খালেক স্যার কাটাকাটা নয়টা বাজে ক্লাসে এসে পৌঁছেছেন। তিনি হাইস্কুলের গণিত শিক্ষক। সবার কাছে বদরাগী হিসেবে পরিচিত।
দুষ্টামি আর পড়া না শিখে আসার অপরাধে তিনি ভয়ংকর সব শাস্তি দিতে পছন্দ করেন।
তিনি বর্তমানে মেয়েদের ক্লাস নাইনের গণিত শিক্ষক। সব মেয়েরাই তাকে যমের মত ভয় পায়। খালেক স্যার এই বছরের পরই রিটায়ার্ড করবেন।
ক্লাস টেনে আর তার ক্লাস করতে হবে না এই আনন্দে সকল কষ্ট মুখ বুঝে মেনে নিচ্ছে নাইনের মেয়েরা।
আজ ক্লাসে ঢুকেই প্রথমে প্রেজেন্ট ডেকে নিলেন খালেক স্যার। আজ তিনি মেয়েদের বোর্ডে অংক করার জন্য ডাকবেন। সপ্তাহে একদিন তিনি এই কাজটি করেন।
তার ভয়েই হোক বা অন্য কারণেই হোক বেশিরভাগ মেয়েরাই সঠিক ভাবে অংক করতে পারে না। তাই স্বভাবতই এই দিনটিতে উপস্থিতি কম হয়।
খালেক স্যার অংক করার জন্য সবার প্রথমে আয়েশাকে ডাক দিলেন। খালেক সাহেব প্রায় প্রতিদিনই আয়েশার পড়া ধরেন।
তাতে অবশ্য আয়েশা কিছু মনে করে না।
সে ভালো ছাত্রী। অংক অনায়াসে করে ফেলা তার কাছে কোন ব্যাপার না।
আয়েশা খুব দ্রুত বোর্ডের অংকটি করে ফেললো। কিন্তু শেষ পর্যায়ে লক্ষ্য করলো তার অংকটি মিলে নাই! ভয়াবহ ব্যাপার।
এর অর্থ আয়েশার জন্য কঠিন শাস্তি অপেক্ষা করছে।
খালেক স্যার খুবই রেগে গেছেন। এই সাধারণ একটা অংক পারলো না। শাস্তি দিতে হবে, কঠিন শাস্তি।
– এই মেয়ে, তুমি বেঞ্চের উপরে দাড়াও!
আয়েশা বাধ্য মেয়ের মত বেঞ্চের উপর দাড়ালো।
– এবার কান ধরো!!
অসম্ভব। এই অপমানজনক কাজ আয়েশা কিছুতেই করবে না। চুপচাপ দাড়িয়ে রইলো।
– কি কান ধরবে না?? পরে কিন্তু মাঠের মাঝখানে কান ধরে দাড়া করাবো।
আয়েশা এবার কান ধরলো। সারা ক্লাস কান ধরে দাড়িয়ে রইলো আর নিরবে কেদে চললো।
তাতে অবশ্য খালেক সাহেবের মন গললো না। পড়া না পারলে শাস্তি পেতেই হবে।
হাফসা লক্ষ্য করলো তার মেয়েটা সেই দুপুরে স্কুল থেকে ফিরে নিজের রুমে গেট লাগিয়েছে আর খুলেনি।
হাফসা কয়েকবার ডেকেছেন কিন্তু কোন সাড়া পাননি। এদিকে সন্ধ্যা হয়ে গেল।
খালেক স্যার সন্ধ্যার ইকটু পড়ে বাসায় ফিরলেন। দেখলেন তার স্ত্রী খুবই চিন্তিত।
– কি হয়েছে তোমার??
– আজ স্কুলে কি কিছু হয়েছে??
– কি ব্যাপারে??
– তোমার মেয়ের ব্যাপারে।
– না তো। কেন??
– তোমার মেয়ে দুপুরে বাসায় ফিরে গেট লাগিয়ে শুয়েছে আর গেট খুলেনি।
খালেক স্যার এবার কারণটা ধরতে পারলেন। কি জবাব দিবেন! চুপ করে রইলেন। তবে হাফসা প্রশ্ন করতে থাকলেন,
– কি হলো, চুপ করে রইলে যে??
– আজ আয়েশা ক্লাসের পড়া পারেনি।
– কি করেছো? মেরেছো?
– না।
– তাহলে??
– কান ধরে দাড়া করিয়ে রেখেছিলাম।
হতাশ হয়ে গেলেন হাফসা। নিজের মেয়েকে কেউ এত কঠিন শাস্তি দেয়।
– এটা কোন কাজ করলে তুমি?? ইকটু দয়ামায়া নেই?
– ভুল হয়ে গেছে!
– তুমি তোমার মেয়েকে চিনো না।
– এখন যাবো ডাক দিতে?
– তোমার সাথে সামনের এক মাস কথা বলবে কিনা কে জানে! তোমার রাগ ভাঙ্গাতে হবে না। হাসান আসুক, ও যা করার করবে।
– হাসানের ইন্টারভিউর কি অবস্থা?
– জানিনা, ফোন ধরছে না। ভাত দিবো তোমাকে??
– না, হাসান আসুক, একসাথে খাবো।
•••
বাসা মোটামুটি দুরেই। বাসে যেতে হয়। কিন্তু বাসে উঠার মত ইচ্ছে এখন হাসানের নেই। ভাইভা পরীক্ষা শেষে বাসায় ফিরছে হাসান।
লোক ছাড়া যে চাকরি হয় না তা ভালভাবেই বুঝে গেছে হাসান।
সরকারি, বেসরকারি, ব্যাংক প্রায় সব জায়গাতেই চেষ্টা করেছে, কোনটিতেই হলো না।
মাস্টার্স শেষ করা হাসান ছাত্র হিসেবে মেধাবী। তাই বেশিরভাগ জায়গাতেই লিখিত পরীক্ষায় পাশ করে ফেলে হাসান।
কিন্তু সমস্যা ওই ভাইভা বোর্ডে। হাসানের লোক বা টাকা কোনটিই নেই। তাই বারবার হোচট খেতে হচ্ছে। এই বছর পরেই বাবা রিটায়ারমেন্টে যাবে।
তারপর সংসার হাসানকেই চালাতে হবে। তাই যেকোন মূল্যে একটা কাজ চাই।
হাসানের সামনে একটা সিএনজি থামলো। খালি সিএনজি। তবে ড্রাইভার সিট থেকে নেমে আসলো শহীদ। হাসানের স্কুল জীবনের বন্ধু।
– কিরে দোস্ত, কতদিন পরে তোকে দেখলাম! কেমন আছিস?
– ভালই, তোর কি অবস্থা?
– অবস্থা তো দেখছিস। সিএনজি চালাই এখন।
তাজ্জব হয়ে গেল হাসান। শহীদ অনেক মেধাবী ছাত্র ছিলো। তার এই অবস্থা কেন বুঝতে পারলো না।
– সিএনজি চালাচ্ছিস কেন??
– আর কি করবো? অনার্স পাশ করে ৪ বছর চাকরি খুজলাম কিন্তু পেলাম না। বাবা প্যারালাইসিস। সংসার চলবে কিভাবে?
তাই সিএনজি নিয়ে নেমে গেছি।
– ও আচ্ছা।
– চল তোকে বাসায় নামিয়ে দেই।
হাসানকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে চলে যেতে চাইলো শহীদ। কিন্তু হাসান ওকে ছাড়তে চাইলো না।
– কিছু বলবি মনে হচ্ছে??
– হ্যাঁ।
– বলে ফেল।
– তোর সময় হলে এক চায়ের দোকানে বসি।
– আচ্ছা চল।
••••
হাসান এশার নামাজের পর বাসায় ফিরলো। প্রথমেই দেখা হলো মায়ের সাথে।
– মা, কেমন আছো?
– ভালো। তোর ইন্টারভিউ কেমন হলো রে??
– আগে ভাত খেয়ে নেই তারপর বলবো। বাবা কোথায়??
– শুয়ে আছে।
– ডাক দাও, আয়েশা খেয়েছে??
– আরে না, আয়েশা দুপুর থেকে গেট আটকে নিজের রুমে বসে আছে!
– কেন??
– পড়া পারেনি বলে তোর বাবা কান ধরে দাড়া করিয়ে রেখেছিলো। আমি ডাক দিয়েছি অনেকবার কোন সাড়া দেয় নি।
তুই ইকটু দেখ রাগ ভাঙ্গাতে পারিস কিনা!
– আচ্ছা, আমি ইকটু বাইরে থেকে আসছি।
– কোথায় যাবি আবার??
– এই যাবো আর আসবো।
•••••
ছোট বোন আয়েশার গেটের সামনে দাড়িয়ে হাসান। ছোট বোনকে হাসান তার নিজ নামে ডাকে, নামটি হলো পাখি।
– পাখি, এই পাখি….
– ……
– বেচেঁ আছিস নাকি মরে গেছিস, জবাব দে?!
– হু!
– রাগ করেছিস??
– হু!
– গেট খুলবি না??
– না।
– আমি তো চাকরি পেয়েছি।
– তাতে আমার কি!!
– তাতো বুঝলাম! কিন্তু পোলার আইসক্রিম এনেছিলাম একটা, গলে যাচ্ছে যে….
গেট খুলে ফেললো আয়েশা। চোখ ফোলা ফোলা। অনেক কেঁদেছে মেয়েটা। খুবই অভিমানী।
– আমার আইসক্রিম দাও।
– এই নে।
– বাবার সাথে আর কোনদিন কথা বলবো না।
– আচ্ছা বলিস না।
– ভাইয়া??
– হু।
– তুমি প্রথম বেতন পেলে আমাকে একজোড়া নতুন জুতা কিনে দিও।
– আচ্ছা দিবো।
– আমার জুতা পুরনো হয়ে গেছে অনেক। বাবাকে বলিনি , কারণ বাবা অনেক কষ্টে সংসার চালাচ্ছে, আমি জানি।
– ওরে বাবা, তুই এত বুঝিস?!
– হু, আমি বড় হয়ে গেছি না!
– চল এখন ভাত খেতে যাই।
আজকের রাতটা হাসানদের বাড়িতে উৎসব মুখর। কারণ হাসান বাড়ির সবাইকে বলেছে সে চাকরি পেয়েছে।
খাওয়া দাওয়া শেষে সবাই দ্রুতই ঘুমিয়ে পড়লো। কিন্তু হাসান জেগে রইলো। কারণ মূল ঘটনা শুধু হাসানই জানে, আর কেউ জানে না!!
••••••
ভোর সকালে শহীদের ফোন পেয়ে ঘুম ভাংলো হাসানের।
– কিরে এখনো ঘুমাচ্ছিস!
– হু।
– তাড়াতাড়ি চলে আয়। আজকে কিছুটা তোকে শিখিয়ে দেই। এই সপ্তাহে শিখা শেষ হলে সামনের সপ্তাহেই সিএনজি নিয়ে নামতে পারবি।
– আচ্ছা আসছি।
বাসা থেকে বের হওয়ার সময় আয়েশার সাথে দেখা হলো হাসানের। আজকে আয়েশা একাই স্কুলে যাচ্ছে, প্রতিদিন বাবার সঙ্গেই যেতো।
আর হাসান যাচ্ছে বাস্তবতার সাথে লড়াই করতে। প্রতিটি পুরুষই জন্মগ্রহণ করে বাস্তবতার সাথে লড়াই করার জন্য।
কেউ লড়াই করে টিকে থাকতে পারে কেউ পারেনা।
যারা লড়াই করে টিকে থাকতে পারে না তাদের দেখা যায় খারাপ কাজে জড়িয়ে যেতে। সবাই তো আর হাসানের মত ভালো ছেলে নয়।
দোষটা তাদেরও দেয়া যায় না। খেয়ে পড়ে তো বাঁচতে হবে। যোগ্যতা দিয়ে চাকরি পাওয়া যায় না তাহলে করবেটা কি?!
সৎ পথে স্বল্প ইনকাম করে বেচেঁ থাকলে সংসারে হবে অশান্তি আর সমাজের চোখে হবে বোকা।
আজ আয়েশা বুঝতে পারছে না তার ভাইটির এত মন খারাপ কেন?! প্রথম চাকরির দিন কেউ এত মন খারাপ করে থাকে।
– ভাইয়া, তোমার এত মন খারাপ কেন??
হাসান বোনের প্রশ্নের উত্তর দেয়ার প্রয়োজন বোধ করলো না। বাসা থেকে বের হলো। আজ থেকেই শুরু হলো বাস্তবতার সাথে যুদ্ধ।
এই যুদ্ধে লড়তে হবে একা, পাশে কেউ নেই…… কেউ নেই!!