অনিকেত! এই অনিকেত!
ওঠো তাড়াতাড়ি| ধরফরিয়ে ঘুম থেকে জেগে দেখি অহনা আমার উপর ঝুকে আছে, তার কালো চুলগুলো ফ্যানের বাতাসে আমার নাকে-মুখে বাড়ি খাচ্ছে| অনেকটা উদ্বেগ নিয়ে প্রশ্ন করলাম
– কি হইছে?
– বিরাট এক কান্ড ঘটছে।
– কি হইছে একটু ঝেড়ে কাশো। তোমার কাছে সাধারণ
জিনিসওতো বিরাট কিছু।
– কিছুদিন আগে তুমি যে গোলাপের গাছটা এনেছিলে
সেটাতে ফুল ফুটেছে| তিনটা ফুল| একটা পুরো ফুটছে আর
দুটা অর্ধেক|
– এখন কটা বাজে?
– সাড়ে পাঁচটার মত হবে,কেন?
– কেনো মানে!!! যাও এখান থেকে!!
প্রচন্ড ধমকের স্বরেই বললাম….অহনা চলে গেলো অভিমান করে|
.
.
আজ অফিস থেকে ছুটি নিয়েছি। কই একটু আরামে ঘুমোবো তা না সকাল সাড়ে পাঁচটায় ঘুম ভাঙিয়ে দিলো| মেজাজটা খুব খারাপ হয়ে গেছে। গোলাপ ফুলের নিকুচি করি। আমি পাশ ফিরে শুয়ে পড়লাম ঘুমানোর জন্য, কিন্তু ঘুম আসছেনা| মনের ভিতর খচখচানি শুরু হয়ে গেছে| গাছে ফুল ফুটবেই, তাই বলে এত মাতামাতির কি আছে বুঝিনা….. ধুর! এই মেয়েটাকে নিয়ে আর পারিনা| সবকিছুতেই ওর বাড়াবাড়ি। সাধারণ জিনিস নিয়েওতুলকালাম কান্ড করতে উস্তাদ। মা-বাবার পছন্দে ওর সাথে বিয়ের মাত্র ছমাস হলো। এরমধ্যেই অহনা সবার খুব প্রিয় হয়ে গেছে| ছোট বোন, মা-বাবা সবাই ওর একনিষ্ঠ ভক্তই বলা চলে| মাঝে মাঝে হিংসা হয়, আমার থেকে আমার বউয়ের প্রতি তাদের টান দেখে। অস্থির পাগলাটে প্রকৃতির একটা মেয়ে| অনার্স পাশ করে ফেলেছে অথচ কিশোরী টাইপ ছাপটা স্পষ্ট বুঝা যায়| এরকম একটা মেয়ের কাছে গোলাপ ফোটার মত ঘটনা বিরাট কান্ড হতেই পারে|
.
.
বিয়ের কিছুদিন পরের ঘটনা……
রাত দুটোর মত বাজে| হঠাত্ ঘুম ভেঙ্গে গেলো, দেখি বৌ বিছানায় নাই| গেলো কই? বারান্দাতেও নাই ড্রয়িংরুমেও নাই। খুঁজতে খুঁজতে মহারাণীকে আবিষ্কার করলাম ছাদে| বৃষ্টিতে ভিজতেছে আর গান গাইতেছে| অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি আমি…কেমনে কি??!! রাত দু টা বাজে এমন সময় কোন পাগলে বৃষ্টিতে ভিজবে!
.
– ঐ, সমস্যা কি তোমার??
– ওহ, তুমি? কখন আসলা? আর সমস্যা নেইতো কোনো।
– আমি মাত্রই আসছি কিন্তু এতরাতে বৃষ্টিতে ভিজছো ঠান্ডা লেগে যাবেতো|
– নাহ লাগবেনা|
– লাগতেওতো পারে। চলে আসো।
– উহু লাগবেনা, এই একটা রিকোয়েস্ট করবো, রাখবে?
– বলো?
– যদি রাখো তারপর বলবো|
– আচ্ছা বলো যথাসাধ্য রাখার চেষ্টা করবো|
– আইসক্রিম খেতে ইচ্ছে করছে| প্লিজ নিয়ে আসোনা।
– এতরাতে! সব দোকানতো বন্ধ|
– জ্বী না স্যার, মোড়ের একটা দোকান এখনো খোলা,
এখান থেকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে|
– কিন্তু….
– চলো না যাই প্লিইইইজ না করো না…..
– চলো যাই মানে! তুমিও যাবা নাকি?
– প্লিইইইজ…..
.
.
.
না করতে পারলাম না|
– যাও ছাতা নিয়ে আসো|
– উহু ভিজে ভিজে যাবো এবং তুমিও আমার সাথে ভিজে ভিজে যাবা। একদিন ভিজলে কিচ্ছু হবেনা।
.
.
.
কি আর করা উপায় নেই। অগ্যতা রাজি হতে হলো| আইসক্রিম হাতে নিয়ে বৃষ্টির মধ্যে হাঁটছি আমি আর অহনা। অহনা আমার একটা হাত খুব শক্ত করে ধরে আছে| তার অপর হাতে আইসক্রিম ধরা| ল্যামপোস্টের আলোয় দেখতে পেলাম মায়াবতী মেয়েটার মুখ ছোট বাচ্চাদের মত আনন্দে ঝলমল করছে| আমি কেমন যেন ঘোরলাগা অনুভূতিতে ডুবে গেলাম। একজন কিশোরের প্রথম প্রেমের মত সর্বগ্রাসী প্রেমে আমিও পড়লাম| কিন্তু বৃষ্টিতে ভেজার ফলস্বরুপ আক্রান্ত হলাম প্রবল জ্বরে| সেবা শুশ্রুষার চুড়ান্ত করলো অহনা। নিজ হাতে খাইয়ে দেয়া, ঔষধ খাওয়ানো, মাথায় পানি ঢালা, গা মুছে দেয়া, সব| একমুহুর্তের জন্যও আমার পাশ থেকে নড়েনি| তৃতীয় দিন একটু ধাতস্থ হলাম| অহনার সাহায্যে বিছানায় ভর দিয়ে আধশোয়া হলাম। ও আমার দিকে তাকিয়ে আছে ফ্যালফ্যাল করে। কিন্তু এ কোন অহনা!! মুখে বিশ্বজয়ের হাসি কিন্তু চোখের নিচে কালো দাগটাগ পড়ে কেমন যেন ফ্যাকাশে হয়ে আছে মায়বী মুখখানা| বুকের ভেতরটায় মোচড় দিয়ে উঠলো| হাতটি ধরে বললাম, ভালোবাসো খুব??? ও কোনো উত্তর দিলোনা, আচমকা আমায় জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করলো| আরে পাগলী কাঁদছো কেন? ভালোবাসিতো বৌটারে, অনেক বেশি | তারজন্য আরো হাজারটা দিন বৃষ্টিতে ভিজতে পারি। দেখো, এরপর থেকে আর কখনো জ্বর আসবেনা। একথা বলার সাথে সাথে ওর কান্না আরোও কয়েকগুণ বেড়ে গেলো| আমি শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম অহনাকে। ও কান্না করেই চলেছে……….
.
.
ওর এসব পাগলামো হুটহাট বায়না ধরা সব সয়ে গেছে| প্রথম প্রথম বিরক্ত লাগতো। এখন আর বিরক্ত লাগেনা| বরং ওর বায়না ধরা আর পাগলামো না দেখতে পেলেই বিরক্ত লাগে| তাইতো মাঝেমাঝেই রাগিয়ে দেই পাগলিটাকে| রাগ করলে একা একাই কথা বলে গাল ভারী করে। আমি আড়াল থেকে দেখি আর মনে মনে হাসি|
.
.
.
যাইহোক…. আজ আর ঘুম হবেনা|ভিতরে ভিতরে অপরাধবোধ জেগে ওঠছে| অহনাকে এভাবে না বললেও পারতাম| অভিমানী মেয়েটা নির্ঘাত অভিমান করে চোখ থেকে ঝরণা জড়াচ্ছে| আমি জানি ওকে এখন কোথায় পাওয়া যাবে| টিশার্টটা গায়ে চাপিয়ে সোজা বাসা থেকে বেরিয়ে দোকানে চলে আসলাম। খুব সকালে কিন্ডারগার্টেনের ক্লাস থাকায় বেশ কয়েকটা দোকান খোলা থাকে এসময়।
.
.
আমার হাতে এখন ওর পছন্দের আইসক্রিম। যা ভেবেছিলাম তাই হলো, ছাদের পশ্চিম কোণটাতে রেলিংয়ে হাত দিয়ে মুখ গোমড়া করে দাঁড়িয়ে আছে পাগলীটা| চোখ মুখ ফুলে ঢোল হয়ে আছে। নিশ্চিত কান্না করে করে এই অবস্থা করেছে। একটা মানুষ কিভাবে এত কাঁদতে পারে আমার মাথায় আসেনা| প্যাকেটটা খুলে আইসক্রিমটা ওর দিকে বাড়িয়ে দিলাম| অহনা আইসক্রিমটা হাতে নিয়ে আগের মতই দাঁড়িয়ে আছে| আর আমি একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি অহনার দিকে, সকালের স্নিগ্ধ হাওয়ায় তার খোলা চুল উড়ছে, চোখ ভর্তি জল, ঠোটের কোনায় মৃদু একটা হাসির রেখা জেগে ওঠছে ধীরে ধীরে। অহনার হাতে ধরা আইসক্রিমটা এরই মধ্যে গলতে শুরু করেছে সেই সাথে গলছে তার টুকরো অভিমান। সাথে পাল্লা দিয়ে বিস্তৃত হচ্ছে মৃদু হাসির রেখাটা……
গল্পের বিষয়:
ভৌতিক