি হাঁসি দিয়ে মনে মনে বললেন,
“”হয় হয় , পেটে ক্ষুধা লয়ে সেই সুখী হয়, যাহার অন্তরে রই পাপাচারের ভয় । “”