“প্রত্যাশা অনুযায়ী ফলাফল না পাওয়ার গল্প”

গতবছরের এমনি একটা দিন। এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয়। আমি তখন রাজশাহীতে। একটা কোচিংয়ে এডমিশনের প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম।সকাল থেকে বুকটা ধড়ফড় করছিলো। রেজাল্টের টেনশনে মাথা শুধু ঘুরছিলো। তবুও সাহশ রেখেছিলাম। মনের মধ্যে বিশ্বাস রেখেছিলাম। পরীক্ষা মোটামুটি ভালোই দিয়েছিলাম। সেই অনুযায়ী ফলাফলটাও প্রত্যাশা ছিলো। ফলাফল যাইহোক না কেনো এসএসসির তুলনায় ভালো হবে, এমনি দৃঢ় আত্ববিশ্বাস ছিলো।

দেখতে দেখতে ঘরিতে তখন দুপুর দুইটা। অলরেডি রেজাল্ট পাব্লিস্ট হয়ে গেছে। আমি তখনো রেজাল্ট পাইনি। ফোনে ফিরতি মেসেজ পাইনি। নেটেও প্রচুর জ্যাম, রেজাল্ট দেখা সম্ভব হচ্ছিলো না। তাই ক্ষণে ক্ষণে শুধু হার্টবিট বাড়তেছিলো।

হঠাৎ ফোনে একটা মেসেজ এলো। রেজাল্ট পেলাম। কিন্তু কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। সম্পূর্ণ অনাকাঙ্ক্ষিত একটা ফলাফল।  আমার পরীক্ষা এতোটা খারাপ হয়নি। এ কিছুতেই আমার রেজাল্ট হতে পারে না। বারবার বিভিন্নভাবে রেজাল্ট দেখার চেষ্টা করলাম। কিন্তু ফলাফল শূন্য। একই রেজাল্টের পূনরাবৃত্তি।

ফলাফল প্রকাশের এই দিনটাকে ঘিরে কতো আশা আকাঙ্ক্ষা ছিলো। প্রিয়জনদের সাথে ভালো কিছু মুহূর্ত কাটানোর প্লান ছিলো। কিন্তু সবকিছু যেনো এক মুহুর্তেই শেষ হয়ে গেলো। কিছু সময়ের জন্য যেনো আমার পৃথিবীটা পুরো থমকে গেলো। সবার কাছে নিজেকে বড্ড বেমানান মনে হতে লাগলো। পৃথিবীতে নিজেকে খুব তুচ্ছ মনে হচ্ছিলো।

মেসে আমি যে রুমে থাকতাম তার পাশের রুমে দুইজন পরীক্ষার্থী ছিলো। তারা নেট সুবিধা থাকায় রেজাল্ট জানার জন্য আমার রুমে ভিড় জমিয়েছিলো। দুইজনেই গোল্ডেন এ প্লাস। খুশিতে তখন তারা আত্মহারা। আনন্দে তাদের চোখগুলো তখন জ্বলজ্বল করছিলো। ফোনে সবাইকে নিজেদের খুশির খবর দিচ্ছিলো। মুহুর্তেই পুরো মেস যেনো আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে গেলো। একটু পরে মিষ্টি আনা হলো। সবাইকে মিষ্টি বিতরণ করা হলো। আমাকেও মিষ্টি দেওয়া হয়। কিন্তু সে মিষ্টি আমার মুখে তুলার সাহশ হয়নি।

এমনিতে মেসের খাবার যেমনতেমন ভাবে খেতাম। রেজাল্ট খারাপ হবার পর থেকে খাওয়াদাওয়ার প্রতি একেবারেই অনীহা তৈরি হয়। শরীরে পানি শূন্যতাও বাড়তে থাকে। রুম থেকে খুব একটা বেড় হইতাম না। কারো সাথে কথা বলতাম না। দিনরাত শুধু ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেছি। বালিশের কভার অশ্রুজলে ভিজিয়েছি।

যে আমি সারাদিন ফেসবুকে থাকতাম। ফোন নিয়ে ব্যস্ত থাকতাম। সেই আমি আইডি ডিএক্টিভ করি। ফোন থেকে সিম খুলে ফেলি। বাইরের পৃথিবীর সাথে যোগাযোগ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করি। কলেজে আমি খুব একটা খারাপ ছাত্র ছিলাম না। পড়াশোনা ও পরীক্ষায় পারফরমেন্স ছিলো মোটামুটি। তাই আমার প্রতি স্যারদেরও আস্থা ছিলো। তারাও আশা করেছিলো আমি ভালো কিছু করবো। কিন্তু সেদিক দিয়ে আমি ব্যর্থ। ক্লাসে প্রত্যাশিতভাবেই অনেকে ভালো রেজাল্ট করেছে। আবার কেউ কেউ কাকতালীয় ভাবে ভালো রেজাল্ট করে সবাইকে চমকে দিয়েছে।

এভাবে চারদিন পেরিয়ে যায়। আমার সবকিছুই অনিয়মিত হয়ে যায়। শারীরিক ভাবে খুব দুর্বল হয়ে পড়ি। হাটাচলার শক্তিও হারিয়ে ফেলি। একপর্যায়ে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ যেনো নিয়ন্ত্রনহীন হওয়ার মতো অবস্থা। হাত-পা নড়ানোর সাধ্যটুকু পর্যন্ত নেই। এমন্তবস্তায় আমার অবস্থার অবনতি চোখে পড়ে মেসের বড় ভাইদের। তড়িঘড়ি করে আমাকে মেডিকেলের পথে নিয়ে যাওয়া হয়। যেতে যেতে অবস্থার আরো অবনতি। ঠিকমতো তাকাতেও পারছিনা। শরীরে অসহ্য যন্ত্রণা সইতেও পারছিনা। একটা সময়ের জন্য ধরেই নিয়েছিলাম আমি হয়তো মরে যাচ্ছি।

বেশ কয়েকদিনের চিকিৎসার পর আমি অনেকটাই সেরে উঠি। সবকিছু ঝেড়ে ফেলে পড়াশোনায় মনোযোগ দেই। বিভিন্ন ভার্সিটিতে পরীক্ষা দেই। কিন্তু এক্ষেত্রেও বলা যায় আমি ব্যর্থ। অনেকের মতো আমার স্বপ্নভঙ্গ হয়। তবে এখন যে অবস্থানে আছি। সেটা যে খুব খারাপ, ঠিক এমনটা না। বরঞ্চ আমার ক্লাসের ভালো রেজাল্ট করা অনেকের থেকেই আজকের আমার এই অবস্থান কিছুটা হলেও এগিয়ে। পড়াশোনার বাইরে অন্যান্যক্ষেত্রেও আমি আজ কলেজের সহপাঠীদের থেকে এগিয়ে।

যাইহোক এবছরও এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হলো। অনেকেই প্রত্যাশা অনুযায়ী হয়তো ফলাফল করতে পারো নি। নিজেদের কাঙ্খিত লক্ষ পূরণ করতে পারো নি। তোমাদের উদ্দেশ্যে বলছি অপ্রত্যাশিত রেজাল্টের কারনে কোনপ্রকার পাগলামি করতে যেও না। হয়তো এইচএসসি পরীক্ষার রেজাল্টের গুরুত্ব অপরিসীম। কিন্তু তা কোনভাবেই জীবনের মূল্যের থেকে বেশি নয়। তাই এমনকিছু করিও না, যাতে তোমাকে বা তোমার পরিবারকে সারাজীবন ভুগতে হয়। জীবনে হোচট খেলেও ঘুরে দাঁড়ানো যায়। কিন্তু জীবনকে তুচ্ছ মনে করলে কখনোই হবেনা জয়।

গল্পের বিষয়:
অনুপ্রেরণা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত