পিশাচ শিশু

পিশাচ শিশু

সারাদিন মাথাটা ব্যাথা করছে। ভাবলাম ঘুমালে সেরে যাবে। কিন্তু বিকেলে ঘুম থেকে উঠে দেখলাম ব্যাথাতো সারেনি, মনে হয় খানিকটা বেড়েছে। ভাবলাম কফি খেতে পারলে হয়ত ব্যাথাটা যাবে। কিন্তু কুক ব্যাটাকে পেলাম না। নিশ্চয় বউয়ের সাথে প্রেম করতে গেছে। তাই বের হলাম শহরের উদ্দেশ্যে। শহরে নেমে আমার প্রিয় কফি শপের উদ্দেশ্যে যাচ্ছি। হটাৎ শহরের যে অংশে ভিখারিরা দাঁড়িয়ে ভিক্ষে করে সেখানে এক মহিলা ভিখারির (যেহেতু সেখানে দাঁড়িয়ে আছে, ভিখারি ছাড়া আর কিছু ভাবিনি) প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ হল। কিন্তু কেন হল বুঝলাম না। তার মাঝে কিছু এক্তা ছিল! মাথার সামনে কগাছি চুল শুধু সাদা। তা ছাড়া বোঝার উপায় নেই মহিলাটি বয়স্কা। চেহারার কোথাও বলিরেখা নেই। পরনে মলিন পোশাক। কিন্তু অন্যান্য ভিখারিদের মত পথচারীদের কাছে ভিক্ষে চেয়ে তাদের বিরক্ত করছে না । পথচারী বা ভিখারিরা যে তার অস্তিত্ব সম্পর্কে সচেতন তাও মনে হচ্ছে না।

যাই হোক, মাথা ব্যাথার কারনে বেশি মাথা ঘামালাম না। কফি শপে কফি, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই আর নুডলস খাওয়ার পর মনে হল মাথা ব্যাথা কিছুটা কমেছে। দাম চুকিয়ে বাইরে বেরিয়ে দেখি সন্ধ্যা পার হওয়ার পথে। মৃদুমন্দ বাতাস বইছে। ভাবলাম কিছু নিব না, হেঁটেই যাব। হাঁটছি হটাত আমার সামনে বিকেলে দেখা সেই মহিলা ভিখারিনি (তখনও পর্যন্ত আমার তাই ধারনা)। কিছু বলছে না। ভাবলাম মানসিক সমস্যা আছে হয়ত, মানিব্যাগ খুলে টাকা বের করতে গিয়ে ব্যাগে একটি মাত্র ৫ টাকার কয়েন দেখলাম। কয়েনকে সবসময় আমি ঝামেলা মনে করি। প্রায়ই হারিয়ে ফেলি। ভাবলাম একে দিয়ে দেই। একে কয়েনটি দিলে মহিলা মৃদু হেসে কয়েনটি আমার হাত থেকে গ্রহণ করে। এরপর কিছু না বলে চলে যায়। হটৎ একটা সুগন্ধ পেতে শুরু করলাম, যদিও উৎসটা ধরতে পারলাম না। হাঁটছি, হটাৎ তীব্র হাওয়া বওয়া শু রু করল। টাঙ্গাইলের কুখ্যাত কালবৈশাখীর লক্ষণ। বিনা নোটিশে এসে সব লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে যায়। নিজের বোকামীর জন্য নিজের উপর রাগ হচ্ছে। এমন এক জায়গায় এসে গেছি, ঘন্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকলেও যান বাহন পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। ঝড় হলে যে কোথাও আশ্রয় নিব, ধারেকাছে সেরকম কোন দোকানপাটও চোখে পরছে না। মেসে তাড়াতাড়ি পৌঁছাবার জন্য ডান পাশের শর্টকাট রাস্তাটি ধরলাম ভুতের গল্পে প্রায় নায়ক শটকাটে গনতব্যে পচাবার জন্য ডান পাশের রাস্তা ধরে হাঁটতে গিয়ে সোজা পেত্নির খপ্পরে পরে, এরকম আমি পড়েছি)।

পা চালিয়ে হাঁটছি, হটাৎ দেখলাম সামনের বাঁশঝারটিতে দাউ দাউ করে আগুন জলছে। আগুনের শিখা আকাশ ছুঁই ছুঁই। এরপর যা দেখলাম, তা দেখে আমার আত্মারাম খাঁচাছাড়া হয়ে যাওয়ার জোগার। শুন্যে আগুনের মাঝে একটা শিশু পুড়ছে। বাচ্চাটির মুখে ক্রুর হাসি, দাঁতগুলো সুচালো। চোখের জায়গায় কালো গর্ত। আমি এত ভয় পেয়েছিলাম যে, চোখ বন্ধ করতে বা নড়াচড়া করতে পারছিলাম না। কোথা থেকে একদল কুকুর এসে জড় হয়ে করুন স্বরে কাঁদতে শুরু করল। আমি বুঝতে পারচ্ছি, আজকেই আমার শেষ দিন। ভয় পেলে আমি আম্মার নাম নেই, তাই নিজের অজান্তেই মুখ থেকে বেরিয়ে এল আম্মু। বাচ্চাটি তার একটা হাত আমার দিকে নিশানা করল। মনে হল যেন, আমার সারা শরীরে আগুন ধরে গেছে। হটাৎ আমার ডান পাশ থেকে শুনলাম একটি নারী কন্ঠ, “সাহেব চোখ ফিরিয়ে নিন, চোখ ফিরিয়ে নিন”। কন্ঠ লক্ষ্য করে আমি ফিরলাম। দেখলাম সেই ভিখারী মহিলাটি। কিন্তু একই সেই। বয়স তার এক লাফে কমে গেছে, আঠার-উনিশ বয়স। গায়েও দামী পোশাক। আমি আবার সুগন্ধ পেতে শুরু করলাম। মেয়েটি রাগত স্বরে বাচ্চাটিকে বলছে, “তুই মায়ের কথা শুনবি না, মাকে কষ্ট দিবি?” না তাকিয়েও বুঝতে পারলাম, আগুন নিভে যাচ্ছে। আর ভোজভাজির মত কুকুরগুলোও সব উধাও হয়ে গেছে। এবার মহিলা বললেন, “সাহেব আপনি আমার পিছে পিছে আসেন, যতক্ষণ আমি আছি ও আপনাকে কিছু বলবে না। আমি তো ওর মা।” আমি মহিলার পিছে পিছে আসতে লাগলাম, একসময় আমাদের মেসের আলো দূর থেকে দেখতে পেলাম। মহিলা আঙ্গুল বাড়িয়ে সে দিকে এগিয়ে যেতে নির্দেশ করল। আমি কিছু দূর গিয়ে ভাবলাম, মহিলাকে তো ধন্যবাদ দেওয়া হল না।

ধন্যবাদ দেওয়ার জন্য পিছে ফিরতেই দেখি কেউ নেই। পা চালিয়ে তাড়াতাড়ি মেসে ফিরলাম। মেসের কয়েকজন স্টাফকে ঘটনটা বলতে তাঁরা আমার দিকে এমন ভাবেতাকাল যে আমি বুঝতে পারলাম তারা ধরে নিয়েছে আমি শহর থেকে টেনে এসেছি। আমাদের মেসের নির্মাণ কাজ চলছে। নির্মাণ কাজের যন্ত্রপাতি পাহাড়া দেওয়ার জন্য এক চাচামিয়া ছিল। সমস্ত কাহিনী শোনার পর নিজের আঞ্চলিক ভাষায় যা বললেন, তার সারমর্ম এই, তার ছোটবেলার কথা। গ্রামে এক অনাথ তরুণী ছিল, অসম্ভব সুন্দরী। সচরাচর সুন্দরি অসহায় মেয়েদের বেলায় যা হয়, এর বেলাতেও তাই হল। গ্রামের সবচেয়ে ধনী পরিবারের বড় ছেলের নজর পরল তার উপর। গোপনে বিয়ে করে ঐ ছেলে তার কামনা পূর্ণ করার পর, তার কথা ভুলে যায়।

ইতিমধ্যে তাদের ভালবাসার ফসল হিসেবে মেয়েটি গর্ভবতী হয়ে পরে। মেয়েটি, ছেলেটিকে ঘরে তুলে নিতে বললে সে তাকে পরিহাস করে। মেয়েটি ছিল সাহসী। এই অন্যায় মেনে নেওয়ার পক্ষে ছিল না। গ্রামবাসীদেরকে ঘটনা জানিয়ে দেয়ার হুমকি দেয়। রাতারাতি তাদের বইয়ের সকল সাক্ষী গ্রাম থেকে উধাও হয়ে যায়। ছেলের বাবা ঘটনা সব জানতে পারে। নিজের বংশের কলঙ্ক ঢাকতে মেয়েটির নামে সালিশ বসায়। শুরু হয় প্রহসনের বিচার। বিচারে মেয়েটিকে একঘরে করা হয়। ছেলেটির পরিবারের ভয়ে দিনের বেলা কেউ মেয়েটিকে সাহায্য করতে সাহস না পেলেও রাতে কেউ কেউ এসে সাহায্য করত। এরি মাঝে মেয়েটি একটি ছেলে সন্তানের জন্ম দেয়। ছেলের বাবা বুঝতে পারে, গ্রাম্বাসী ভয়ে কিছু না বললেও, তারা জানে এটা তারই ছেলেত সন্তান। রাগে অন্ধ হয়ে সে একদল পালা দুর ্বৃত্তকে পাঠায় মা ছেলেকে শেষ করতে। তারা মেয়েটির ঘরে বাইরে থেকে তালা মেরে আগুন লাগিয়ে দেয়। মা, ছেলে আগুনে পুড়ে মরে। এই ঘটনার কয়েকদিন পরই ঐ ধনী ব্যক্তি তার সুপত্রকে শহরে পাঠিয়ে দেয়। ঘটনার প্রায় এক বছর পর ঐ ছেলে গ্রামে ফিরে আসে। সে বিয়ে করে, তার মতই আরেক ধনীলোকের মেয়েকে। অঘটনের শুরু সে দিন থেকেই, সেদিনই তার ছোটবোন গায়ে আগুন লেগে পুরে মারা যায়। মেয়ে তার বাবার খুব আদরের ছিল।

এই আঘাত সহ্য করতে পারেনি। স্ট্রোক করে পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হয়। তার আরো দুই ছেলে ছিল। স্পতাহের ব্যব্ধানে দুজনেই পুরে মরে। একজন নিজ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে, আর একজন ব্জ্রপাতে। ব্যবসায় নামে ধস। তারপর একদিন, তার সি ছেলেটিকে পাওয়া যায়, ঠিক সেখানে, যেখানে একসময় মেয়েটির বাড়ি ছিল। সারা শরীরে অসংখ্য ক্ষত চিহ্ন। মনে হয় কোন প্রানী তার মাংস জিবন্ত খুবলে খেয়েছে। চোখ ছিল বিস্ফোরিত, তাতে রাজ্যের আতঙ্ক। সবচয়ে আশ্চর্য এই তার হৃদপিণ্ডটি বুক থেকে বের করে তার হাতের মুঠোয় ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এর পরের ঘটনা খুবই সামান্য। কিছুদিন পরে অঈ লোকের বিধবা পুত্রবধূকে তার পিতা এসে নিয়ে যায়।

বাড়ির চাকরবাকররা এক সময় কেটে পরে। ইতিমধ্যে লোকটি কিছুটা চলাফেরার ক্ষমতা অর্জন করে। এভাবে একাকি থাকতে থাকতে, একদিন নিজের হাতে বাড়িতে আগুন লাগিয়ে আত্যহত্যা করে। গ্রামবাসীরা অনেকেই রাতের বেলা একটা শিশুকে আগুন পুড়তে দেখত। যে দেখত সে বেশিদিন বাঁচত না, কয়েকদিন পর যে কোনভাবে আগুনে পুড়ে মারা যেত। চাচামিয়া তরুণ হওয়া পর্যন্ত এই ঘটনা ঘটেছে। তারপর আজ আবার! আজকে আমিও দেখেছি ঐ প্রতিশোধপরায়ণ শিশুটির প্রেত্মাকে। কিন্তু আমি জানি, আমার কিছু হবে না। কারণ শিশুটির মার আশীর্বাদ আমার সাথে আছে। হটাৎ মনে হল মানিব্যাগটি দেখি। দেখলাম ব্যাগের ভিতর একটি পোড়া কয়েন!

গল্পের বিষয়:
ভৌতিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত