চার্লি পটার নামে আমার বাবার একজন বন্ধু আছেন। ছোটখাটো মানুষ তিনি। সব সময় কেমন যেন ভয় পেয়ে রয়েছেন বলে মনে হয়
ওনাকে দেখে। সর্বক্ষণ ভয়ে ভয়ে এদিক ওদিক তাকান যেন এখুনি ভয়ঙ্কর একটা কিছু তেড়ে এসে ওঁর ঘাড়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে! উনি
কেন এমনটা করে সেটা জিজ্ঞেস করতে উনি আমাকে নিজের কলেজ জীবনের যে ঘটনাটা বললেন সেটা শুনে আমি বুঝতে
পারলাম ওঁর ভয়ের কারণ।
“আমাদের সেই দলটা আর নেই,” উনি বললেন, “অনেক বছর আগেই সেটাকে ভেঙে দেয়া হয়। কলেজে পড়ার সময় দলটাকে
গড়েছিলাম আমরা। দলে তখন আমরা ন’জন ছিলাম আর আরো দু’জনকে নেওয়ার কথা চলছিল ; জ্যাক লটন আর আর্নি ক্রেমার।”
“জানুয়ারি মাসের এক শীতের রাতে, এই এখনকার মতন সময়ই হবে আমরা ন’জন ওদের দুজনকে শহরের বাইরে একটা জায়গায়
নিয়ে গেলাম ওদের সাহসের পরীক্ষা নেওয়ার জন্যে। কথা হয়েছিল যে সাহসের পরীক্ষায় পাশ করতে পারলে তবেই ওরা দলে ঢুকতে
পারবে। আমরা সবাই ওদের একটা পরিত্যক্ত বাড়িতে নিয়ে গেলাম যেখানে কয়েকদিন আগেই আমাদের বয়সি দু’জন যুবক খুন
হয়েছিল। তাদের খুনিদের ধরতে পারেনি পুলিশ।“
“প্রথমে জ্যাককে একটা জ্বলন্ত মোমবাতি দিয়ে ওকে তিনতলায় উঠে যেতে বললাম আমরা। এ-ও বলে দিলাম যে কোন কথা বলা বা
শব্দ করা চলবে না মোটেই। ওর মোমবাতি নিভে গেলে ওকে অন্ধকারেই থাকতে হবে ।”
“আমরা নীচের তলায় যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম সেখান থেকে দেখতে পাচ্ছিলাম জ্যাক মোমবাতি নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠে যাচ্ছে। দোতলা
অবধি সব ঠিক ছিল কিন্তু তিনতলায় পৌঁছতেই ওর হাতের মোমবাতিটা নিভে গেল। আমরা মনে করলাম বুঝিবা দমকা হাওয়ায় নিভে
গেছে। এরপর এক ঘন্টা কেটে গেল কিন্তু জ্যাক ফিরল না। তখন আমাদের কেমন একটা ভয় ভয় করতে লাগল। আরো মিনিট
পনেরো অপেক্ষা করলাম আমরা। ভয়ে তখন বুক ধুকপুক করছিল আমাদের।”
“কী করব ঠিক বুঝতে না পেরে আমরা এবার আরেকটা জ্বলন্ত মোমবাতি হাতে দিয়ে আর্নি ক্রেমারকে পাঠালাম তিনতলায়, ঠিক কী
হচ্ছে দেখতে। তিনতলায় পৌঁছতেই আর্নির মোমবাতিটাও নিভে গেল। আমরা অপেক্ষা করতে লাগলাম, দশ মিনিট, কুড়ি মিনিট
কিন্তু দুজনের কারোরই কোন চিহ্ন দেখা গেল না।”
“আমরা তখন চেঁচিয়ে বললাম, “এই তোমরা দুজনে নীচে চলে এসো, কোথায় গেলে তোমরা?”
“কিন্তু ওরা কোন উত্তর দিল না। তখন শেষমেশ আমরা ঠিক করলাম যে আমরাই গিয়ে ওদের নিয়ে আসব। টর্চ ইত্যাদি নিয়ে আমরা
সিঁড়ি দিয়ে উঠতে লাগলাম। ঘুটঘুটে অন্ধকার আর শ্মশানের মতন নিঃস্তব্ধতা বাড়িটায়। দোতলায় উঠে আমরা ডাক দিলাম ওদের
কিন্তু আবার কোন উত্তরই পেলাম না।”
“তিনতলা পর্যন্ত উঠে গিয়ে দেখলাম সেখানে বড়োসড়ো ফাঁকা একটা ঘর। জ্যাক বা আর্নি কেউই নেই সেখানে কিন্তু ধুলোর ওপর
পায়ের ছাপ দেখতে পাওয়া গেল একটু ভাল করে লক্ষ করতেই। পায়ের ছাপগুলো পাশের একটা ঘরে গিয়ে ঢুকেছে দেখে আমরাও
সেই ঘরে গেলাম।”
“সেই ঘরটাও খালিই ছিল কিন্তু সেখানে মেঝেতে টাটকা রক্ত পাওয়া গেল! আর ঘরটার একটা জানালাও খোলা দেখলাম। জানালাটা
মাটি থেকে প্রায় ২০-২৫ ফুট ওপরে আর কোন মই বা দড়ি জাতীয়ও কিছু নেই যা বেয়ে ওরা পালাতে পারে। তাহলে ছেলেগুলো গেল
কোথায়?”
“এরপর আমরা সারা বাড়ি এবং বাড়িটার আশপাশে খুঁজলাম কিন্তু কিছুই পেলাম না। ছেলেগুলো আমাদের বোকা বানিয়েছে বলেই
মনে হল আমাদের। আমরা ভাবলাম ওরা নির্ঘাৎ কোনভাবে পালিয়ে জঙ্গলে গিয়ে লুকিয়েছে। ও সব মাটিতে রক্ত টক্ত আমাদের ভয়
পাওয়ানোর জন্যে। আমরা ভেবেছিলাম ওরা পরের দিন কলেজে উদয় হবে আর ব্যাপারটা নিয়ে খুব হাসি ঠাট্টা করবে। কীভাবে
আমাদের বোকা বানিয়ে পালাল সেই সব গল্প সবাইকে শোনাবে। কিন্তু তা হল না, পরদিনও ওদের কোন খোঁজ পাওয়া গেল না।”
“তখন আমরা প্রচন্ড ভয় পেয়ে কলেজের ডিনকে পুরো ঘটনাটা জানালাম। সব শুনে উনি সঙ্গে সঙ্গে পুলিশে খবর দিলেন। পুলিশ
এসো খুঁজেটুঁজেও কিছুই পেল না। কয়েক সপ্তাহ পরে খোঁজা খুঁজিও বন্ধ হয়ে গেল। আজ অবধি কেউ জানে না জ্যাক লটন আর
আর্নি ক্রেমারের ঠিক কী হয়েছিল, কোথায় গেল ওরা!” এতটা বলে আঙ্কেল চার্লি থামলেন।
“এর পর আর বিশেষ কিছু বলার নেই। আমাদের জেলে পুরে দেওয়া হয়নি কিন্তু কলেজ থেকে আমাদের ন’জনকে সাসপেন্ড করা
হয়েছিল এক বছরের জন্যে। দলটাও যে ভেঙে দেওয়া হয়েছিল সেটা তো আর বলে দিতে হবে না নিশ্চয়ই।”
“সব থেকে অদ্ভুত ব্যাপারটা হল আমরা পাশ করে বেরিয়ে যাওয়ার পর। কারা যেন অভিশাপ দিয়ে দিয়েছিল আমাদের ওই ন’জনের
দলটাকে। প্রতি বছর যেদিন ওই ছেলে দুটো গায়েব হয়েছিল সেই দিন আমাদের মধ্যে থেকে কেউ একজন হয় মারা যায় বা পাগল
হয়ে যায়। আমিই এখনও পর্যন্ত ঠিক আছি আর আমার শরীরও ভালই আছে। তবে মাঝে মাঝে কেমন একটা অদ্ভুত অনুভূতি
হয়…”
এই গল্পটা বলার কয়েকদিন পরই আঙ্কেল চার্লির মাথাটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। ডাক্তাররা কোন কারণই ধরতে পারেননি।
…………………………………………(সমাপ্ত)………………………………………